আশঙ্কা একটা ছিলই। বিপদ-আপদের ভয় করেছিলেন। দামাল হইহই-টইটই করা লোকটা রাতে ঘুমের ভেতর হঠাৎ উঠে বসে শিশুর মতো আঁতকে আর্তনাদ করতেন— ‘এলা লা লা লাহ্…’। সে বহুকাল আগের কথা। বিয়ের পর কয়েক বছর কাটতেই এমনটি দেখেছেন মালবিকা। প্রথম দিকে রাতে ঘুম ভেঙে ছটফটিয়ে উঠে বছরে কয়েক বার আর্তনাদ— ‘এলা লা লা লাহ্…’। যে-ভয় করতেন মালবিকা, ঘটে গেল সেই বিপদ। কী কাণ্ড! দিল্লিতে গিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভেতর পড়ে সুবিমলের একবারে রক্তারক্তি হয়ে প্রাণরক্ষা! বিল্টু সঙ্গে ছিল, সে ঝুঁকি নিয়ে কাকাকে দিল্লির নার্সিংহোমে ঘাড়ে পাঁচটা সেলাই দিয়ে কলকাতায় ফেরত আনে। চিকিৎসার পর সুবিমল চাঙ্গা হয়। ওই তো সেবার দিল্লির শাহিনবাগে যখন চলছিল ধর্না, দাঙ্গা বেঁধে যায়। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে। মালবিকা জানেন, শুধু দাড়ির জন্য নয়, হট্টগোলে আঁতকে উঠে সুবিমল ওই বিকট ‘এলা এলা এল্লা’ হাঁক দিয়েছিলেন বলেই সিলামপুরের রাস্তায় পানের দোকানি তার কাঁচি বিঁধিয়ে হুঙ্কার দিয়েছিল ‘জয় শ্রীরাম!’, ছুটে এসে বিল্টু সামলেছিল, ‘মেরা আঙ্কেল ব্রামহিন হ্যায়, মেরা আঙ্কেল ব্রামহিন…।’ মালবিকা জানেন, তাঁর স্বামীর ওই ‘এলা এল্লা’তেই এই কাণ্ড হয়েছিল। সুবিমলকে মুসলমান ভেবেছিল জয় শ্রীরামের দল।
হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকেই স্বামীর মুখে ওই বুলি শুনে আসছেন মালবিকা। প্রথম দিকে সংক্ষিপ্তভাবে ‘এলা এল্লা’। ক্রমে মুখের ওই লব্জ ছড়িয়ে গেল। দীর্ঘায়িত হল, ‘এলালা লালা ল্লা ল্লা’, এইরকম। রাতে ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে, দিনদুপুরে, জাগরণে, চলতে-ফিরতে যখন-তখন ওই— ‘এলা লা লা…’, পথেঘাটে একসাথে থাকলে ধাক্কা দিয়ে স্বামীর হুঁশ ফেরাতেন মালবিকা। সুবিমল চুপ করে যেতেন।
আর কোনও গোলযোগ ছিল না সুবিমলের। দিব্যি হাসিখুশি, একটু অতিরিক্ত প্রাণোচ্ছল এবং কেতাদুরস্ত মানুষটি, উচ্চপদে ইঞ্জিনিয়ার। ঘুমের ভেতর ওইরকম করলে ধাক্কা দিয়ে, মালবিকা পাশে থাকলে রাস্তাঘাটে চিমটি কেটে চুপ করিয়ে দিতেন। কিন্তু অফিসে তো তা চলে না! পার্থ, যে কিনা সুবিমলের অফিসেই ওভারসিয়ার, পাশের পাড়ায় থাকে, সে এক সন্ধ্যায় এসে বলল, ‘বৌদি জানেন, কী কাণ্ড! ভরদ্বাজ আজ ব্যানার্জিদার ওই ‘লাল্লালা’ শুনে খোঁচা মেরে বলেছে, ‘কলমা পড়ছ নাকি ব্যানার্জি!’’ সুবিমল তখন বাড়িতে ছিলেন না। মালবিকা যেন পার্থর কথা শুনতে পাননি এমনভাবে অন্য কথায় চলে গিয়েছিলেন, তবে কিনা চিন্তায়ও পড়েছিলেন। স্বামীকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবেন কি না, সেদিন ভেবেছিলেন তিনি। সে-সময় সুবিমলের আঁতকে ওঠা ওই আর্তনাদের দীর্ঘতাও মাঝে মাঝে বেড়ে যেত, শুধু ভয়ে-ভাবনায় নয়, মালবিকা লক্ষ করেছেন, খুশিতে-স্ফূর্তিতে সুবিমল কখনও-কখনও চিৎকার করে উঠেছেন, ‘এলা লা ল্লা লাহ্ লা লা লা…’
বড় বিব্রত হতে হত। অনুষ্ঠানে, সভায়, জমায়েতে, এমনকী বিয়েবাড়িতে ব্যাটার ফ্রাইয়ে কামড় দিয়ে খুশিতে সুবিমল চেঁচাচ্ছেন, ‘এলালালা ল্লা ল্লা ল্লাহ্…’। লোকজন তাকাত। মালবিকা কনুইয়ের গোঁতা দিয়ে থামাতেন। তখন খুব ভাবতেন মালবিকা, সুবিমলকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতেই হবে। খুব ভয় পেতেন তখন, শঙ্কা হত, কোনও-না-কোনও বিপদ ঘটিয়ে ফেলবে লোকটা!
সেসব অনেক বছর আগের কথা। হইহই করা, বছর-বছর দু-একবার পাহাড়-পর্বতে যাওয়া দুরন্ত মানুষটিকে কেন খামোখা টেনে নিয়ে মনোবিদের কাছে যাবেন, এমনটি ভেবে মালবিকা সেসব পরিকল্পনা খারিজ করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সুবিমলের ওই হঠাৎ-হঠাৎ আঁতকে উঠে ‘এল্লা এল্লা’ করা সয়ে গেছিল মালবিকার। ততদিনে ওদের মেয়ে তিতলি বড় হয়ে উঠেছে। সে-ও ধমকে, চোখ পাকিয়ে বাবার ওই হল্লাগুল্লা থামিয়ে দিত। সুবিমলেরও ওই আর্তনাদ ক্রমে কমে এসেছিল, অর্থাৎ বিরতিকাল বেড়েছিল। বছরে দু-তিনবার রাত্রে ঘুম ভেঙে, কখনও রাস্তাঘাটে দু-একবার সুবিমল ওই ‘এল্লা এল্লা’ করে উঠতেন। বছরে মাত্র দু-একবার!
এসবও অনেক বছর আগের কথা। কর্মস্থল থেকে সুবিমল অবসর নিয়েছেন, তাও বছর দশেক হতে চলেছে। অবসরের আগে, মেয়ে তিতলিকে বিয়ে দিয়েছেন সুপাত্রে। মেয়ে-জামাই রয়েছে হায়দ্রাবাদে। সুবিমল-মালবিকার ফুটফুটে একটি নাতনিও হয়েছে। এই ৬৮-৬৯ বয়সেও বছরে দু-একবার ট্রেকিংয়ে পাহাড়-পর্বত-অরণ্যে ঘোরার নেশা যায়নি সুবিমলের। বরং যত বুড়ো হচ্ছেন, এ-ব্যাপারে তাঁর লম্ফঝম্প বাড়ছে, মনে হচ্ছে মালবিকার। সুবিমলের দলবল আছে, বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, তারা হইহই করে সুবিমলকে ট্রেকিংয়ে নিয়ে যায়। ২০১৯-এর আগস্টে ওরা ঘুরে এল সেই কোথায়— হিমাচলের বুরান ঘাঁটি! ভয়-ভাবনা হয় না মালবিকার, তা নয়। মাঝে মাঝে আপত্তি তোলেন না, তাও নয়! আপত্তি তুললে সুবিমল তখন রমেশবাবুর কথা তোলেন। জনাইয়ের রমেশ মুখোপাধ্যায়। ইনি সুবিমলের চেয়ে কয়েক কাঠি ওপরে। পর্বতারোহী, সুবিমলের চেয়ে কয়েক বছরের বড়। মালবিকা তাজ্জব, ৭৬ বছরের মানুষটি এখনও পাহাড়ে ওঠেন! এভারেস্টে ওঠেননি, তবে মাকালু, ধৌলাগিরি এসব পাহাড়ে উঠেছেন। মালবিকা শুনেছেন, এই তো করোনার আগের বছরেও ৭৩ বছর বয়সে রমেশবাবু নন্দাদেবী সামিট করে এসেছেন। তাছাড়া এখন রমেশবাবু পর্বতারোহীদের মাস্টারমশাই, গত বছর ওঁর ছাত্র মলয় এভারেস্ট জয় করেছে। তা মলয়কে নিয়ে রমেশবাবু কিছুদিন আগে এসেছিলেন তাঁদের বাড়ি, ভারি খুশি হয়েছিলেন মালবিকা। তাঁকে, সুবিমলকে প্রণাম করেছিল এভারেস্টবিজয়ী ছেলেটি।
২.
দিল্লির ওই ঘটনার পরই মালবিকা স্থির করে ফেলেন, সুবিমলকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সুবিমল দিল্লি গিয়েছিলেন ২০২০-র ফেব্রুয়ারির থার্ড উইকে, তাঁর পিসতুতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে। মালবিকা যেতে পারেননি তাঁর হাঁটুদুটির কারণে। ভাশুরের ছেলে বিল্টুকে ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলেন সুবিমলের সঙ্গে! কাকা এটিএম থেকে টাকা তুলবেন, তাই ঘটনার দিন বিয়েবাড়ি থেকেই গাড়ি নিয়ে বিল্টু বের হয়েছিল। শাহদরার শ্যামলাল কলেজের পাশেই এটিএম। সুবিমল টাকা তুলতে এটিএম-এ ঢুকলেন, আর কলেজের গেটের সামনে গাড়ি পার্ক করে আড়াল নিয়ে বিল্টু সিগারেট ধরাল। তখনই একটা হইহই হতে লাগল সিলামপুর-জাফরাবাদ সড়কটিতে। বিল্টু দেখল, ওই সড়কে কয়েকটি ট্রাক আর কিছু মোটর সাইকেলে লাঠিসোটা-তরবারি উচিয়ে যুবকের দল আওয়াজ দিতে-দিতে আসছে— ‘মোল্লা কাটে জায়েঙ্গা’, ‘জয় শ্রীরাম’! বিল্টুর চোখে পড়ল, সুবিমলও তখন এটিএম থেকে বেরিয়ে হকচকিয়ে গেছেন, আর দূরে আগুন জ্বলতে দেখে সুবিমলের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই আর্তনাদ— ‘এলা এলা এল্লা এল্লা এলাহ্ এলাহ্’। ‘আব্বে মোল্লা…’, পানকাটার কাঁচিটি হাতে লাফিয়ে নেমে দোকানদার কাঁচি বিঁধিয়ে দিচ্ছে কাকার ঘাড়ে, দেখেই বিল্টু ‘ব্রামহিন হ্যায়, ব্রামহিন হ্যায়’ বলে দৌড়ে আসে। সে দেখতে পায়, কাকা পান-দোকানিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজের রক্তাক্ত ঘাড় চেপে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে ধরা ৫০০ টাকার নোটের গোছা রক্তে ভিজে গেছে। এগিয়ে আসছে হুঙ্কার দেওয়া ট্রাক, মোটর সাইকেল। বিল্টু তালতলার ছেলে বলেই, চটজলদি কাকাকে গাড়িতে তুলে অলিগলির পথ ধরে নার্সিংহোমে এনেছিল; পরদিন সকালেই প্লেনে কলকাতায়।
সুবিমল ফিরতেই ওঁর ডাক্তারবন্ধুরা, ডা.সোমনাথ মিত্র, ডা.সুশোভন অধিকারী বাড়িতে ছুটে এলেন। চিকিৎসাদির ব্যবস্থা তাঁরাই করলেন। ট্রমা কাটাতে নিদান দিলেন, একমাস বেডরেস্টের। ‘ট্রমা? ধুস!’ সুবিমল বললেন, ‘ভয়-টয় কিচ্ছুটি পাইনি আমি, খুচরো ব্যাপার।’ আসতে শুরু করলেন রমেশবাবু, ট্রেকিংয়ের ছেলেমেয়ের দল। পক্ষকালের মধ্যে ছটফট করতে লাগলেন সুবিমল বাইরে বেরোনোর জন্য। তখনই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন মালবিকা। ও মা, রাজি হয়ে গেলেন সুবিমল। মালবিকার হাতটি ধরে নাচতে-নাচতে গাড়িতে উঠলেন। গেলেন সল্টলেকে মনোবিদ ডা. অরুণাভ মুখার্জির চেম্বারে।
পয়লা সিটিংয়েই ডা. মুখার্জির সঙ্গে সুবিমলের খুব জমে গেল। মালবিকা দেখলেন যেন আড্ডা চলছে দুই সমবয়সির। ট্রেকিংয়ের বিষয় জেনে নিলেন ডা. মুখার্জি। সুবিমল বাল্যকাল থেকে ডাকটিকিট সংগ্রাহক, সে-কথাও জানলেন। ওষুধপত্র প্রেসক্রাইব করে তারপরে হেসে মালবিকাকে বললেন, ‘কিচ্ছুটি না। অনেকেই ঘুমের ভেতর এইরকম কথা বলেন, কিংবা একই কথা আওড়ান। জেগে থাকা অবস্থাতেও কখনও বলেন। ধীরে-ধীরে কমে যায়। মিলিয়ে যায়।’ মালবিকার মনে হল, ঠিক কথাই। সুবিমলের অনেক কমে গেছে। দিল্লির ব্যাপারটা অনেকদিন পরে ঘটল। মাসদুয়েক পর পঞ্চম সিটিংয়ে ডা. মুখার্জি সুবিমলের ডাকটিকিট সংগ্রহ দেখতে চাইলেন। মস্ত বড় দুটো ট্রলিব্যাগে ডাকটিকিটের অ্যালবামগুলি, সেই সঙ্গে বেশ কিছু প্যাকেট নিয়ে এবার সুবিমল-মালবিকা গেলেন নিউটাউনে ডা. মুখার্জির ফ্ল্যাটে। রবিবার ছুটির দিন সারাদিন ধরে ওই সব বিছিয়ে সুবিমল দেখাল ডা. মুখার্জিকে। মিসেস মুখার্জিও চমৎকার মহিলা, মালবিকার সঙ্গে গল্প জুড়লেন। পানভোজন হল। এরপর বিকেলবেলা ডা. মুখার্জি কয়েকটি পোস্টকার্ড সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করলেন। ব্রিটিশ আমলের, স্বাধীনতার পরের দু-চার বছরের পোস্টকার্ডগুলির মধ্যে কয়েকটিতে পত্রলেখক চিঠি শুরু করছেন ‘এলাহী ভরোসা’ বা ‘এলাহী ভরসা’ লিখে। অন্য পোস্টকার্ডগুলিতে ‘দুর্গা সহায়’ বা ‘শ্রী’ দিয়ে পত্র শুরু। কিন্তু এই যেমন ১৮৯৫-এ মহারানি ভিক্টোরিয়ার ছবি দেওয়া টিকিটের পোস্টকার্ডটিতে ‘এলাহী ভরোসা’, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের দাড়িপাল্লা-চাঁদতারার ছবির টিকিটের পোস্টকার্ডটিতেও ওই ‘এলাহী ভরসা’। সুবিমল বললেন, ছোটবেলায়, একেবারে বাল্যে, ‘বর্ণপরিচয়’-এর সঙ্গে ‘আদর্শলিপি’ নামে একটি বই তাঁদের পড়তে হত। তাতে পত্রলিখনে দুভাবেই ‘শ্রী দুর্গা সহায়’ এবং ‘এলাহী ভরসা’ লিখে চিঠি লেখানোর রীতি দেওয়া ছিল। আদর্শলিপিতে আলেফ, বে, পে, তে-এসবও ছিল। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে-হাসতে ডা. মুখার্জি বললেন, ‘কিচ্ছুটি হয়নি আপনার। যান বাড়ি ফিরুন। ঘুরে বেড়ান।’ মালবিকার দিকে একবার তাকিয়ে ডা. মুখার্জিকে সুবিমল জিগ্যেস করল, ‘ট্রেকিংয়ে যাই তাহলে?’ ডা. মুখার্জি বললেন, ‘নিশ্চয়ই, ঘুরে আসুন।’ করোনার দ্বিতীয় ঢেউটির পর স্তিমিতকালে যখন উত্তরের রাজ্যগুলি আবার ট্রেকিংয়ের রাস্তাগুলি খুলে দিল, ছেলেমেয়েদের দল নিয়ে সুবিমল ঘুরে এলেন উত্তরাখণ্ডের আলি বেদনি বুগিয়াল ট্রেক করে।
৩.
এখন আর সুবিমল ঘুমের ভেতর ‘এলা এল্লা’ করেন না, এইরকমই মনে হয় মালবিকার। তিনি অন্তত শোনেননি। দিনের বেলা রাস্তাঘাটে কখনও করেন কি না, মালবিকা জানেন না। সন্ধেবেলা পাড়ার চায়ের দোকানে যান, সেখানে চক্রাবক্রা জামা পরা ৭০ ছুঁই-ছুঁই বয়সের সুবিমল পাহাড়-পর্বতের গল্পে ছেলেছোকরাদের মাতিয়ে দেন, চারতলার ব্যালকনি থেকে মালবিকা দেখেছেন। যুগ পরিবর্তন ঘটেছে। চায়ের দোকানেও যদি কখনও হঠাৎ করে সুবিমল ‘এলা এলা এলা’ করেন, ছেলেছোকরারা ভাববে কাকা র্যাপ গাইছেন হিন্দি গানে, এখন বাংলা সিনেমার গানেও অবশ্য ওইসব ‘লাল্লা লাল্লা’ খুব হয়, ভাবেন মালবিকা।
এই সেদিন করোনার তৃতীয় ঢেউটি মিলিয়ে গিয়ে যখন লোকজন নববর্ষে মেতে উঠল, বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরই সুবিমল পিঠে বোঝাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পশ্চিম সিকিমের গোয়েচালার দিকে। সঙ্গে ১৮জন ছেলেমেয়ের মস্ত দল। যে-কয়েকটি ছেলে তাঁকে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে যেতে এসেছিল, তাদের মালবিকা বললেন, সুবিমলকে সামলেসুমলে রাখতে; তারা হো-হো হেসে বলল, পাহাড়ে গুরুই তাদের ভরসা। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি গিয়ে সেখান থেকে জিপে প্রায় ৬ হাজার ফুট উঁচু ইয়াকসুম পৌঁছে তারপর ট্রেক। দিনের বেলা হাঁটা, হাঁটা আর হাঁটা। তাঁবুতে রাত্রিবাস। স্লিপিংব্যাগে ঘুম।
ইয়াকসুম পৌঁছে পরদিন ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে সদলবলে ট্রেকিং শুরু। ট্রেকিংয়ে সবচেয়ে মানতে হয় সময়। ট্রেকিংয়ের এই পয়লা দিনটিতে পৌঁছতে হবে ৭২০০ ফুট উচ্চতার সাচেনে। চলতে-চলতে চকোলেট, প্রোটিন বার, চাউমিনে সেরে নিতে হবে মধ্যাহ্নভোজ। তিনটি সেতু, শুসোখোলা জলপ্রপাত, মেন্টোগাংখোলা নদী পেরিয়ে সুবিমল বিকেলের মধ্যে পৌঁছে গেলেন সাচেন। এরপর আর মালবিকাকে ফোন করা গেল না। টাওয়ার চলে গেছে। দ্বিতীয় দিন সারাদিন হেঁটে সুবিমলরা বিকেলে পৌঁছলেন বাখিম পেরিয়ে সোখায়। ৮৬০০ ফুট উঁচু সোখা-কে এখানকার বড় হ্যামলেটই বলা হয়। বিভিন্ন দলের ট্রেকাররা জড়ো হন বলে চারটি ফরেস্ট গেস্ট হাউস আছে এখানে। সুবিমল দেখলেন টুরিস্ট-ট্রেকারদের ফেলে দেওয়া খাবার খেতে জড়ো হয়েছে লাফিং থ্রাসের ঝাঁক। কী মিষ্টি এই পাখির ডাক! দেখলেন ঝাঁক-ঝাঁক গ্রিন টেইল্ড সানবার্ড, গ্রিন পিজিয়ন ও হরিয়াল। সবুজে সবুজ এই উপত্যকা। অদূরে খরস্রোতা পার্ক নদীর তরল রবটিও শোনা যাচ্ছে। পরদিন তৃতীয় দিবসের পথটিই সবচেয়ে দুর্গম। সোখা থেকে ফেদাং পেরিয়ে যেতে হবে জোংরি।
ধর্মশালা থেকে আসা ট্রেক-গাইড রাহুল কাকভোরে গ্রুপের সকলকে মিটিংয়ে বসিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল। সুবিমল জানেন, গোয়েচালার ট্রেকিংয়ে এইবার চূড়ান্ত অভিযান। সকালে সাড়ে সাতটায় যখন রওনা হলেন তখন ঝকঝক করছে আকাশ। হিমেল হাওয়ায় বালক-বালিকার মতো হুল্লোট করছে শীতল রোদ। সোখা থেকে ফেদাং যাবেন সুবিমলরা। পথে পড়বে বড়া পাথর। মস্ত বড় পাথরের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর আবার চড়াই ফেদাংয়ের উদ্দেশে। তারপর জোংরি। ফেদাংয়ের উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট। জোংরি ১৩,০০০ ফুট। ৮/৯ ঘণ্টার পথ। তীব্র খাড়াই। জোংরিকে বলা চলে গোয়েচালার দরজা।
পাইন, সিডার, বাঁশ-এ সব বড়-বড় গাছের বন শেষ হয়ে গিয়ে গুল্মের ঝোপঝাড়ের ঢাল-খাড়াই শুরু হল। অনেক হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে ফেদাংয়ে পৌঁছলেন সুবিমলরা। জায়গাটা মাঠের মতো। চতুর্দিকে পাহাড়ের চূড়া। হিমেল বাতাস বইছে। এখানে খাবারের একটি ক্যান্টিন— ম্যাগি পয়েন্ট। সুবিমলরা খেলেন। আধঘণ্টা বিশ্রাম নিলেন। তারপর অপরিসীম সৌন্দর্যরাশির ভেতর তোলপাড় করতে-করতে দু্র্গম পথ ভাঙতে লাগলেন জোংরির দিকে। দুপুর যখন ঝলমল করছে, সুবিমলরা পৌঁছলেন দেওড়ালি টপ। একেবারে জোংরির দোরগোড়ায়।
ও মা! তখনই দেখলেন সুবিমল, শ্বেতাঙ্গিনী এক তরুণী, বিদেশিনী, গোয়েচালা থেকে ফিরতি পথের ট্রেকার, পাথরে পা স্লিপ করে টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। পিছনে নামছে শ্বেতকায় তরুণ-তরুণীদের একটি দল। ‘এলা, এল্লা এল্লা এল্লাহ’ আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে গিয়ে সুবিমল জাপটে ধরলেন মেয়েটিকে। ডান বাহুমূলে একহাত, কোমরে আরেক হাত দিয়ে খাড়া করলেন তাকে। ক্ষিপ্রভাবে নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল মেয়েটি। হাসল। তন্মুহূর্তেই বলে উঠল, ‘এ ম্যান, হোয়াই আর ইউ শাউটিং মাই নেম! আই অ্যাম এলা ওয়াগনার, ফ্রম ড্রেসডেন, ডয়েশল্যান্ড।’
বিদ্যুচ্চমকের মতো সুবিমলের মনে পড়ল বাল্য-কৈশোরের মাথরুন শহরটি। বিহার সীমান্তে ওই গঞ্জ-শহরের রেলকলোনিতেই তিনি বড় হয়েছেন। সেখানকার এ ভি কলেজে প্রি ইউ পড়তেন, তাঁদের এক সহপাঠিনী ছিল রাজকুমারী। রূপকথার রাজকন্যা, সত্যিই। এলা সিংদেও। মাথরুনের কাছেই ছিল ওই কুসুমপুর রাজ-এস্টেট। শেভ্রোলে গাড়িতে রাজকুমারী আসতেন কলেজে। রাজবাড়ির কর্মচারী মাথায় রঙিন ছাতা ধরে রাজকুমারীকে বসিয়ে দিতেন টিচার্স রুমে। রাজকুমারী বলে নয়, তখনকার দিনে মেয়েরা যারাই কলেজে পড়ত, ক্লাস শুরুর আগে তারা বসে থাকত টিচার্স রুমে। অধ্যাপকরা ক্লাস শুরুর সময় তাদের নিয়ে আসতেন ক্লাসে। ছেলেরা ‘তুমি’ বলত না মেয়েদের, ‘আপনি’ বলতে হত। সুবিমলের মনে পড়ল, তাঁরা ডানপিটে বালকের দল— তিনি, সোমনাথ, সমর, পল্টু, ঘনশ্যাম বাজি ধরেছিলেন রাজকুমারী এলার হাতটি ধরার। করস্পর্শ। উঁহু, কেউ পারেননি। তবে, পিছল সিঁড়ি দিয়ে সেই যে এলা পড়ে গিয়েছিল, ‘এলা এলা এল্লা’ চিৎকারে তিনিই এলাকে জাপটে ধরে বাঁচিয়েছিলেন, মনে পড়ল সুবিমলের। সবাই সুবিমলের তারিফ করেছিল। রাজবাড়িতে ডাক পড়েছিল সুবিমলের। এলার মা রানি বিভাবতী খুব প্রশংসা করেছিলেন। সুবিমলকে দেখতে পিয়ানো বাজানো থামিয়ে পাশের ঘর থেকে এলার দিদি লীলা উঁকি দিয়েছিলেন। টি-পট সাজিয়ে এলা নিজে কাপে ঢেলে দিয়েছিল চা। এরপর তো চান্স পেয়ে রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে চলে গেলেন সুবিমল। পরে শুনেছিলেন এলা ল পড়তে বিলেতে চলে গেছে। শুধু এইটুকুই। তবু সুবিমলের মনে হল, জীবন বিরাট। এলাহি ভরসা!
এলা ওয়াগনার, জার্মান তরুণীটি টাল সামলে সটান দাঁড়িয়ে হাসছে। পিঠের স্যাক থেকে পানীয়ের বোতল বের করে নিজে কয়েক ঢোক খেয়ে সুবিমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বোতল। চুমুক দিলেন সুবিমল। বললেন, ‘থ্যাঙ্কিউ এলা।’ ঝলমলে রোদে বাঁ-দিক থেকে ডানদিকে হো-হো হাসতে শুরু করে দিল হিমালয়ের গিরিচূড়াগুলি— কোকথাং, রাথোং, কাব্রু সাউথ, কাব্রু লি, কাঞ্চনজঙ্ঘা, গোয়েচা পিক, পান্ডিম, তেনজিং খা, জপুনো, লামা-লামুনো, মাউন্ট নার্সিং। পর্বতমালার সমবেত হাসি। হাওয়ায় ছড়াল হো-হো-হো-হো। রঙিন বাতাসের অগুনতি ঢেউ যেন ঘুরপাক দিতে লাগল চারদিকে। শিখরে-শিখরে জমায়েত তুষারের মহাসভা করতালি দেওয়া শুরু করে দিল, হাওয়ায় উড়তে লাগল তুষারকণা। রাশি-রাশি তুষারকণা।
‘বাই বাই’, হাত নাড়তে-নাড়তে এলা ও তার জার্মান দলটি নীচে নেমে গেল।
ওপরে উঠতে লাগলেন সুবিমলরা।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত