ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • উপেক্ষিত বাঙালি, স্বশিক্ষিত মন


    পৃথ্বী বসু (April 9, 2022)
     

    প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার কোনও ডিগ্রিই তাঁর ছিল না, অথচ তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি এমনকী আরবি-ফার্সির মতন ভাষাতেও। স্বশিক্ষিত বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। ছোটবেলায় মাতৃভাষা চর্চার সূচনালগ্নে বাবার অনুরোধে ফারসি পড়া শুরু করলেও, পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকায় সেই শিক্ষা কোনওভাবেই কার্যকর হয়নি। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাজ্ঞানেও ফাঁক থেকে যায় বিস্তর। পরবর্তীতে তাঁকে ইংরেজি স্কুলে দেওয়া হলে, বেতের ভয়ে এবং একটানা পাঁচ ঘণ্টা বসে থাকার অনীহায় সে-পাটও অল্প কিছুদিনের মধ্যে তুলে দেন। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ বলতে একবারই, নর্মাল স্কুলে। তবে সেখানেই কিন্তু তার ইতি নয়। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁর আসল অধ্যয়ন। বাকি জীবনে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এক-একটি ভাষা সম্পর্কে তিনি জ্ঞানার্জন করেছেন। এমনকী যে-কাজের জন্য আজও ভাই গিরিশচন্দ্র সেন আমাদের কাছে স্মরণীয়, সেই কোরআন শরীফের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ করার কথা যখন তিনি ভেবেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ৪২। এবং ভাবলে অবাক লাগে, ওই বয়সে পৌঁছেও শুধু একটা ভাষাকে ভালভাবে আয়ত্তে আনার উৎসাহে তিনি সেদিন ছুটে বেড়িয়েছেন সুদূর লখনউ থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে ঢাকার পথে!


    গিরিশচন্দ্র সেনের (১৮৩৪-১৯১০) জন্ম হয়েছিল এক নিষ্ঠাবান শাক্ত হিন্দু পরিবারে। নিজের গ্রাম পাঁচদোনার তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, ‘সেই সময় পাঁচদোনা গ্রামের অত্যন্ত দুরবস্থা ছিল, স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে নীতির বন্ধন ছিল না… অধিকাংশ জ্ঞাতিকুটুম্ব পুরুষ ঘোরতর মদ্যপায়ী ছিল।… আমার চরিত্রেও নীতির বন্ধন অত্যন্ত শিথিল হইয়াছিল।… নানা কুভাব ও কুচিন্তায় অন্তর কলুষিত হইয়াছিল, চরিত্রের স্খলনও ঘটিয়াছিল…।’ একইসঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে হিন্দু রক্ষণশীলতার নানান গোঁড়ামি বাসা বাঁধতে থাকে। জানা যায়, যে-পরিচারিকার কোলেপিঠে তিনি মানুষ হন, তার শাড়ির আঁচল একদিন গিরিশের শরীর স্পর্শ করায়, তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে যান। কেননা সেই মহিলা ছিলেন শূদ্র। আরও একবার দাদার সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার পথে, দোকান থেকে ক্ষীর কেনা হলে তিনি নাকি তা মুখে তোলেন না! কারণ জিগ্যেস করলে বলেন, ওই দোকানে এক ফিরিঙ্গি প্রবেশ করায় তা ‘অপবিত্র’ হয়ে গেছে। ফলে এইরকম যাঁর মনোভাব ছিল শুরুতে, জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সেই তিনিই ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করছেন ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় বইকি! তাও আবার কী, যে-ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মদের ওপরে তিনি এক সময়ে ছিলেন হাড়ে-চটা! এমনটাও শোনা যায়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের সম্পর্ক আছে এমন খবর পেয়ে বিদ্যাসাগরের বই স্পর্শ করতেও তাঁর বিতৃষ্ণা জাগত। কিন্তু এর কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই, যখন গিরিশচন্দ্র ধর্মপথ নিয়ে একপ্রকার উদ্‌ভ্রান্ত, বুঝতে পারছেন না কোনদিকে যাওয়া উচিত এবং ময়মনসিংহে থাকাকালীন সেখানকার ব্রাহ্ম-পরিচিতজনদের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছেন মাত্র— সেই সময়েই, ১৮৬৫ সালে তিনি সান্নিধ্যে আসেন কেশবচন্দ্র সেনের। বলা যায় তাঁর সাহচর্যের কারণেই গিরিশচন্দ্র ব্রাহ্মধর্মের অনুরাগী হয়ে মন্ডলীভুক্ত হন। এবং তাঁরই পরামর্শে পরবর্তীতে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যদিও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার ফল সামাজিক ভাবে গিরিশচন্দ্রের জীবনে ভাল হয়নি। একমাত্র স্ত্রী ব্রহ্মময়ী ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সকলে তাঁকে একভাবে ব্রাত্যই করেছিলেন। এমনকী ময়মনসিংহে তখন তিনি যে-বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী তাঁর আহারের ব্যবস্থা তো বন্ধ করে দিয়েছিলেনই, এমনকী বন্ধুবান্ধবরাও তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া করতে সাহস পেতেন না। মেলামেশাও করতেন অনেক বুঝে। ফলে ময়মনসিংহের শুরুর দিনগুলোয় তাঁর কেটেছিল প্রায় একঘরে অবস্থায়। খানিকটা বিছিন্ন দ্বীপের মতন, নিঃসঙ্গ।

    যদিও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার ফল সামাজিক ভাবে গিরিশচন্দ্রের জীবনে ভাল হয়নি। একমাত্র স্ত্রী ব্রহ্মময়ী ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সকলে তাঁকে একভাবে ব্রাত্যই করেছিলেন। এমনকী ময়মনসিংহে তখন তিনি যে-বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী তাঁর আহারের ব্যবস্থা তো বন্ধ করে দিয়েছিলেনই, এমনকী বন্ধুবান্ধবরাও তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া করতে সাহস পেতেন না।


    ব্রহ্মময়ীর মৃত্যু হয় ১৮৭০ সাল নাগাদ। তারপর কিছুদিন গিরিশচন্দ্র পাগলের মতন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। ফিরে এসে এক সময়ে যখন লক্ষ করেন ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজে তাঁরই এক পরম বান্ধব তাঁর সঙ্গে শত্রুতা করছেন, তখন সেই সংঘাত এড়িয়ে যাওয়ার কারণে ১৮৭৫ সালে কলকাতায় চলে আসেন। থাকার ব্যবস্থা হয় কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ভারতাশ্রমে। আর এই সময় থেকেই তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গিরিশচন্দ্রের নিষ্ঠা ও ক্ষমতা সম্পর্কে কেশবচন্দ্রের প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। তাই তাঁকে তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হতে চাইতেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভিন্নধর্মের প্রতি আগ্রহ তৈরি করার কারণে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে যখন অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রের পাশাপাশি ইসলামি ধর্মশাস্ত্র ও মুসলমান ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনচরিত অনুবাদ করে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেই ভারও এসে পড়ে গিরিশচন্দ্রের ওপরে। তিনি তা নিষ্ঠাভরে পালনও করেন। মৌলিক লেখার পাশাপাশি এই সময় থেকেই কোরআন শরীফ-সহ ইসলামি শাস্ত্রের একাধিক গ্রন্থ তাঁর অনুবাদে বেরোতে শুরু করে। এবং তিনিই ছিলেন এই সমস্ত বইয়ের প্রথম বঙ্গানুবাদক। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ১৮৮১ সাল থেকে যখন কোরানের অনুবাদ খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত হতে শুরু করে, তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেকদিন পর্যন্ত অনুবাদকের নাম থাকেনি তাতে। পরবর্তীতে অবশ্য তা উল্লেখ করা হয়। নিন্দার পাশাপাশি কিন্তু সে-সময়ে মাদ্রাসার উদারচেতা মৌলবিরা প্রশংসা করে এরকম চিঠিও পাঠিয়েছিলেন, ‘…The version of the Koran above quoted has been such a wonderful success that we would wish the author would publish his name to the public, to whom he has done such a valuable service, and thus gain a personal regard from the public.’ আর শুরু থেকে এই সমস্ত কাজে কেশবচন্দ্রের আবেগ ছিল মাত্রাছাড়া। কেউ এই অনুবাদের ভাষ্য নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলেই, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রতিবাদ করতেন। অন্যদিকে কেশবচন্দ্রের প্রতি গিরিশচন্দ্রের আনুগত্যও ছিল অভাবনীয়। ১৮৭৮ সালের কুচবিহার-বিবাহকে কেন্দ্র করে কেশবচন্দ্রকে যখন একের পর এক নিন্দাবাণের সম্মুখীন হতে হয়, এমনকী যার ফলে ব্রাহ্মসমাজেও পুনরায় ভাঙন ধরে— সেই সংকটের দিনে গিরিশচন্দ্র শুধু সর্বক্ষণ কেশবচন্দ্রের পাশে থেকেছেন বললে কম বলা হয়— সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ‘কোচবিহার বিবাহের বৃত্তান্ত’ নামক একটি সমর্থনসূচক বই লিখে তা প্রচারও করেন। এবং যে প্রচারকের দায়িত্ব তাঁকে কেশবচন্দ্র দিয়ে গেছিলেন, তিনি আমৃত্যু তা পালন করে গেছেন।


    ব্রাহ্মধর্মের প্রচারের পাশাপাশি, সারাজীবন ধরে তিনি আরও একটা দিক নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তা হল, কীভাবে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো যায়। সেই ভাবনা থেকেই দীর্ঘকাল ধরে ‘মহিলা’র মতন পত্রিকা সম্পাদনা করে গেছেন। যুক্ত থেকেছেন নারীসমাজ সম্পর্কিত একাধিক পত্রিকার সঙ্গে। শুধু তাই নয়, নানান প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তাঁর নিজগ্রাম পাঁচদোনাতে, এমনকী ময়মনসিংহতেও প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়েও কিছুদিন পড়িয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে নারীশিক্ষা ও নারীর প্রতিভা বিকাশের বিষয়টিকে তিনি তাঁর অন্যতম ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেমনটা করেছিলেন, তাঁর সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেও। শেষজীবনে অতিরিক্ত লেখালিখির কারণে ডান হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেও, নতুন করে বাঁ-হাতে লেখার অভ্যেস করেছেন। কিন্তু লেখা থামাননি।

    কী বিপুল শ্রমের মধ্যে তিনি নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন, তাঁর বইয়ের প্রকাশকালগুলোর দিকে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়। সেই অর্থে সাহিত্যিকজীবন তাঁর কতই-বা! চল্লিশ বছর বড়জোর! কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা ও উর্দু বইয়ের সংখ্যা (অনূদিত ও মৌলিক মিলিয়ে) পঞ্চাশ-অধিক। অগ্রন্থিত লেখার কোনও হিসেব নেই। কোনও বিশেষ ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সেই মাধ্যমেরই স্কুলে পড়তে হবে কি না— এই নিয়ে বর্তমানে যে-কাজিয়া তুঙ্গে উঠেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও একবার ভাষাশিক্ষার প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনে উঁকি মারা হয়তো অসঙ্গত হল না! কিন্তু দুঃখের কথা এটাই, তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ এবং অন্যান্য দু-একটা বই ছাড়া আর কোনও বই-ই আজ সেভাবে সহজলভ্য নয় পাঠকের কাছে!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook