ব্যোম
আবার প্লেন? দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায় কয়েকদিন আগে থেকে। ভোরের ফ্লাইট ধরতে হলে আরও বেশি। বিকেল হলেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। মাঝরাতের অনেক আগে ঘুম-না-আসা বন্ধ চোখ খুলে ফোনে বার বার মাপি, আর কতটা সময় বাকি। যদি ট্যাক্সি না পাই? ফোনের গাড়ি যদি শেষ মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে নেয়? সময়ে পৌঁছলেও ভয় অনেক। এয়ারপোর্টে একবার প্রথম দরজার সিকিউরিটি, একটি মেয়ে, কঠিন মুখ নয় মোটেই, আমার চোখে চোখ রেখেছিল প্রায় এক যুগ ধরে। সেই কবেকার আধার আমার। ওই ছবির সঙ্গে আজকের মুচড়ানো কাগজের ঠোঙার মতো মুখের মিল খুঁজে পায়নি সে। ক্ষমার অযোগ্য আসামি ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্তে যেভাবে বিড়বিড় করে, সেভাবেই বলেছিলাম, ‘ছেড়ে দাও না।’
দরজা পেরিয়ে একঝলক দমকা ঠান্ডা হাওয়ায় আতঙ্কটা কেটে যায়। তারপর আবার একটা। ভোর-ভোর শহর ছেড়ে উড়ে যেতে যায় সবাই। সারি দেওয়া পাখিদের গুটি-গুটি এগোনো লাইন ছোট আর হয় না। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রবেশপত্র না পাই, তাহলে কয়েক সেকেন্ড দেরি হওয়ার দোষে আমাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার অধিকার ওদের আছে। আমার ফ্লাইটের নাম ধরে কেউ ডাকলে তবেই লাইন পেরিয়ে একেবারে সামনে। এরপর সহজ মৌখিক পরীক্ষা। তারপর সিকিউরিটি চেক। আমার প্রাণের পুঁটলিকে না খুলেই বিবস্ত্র করবে সুপ্রিম ধর্ষক এক এক্স-রে মেশিন। কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে খুলবে। একবার কয়েকটা ঝিনুক পেয়েছিল। ফেলে দেয়। ধারালো, সেই দোষে। হাউ-হাউ করে কাঁদতে দেখেছিলাম এক বৃদ্ধাকে। রাষ্ট্র সদ্য শুষে নিয়েছে তাঁর বিয়েতে উপহার পাওয়া পানের বাটা। যাঁতা ছিল মূল অপরাধী। চুন-খয়ের যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। এরপর মহিলাদের জন্য নারী, আমাদের জন্য পুরুষ দেহসন্ধানী। ফ্রেম ডাকবে। ক্ষতবিক্ষত যিশুর মতো দু’বাহু প্রসারিত করে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। শরীরের অবয়বের প্রান্ত ছুঁয়েও না ছুঁয়ে পারভার্ট যন্ত্রটা ঘুরবে-ফিরবে। কঁকিয়ে উঠলে ঠান্ডা প্রশ্নভরা দৃষ্টি। বেল্ট? নো নো। হাত তুলতেই একজনের প্যান্ট মাধ্যাকর্ষণের ষড়যন্ত্রে নিম্নগামী। মানসম্মান ধূলিসাৎ। একবার আমার কোমরের ভেতরে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গিয়েছিল। সেবারে ‘আই হ্যাভ আ স্টিল বল ডাউন দেয়ার, মাই সকেট ইস নরমাল বাট’ বলে পেরিয়ে গিয়েছিলাম সদর্পে।
আকাশ আর জমির মাঝখানে লম্বা অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো কাচের ঢাকা বারান্দা। এখানে একবার পৌঁছলে ফেরার পথ নেই। ডাক না এলে এগোনোরও উপায় নেই। অপেক্ষা করাকে মোহময় করে তোলার কত কী ব্যবস্থা সেখানে। খাবারের খুব দাম। এখন আর রাগ হয় না। প্রায় সব বিষয়ে খিদে মরে গেছে, এরকমই নিজেকে বুঝিয়েছি। তৃষ্ণা মেটেনি। আঁজলা করে জল খাবার উৎস রয়েছে টয়লেটের বাইরের দেওয়ালে। উট, সারস, দীর্ঘ গ্রীবা কেউই জলপান করতে পারে না এই আধুনিক টিপকলে। এয়ারপোর্টের মতো সম্ভ্রান্ত জায়গায় মুখ শুকিয়ে যাওয়া মানুষকে চরম অপমান করার প্রযুক্তি। একজন বলে উঠেছিলেন, ‘এর চেয়ে ইউরিনাল ভাল। কাছে মুখ নিয়ে গেলে সে ঠিক বুঝে নেবে তৃষ্ণার্তের প্রয়োজন। একই জল।’
ভোররাতের ফ্লাইট থাকলে আকাশছোঁয়া কাচের জানলার বাইরেটা লাল হয়ে ওঠে। কুয়াশায় ছাই নীল। একবার বর্ষায় খুব ঝড় উঠেছিল। রানওয়ের ওপর, আশেপাশে, রঙিন বাসমতী চালের মতো প্লেনগুলোকে দেখে ভয় করছিল। উড়ে না যায়। কমলা ধুলোঝড়কে পাত্তা না দিয়ে একের পর এক টেক-অফ ল্যান্ডিং চলছিল। নীচুতলার অবাধ্য, অসভ্য হাওয়ার স্তর ভেদ করে ওপরে উঠে যাওয়ার দম যার আছে বা হরেক কিসিমের মেঘের কার্পেটের ওপর দিয়ে যার নিত্য আনাগোনা, তারা এসবে ঘাবড়ানোর পাত্র নয়। কদাচিৎ পিছলে যাওয়া, জ্বলে যাওয়া, ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটে যদিও। তখন টিভি, খবরের কাগজ, ফোন হয়ে ওঠে জরুরি ব্ল্যাকবক্স। ভাবতে-ভাবতে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা নিমকি পিষতে শুরু করলাম মুখের মধ্যে। নজর স্ক্রিনে। স্বর্গযাত্রার অনেক দ্বার। কার খোলার মর্জি হচ্ছে সেই খোঁজ রাখতে হয়। তার কণ্ঠলগ্ন হয়ে থাকা জরুরি। এই শেষ ধাপ। এরপর ডাক পড়লে জমিতে অপেক্ষা করা বাসে অথবা এরোব্রিজ পেরিয়ে সরাসরি প্লেনের সুগন্ধি শরীরের নির্ধারিত কুর্সিতে নিজেকে সঁপে দেওয়া। এবারে আমার ফোর ডি।
জানলার ধরে থ্রি এ-র ভদ্রমহিলার কোলের বাচ্চা ম্যাজিক রোপ ধরে ওপরে উঠতে চায়। সে নিশ্চয়ই দেখেছে ওপরে ক্যাবিন লাগেজ রাখার জায়গাটা। ছোটবেলায় ট্রেনে নীচের সিট দেদার খালি থাকা সত্ত্বেও বেয়ে-বেয়ে ওপরে ওঠার তালে থাকতাম। সেরকমই ব্যাপার। মাথার ওপরের গোল-গোল পোর্টগুলো দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বেরোচ্ছে। ঘুরিয়ে বাড়ানো-কমানো যায়। সেখানেও বাচ্চার হাত চলে যাচ্ছে। দেখে থ্রি বি, থ্রি এ-কে কিছু একটা বললেন। আমি শুধু ওদের মাথাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। ‘কী অসভ্য তুমি’ প্রায় চিৎকারের মতো শোনালো থ্রি বি-র গলা। একদম পাশেই, থ্রি সি নিশ্চয়ই সবটা দেখেছেন, বুঝেছেন। বিশাল শরীর কাঁপিয়ে হাসি শুরু হয়ে গেল। বিশ্বযুদ্ধের মিসারমিট বম্বার স্টার্ট করার মতো শব্দ তার। প্যাসেজের এপাশে, আমার সামনে থ্রি ডি, থ্রি সি-র বৌ নিশ্চয়ই, দাবড়ে দিলেন, ‘আস্তে, আস্তে! সিট ভেঙে যাবে!’ কোথা থেকে কে জানে কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশার মতো কীসব বেরিয়ে আসছিল ওপর থেকে। বাচ্চাকে শান্ত করার জন্য থ্রি এ বললেন, ‘একটু পরেই আমরা ইয়াম্মা-ইয়াম্মা মেঘ দেখব। এখন বেবি-বেবি মেগু দ্যাখো।’ বাচ্চা ভোলার নয়, ছ্যাঁ-চ্যাঁ বাড়তেই থ্রি বি তাকে কোলে নিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম, ‘চুপ করে বোস, না’লে বাইরে বের করে দেব।’ লাভ হল না। ‘একদম সিটের তলায় ঢুকিয়ে বোল্টু টাইট করে দেব কিন্তু।’ এবারের ডোজে কাজ হল। বাচ্চা আবার ফেরত গেল সি ওয়ানে। সিটবেল্ট বাঁধতে বলা হয়েছে। গড়িমসি করছেন অনেকে। কথা না শোনাই কাজ। একেবারে সামনে, পাইলটের দরজার উল্টোদিকে, এয়ার হোস্টেসরা হাসি-হাসি মুখে কলবল করছে। বিশিষ্ট কেউ যাচ্ছেন কি? আমার মনের কথা তুলে নিয়ে থ্রি ই বললেন, ‘অপর্ণা।’ থ্রি এ গলা তুলে বললেন, ‘নোপ, শর্মিলা।’
এদিকে স্ক্রিনে দেখিয়ে দিয়েছে বোর্ডিং কমপ্লিট। ধপ করে বন্ধ হয়ে গেল আমের ফালির মতো দরজা। চারপাশের গোঁ-গোঁ শব্দটা এখন চাপা শোঁ-শোঁ। থ্রি সি-র দশাসই লোকটা বেল্ট বাঁধেনি, দৌড়ে এসেছে এয়ার হোস্টেস। সে নাকি পারছে না। সহায়তা চাই। হোস্টেস, বয়স কম তো কী হয়েছে, পোড় খাওয়া প্রফেশনাল। এসব মতলব ভালই বোঝে। কাছে এসে, মডেস্টি ডিসট্যান্স মেন্টেন করে হাসিমুখে স্লো-মোশনে নিজের নাভির ওপর অদৃশ্য একটা বন্ধনীকে জুড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করতেই মোটা কড়াৎ করে নিজের জালা বেঁধে ফেললেন। আমার ঠিক সামনের সিটে, থ্রি ডি-র মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। প্লেন দৌড়তে শুরু করেছে।
এই সময়ে ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বন্ধ না রাখলে, বা সাইলেন্ট না করলে মুশকিল হতে পারে। থ্রি ই-র ফোন বেজে উঠল— ‘জয় জগদীশ হরে।’ দুটো সিটের হেড-রেস্টের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের। প্লেন জমি ছেড়ে দিয়েছে, ঘটাং করে সন্দেহজনক একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে চাকা তার পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে। নিজের পেটের মধ্যে একটা খালি-খালি ভাব। উত্তেজনায় থ্রি ই ফোনে থাপ্পড় মারতে লাগলেন প্রাণপনে। কাজ না হওয়ায় কানে তুলে দ্রুত বললেন, ‘আমরা ঠিক আছি ছোড়দি, আমরা, তোমরা ভাল তো? কেটে দেবে, কেটে দেবে কিন্তু।’ কেটে গেল। থ্রি এফ-এর গলা শুনলাম, ‘আর সময় পেল না?’ উত্তর-প্রত্যুত্তর শুনতে পেলাম, ‘ইচ্ছে করে করেছে। মনে আছে? সেবারেও ঠিক এরকম সময়ে করেছিল। হিংসে। রেলের পাস নিয়ে চিরকাল ঘুরেছে অন্যের ট্যাক্সের পয়সায়, প্লেনে চাপার মুরোদ হয়নি তো!’ ‘তোমার ছোড়দির মেয়ে তো এয়ার হোস্টেস পাশ দিল, তার কী হল?’ ‘কী আর হবে, এয়ার ডেকান ডালমুটের দামে প্লেন চড়াতে গিয়ে নিজেরাই সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে গেল।’ ‘যত্ত সব ফালতু কথা, এরা খেতে দেবে তো?’ ডি, ই বা এফ এই ব্যাপারটা ঠিক জানে না। ওদিকে বাক্স গাড়ি নিয়ে খাবার আসবে আসবে করছে। থ্রি বি বলল, ‘এ কি মাসিপিসিদের সেই এয়ার ইন্ডিয়া নাকি যে উঠলেই পাত পেড়ে পান্তা খাওয়াবে?’ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি টু সি-কে খেতে দেওয়া হচ্ছে। টু ডি কী আছে শুনে পছন্দ না হওয়ায় কিছুই নিল না। দু’নম্বর রো শেষ করে গাড়ি যখন তিন পেরোচ্ছে, দেখি সবাই তাকিয়ে আছে এয়ার হোস্টেসের দিকে। আমি প্রমাদ গুনলাম। আস্তে করে সামনের ট্রে খুলে পেতে রাখলাম। নলি কাটা দাম, তা সত্ত্বেও আমি ওই তিন কোনা, তিন থাক মেয়োনিজে মাখানো মুরগির গুঁড়ো ভরা বাসি পাঁউরুটিটা খাই। টিকিটের সঙ্গে বুক করি। কারণ আছে। বলছি পরে। যেন কতকালের চেনা, এমন মুখ করে আমার নাম শুধিয়ে ন্যাপকিন মুড়ে স্যান্ডউইচের বাক্স দেওয়া হল আমাকে। কাশির শিশির সিরাপের মাপের বোতলে একবার কুলকুচি করা যেতে পারে, সেই জল-ও। ড্রিঙ্কস বরাদ্দ ছিল। আমার শব্দহীন ইশারায় সেবিকা একটু হেসে পাল্টা বুঝিয়ে দিল, বুঝেছি, কফি পরে দিচ্ছি। এই আমার একমাত্র লাক্সারি। প্লেনের সিটে বসে পাঁউরুটি কামড়ে আমার অন্তত বারোখানা দাঁত বের করা সেলফি তুলে কতবার পোস্ট করেছি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। দশজন আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে। পঁচিশটা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। এখন আমরা সবাই পরস্পরকে দাঁত দেখাই। বন্ধু হয়ে গেছি। এইজন্যই তো।
ওদিকে বাচ্চা কোলে থ্রি এ থেকে শুরু করে তিন নম্বর রো-র সবাই উঠে পড়েছেন। আমাকে দেখছেন মুখ ঘুরিয়ে। দেখেই বুঝতে পেরেছেন আমি স্বজাতি। এই যে, কাউকে দেওয়া হবে, কারণ সে প্রি-বুক করেছে, অন্যদের নয়, তা সত্ত্বেও, অন্তত পঁয়ত্রিশ হাজার ফিটে, ফর্মুলা রেসিংয়ের তিন গুণ গতিতে আকাশ দাপিয়ে চলার সময় এটাই ভীষণ একটা অপমানকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ওঁদের কাছে। তিন নম্বর রো-র লোকজন খাবার বুক করেননি। তাই কেউ থামেনি। বোর্ডিং পাশে ছাপা সাংকেতিক প্রমাণ দেখিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে খাবার বিতরণ করতে-করতে অন্নদাত্রী গজেন্দ্রগমনে চলে গেছে অনেক দূরে। থ্রি সি ওপরের বোতাম টিপে এয়ার হোস্টেসকে ডাকবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। সিটবেল্ট খুলতে ভুলে গেছেন। এখন উনি আটকে গেছেন। হাঁসফাঁস করছেন। থ্রি এফ-কে দেখতে পেলাম। উনি ঘোষণা করলেন, ‘খাবার দেবে না মানে? বাবা দেবে!’ থ্রি ই ওঁকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। সুবিধে হচ্ছে না। গোলমাল হবেই। প্যাসেজ দিয়ে একজন এদের কাছেই আসছিল, জলের বোতল নিয়ে। যাতে পেরিয়ে যেতে না পারে, সেইজন্য থ্রি সি তাঁর প্রবল পাঞ্জা সটান বাড়িয়ে দিলেন প্যাসেজে। রেলের লেভেল ক্রসিংয়ের ডান্ডার মতো। কেন সবাইকে দেওয়া হল, আমরা কেন উপেক্ষিত, ঘ্যানঘ্যান দিয়ে শুরু হল। কারণ ফের শুনে, বুঝেও না বুঝে প্রথমে সেন্টিমেন্টাল নাটক, দাবিটা হল মনের ওপর নাকি সাংঘাতিক চাপ পড়ছে। মনে-মনে ভাবলাম, পড়ারই কথা, এয়ার প্রেশারের তারতম্যে অনেক কিছু হতে পারে। ব্লাড প্রেশার বেড়েছে দেখতেই তো পাচ্ছি। ছোট আলাপের পর এরপর বিতন্ডার প্রলম্বিত ঝালা, নানারকম ঝাল ঝাড়া। সবটাই ভাববাচ্যে। টিকিটের প্রচুর দাম নিয়েছে। অনেকে, এই প্লেনেই, এর চেয়ে অনেক কম ভাড়ায় উড়ছে। তাই বা হবে কেন? পরে টিকিট কাটলে কি মিনিবাসে বেশি টাকা নেওয়া হয়? ইকোনমিক্সকে কনুই মেরে সাম্যবাদের পলিটিকাল থিওরি ঢুকে পড়েছে উড়ন্ত প্লেনে। এবারে চেনা গত। রেগে গেলে শরীরে পরিবর্তন হয়। থ্রি সি-কে নিয়ে আমার চিন্তা। নড়াচড়া, এদিক-ওদিক দেখাগুলো সুবিধের নয়। থ্রি ডি প্যাসেজের এপাশ থেকে, ‘এখন না, এখন না’ বলেছেন দু’বার। স্বামীকে চেনারই কথা। প্রেশারাইজড কেবিনে বাতকম্ম করলেই সর্বনাশ।
এয়ার হোস্টেস এখনও সরস্বতীর মতো অবিচল। মুহূর্তে কালীমূর্তি ধারণ করবে তাও নয়। তিন নম্বর রো-এর আবেদনগুলো শালীনতার সরু সীমানার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। ‘ঠিক আছে, দেবে না তো দেবে না। আমরা কি খেতে পাই না না কি? একটু পরেই নামব লখনৌতে। হজরৎগঞ্জের রয়্যালে গিয়ে খাব। এমন সাংঘাতিক খাব যে কলকাতায় ওয়াজেদ আলী শাহ অবধি কবরের মধ্যে চমকে উঠবে।’ পরিস্থিতির পারদটা নেমে আসছিল। বাচ্চাটাও চুপ। দুম করে উঠে দাঁড়ালেন থ্রি বি। রিভলভারের নলের মতো আঙুল তুলে টু হুম ইট মে নট কনসার্ন কর্তৃপক্ষকে বললেন, ‘উই হিয়ার নাথিং। ইউ মাস্ট ইট আস।’
গোলমালে অন্য যাত্রীরা প্রথমে মাথা না দিলেও এখন অনেকেই তাদের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। উড়ন্ত প্লেনের মধ্যে দুটো শিবির তৈরি হয়ে গেছে। তিন নম্বর রো। এবং বাকিরা। বোঝানোর কাজ শেষ করে এয়ার হোস্টেস চলে গেছে নিজের কাজে। প্লেনটা একটু ঝাঁকুনি দিচ্ছে। এয়ার পকেটে পড়ছে নিশ্চয়ই। শুনেছি, কম প্রেশার থাকলে প্লেন চলন্ত অবস্থায় অনেকখানি অল্টিচিউড লুজ করে। ভেতরে বসে বোঝার উপায় নেই, এক-এক বারে নাকি বেশ কয়েকশো ফিট ড্রপ করে। পাইলট ঘোষণা করল, ‘প্লেন টার্বুলেন্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা যেন এদিক-ওদিক যাতায়াত না করেন। সিটবেল্ট বেঁধে ফেলেন।’ খাবার না দেওয়া নিয়ে ডামাডোলে থ্রি এফ বিশেষ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। বললেন, ‘প্লেন ঝাঁকিয়ে, মিথ্যে ভয় দেখিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে দিল। এভাবে আমাদের দাবায়ে রাখা যাবে না কো।’ ‘চুপ করো না। মুরোদ জানা আছে, দেখছে সবাই।’ হল্লা থামল আপাতত। আমার নিজের ভয়ঙ্কর খারাপ লাগছিল। এভাবে সিন করার কোনও মানে হয়? এয়ারলাইনসের মেনুকার্ডে আর কী কী পাওয়া যায় দেখছিলাম, মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রত্যেকবারই দেখি। এরই মধ্যে থ্রি সি তার ফোনে যেন কিছু একটা দেখছে এমন ভান করে চলাফেরা করা এয়ার হোস্টেসের ছবি তুলছিল। ‘নট অ্যালাউড স্যার’, বলে হনহন করে চলে গেল সে। লোকটা মুখ ঘুরিয়ে একবার আমাকে দেখল। তারপর প্লেনের সেফটি বুকলেট পড়তে শুরু করল।
আমার পাশের লোক পেরিয়ে জানলার বাইরে ঘন নীলের ওপর সফেন সাদার প্রশস্ত এক পাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। প্লেনের রুপোলি ডানার ওপর দ্রুত সরে যাচ্ছিল মেঘের ছায়া। পাখির মতো ঝটপটানি নেই। শেষ প্রান্তে একটা শার্ক ফিন। এখানেই কোথাও আকাশপ্রদীপ জ্বলে, অন্ধকারে। ডানার তলায় বিশাল জেট পট। তার সৌম্যকান্তি অবয়ব দেখে বোঝার উপায় নেই, কী চলে তার ভেতরে। জানি, সাংঘাতিক থ্রাস্ট জেনারেট করে চলেছে সে, অবিশ্রান্ত ভাবে। এতগুলো মানুষ এবং নিজেকে অবলীলায় তুলে আনছে অকল্পনীয় উচ্চতায়। নিয়ে চলেছে স্থির লক্ষ্যে, রাজসিক স্টাইলে, অনায়াসে। পথে দেখা হওয়া সমস্ত মেঘের সঙ্গে সহবাস সমাপনে এক সময় নিশ্চিন্তে নেমে যাবে আলোয় সাজানো রানওয়ের দীর্ঘ বিছানায়, যথা সময়ে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব আমরা। এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে, আমাদের দিকে। সর্দারজি। ঘন নীল স্যুট। এক পুঞ্জ মেঘের মতো সাদা দাড়ি। মেগা মেঘের মতো পাগড়ি। ভুর-ভুর করছে বয়সকালীন গ্রেস। হাতে বাক্স জাতীয় কিছু। থামলেন আমার একটু আগে। ডাইনে-বাঁয়ে সবাইকে দেখলেন। ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বললেন থ্রি সি-কে, নীচু স্বরে। অন্যদেরও। শুনতে পেলাম না। ওরা প্রায় সকলেই একটু যেন অস্বস্তিতে। আপত্তি জানাচ্ছেন। জোরাজুরি না করে ঘুরলেন থ্রি ডি-র দিকে। এবারে শুনতে পাব ঠিক। ঝকঝকে বাংলা। ‘মন খারাপ করবেন না বৌদি। একটু মিষ্টি খান। আমি অচেনা লোক। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। লখনৌ তো? হলিডে?’ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল, বাক্সটা এগিয়ে দিলেন, একটা কাজু বরফি নিলাম। উনি আবার ঘুরলেন ওদের দিকে। ‘একটু পরে নেমে যাব, এরপর আর কেউ তো কাউকে দেখতে পাব না, নিন।’ থ্রি এ-র কোল থেকে বাচ্চা হাত বাড়িয়েছে। দেখাদেখি, একে-একে, আস্তে-আস্তে, অন্যরাও। মিষ্টিটা হাতে নিয়ে বসে আছি, গলা বুজে আছে। এয়ার প্রেশারে কি এমন হয়? প্লেন নামবে এবার। ইঞ্জিনের আক্রোশটা কমে আসছে। নরম একটা বিনবিনে সুর। সবাইকে নিজের সিটে ফিরতে অনুরোধ করা হয়েছে। ফিরে যাচ্ছেন সর্দারজি। মহাকাশের দেবদূত। দু’সারি মানুষের বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। ঠিক যেভাবে প্লেনটা অনেক মেঘের মধ্যে দিয়ে নেমে আসছে নীচে। অথবা এমনি ভেসে যাচ্ছে তার জন্য অপেক্ষা করা ল্যান্ডিং স্ট্রিপের দিকে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র