ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দৈনন্দিন অর্থহীন বোঝা


    ঋদ্ধি সেন (September 24, 2022)
     

    হাত-ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার অস্ফুট আওয়াজ হঠাৎ মনে হল বেড়ে গিয়ে কানের কাছে প্রায় মহাত্মা গান্ধী রোডের ব্যান্ডপার্টির তাসার মতো সজোরে বাজছে। ঘড়ির কাঁটা বলছে চারটে বাজতে দশ মিনিট বাকি। ভয়ে পেনের খাপ চিবোতে-চিবোতে দেখি ক্লাসরুমে রীতিমতো রেস লেগে গেছে, দাপাদাপি করে একে অপরকে প্রায় কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে স্কুলের উর্দি পরা আগামী দিনের আইনস্টাইন আর নিউটনরা শিক্ষকের ডেস্কে যাচ্ছে এক্সট্রা কাগজ নিতে। আর আমার পরীক্ষার ১০টা পাতার মধ্যে এখনও আটটা খালি, আর যে-দুটো পাতার সাদা একটু কম, মন বলছে, সেখানেও লাল কালির দাগ ভরে যাবে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে এই গোটা দৃশ্যটা দেখে যা বুঝলাম, তা হল আমি সেই ব্রহ্মগুপ্ত-র আবিষ্কার করা জিরো, একেবারে শূন্য়, বিগ জিরো যাকে বলে আর কি!

    পরীক্ষা শেষ হওয়ার আর পাঁচ মিনিট বাকি, এবার ঘড়ির কাঁটার সেই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া কান ঝালাপালা করা শব্দের সাথে আমার বুকের ধুকপুক শব্দ পাল্লা দিয়ে তাল মেলাচ্ছে। পাঁচ মিনিটে সামনের জনের খাতা দেখে অন্ধ অনুকরণও কাজে দেবে না আর, এমনিতেও অঙ্ক টুকে পাশ করা যায় না। ফাইনাল সাইরেন বেজে ওঠার আগে শেষবারের মতো চোখ রাখলাম খাতায়, কিন্তু যা লেখা আছে খাতায় তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ। পরীক্ষার খাতায় দেখি বড়-বড় করে লেখা ‘বয়কট’। ১০টা পাতাতেই দেখলাম স্পষ্ট অক্ষরে ছাপা, একটি বিশেষ হিন্দি ছবিকে বয়কটের আবেদন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি শিক্ষকের কুর্সিতে বসে মুম্বইয়ের এক নামী বাণিজ্য-বিশ্লেষক। খ্যানখ্যানে গলায় নাকের ডগায় চশমা রেখে সবজান্তা চাউনি নিয়ে অধীর আগ্রহে সে ক্লাসভর্তি সব অচেনা মুখেদের বোঝাচ্ছে এই ছবিটি কেন বক্স-অফিস ফেলিওর। 

    সে দিচ্ছে প্রতিদিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেবে, সংখ্যার মারপ্যাঁচ, কোন দিনে কত আয় হয়েছে ছবিটির আর কত আয়ে হওয়া উচিত ছিল। আর উদ্বিগ্ন মাথাগুলো, সেগুলো নোট করে নিচ্ছে পরীক্ষার খাতায়, ছবিটি কেমন হয়েছে তাদের যায় আসে না, কিন্তু কত আয় হল আর কত লোকসান হল এই নিয়ে জানতে তারা বেশ উত্তেজিত। হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক সংখ্যার খেলা খেলতে-খেলতে আমার দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকালেন, চশমার ফাঁক থেকে আমার হতভম্ব মুখ দেখে আচমকা প্রশ্ন করলেন, ‘বলো তো খোকা, দর্শকদের শিল্পের এবং শিল্পীর কাছে নৈতিকতার দাবি ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার পর শিল্পীর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অপরাধবোধের শতকরা কত হ্রাস পেলে বক্স-অফিসে সাফল্য আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে?’ এই কিম্ভূত প্রশ্নের উত্তর হাতড়াচ্ছি, এমন সময় গাড়িটা জোরে ব্রেক কষল। 

    মাথাটা ঠুকে গেল গাড়ির জানলার কাচে। এই ঝট্কা খেয়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম, ভেঙে গেল ঘুম, রেহাই পেলাম এই অদ্ভুত স্বপ্নটা থেকে। সিগনাল লাল। শুটিং-স্পটে যেতে আরও দশ মিনিট। ভোরবেলা কলটাইম ছিল বলে গাড়িটাকেই প্রায় বিছানা বানিয়ে ফেলেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা খেয়াল নেই। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম, কস্টিউমটা ঘামে ভিজে সপসপে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম মানুষ, ঠেলা, গাড়ি, রিক্সা, বাইক, বাজার, দোকান, হকার মিলিয়ে একটা তুমুল যানজট। বুঝলাম বড়বাজার পৌঁছে গেছি আমরা, শুধু ক্যামেরা টিমের আশা বাকি এখনও। তবে এতক্ষণে উপলব্ধি হল যে, আমার মাথার ভেতরের যানজট বড়বাজারের যানজটকে দশ গোল দিতে পারে, নাহলে এরকম কিম্ভূত-কিমাকার স্বপ্ন কেউ দেখে। এই সব হচ্ছে বদহজমের দোষ, মস্তিষ্কের বদহজম।

    আচ্ছা সত্যি বলুন তো, জীবন বাঁচাতে গেলে এত ইনফরমেশন লাগে? সারাদিন আমাদের বিভিন্ন আকারের চকচকে চৌকো বা আয়তক্ষেত্রাকার লিকুইড মার্কারি ডিসপ্লে-তে বয়ে চলেছে তথ্যের ঝড়। যে-তথ্য আমরা গোগ্রাসে গিলে চলেছি, চেটেপুটে নিচ্ছি প্রাণ ভরে, কিন্তু বাঁচতে কি সত্যিই এত তথ্য লাগে? কোন অভিনেত্রীর কুকুরের মনখারাপ আজকে বা কোন রাজনীতিবিদ বউকে ছেড়ে কোন প্রেমিকার শ্যাম হলেন বা আমার স্বপ্নে দেখা মুম্বইয়ের সেই সবজান্তা বাণিজ্য-বিশ্লেষক, যিনি সারাদিন ধরে চলচ্চিত্র-জগতের বাণিজ্যিক লড়াইয়ের চড়াই-উতরাই নিয়ে এত লেখা লেখেন তাঁর টুইটারে যে পড়েই ক্লান্ত হয়ে যাই— এসব জেনে করবটা কী? যে-মানুষটা অটো চালায় বা বাসে রোজ সন্ধেবেলা ভিড়ের মধ্যে ঝুলতে-ঝুলতে বাড়ি ফেরে বা একজন নার্স যে নাইট ডিউটিতে হাসপাতালে চাকরি করে বা সেই মিস্তিরি যার বালি আজকে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে, এদের কারো কি এই একটা তথ্যে কিছু এসে যায় বা যাবার কথা ছিল? তাই এত বেশি অপ্রয়োজনীয় তথ্য যদি ইন্টারনেটের দৌলতে ঢুকে পড়তে শুরু করে আমাদের মাথার ভেতরে, তাহলে ব্রেনের কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন? অফুরান তথ্য, এত তথ্য নিয়ে আমরা কে কী করব জানি না, কিন্তু ‘আবোল তাবোল’এর এক চরিত্র, কাঠ বুড়ো, বলে দিয়েছে নাকি সুরে, ‘ইন্ডিয়া বানেগা ডিজিটাল’।

    আমাদের জানতে চাওয়ার চিৎকার অন্ধকার আকাশে ভেসে বেড়ায় এবং অবশেষে হারিয়ে যায় একটা নিভে যাওয়া তারার মতো। তাই সিসিফাস দেবতাদের অভিশাপে ঘাড়ে করে একটা বিরাট পাথর ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায় এবং পৌঁছনোর পরেই আবার পাথরটা গড়িয়ে পড়ে যায় সমতলভূমিতে, আবার সেই একই ভাবে সিসিফাসকে চালিয়ে যেতে হয় পাথর তোলার কাজ প্রতিবার পাথরটা পড়ে যাবে জেনেও। 

    আমার চেনা একজন খুব পছন্দের দাদা এবং অভিনেতা একবার বলেছিলেন আড্ডা মারতে-মারতে, পেটে যদি বেশি ভাত যায়, পরিমাণের থেকে বেশি ভাত, তাহলে বদহজম হবে; ঠিক সেরকম ভাবেই, মাথায় যদি প্রয়োজনের থেকে বেশি তথ্য যেতে থাকে, তাহলে একটা বড়সড় বদহজম হবার সম্ভাবনা আছে। এবং মস্তিষ্কের অ্যাসিডিটির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আজকে সামাজিক মাধ্যমের অসহিষ্ণুতা, মাথার খোপগুলোর ভেতরে কোন তথ্য কে কখন ঢুকে বদহজম করিয়ে যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, তা কে জানে! এটাই হয়তো আজকের দিনের অসুর, যার হাত থেকে আমি মুক্তি পেলাম একটু আগেই। নিশ্চয়ই চোখ বোজার আগে খানিকক্ষণ ফেসবুক ঘেঁটেছিলুম, সম্মোহিত আঙুলগুলো ঠান্ডা কালো চকচকে স্ক্রিনটাকে আদর করে চলছে, শুধু স্ক্রোল-আপ, আর খুলে যাচ্ছে মতামতের প্যান্ডোরার বাক্স। তখনই খেয়াল করেছিলাম সাম্প্রতিক এক হিন্দি ছবির বয়কটের ঘটনার একটি পোস্ট, যেখানে মুম্বইয়ের সব বাণিজ্যিক-বিশ্লেষকরা এবং সোশ্যাল মিডিয়া আইটি সেল প্রায় একজোট হয়ে ছবিটি না দেখে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, এ-ছবির যাত্রা শুরুর আগেই শেষ। 

    কিন্তু মাথার ভেতর এই ঘটনা আমায় আমার ছোটবেলার গণিত পরীক্ষার দিনে কেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল জানি না, এমনি আমাদের মাথার কুড়ি ভাগ স্থল আর বাকি পুরোটাই ডুবে থাকে মাথার গভীরে, টাইটানিকের আইসবার্গের মতো, তাই বেশির ভাগটাই অজানা। তা-ও মনে হল, এই সংখ্যার ভাগ গুণ-যোগ-বিয়োগের দাপাদাপি আমাকে ফেরত নিয়ে গেল ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষার দিন। ওই সময় আমার জীবনে একটাই অসুর ছিল, তা হল অঙ্ক। অ্যালজেব্রা, এরিথমেটিক, জিওমেট্রি, ট্রিগোনোমেট্রি— পুরো যেন অসুরের পাল। যদিও তখন আমার দুর্গা ছিল আমার মা আর আমার অঙ্কের শিক্ষক। গণিত পরীক্ষা দিতে যাওয়ার দিন সকালে দেশাত্মবোধক গান শুনতাম, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে বাজছে বন্দেমাতরম, আর আমি ৯০ ফ্রেম পার সেকন্ডে, স্লো মোশনে, আমার চিন্তায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা নিয়ে এগিয়ে যেতাম যুদ্ধের ময়দানে। এত হাই-অ্যাড্রিনালিন সংগীত শুনে আমার হৃদয় যখন আমার মস্তিষ্ককে জিজ্ঞেস করল, ‘হাউজ দ্য জোশ?’, কাঁপা-কাঁপা গলায় উত্তর এল, ‘ভেরি লো স্যার!’ পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এসে যখন আবার বলতাম, এবারও মনে হয় ১০-১২’র বেশি নম্বর উঠবে না, তখন মা জড়িয়ে ধরত আমায়। মনে হত যে যাক বাবা, রেহাই পেলাম অসুরের হাত থেকে! 

    কিন্তু স্বপ্নের দ্বিতীয়াংশের যে অসুরের দেখা পেলাম, তার দমন কীভাবে হবে তা কেউ জানে না। সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান এবং আস্তে-আস্তে দিশাহীন হয়ে যাওয়ার কাহিনি মনে করিয়ে দেয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কথা। এটা আসলে তথ্যের ব্যবসা না, নয় কোনও জাদুকাঠি যা বন্ধুদের একে অপরের কাছে নিয়ে আসে, এই প্রথমবার সারা পৃথিবীতে এই ভাবে শুরু হল মানুষের প্রবৃত্তির ব্যবসা। তার ইচ্ছে, তার স্বভাব, তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হল এই ব্যবসার পণ্য। ইনভেস্টমেন্ট শূন্য, কিন্তু মুনাফা ডবল। এবং এই অসুরকে আরও বৃদ্ধি পাওয়ানোর জন্য তৈরি হয়ে রয়েছেন, সারা পৃথিবীর ব্যবসাদাররা, রাজনীতিবিদরা এবং মজার কথা— আমরাও। মহানন্দে আমরা তুলে দিচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, ব্যবসা বৃদ্ধির স্বার্থে। 

    সিগনাল সবুজ হল; তবে এই এলাকায় সিগনাল লাল হোক বা সবুজ, আলাদা করে কিছু যায় আসে না, কারণ গাড়ির গতি দুই ক্ষেত্রেই এক। ঠিক যেমন, যে-মানুষটি আমার সামনে দিয়ে একটা ঠেলায় করে একটা সাদা চটে মোড়ানো প্রকাণ্ড ভারী জিনিস ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে চলে গেল, তার কাছে যায় আসে না রাজ্যের রং লাল, নীল না গেরুয়া। যেই থাকুক না কেন, তাকে আজীবন এই ঠেলা ঠেলে যেতে হবে। এই এলাকায় এলে এরম আরও অনেক মানুষ দ্যাখা যায়, যারা ভ্যান রিক্সায় করে, বা ঠেলায়, বা মাথায় দড়ি লাগিয়ে প্রকাণ্ড শাদা চটে মোড়ানো বস্তা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ভারী বাক্সগুলোতে যে কী থাকে জানি না, কোথায়ই বা নিয়ে যায় তারা, জানি না। কাঁচামাল হয়তো, বা মার্কেটে বিক্রি হবে এমন অনেক সামগ্রী। বড়বাজার বলে কথা, ‘পাওয়া যায় না’ বলে কিচ্ছু নেই। তাই সেই সব জিনিস কোথাও থেকে তো আসছে না কি? নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হল, নিজের শহরে থেকে নিজের শহরটার সম্বন্ধে কত কম জানি। লোকটা একটা বিরাট বাঁশের কাঠামোর সামনে দিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের মতো ঠেলা ঠেলতে-ঠেলতে চলে গেল, মুখে তার ক্লান্তির লেশমাত্র নেই, এমনকী অদ্ভুত ভাবে তার মুখে কোনও অভিব্যক্তিই নেই। এই বোঝাটা যদি তার অসুর হয়, তাহলে সে হাত মিলিয়ে নিয়েছে সেই অসুরের সাথে।

    তাকে দেখে মনে পড়ে গেল, ১৯৪২ সালে আলব্যের কামুর লেখা ফরাসি বই ‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’। যেখানে কামু দৈনন্দিন জীবন এবং গোটা মানুষের জীবনের অর্থহীনতার কথা বলেন, কারণ ওঁর মতে জীবনের বেশির ভাগ মানে খুঁজতে গিয়ে আমরা ধাক্কা খাই। কারণ যে ‘মানে’ আমরা চাইছি, তা বেশির ভাগ সময়েই আমরা পেতে অক্ষম। আমাদের যে অন্যায় মেনে নিতে হয়! মেনে নিতে হয় মিথ্যে, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও চোখের সামনে দেখতে হয় খুন, যুদ্ধ, আত্ম্যহত্যা। এই অদ্ভুত অবস্থা কেন, জন্ম থেকেই মৃত্যুর প্রস্তুতি কেন, মৃত্যু আসবেই জেনে তাও কেন হত্যা, বেশির ভাগ সময়েই সুবিচার হয় না কেন, এই ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে চিৎকার করে গলা ফাটালেও উত্তর মেলে না, মহাবিশ্বের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আর ধর্মের সীমাবদ্ধতা দুইই অপারগ এর উত্তর দিতে। আর আমাদের জানতে চাওয়ার চিৎকার অন্ধকার আকাশে ভেসে বেড়ায় এবং অবশেষে হারিয়ে যায় একটা নিভে যাওয়া তারার মতো। তাই সিসিফাস দেবতাদের অভিশাপে ঘাড়ে করে একটা বিরাট পাথর ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায় এবং পৌঁছনোর পরেই আবার পাথরটা গড়িয়ে পড়ে যায় সমতলভূমিতে, আবার সেই একই ভাবে সিসিফাসকে চালিয়ে যেতে হয় পাথর তোলার কাজ প্রতিবার পাথরটা পড়ে যাবে জেনেও। আমার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ঠেলাওয়ালাটার অবস্থা সেই একইরকম। অর্থহীন বা কামুর ভাষায় অ্যাবসার্ড, একটা কাজ করে চলা দিনের পর দিন। এই বোঝার অসুরের কাছ থেকে মুক্তি পাবে কী করে ও জানে না। প্যান্ডেলের অসুর বিনাশ হবে পুজোর পাঁচদিনে, তারপর বিসর্জন, কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অসুর বেঁচে থাকবে আমাদের পাশেই। ক্যামেরা টিম এসে গেছে, শুটিং শুরুর তোড়জোড় চলছে। গাড়ি থেকে নামলাম, সেই বাঁশের কাঠামো ভরে আছে বিজ্ঞাপনে। পোস্তর বিজ্ঞাপন। পোস্তর প্যাকেটের পাশে দুর্গা আর অসুরের ছবি লেখা এই পুজোতে এই পোস্তর গুণে জেগে উঠবে শক্তি, যা দিয়ে দমন হবে অসুরগণ। তার পাশে ছোট করে লেখা, পুজোর জন্য একটা প্যাকেট কিনলে একটা ফ্রি। 

    লোকটা একটা বিরাট বাঁশের কাঠামোর সামনে দিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের মতো ঠেলা ঠেলতে-ঠেলতে চলে গেল, মুখে তার ক্লান্তির লেশমাত্র নেই, এমনকী অদ্ভুত ভাবে তার মুখে কোনও অভিব্যক্তিই নেই। এই বোঝাটা যদি তার অসুর হয়, তাহলে সে হাত মিলিয়ে নিয়েছে সেই অসুরের সাথে।

    তার পাশেই আরেকটা বিজ্ঞাপন, তাতে একটা মোবাইল কোম্পানি একটা কনটেস্ট দিয়েছে ‘চিনে নিন আপনার জীবনের অসুরকে’, যাদের উত্তর সব থেকে পছন্দ হবে তারা পাবে আমাদের সেলফি কাউন্টারে আমাদের অসুরের মতো চেহারার নায়কের সাথে সেলফি তোলার সুযোগ। আমিও ভাবছি আমার জীবনে অঙ্ক পরীক্ষা ছাড়া অসুর বলতে ঠিক আর কী আছে, এমন সময় আমাদের মেক-আপ আর্টিস্ট আমার সামনে এসে আয়না ধরল মেক-আপ ঠিক করার জন্য। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ নিজের দিকে তাকিয়ে কীরকম অদ্ভুত লাগল; চুপ করেই ছিলাম, কিন্তু চারপাশের শোরগোল কেমন জানি একটু বেশি কমে এল। কেন জানি মনে হল, বিজ্ঞাপনের উত্তরটা পেয়ে গেছি। আমার জীবনে বা আমাদের জীবনের অসুরটা বোধহয় আমরা নিজেরাই। আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে অসুর হবার কতরকম উপাদান। চারপাশের এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার জন্য কোথাও অজান্তেই আমার হাত তো রয়েছেই। ক্ষুদ্র হলেও, সেই দায়ভার এড়ানো আর কতদিন সম্ভব?

    মুখে মেক-আপ দেওয়া প্রায় শেষ, তা দিয়ে মুখের দাগ কিছুটা ঢাকল, কিন্তু চিন্তার ছাপ গেল না। আয়নাটা নামাতেই দেখলাম মানুষের মেলা, রামধনু যেন। কত রঙের মানুষ, হেঁটে চলেছে অবিরাম, সবার যেন বড্ড তাড়া। যেন এক অদৃশ্য হাত ওপর থেকে খেয়াল রাখছে তাদের গতিবেগ, যেন গতি একটু কমলেই তাদেরকে বাতিল করে দেওয়া হবে জীবনের ময়দান থেকে। মানুষের এই অর্থহীন অবস্থানের থেকে বড় অসুর আর কী আছে পৃথিবীতে? তবু এত কিছুর মধ্যেও মুখে হাসি এল, একটা ভাবনা চেপে বসল মাথায়, এরা প্রত্যেকেই এই অসুরের মতো কঠিন বাস্তবের কাছে হার মানছে না কিছুতেই, হেরে যাওয়ার একশোটা কারণ থাকতেও তারা সিসিফাসের মতো পাথরটা ঠেলে যাচ্ছে। কারণ সিসিফাস জানে যে, পাথর ঠেলা আর পাথর তোলার মাঝখানে একটা মুহূর্ত আছে, যখন সে হেঁটে নামে পাহাড় থেকে পাথরটা তোলার জন্য, তখন সে মুক্ত। তাই আসল প্রতিবাদ শুরু হয় এই অর্থহীন অবস্থানের বিরুদ্ধে, সেই অর্থহীনতা থেকে পালিয়ে না বেড়িয়ে তার মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানো, যা আমাদের শহরের বা দেশের বা গোটা বিশ্বের বহু মানুষ করছেন, সেটাই একমাত্র শুভশক্তির আবির্ভাব। 

    সামনে দিয়ে আবার সেই প্রকাণ্ড ঠেলা বোঝাই মাল নিয়ে আরেকজন ঠেলাওয়ালা চলে যাচ্ছে, তার ঠেলার ওপর রাখা একটা ছোট্ট স্পিকার, বেড়ে চলেছে মানুষের ভিড়, নুয়ে পড়েছে ঝুরঝুরে বাড়িগুলো, ঝুলে থাকা কালো-কালো তারগুলোতে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না আকাশটা, আর ঠেলার সেই স্পিকারে বেজে চলেছে,

    ‘গঙ্গা অর যমুনাকি কি গ্যাহেরী হ্যায় ধার
    আগে ইয়া পিছে সাবকও জানা হ্যায় পার
    মৌসম বিতা যায়, মৌসম বিতা যায়…’

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook