ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শোক


    অম্লান চক্রবর্তী (March 24, 2023)
     

    পাপা…’। ‘আস্তে…’ রজত ঠোঁটে আঙুল রেখে তড়িঘড়ি রুকুকে চুপ করাল। তারপর ছেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’

    রুকুও ফিসফিস করে বলল, ‘পাপা, এখানে কি পককর্ন পার্টি হয়েছে?’

    রুকুর বয়স পাঁচ। ও এখনও পপকর্ন বলতে পারে না। দীপশিখা শুনলেই রেগে যায়, ছেলের ভুল শোধরাবার জন্য উঠে পড়ে লাগে। রজতের অবশ্য আধো-আধো কথাগুলো শুনতে ভালই লাগে। যে বয়সে যা মানায়।

    রজত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে কে বলল এখানে পপকর্ন পার্টি হয়েছে?’

    ‘ওই দ্যাখো।’ রুকু আঙুল দিয়ে দেখাল।

    শোকের পরিবেশেও রজতের হাসি পেল। ‘ওগুলো পপকর্ন নয়, খই। কেউ মরলে ওগুলো ছড়াতে-ছড়াতে নিয়ে যায়। হয়তো প্যাকেট থেকে পড়ে গেছে।’

    রুকু অবিশ্বাস নিয়ে খইগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এদিকে ভিড় বেড়েই চলেছে। টাওয়ারের প্রতিটি ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট নাম্বার ১০১-এর বসবার এই প্রশস্ত ঘরের অন্য দিকটায় বিশ্বনাথ কাকুর নিথর শরীরটা ফ্লোরে শোয়ানো। নাকের ফুটো দুটো তুলো দিয়ে বন্ধ। চোখের পাতার ওপর একটি করে তুলসীপাতা রাখা। শিয়রে ধূপ, স্টিলের গ্লাসে জল, আর টবে পুষ্টিহীন শিশুর মতো একটা শীর্ণ তুলসী গাছ। চারপাশে থোকা-থোকা সমব্যথীদের জটলা আর চাপা গুঞ্জন। রজতও এসেছে রুকুকে নিয়ে শোকপ্রকাশ করতে। একই টাওয়ার বলে কথা। বিশ্বনাথ কাকু আর কাকিমা গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভাড়া থাকতেন। সাত দিন অ্যাকিউট নিউমোনিয়ায় ভুগে কাকু আজ সকালে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে অপর্ণা আর জামাই দীপঙ্কর পাশের টাওয়ারে নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে। বিয়ের পরও অপর্ণাই বাবা-মাকে কাছাকাছি রাখবে বলে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিল। দীপঙ্কর রজতের বন্ধুও। সেই সূত্রেও আসতেই হত।

    ঘরের মাঝখানে কার্পেটে একটি কমবয়সি মেয়ে থমথমে মুখে বসে আছে। দূর-আত্মীয় হবে। মৃত স্বামীর পায়ের কাছে লুটিয়ে আছেন কাকিমা। নাইটির ওপর সোয়েটার পড়া, মাঝে মাঝেই ডুকরে উঠছেন। ভাবতেই পারছেন না একান্ন বছর সংসার করার পর হঠাৎই একলা হয়ে গেছেন। এটা কি এক ধরনের প্রতারণা নয়? দুঃখ না ক্ষোভ কোনটা বেশি সঙ্গত, তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।  

    ডিসেম্বর ফুরিয়ে আসছে আর দিল্লিতে শীত জাঁকিয়ে বসছে। সকালের হাওয়া যেন আততায়ীর ব্লেডের মতো অনাবৃত চামড়া খুঁজছে। লিফটে মিল্কবাস্কেটের ছেলেটা জ্যাকেটের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বিড়বিড় করছিল। রজত পরে বুঝেছিল মোবাইলটা ছেলেটার মাঙ্কিক্যাপে গোঁজা ছিল। ঠান্ডাটা যেন ঘরেই বেশি। ভদ্রতা করে রজত জুতো খুলে ঢুকেছিল। টাইলসের ঠান্ডা ওর মোজা ভেদ করে পায়ের পাতা জমিয়ে দিচ্ছে। রুকুর মতো সোফায় পা তুলে বসতে পারলে ভাল হত কিন্তু তা শোভন হবে না। বাঁ-পায়ের গোড়ালিটুকু মাত্র ফ্লোরে রেখে ডান পা-টা তার ওপর চড়িয়ে দিয়ে বসেছিল। একটু চায়ের ব্যবস্থা হলে ভাল হত, কিন্তু এ-অবস্থায় চা আশা করাও অন্যায়।

    ‘অ্যাই রজত, কখন এলে?’ অপুদা এর মধ্যেও হইহই করে উঠলেন। ‘আমার একটু দেরি হল, একটা চেক ডালতে গেছিলাম।’ দীর্ঘ-প্রবাসী অপুদার এই খিচুড়ি বাংলা শুরুতে কানে ঠেকলেও আজকাল রজতের সয়ে গেছে।

    ‘অ্যাই রুকু, আয় তোর হাতের স্ক্রুগুলো খুলে নেই।’ অপুদার এই পরিচিত রসিকতায় রুকু হেসে ওঠে। রজতের অস্বস্তি বেড়ে উঠল। অপুদা মাটির মানুষ, কিন্তু একটু কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে। তাছাড়া সব বিষয়ে নিজস্ব কোনও গল্প ফেঁদে বসেন। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহবিচ্ছেদ-পকেটমার-দুর্ঘটনা যাই হোক না কেন, খবর পেলেই হাজির হন, আর তাদের পরিবার-পরিচিতদের মধ্যে কবে সে-ধরনের ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেন। অপুদা সেই ধরনের লোক, যারা আনন্দে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু শোকে বেমানান। হইহই করে মাততে পারেন, কিন্তু শোকের গাম্ভীর্য আনতে পারে না। এই কি ঠাট্টা-মস্করার সময়?

    দীপঙ্কর রজতের পাশে বসে কানে-কানে বলল, ‘শোন, তোকে শ্মশানযাত্রী হতে হবে না। যথেষ্ট লোক আছে যাওয়ার। ফর্মালিটি করিস না, প্লিজ।’

    রজতের বুকের ভার নেমে গেল। পর পর দু’দিন ঘরে থাকা যাবে ভেবেই ক্রিসমাসের আগের দিনটা ছুটি নিয়েছিল। তাছাড়া রুকুর স্কুলও বন্ধ। বুক-মাই-শো’তে ‘ফ্রজেন টু’র টিকিট কাটা হয়ে গেছিল। অতগুলো টাকা! প্ল্যান বাতিল হলে রুকুও সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে মাথা ধরিয়ে দিত। ওর ক্লাসের প্রায় সবাই ছবিটা দেখে ফেলেছে।

    ‘ইনশিওরেন্স ছিল তো রে?’ রজত উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করল। দীপঙ্কর চোখমুখের শোক গভীরতর করে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’ অপর্ণা একবার এসে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। চোখমুখ দেখে মনে হল এর মধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছে। হাসপাতালের সাতদিনে হয়তো কিছুটা মানসিক প্রস্তুতিও হয়ে গেছিল। মূহ্যমান মা, সমব্যথী পড়শি, শেষযাত্রার প্রস্তুতি— এতসব হাঙ্গামার মধ্যে শোকের অবসর সীমিত। সবার একই জিজ্ঞাসা, ‘কী করে হল?’ আর অপর্ণাও করুণ হাসি টেনে ক্লান্তিহীন আন্সারিং মেশিনের মতো একই উত্তর সবাইকে দিয়ে যাচ্ছে, ‘ম্যাক্সে ছিল… নিউমোনিয়া… অ্যাকিউট হয়ে গেছিল… অন্য কোনও প্রবলেম ছিল না।’

    দরজার বাইরে শর্মাজি ধুতির ওপর সোয়েটার আর মাঙ্কিক্যাপ পরে ঘুরঘুর করছেন। সোসাইটির মন্দিরের হর্তা-কর্তা-বিধাতা সবই উনি। লম্বা উলের মোজা, বাদামি পাম্প শু থেকে গাছের কাণ্ডের মতো ওপরের দিকে চারিয়ে হাঁটুর কাছে ধুতির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে। অপর্ণার গানের গলা ভাল। পাশের সেক্টরগুলোতেও অনুষ্ঠানে ট্র্যাক বাজিয়ে গান গায়। নিজের ইউটিউব চ্যানেলও আছে। যাকে বলে, ‘লোকাল সেলেব্রিটি’। সেই সূত্রেও কিছু অবাঙালি বন্ধুও এসেছে। রজত দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। অরিন্দম আর সাহানা প্রায় একসাথেই ঢুকল।

    ‘কী স্যার, আজ ছুটি ছিল, না কি আমার মতো ওয়ার্ক ফ্রম হোম?’ অরিন্দম রজতের পাশে বসে হাত বাড়িয়ে দিল। ও সেকেন্ড ফ্লোরে থাকে। ‘আরে আমার মা আর আন্টি তো একসাথেই মর্নিং ওয়াক করে। মা-ই বলছিল যে, কাকুর ভেনটিলেশন খুলে দেবে ঠিক করা হয়েছিল। ব্যাপারটা হোপলেস, এদিকে জলের মতো পয়সা যাচ্ছিল। হসপিটালগুলোতে তো আজকাল ডে-লাইট রবারি চলে।’

    সাহানা থাকে এগারো টাওয়ারে। জুম্বা ট্রেইনার, বেতের মতো ছিপছিপে চেহারা। দেখে বোঝার উপায় নেই ওর ক্লাস টেন-এ পড়া একটি মেয়ে আছে। ডিভোর্সি, সুন্দরী— তাই ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সোসাইটিতে কৌতূহলের অন্ত নেই। বিশেষ করে মহিলামহলে। বিধবা মা’কে নিয়ে তিনজনের পুরুষবর্জিত সংসার। পাশের সোসাইটি থেকে পারমিতাদিও এসেছে। পারমিতাদি নিজের সবেধন মেয়েকে কলেজে তুলে দিয়ে দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য একটি এন.জি.ও চালান। নাক-উঁচু বলে বদনাম আছে। সব সময়ে অস্বস্তিকর রকমের ফিটফাট থাকেন, আর অনুষ্ঠানে চিবিয়ে-চিবিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। রিংকুও এসেছে মেয়ে নিয়ে। ওর বর কলকাতায় থাকে, কালেভাদ্রে দিল্লি আসে। ডিভোর্সি না হলেও অন্তত সেপারেশন চলছে বলেই জল্পনা। মন্দিরা আর শর্মিলাও হাজির।

    রজতের পা জমে যাচ্ছিল। একটু নড়াচড়া করতে পারলে গরম লাগত। শ্মশানে যেতে হবে না, কিন্তু ছোটখাটো কাজে সাহায্য করতে পারলেও ভালো হত।

    ‘অ্যাই, মালার ব্যবস্থা হয়েছে?’ ও অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করল।

    ‘একজনকে কিছু ফুল আর মালার কথা বলে হয়েছে, কিন্তু এখনও পৌঁছয়নি দেখছি।’

    রজত তড়াক করে উঠে পড়ল। ‘দু’নম্বর গেটের বাইরে ফুলওলা বসে, আমি দেখছি।’        

    ‘আরে বোসো! হয়তো এক্ষুনি এসে যাবে।’ অরিন্দম হাত ধরে টানল।

    ‘ফুল-মালাই তো, বেশি হলে প্রবলেম নেই’, রজত হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘রুকু, এখানেই থেকো, আমি আসছি।’

    পা বাড়াতেই দরজার মুখে পারমিতাদির মুখোমুখি হল।

    ‘বাড়ি যাচ্ছ?’

    ‘না, একটু ফুল-মালার ব্যবস্থা দেখছি।’

    ‘দু’নম্বর গেটের সামনে দ্যাখো। তোমার দাদা রোজ সকলে ওখান থেকেই পুজোর ফুল আনে। আচ্ছা চলো, আমিও যাচ্ছি।’ নকশা-কাটা চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে পারমিতাদি ওর সঙ্গে বেরিয়ে এল। বাইরে পা রাখতেই, শীতের রোদ যেন কাশ্মীরী শালের উষ্ণতা নিয়ে রজতকে জড়িয়ে ধরল। ডানদিকে বেঁটে রয়াল পামের সারি। বাঁ-দিকে ল্যান্ডস্কেপিং-এর কাজ এখনও শেষ হয়নি। দু’নম্বর গেটের কাছে আসতেই রজতের ফোন ঝমঝমিয়ে উঠল।

    ‘হ্যালো সাহানা… ওহ্‌, তুমি! … হ্যাঁ, ওই ফ্ল্যাটে সিগনাল উইক। এসে গেছে? ওকে, আসছি।’ ফোন পকেটে রেখে রজত দেখল পারমিতাদি উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছেন।

    ‘লাগবে না, ফুল-মালা এসে গেছে। অরিন্দম ফোন করেছিল।’

    ‘সাহানার নাম্বার থেকে?’ পারমিতাদি মুখ টিপে হাসলেন।

    ‘হ্যাঁ, অরিন্দমের ফোনে সিগনাল আসছিল না। এয়ারটেল আজকাল খুব ভোগাচ্ছে।’

    ‘সেদিন সাহানা মেয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ি। টিয়া তো দেখলাম অরিন্দম আঙ্কল বলতে পাগল!’ পারমিতাদি আবার মুচকি হাসলেন। ঘরে ফিরে রুকুকে ঘরে পাওয়া গেল না। নিশ্চয়ই পেছনে সুইংগে ঝুলছে। পরে দেখা যাবে।

    শেষযাত্রায় নেহাত কম লোক হল না। বিশ্বনাথ কাকুর দেহটা বাইরে বার করতেই কাকিমা ভেতরে আর্তনাদ করে উঠলেন। অপর্ণা থমথমে মুখে পেছন-পেছন বেরিয়ে এল। রজতও এল। মৃতদেহ হাতে-হাতে উঠে যেতেই শবযান রওনা দিল নিগমবোধ ঘাটের উদ্দেশ্যে। তিনটে গাড়িতে দীপঙ্কর আর ওর বন্ধুরা পিছু নিল। রজত শুন্যে নমস্কার করে দাঁড়িয়ে রইলো।

    খেলার জায়গাটায় রঙিন সোয়েটার-জ্যাকেটে মোড়া বাচ্চাদের মেলা বসেছে। উলটো হয়ে পেট ঘষটে স্লাইড দিয়ে নামছে, আর বকুনি খেয়েও বার বার অবাধ্য হচ্ছে। রুকুর দুটো বন্ধু পাওয়া গেল, কিন্ত তার দেখা নেই। লনের অন্য প্রান্তে আরেকটা বাচ্চাদের খেলার জায়গা আছে। বাবু নিশ্চয়ই সেখানেই আছেন। রজত ওদিকে পা বাড়াল।

    একটু বাদেই মনে পড়লো রুকুকে খুঁজতে হবে। টাওয়ারের সামনে জটলা বাড়ছে। শুধু অপর্ণা নেই, নিশ্চয়ই মায়ের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে। রজত ওদের পাশ কাটিয়ে টাওয়ারের পেছনে পার্কের দিকটায় এল। খেলার জায়গাটায় রঙিন সোয়েটার-জ্যাকেটে মোড়া বাচ্চাদের মেলা বসেছে। উলটো হয়ে পেট ঘষটে স্লাইড দিয়ে নামছে, আর বকুনি খেয়েও বার বার অবাধ্য হচ্ছে। রুকুর দুটো বন্ধু পাওয়া গেল, কিন্ত তার দেখা নেই। লনের অন্য প্রান্তে আরেকটা বাচ্চাদের খেলার জায়গা আছে। বাবু নিশ্চয়ই সেখানেই আছেন। রজত ওদিকে পা বাড়াল। রাস্তায় মজুমদার কাকিমার সাথেও দেখা হল।

    ‘তুমি গেছিলে? আচ্ছা। ডেডবডি নিয়ে গেল? আহা রে, দেখতেই পেলাম না। যাই, মিসেস সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করে আসি। অপর্ণা ফ্ল্যাটেই আছে তো?’

    রুকু দুটো অপরিচিত বাচ্চার সাথে স্লাইডের কাছে বালু খুঁড়ে কিছু একটা বানাচ্ছিল। উলের টুপি ওর মাথা ছেড়ে কাঠগোলাপের একটা ভাঙা ডালের ডগায় ঝুলছিল। পাশেই একটা তালপাতার সেপাইয়ের মতো লোক এক হাতে পুপ-স্কুপার আর অন্য হাতে লীশ টেনে পেল্লাই এক জার্মান শেপার্ডকে নড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

    ‘রুকু, বাড়ি চলো। রুকু…’

    ‘আরেকটু খেলি না পাপা…’

    ‘না বাবা, অনেকক্ষণ হল, মামা চিন্তা করছে।’

    ‘প্লিইইইইইজ…’

    ‘প্লিজ বললেই সব হয়ে যায়? চলো এবারে। হাতটা ভাল করে ঝাড়ো…’

    ‘বাই ভিভান, বাই রিশিত…’

    ‘টুপিটা নাও… ওদের তুমি চেনো?’

    ‘ভিভান তো আমার ডে-কেয়ারেই যায়। রিশিতকে তো আজ ফার্স্ট মিট করলাম। আরেকটু খেলতাম…’   

    বোতাম টিপে লিফ্টের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে রজত রুকুর মুখের দিকে চাইল। একটু আগেও খেলা ছেড়ে আসার দুঃখটা চোখে মুখে ছিল। এখন লিফটের সামনে দুলছে আর মন দিয়ে ডিসপ্লে বোর্ডে ফ্লোরের কাউন্টডাউন দেখছে।

     ‘রুকু, তুমি ওপরে চলে যাও। মামাকে গিয়ে বলবে আমি পরে আসছি, ঠিক আছে?’ রজত ওকে লিফটের দিকে এগিয়ে দেয়।

    ‘পাপা, চলো না। আমাদের সিনেমা দেখতে দেরি হবে।’

    ‘ডোন্ট ওরি। তুমি স্নান করে লাঞ্চ করে নেবে, আমি ততক্ষণে এসে যাব। ওকে?’

    রুকু মাথা নেড়ে লিফ্টে উঠে দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই একটা ফ্লাইং কিস দিল। রজতের ফ্লাইং কিস বোধহয় ও দেখতে পেল না।

    ওখান থেকেই বাঙালিদের সরগরম আড্ডার আওয়াজ রজতের কানে এল। সোসাইটির বেশির ভাগই অন্য ভাষাভাষী হলেও বাঙালিদেরই দাপট। সেদিন অফিসেও ভুপিন্দর বলছিল, ‘ইয়ার, তুম বাঙ্গালি লোগ এক হোতে হি আপনি জুবান মে শুরু হো যাতে হো— মচ্ছি, রাসগুল্লা, হমি তুমাকে ভালোবাসে…। চিল্লা-চিল্লাকে দুসরো কে বেহরা কর দেতে হো, অর হাম পাঞ্জাবি লোগোকো লাউড বলতে হো সালে…’

    টাওয়ারের সামনে রোদের প্রশ্রয়ে সত্যি জটলা জমে গেছে। সবাই হাত নেড়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে।

    ‘একমাত্র মেয়ে, এত বড় শোক, কিন্তু অপর্ণা নিজেকে কেমন ধরে রেখেছে দেখেছ? অ্যাডমায়রেবল!’ পারমিতাদি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কথাটা আলতো ভাসিয়ে দিল।

    ‘তা ঠিক!’ অপুদা মাথা নাড়ল।

    ‘এক্সট্রিমলি সরি, বাট আই কান্ট বি সো পলিটিকালি করেক্ট।’ মন্দিরা ঝাঁঝিয়ে উঠল। ‘অ্যাডমায়রেবল, না আনন্যাচরাল? সাজগোজে শোকের কোনো ছাপ দেখেছ? কালই ম্যাডামের সঙ্গে লুক্‌স-এ দেখা হল, ইমাজিন! যার বাবা অন ডেথবেড!’

    ‘আই ডোন্ট ওয়াণ্ট টু বি মিন, বাট…’ পারমিতাদি বলল, ‘এতই যদি বাবা-মায়ের প্রতি ভালবাসা, ভাড়া করা ফ্ল্যাটে কেন? নিজের ফ্ল্যাটে রাখলেই পারতিস।”

    ‘টু বি অনেস্ট’, রজত গলা খাকরে বলল, ‘আমি এর মধ্যে কিছু দোষের দেখি না। এক ফ্ল্যাট থেকে দৈনিক খিটিরমিটির চেয়ে আলাদা ফ্ল্যাটের শান্তি ফার বেটার। এভরিবডি নিডস স্পেস। আমি জানি কত কষ্ট করে তবে গ্রাউন্ড ফ্লোর ফ্ল্যাট পেয়েছে। কাকু লিফট অ্যাভয়েড করতে চাইত। আমি আমার বাবা-মা’কেও বলেছিলাম এখানে একটা ফ্ল্যাট রেন্ট করি, কিন্তু বাবা রাজি হলেন না।’

    ‘সত্যি কথা!’, অপুদা বোধহয় কিছুটা দমে গেছিলেন, কিছুটা সাহস পেয়ে মুখ খুললেন। ‘তাছাড়া দীপঙ্করের মত জামাই হয় না। শশুরের পেছনে জলের মতো টাকা খরচ করেছে।’

    ‘আপনিও খুশি মনে করতেন অপুদা’, মন্দিরার হাসিতে তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ল, ‘যদি শশুরের সল্টলেকের ফ্ল্যাট আপনার হাতে এসে যেত।”

    অপুদার অবশ্য সেই সম্ভাবনা ছিল না। হালিশহরের অপুদা প্রস্তরযুগে মালদার দীপ্তিদিকে বিয়ে করেছিলেন। প্রায় নুন-আনতে-পান্তা-ফুরোয় যার সংসারে, সেই কেরানী শশুরের সল্টলেকে ফ্ল্যাট থাকার কথা নয়। থাকলেও দীপ্তিদির তিন বোন আর চার ভাই দাবিদার থাকতো।      

    ‘এগেইন, আম নট সেয়িং দে উইল, বাট আজকাল অনেক মেয়ে-জামাই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে শাশুড়িকে বৃন্দাবন বা বারাণসী চালান করে দেয়,’ মন্দিরা জোর দিয়ে বলল। মুখ দেখে বোঝা গেল অপুদার মন মানতে চাইছে না, কিন্তু মন্দিরার কথার প্রতিবাদ করার সাহসও অপুদার হলো না। মেয়েটার জিভ তো নয়, ছুরি। লঘু-গুরু জ্ঞান একেবারেই নেই। দুম করে অপমান করে বসলে অপুদা যে জুতসই জবাব দিতে পারবেন সে সম্ভাবনাও নেই। কাজেই চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হল।

    ‘অপর্ণার মেয়েকেও দেখলাম না মনে হল…’ মন্দিরা বলল।

    রজতের রাগ হল। ‘অর্চিতা স্কুলে। কে যেন আনতে গেছে ওকে। ক’দিন রোজ হাসপাতাল যাচ্ছিল মেয়েটা শুনেছি।’

    ‘যাই বলো, সময় পাল্টে গেছে। আমার দাদু যখন মারা গেল আমি শেষ তিনদিন বিছানার পাশ থেকে নড়িনি, মন্দিরা ‘বেশ গর্বের সাথে বলল।’

    স্কুলগুলোও এক-সে-বড়-কর-এক, অরিন্দম যোগ দিল। ‘বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েরা স্কুলের নাম করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে এখানে-ওখানে বংশের মুখ রোশন করছে। ক্লাস এইটে না উঠতেই আজকাল মেয়েগুলোর দুটো-তিনটে করে ব্রেক-আপ!”

    আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে দেখে রজতের অস্বস্তি হল।

    ‘আমারও একটু বেরোনো আছে, চলি’, রজতও সরে পড়ল।

    ‘এই, আমিও আসি, চেকটা ডালতে যেতে হবে’, অপুদা টুপিটা আবার মাথায় দিয়ে রজতের সংগ নিল।

    অপুদা ভেতর দিয়ে শর্টকাট নেবে। টাওয়ারের লিফ্ট পর্যন্ত দুজনে নিঃশব্দে একসাথে এলো। দুজনেরই মুখে কথা নেই, চোখ ফ্লোরে। রজত হাত তুলে বাই করলো। অপুদা এতোটাই অন্যমনস্ক ছিলেন যে লক্ষ করলেন না। রজতের এই প্রথম ভদ্রলোককে পর্যাপ্ত শোকগ্রস্থ মনে হল।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook