এক হাত অনেকদিন পর খুঁজে পেয়েছে তার সঙ্গীকে। অন্য হাতের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে গীতার দু’পাশে শুয়ে। এই সময়টা শরীর ছুঁয়ে থাকতে হয়। অন্তত একজনকে। একটু আগে একজন কব্জিটা ধরে ছিল। যেভাবে ডাক্তার নাড়ি দেখে। কিছু নেই, ছেড়ে দিয়েছে। এমন ঠান্ডা অরিগ্যামি করা হাত আমি বহুবার ধরেছি। গ্রীষ্মের দিগন্তে একজোট তালগাছ যেমন সাইলেন্ট দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়ে দিতে থাকে, এখানে কয়েক গোছা ধুপকাঠি তেমনই গন্ধরেণু উড়িয়ে চলেছে। বিলাপ করা, প্রলাপ বকা, এমনি বসে থাকা, একা বা অনেক লোক পর পর প্রাণছুট দেহ ঘিরে বসে আছে। অগুরু-র ডেডলি গন্ধ, ডাইনি-চুলো রজনীগন্ধা, জাহাজের লাইফ বেল্টের মতো সাদা ফুলের চাকা, ফাটা হাঁড়ি, মাটি, ধুলো, হরেক গুঁড়ো, খুচরো ও আরও অনেক উপাচারে শ্মশান গমগম করছে।
পায়ের তলায় আলতা লাগিয়ে কাগজে ছাপ নেওয়া হল। কেন জানি না আমার মনে হচ্ছিল, এরা আমার মতো, কেউ নিজের লোক নয়। ভীষণ খুশির খবর ভরা চিঠি ডেলিভারি করা ক্যুরিয়ারের মতো নির্লিপ্ত মুখ। ফোটোগ্রাফার এসে গেল যেই, অমনি সবাই শায়িত দেহের পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। কালো কাপড়ের আলখাল্লার মধ্যে থেকে একটা হাতের আঙুল জেগে উঠল আকাশের দিকে। ম্যাগনেশিয়াম ফ্লেয়ারের ফ্ল্যাশ জ্বলল। এক ছবিতেই শেষ। যন্ত্রপাতি গুটিয়ে টাকা গুনে সে লোক চলে গেল। ছবি হতে সময় লাগবে। আমি এগোলাম তার পিছন-পিছন। গেটের বাইরে একটু দূরে একটা গলির মধ্যে তার স্টুডিয়ো। আমাকে সঙ্গে আসতে দেখে আপত্তি জানাল না। অন্ধকার ঘরে ঢুকে, কাজ করতে-করতে ছিটিক-ছটাক অনেক কথা বলে গেল। ‘শ্মশানে তো কারুর মৃত্যু হয় না, যাত্রার আগে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া, বুঝলেন। শোকের কিছু নেই।’ আলো জ্বেলে সদ্য স্নান করা নেগেটিভ শুকোনো হল টেবিল ফ্যানের হাওয়ায়। আবার ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। এবারে প্রিন্ট হবে। ফুটে উঠল ক্ষীণ লাল বালব, মঙ্গলগ্রহের মতো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই আলতার ছাপটা কেন নেওয়া হয় জানেন?’ পাল্টা প্রশ্ন কানে এল, ‘হাতের ছাপ কেন নেওয়া হয় না সেটা ভাবুন বরং।’
নিরুপায় না হলে আমি বাবুকার কাছে যাই না। রেঞ্জে পেয়ে গেলে আমাকে প্রচণ্ড দুরমুশ করে। সস্নেহে বলল, ‘লেখাপড়া করলি না। কিস্যু জানলি না! বুঝলিও না। বেঁচে গেলি। হিংসে হয় রে। এক পাহাড় নলেজ বুকে বয়ে-বয়ে বেড়াচ্ছি। প্রসেসিং হল না, ছাতা পড়ে গেল। ভাল্লাগে না আর। ডায়নামাইট দিয়ে সবসুদ্ধ নিজেকে উড়িয়ে দিলেই হয়। মার্ডার হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লাগে। সুইসাইড করলে ছাড় পাওয়া যায়। অপকম্মের ভিলেনকে নাকি জানা হয়ে গেছে, তাই! হাসি পায়। যে-ব্যাটা নিজের সুইচ অফ করে দিল, তার খুনি তো আসলে কোটি-কোটি লোক। কত ছাপ ঘাঁটবে? শোনো, পা হল সেই পার্ট যাকে শেষবারের মতো দেখা যায় আগুনে ঢুকে যাওয়ার ঠিক আগে। তাই লাস্ট মাইল স্টোনের একটা প্রিন্ট থাকা জরুরি।’ বেশ বলল কিন্তু। একটু অন্যমনস্ক কিন্তু মুডে আছে। কথা বাড়ালে অনিবার্য অশান্তি জেনেও বলে বসলাম, ‘হাতের ব্যাপারটা?’ ‘ওসব ফালতু ফান্ডা।’ এই অবধি বলে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। হাত সরাতে দেখি কপালে অজস্র কাটাকুটি। রাবার স্ট্যাম্প নাকি? আর ঘাঁটালাম না।
রাস্তায় বেরিয়ে পুদিনার শরবত খেয়ে মাথা ঠান্ডা হল। নিজের হাতের তেলো পরীক্ষা করলাম। নর্মাল ক্রসিংগুলো ছাড়া আরও কিছু লাইন আছে। কয়েকটা আগের চেয়ে অস্পষ্ট যদিও। নিজের ওপর করা অত্যাচারের স্মৃতি। ডেসটিনি আর ইমিডিয়েট পাস্ট, পাশাপাশি। চটি খুলে পায়ে কড়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছু পেলাম না। দাগি হাত তো সবার। কেউ-কেউ আসামি, এই যা। শান্ত ভাবে ব্যাপারটা ভাবলাম। স্রেফ অ্যারাইভাল টাইম ধরে কোষ্ঠীতে একজনের জীবনের সম্ভব্য টাইমলাইন লিখে ফেলা হয়। হাতের রেখা আরও ফাইন ব্যাপার। প্রত্যেক মানুষের জন্য কেউ নাকি প্ল্যানিং করেই চলেছে! এক্সক্লুসিভ নকশা করে, হাতে থ্রি-ডি প্রিন্ট করে, ফটাফট জিনে গুঁজে দিচ্ছে। নিজের আইডেন্টিটি কোড সঙ্গে নিয়েই আসছে মানুষ। কিন্তু কেন? কয়েক বছর আগে কেউ শুনেছে বায়োমেট্রিক টেস্টের কথা? সাপের চোখের মতো সবুজ আলোয় কী কী গুপ্ত তথ্য ওতে ধরা পড়ে, রাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ জানে? আচ্ছা, হাত থাক, আঙুলে খেলি একটু। ওই দিয়ে একমাত্র নিজের ফোনের লক খোলা যায়। অঙ্গুলি হেলনে নয়। স্পর্শে ইয়েস। অথবা নো। কপালের বদলে কারুর যদি আঙুল পোড়ে? মুখ দেখে ফেস রেকগনিশন সিস্টেম হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের তফাত বুঝবে? মুখে যদি আসলের মতো নকল মুখোশ পরা থাকে? ওয়েট, ওয়েট, কথায় কথা জড়িয়ে ল্যাং খেয়ে পড়ে যাব, একটু গুছিয়ে নিই। স্টেডি। একগুচ্ছ কমপ্লেক্স নকশা। ইট্স দেয়ার। স্টেবল। তিনশো বছর আগে বাজে পড়ে মরে যাওয়া এক মানুষের হস্তরেখার অবিকল ডিজাইন ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহে আর এক চাষির হাতে পাওয়া যাবে না। সূক্ষ্ম। অতি সূক্ষ্ম এই তফাত সবার চেয়ে সবাইকে আলাদা করে রেখেছে। ব্ল্যাক হোলের মধ্যে কোন ডার্করুমে বসে এই প্রযুক্তির ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল? কে করেছিল? সবার জন্য হয়নি। বাঘের হাত, পা, দুই আছে। পাগমার্কে রেখা নেই। মাপ, কাদায় গভীরতা দেখে দামড়া না খোকা বোঝে বনদপ্তরের লোকরা। আশেপাশের গ্রামে জ্বালাচ্ছে কি না, গুনতির ক-পিস এখনও আছে, এর বেশি তথ্যের দরকার হয় না। থাবার ছবি বিচার করে সে লুচ্চা না সাধু তাও জেনে লাভ নেই। মনুষ্যেতর প্রাণী, তাই এদের গ্রাফিক্সের জন্য কম ব্রেন ইনভেস্ট করা হয়েছে। আপাতত যেখানে পৌঁছনো গেল তা হল, আইডেন্টিফিকেশন। ফ্যাক্ট, ফিকশন পরে হবে, ঝনঝন করছে শেষ অংশটা, আইডেন্টিটি। চোখে দেখে বোঝা না গেলেও, পাম স্ক্যান করে কেউ যদি সব জেনে ফেলে? সব! সেদিকেই এগোচ্ছে কিন্তু।
জিনিয়ার বাবা ফান্টুস লোক। প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ‘যদ্দিন পারিস শ্বশুরমশাই না বলে আমাকে মেসোমশাই বলে ডেকে নে।’ আজ হস্তরেখার কথা তুলতে বললেন, ‘তুই কি জিনিয়ার পাণিপ্রার্থী? মরবি কিন্তু। ডুবিয়ে মারবে।’ সহজে ঘাবড়াব না বুঝে বললেন, ‘সেদিন যে-লোকগুলো নৌকোডুবিতে মরল, তাদের সবার হাতে কোথাও কোন ইন্ডিকেশন ছিল কি? তর্কে গিয়ে কী আর হবে? পামিস্ট্রিটা এখনও মিস্টিরিয়াস কেন বল তো? ফিজিক্স হয়ে উঠতে আর কদ্দিন লাগবে? দু’একটা কাকতালীয় মিলেছে বলে কিরো-কে মরণোত্তর নোবেলও দেবে না কি?’ বুঝলাম, মানেন না। ‘তবে একটু ভয় করে আজকাল’ বলে থেমে গেলেন। ‘কী হবে বল তো আগে থেকে জেনে? স্পিলবার্গের ‘মাইনরিটি রিপোর্ট’ দেখেছিস? কোথাও একটা ক্রাইম হতে চলেছে। তার স্থান-কাল-পাত্র বলে দিচ্ছে টেকনোলজি। ধর, বোঝা গেল, একটা খুন হবে। এর আগেই খুনিকে পাকড়ালে, সে তো তখনও খুনি নয়, তার কী বিচার হবে? প্রি-ক্রাইম কিন্তু। কোন দিকে যাচ্ছে দুনিয়া? আজকাল ইভল্যুশন হয় না। সবাই রেভল্যুশনে ইন্টারেস্টেড। আমাদের না হয় যা হোক করে কেটে গেল। এরপর? যে-বাচ্চাগুলো জন্মাবে, তাদের কপালে কী লেখা আছে সেটা কেউ জানে? খুব শিগগিরই ওদের হাতে আর কোনও রেখা দেখতে পাবি না।’
ছবি এঁকেছেন : শুভময় মিত্র