ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অদ্ভুতুড়ে


    পিয়া চক্রবর্তী (June 18, 2021)
     

    ভয় কয় প্রকার ও কী কী— সেই লিস্টি করতে গেলে তো রাত কাবার হবে। কিছু ভয় আছে, যেগুলো একদম বাঁচা-মরার সঙ্গে যুক্ত। যেমন চাকরি খোওয়ানোর ভয়, অথবা মৃত্যুভয়। এখন আমাদের দেশে আর এক রকম বড় ভয় আছে। কোনও এক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লিখে ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে উঠলেই কেলেঙ্কারি! মুন্ডু গেলে খাবটা কী, মুন্ডু ছাড়া বাঁচব নাকি? বাবা রে! আর, এই পেল্লায় মাপের ভয় ছাড়াও জীবনের আঁকেবাঁকে ছিটিয়ে রয়েছে কত রকমের ছিঁচকে ভয়। অন্ধকারের ভয়। একা-একা নির্জন রাস্তায় হাঁটার ভয়। উঁচু ছাদ থেকে নীচে তাকানোর ভয়। উড়ন্ত আরশোলার ভয়। দেওয়াল থেকে খসে পড়া টিকটিকির ভয়। প্লেনে যাত্রার ভয়। জলে নামবার ভয়। পোশাকি ভাষায় এগুলোকে আমরা ফোবিয়া বলি, অর্থাৎ অমূলক ভয়। 

    তবে আজ যে-ভয়টা নিয়ে লিখছি, সেটা এই সমস্ত নির্দিষ্ট ভয়গুলোর চেয়ে আলাদা। মানুষের মনের একটি বেজায় বড় ভূত হল: ‘অদ্ভুত’। যা কিছু ধরাবাঁধা নিয়মের নোটবুকের বাইরে, তার প্রতি আমাদের একটা অস্বস্তি, একটা বিতৃষ্ণা কাজ করে। থাকে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার প্রবণতা। এও এক রকমের ফোবিয়াই— যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ নেই এই ভয়ের।

    এই নিয়মের নোটবুক আমাদের চারিদিকে একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা টেনে রাখে। তার ভেতরে থাকলে ভারি মজা, কিল-চড় নাই। কিন্তু লাইন ক্রস করতে গেলেই কেস! তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে থাকা বাঁদরের মতন, এক পা বাড়ালেই আবার দু’পা পিছিয়ে আসতে হয়। স্কুলে যখন বাচ্চাদের রং করা শেখানো হয়, সবচেয়ে বেশি নম্বর কাটা হয় আউটলাইন ছেড়ে রং বেরিয়ে গেলে। নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে বেরিও না। ডোন্ট ক্রস দ্য লাইন! প্রতি পদেই সেই শিক্ষা হাতুড়ি মেরে মেরে শরীরে, মনে ও মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে, আমাদের গড়েপিটে নেওয়া হয়। ট্রেনিং-শেষে আমরা ‘আদর্শ নাগরিক’ রূপে সমাজে আবির্ভূত হই। গোপাল কিম্বা গোপালির মতন সুবোধ বালক বা বালিকা। দূরে তাকায় না, ঘাড় বাঁকায় না, চলে সমান পথে, চলে নিয়ম মতে। 

    এই গল্প সব সমাজেই আছে, তবে শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের কথাই বলছি, কারণ এটাই আমার ঠিকানা। কার কেমন সাজগোজ, কী জামাকাপড় পরে, কী ধরনের খাবারদাবার খায়, কার সঙ্গে থাকে, কী চাকরি করে, কেমন তার জীবনযাত্রা, ক’টায় ঘুমোতে যায়, কাদের সঙ্গে মেশে— এইসব দিয়ে এখানে যাচাই করে নেওয়া হয়: সে ঠিকঠাক, না কি গোলমেলে। মানে যা আমাদের চোখে বা কানে লাগে, রোজকার ভেতো পরিবেশে একটু ছন্দপতন ঘটায়, সেটাই অদ্ভুত। 

    দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলে আমার এক বান্ধবীর একটি ফ্ল্যাট আছে। সে এক সময়ে সেখানে একা থাকত— আমরা তখন একসঙ্গে এম ফিল করছি। বয়স আমাদের ওই ২৫/ ২৬ হবে— মানে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও বেশ ৭-৮ বছর কেটে গেছে। ওর মা-বাবা থাকতেন কাছেই বালিগঞ্জের একটি ফ্ল্যাটে। ওর জীবনযাত্রা নিয়ে বিল্ডিং-এর অতীব সজাগ প্রতিবেশীরা বেশ বিচলিত। একদিন ওর মা’র তলব পড়ল ফ্ল্যাট-বাসিন্দাদের মিটিং-এ। সেখানে কাকিমা গিয়ে পৌঁছতেই সরাসরি প্রশ্ন, ‘শুনুন, আপনার মেয়ের চালচলন কিন্তু বেশ অদ্ভুত! সারাদিন বাড়িতে থাকে, সন্ধে হলেই বেরিয়ে পড়ে রোজ— কী ব্যাপার বলুন তো? কী ধরনের চাকরি করে ও?’

    একে তো অবিবাহিত মেয়ে, মা-বাবার থেকে আলাদা থাকছে, এটা হজম করতে গিয়ে ওঁদের জেলুসিল খেতে হত দৈনিক। এ কি বাঙালি মেয়ে না অন্য কিছু? তার উপর ওই বাড়িতে আমাদের কয়েকজনের যাতায়াত ছিল ঘন ঘন, স্পষ্ট মনে আছে প্রতিবার টপ ফ্লোরে ওঠার সময়ে প্রতিবেশীদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি এড়াবার জন্য স্টেপ জাম্প করতে করতে উঠতাম। তাঁরা সর্বদা অস্থির, ওই ফ্ল্যাটে কারা আসে, কারা যায়। আর কোনও পুরুষ-বন্ধু এলে তো কথাই নেই। সোজা আবার বাবা-মা’কে তলব! একটা ভাল, মেয়েতে-মেয়েতেও যে প্রেম হতে পারে, এই কথা মধ্যবিত্ত বাঙালি দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।

    কার কেমন সাজগোজ, কী জামাকাপড় পরে, কী ধরনের খাবারদাবার খায়, কার সঙ্গে থাকে, কী চাকরি করে, কেমন তার জীবনযাত্রা, ক’টায় ঘুমোতে যায়, কাদের সঙ্গে মেশে— এইসব দিয়ে এখানে যাচাই করে নেওয়া হয়: সে ঠিকঠাক, না কি গোলমেলে। মানে যা আমাদের চোখে বা কানে লাগে, রোজকার ভেতো পরিবেশে একটু ছন্দপতন ঘটায়, সেটাই অদ্ভুত। 

    বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে, নারী-পুরুষ সম্পর্কের একটা বাঁধাধরা অভিধান আছে। যদি কোনও পুরুষ ও নারী একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যান, অথবা রেস্টুরেন্টে নৈশভোজ খেতে যান, তার মানেই কিন্তু তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক। যদি তাঁরা দুজনে সিঙ্গল হন, তাহলে তাঁদের শুভস্য শীঘ্রম প্রেম হতে চলেছে। যদি তাঁদের মধ্যে একজন বা দুজনেই অন্য বিবাহে বা সম্পর্কে থাকেন, তাহলে তাঁরা নিঃসন্দেহে দুশ্চরিত্র— পরকীয়া চালাচ্ছেন! এবং যদি তাঁরা বলেন ‘আমরা শুধু বন্ধু’— তাহলে নির্ঘাত মিথ্যে বলছেন। আর যদি প্রমাণিত হয় যে সত্যি সত্যিই তাঁরা শুধুমাত্র বন্ধু, তাহলে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত! এর কোনও মানে দাঁড়ায় না। কেমন একটা সন্দেহ জাগে মনে। কীসের সন্দেহ জানি না। তবে জাগে। আসলে যতই আমরা কেতা মেরে ‘আউট অফ দ্য বক্স’ ভাবনাচিন্তার কথা বলি না কেন, বাক্স আমাদের ভাল লাগে। সবকিছুকে ভাগে-ভাগে সাজিয়ে এক-একটি বাক্সে পুরে তাতে লেবেল সাঁটতে পারলে ভারি আরাম পাই। অদ্ভুত কোনও কিছুই সেই বাক্সে খাপ খাবে না।  কারণ অদ্ভুতের চরিত্রই তো একা হওয়া, একক হওয়া, মৌলিক হওয়া। 

    ‘Fear of the strange’ এবং  ‘fear of  stranger’— এই দুটি একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ। কয়েক মাস আগে বেরনো গে ম্যারেজের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় এই অদ্ভুতুড়ে কনসেপ্টটিকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা আরও উস্কে দিয়েছে। এই রায় নিয়ে এলজিবিটি কমিউনিটির বাইরে মাথাব্যথা সত্যিই বেশ কম। তার কারণ হয়তো অনেক, তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, মানুষ এদের ঠিক বুঝতে পারে না। তাই, এই কমিউনিটির সামাজিক অবস্থান কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়েও দ্বিধায় থাকে। আসলে সমস্ত সামাজিক নিয়মাবলির অভিধান বা নোটবুককে ধ্বংস করা  সীমালঙ্ঘনকারী অদ্ভুতের দল তো এরাই। পোশাক-আশাক, চলন-বলন, জীবনযাত্রা, এই সমস্ত কিছুই ঠিক নিজেদের সঙ্গে মেলাতে পারে না বলেই হঠাৎ এসব দেখলে ভূত দেখার মতনই চমকে ওঠে মধ্যবিত্ত বাঙালি। তার ভাবাবেগ এমনিতেই গরম চায়ে ডোবানো মেরি বিস্কুটের মতন ন্যাতপ্যাতে, মুখ থুবড়ে পড়ে একটুতেই। 

    যে-বাক্সের কথা বলছিলাম, জেন্ডারের ক্ষেত্রেও আমরা সেই বাক্সমাফিকই, দুটো ভাগে আটকে— cisgender/heterosexual পুরুষ ও নারীর বাইনারিতে বন্দি। সেই বাইনারিটা ঝাপসা হলেই আমরা ধাঁ! ঘিলুতে ঠাকুর ওইটুকুই বুদ্ধি দিয়েছেন, যাতে সবকিছুকে এক ছাঁচে ফেলতে চাই, এক রঙে রাঙাতে চাই। তাই আমরা ‘one language, one religion, one culture’-এর মন্ত্র চেটেপুটে খাই। বিভিন্নতায় আমাদের চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। বাঙালি সমাজে ঋতুপর্ণ কিছুটা হলেও এই সোজাসাপটা’র ব্যাকরণটা ঘেঁটে দিয়েছিলেন। গালাগাল দিতে দিতেও অনেকটা ধাতস্থ হয়েছিলাম। তবে সমস্যাটাও ওইখানেই, কেউকেটা হয়ে দেখিয়েছেন উনি। হেঁজিপেজিরা ওরকম হলে মুশকিল— প্রতিভা কই? তা না থাকলে অদ্ভুত হওয়ার লাইসেন্সই বা কই? শিল্পীরা অনেক কিছু করে থাকেন। তুই করবি কেন?

    ঠিক এই মানসিকতার ঘাড়ে ধাক্কা মারার জন্যই পৃথিবী জুড়ে ‘কুইয়ার মুভমেন্ট’-এর উত্থান। কুইয়ার (queer) শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘অদ্ভুত’। উনবিংশ শতাব্দীতে এই শব্দ অপমান হিসেবে ব্যবহৃত হত, সমকামী মানুষ বা তাঁদের সম্পর্কগুলোকে হেয় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই শব্দটিই নতুন করে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে নেয় এলজিবিটি কমিউনিটি। তারপর থেকে এই শব্দ প্রয়োগ হওয়ার মধ্যে এক গর্ব আছে, এক জোর আছে। ‘উই আর কুইয়ার, উই আর হিয়ার!’ আর আছে উদযাপন— অদ্ভুত হওয়ার উদযাপন। মোনোক্রোমকে গুলিয়ে দিয়ে রঙিন হওয়ার উদযাপন। পৃথিবীর যে কোনও কুইয়ার প্যারেড লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যায় এক ক্যানভাস রঙের মেলা— নীল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি— সব মিলেমিশে একাকার। নানান রকম জামাকাপড়, মুখের মেক-আপ, নাচ-গান এবং অঙ্গভঙ্গি— অদ্ভুতের উৎসব! প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে কলকাতায় খোলা প্রথম কুইয়ার ক্যাফের নামও ‘আমরা অদ্ভুত’। 

    এই ফোবিয়া ব্যাপারটায় ভয়ের সঙ্গে ঘৃণাও জড়িয়ে আছে। ‘অদ্ভুত’ বলে দূরে সরিয়ে রাখার মধ্যে একটা অল্পবিদ্যার ভয়ঙ্কর দম্ভ আছে। না-জানা এবং না জানতে চাওয়ার বিপদ। অন্ধকারকে আমরা ভয় পাই তার অস্বচ্ছতার জন্য। টর্চ ফেললেই তো সব আলোকিত, স্পষ্ট, উজ্জ্বল। তেমনই যা কিছু আমরা দূর থেকে দেখে খটকায় ভুগি— তার কাছাকাছি গেলে, তার সঙ্গে সময় কাটালে, অনেক সহজ হয়ে উঠব। তখন আমরা একটি ২৫ বছর বয়সি মেয়ের, বাবা-মায়ের থেকে আলাদা, স্বাধীনভাবে থাকার ইচ্ছেটাকে ছোট করব না। অথবা নারী ও পুরুষের মধ্যে শুধু মাত্র যৌনতাভিত্তিক সম্পর্ক থাকবে, এমন দমবন্ধ করা সমাজকে স্বাভাবিক ভাবব না। সমাজে বাইনারির বাইরে বিচরণ করা মানুষদেরও সাধারণ মানুষ হিসেবেই গ্রহণ করব।

    অদ্ভুত আসলে একটি আশীর্বাদ। আমাদের অলস, জং-ধরা জীবন ও সমাজব্যবস্থাকে কাঁচকলা দেখানো একটা ম্যাজিক। দুপুরের গনগনে রোদে একঘেয়ে, ধূসর রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া গাছ। অদ্ভুতই যে নূতন যৌবনের দূত, এটা ভুলে গেলে চলবে কেমন করে? 

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook