আমি সত্তরের দশকে বর্ধমান জেলার যে মফসসল শহরটিতে বড় হয়েছি, সেখানে মধ্য-সত্তরে প্রথম ‘মৌমিতা’ নামে একটি রেস্টোর্যান্ট খুলে মফসসলের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক যৎপরোনাস্তি চাঞ্চল্য নিয়ে আসে। ‘মৌমিতা’ নামটি তখন এখনকার মতো জলভাত হয়ে যায়নি, তাই লোকমুখে তার নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘মৌমাছি’। সেই নামান্তরে তার জনপ্রিয়তায় অবশ্য একটুও ভাটা পড়েনি, একদিন অচেনার আনন্দকে সর্বশরীরে বহন করে সদলবলে মৌমাছিতে গিয়ে খেয়ে এসেছিলাম মোগলাই পরোটা আর আলুর তরকারি। সে-ই আমার প্রথম ‘ইটিং আউট’, আমার বহু মফসসলি সহ- নাগরিকদেরও তাই। তার কিছু দিন পর কলকাতায় প্রথম বাবার সঙ্গে খেয়েছিলাম পূর্ণ সিনেমা হলের ভবনে তখনকার বিখ্যাত চা-খাবারের দোকান সাঙ্গুভ্যালিতে – সিনেমা হলটি বেশ কয়েক বছর বন্ধ হলেও যে খাবারের দোকানটি এখনও দিব্যি চলছে। আমার ছোট বেলায় ‘সাঙ্গু’ নামটির মধ্যে একটা চিন-টাইপের গন্ধ ছিল, পরে জেনেছি যে ‘সাঙ্গু ভ্যালি’-র ভূগোল আসলে চট্টগ্রাম-আরাকান-বর্মামুলুকের পার্বত্য অঞ্চলের ভূগোল। যাদের দৌড় ওই ‘মৌমাছি’ অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিল, আমার সেই মফসসলি বন্ধুদের সগর্বে সেই ‘সাঙ্গু ভ্যালি’-র খাওয়াদাওয়ার গল্প বলে কিছু ‘ব্র্যাগিং রাইটস’ কুড়োবার চেষ্টা করেছিলাম তখন। অনেক পরে, রাধাপ্রসাদ গুপ্তের লেখা তাঁদের যুবক বয়সের আড্ডা নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধে পড়ে অবাক হয়ে যাই যে চল্লিশের দশকে কালীঘাট পার্কের উল্টো দিকে এ রকম এক সাঙ্গুভ্যালিতেই তার চাটগাঁইয়া মালিকের দাক্ষিণ্যেই জমে উঠত রাধাপ্রসাদ আর তাঁর হদ্দ বেকার সঙ্গীদের আড্ডা, আর সে আড্ডার সঙ্গে সঙ্গত করত ধারে-পাওয়া ‘ডবল হাফ চা’ (অর্থাৎ বেশি দুধ আর চিনি দেওয়া আধ কাপ চা), টোস্ট, ‘মামলেট’, কেক, চপ, কাটলেট। রাধাপ্রসাদ যখন লেখেন, ‘আমাদের দৌড় তো ছোট্ট ছাতা-পড়া সাঙ্গুভ্যালির মতন চায়ের দোকান অব্দি ছিল’, তখন সে লাইন পড়ে বুঝতে পারি যে আমার ছোটবেলায় ওই রেস্টোর্যান্টটির গর্বিত মাহাত্ম্যকীর্তন হয়তো একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছিল।
ভোজনবিলাসী বাঙালির জন্য প্রায়ই বাইরের রেস্টোর্যান্ট হয়ে দাঁড়াত ঘরোয়া রান্নাঘরের ‘শুচিতা’ বাঁচিয়ে নিষিদ্ধ, বা প্রিয় খাবারের স্বাদ নেওয়া। মুরগি হয়তো বাড়িতে অচ্ছুৎ, কিন্তু রেস্টোর্যান্টে ফাউল কাটলেট খেতে তো বাধা নেই! বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে ছাত্রজীবনে মার মৃত্যুর পর কলকাতার ভাড়া-বাড়িতে তিনি দিনের বেলায় হবিষ্যি-রীতি মেনে ঘি, দুধ, আর পাকা কলা দিয়ে আতপ চালের ভাত খেতে বাধ্য হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধের পর বৌবাজার স্ট্রিটের হোটেলের ডিমসেদ্ধ, কাঁকড়া, আর পুরি ছাড়া তাঁর চলত না। এ তো গেল বাড়ির মধ্যে যে খাদ্যবস্তু ‘অ-গ্রহণীয়’, বাইরের ভোজনালয়ে তার আস্বাদনের বৃত্তান্ত, যার মধ্যে সবান্ধবে খানাপিনা ও মজলিসি আড্ডার অনুষঙ্গটি নেই। কিন্তু কলকাতায় ‘ইটিং আউটের’ ইতিহাসে ওই সামাজিকতার পরিসরটি ওতপ্রোত হয়ে আছে। বসন্ত বা অনাদি কেবিনের কথা আগেই হয়েছে, কিন্তু কলকাতার আড্ডা আর সামাজিকতার ইতিহাসে তাদের পাশাপাশি জায়গা করে নেবে আরও অনেক নাম, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার আশেপাশে যাদের বেশ কয়েকটির অধিষ্ঠান। কলেজ স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের মোড়ে ওয়াইএমসিএ রেস্টোর্যান্ট আর জ্ঞানবাবুর চায়ের দোকান বহু ইতিহাসের সাক্ষী থেকে থেকে অবশেষে কালের গর্ভে চলে গেছে, কিন্তু দশকের পর দশক অদূরবর্তী কফি হাউসের অনেক ‘রেগুলার’-রা ওই দোকানগুলিতে আগে চা টোস্ট ‘মামলেট’ হাঁড়ি কাবাব সাবড়ে তার পর কফি সহযোগে রাজা-উজির মারতে রওনা দিতেন। মির্জাপুর (অধুনা সূর্য সেন) স্ট্রিটে পুঁটিরাম মোদকের হাতে তৈরি ১৮৮৯ সালের পুঁটিরাম সুইটস এখনও তার শতাব্দীপ্রাচীন মার্বেলের টেবিলগুলিতে সাজিয়ে চলেছে তার অতুলনীয় কচুরি আর ছোলার ডাল। অনতিদূরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ফেভারিট কেবিন, যেখানে এক সময় বসতেন মাস্টারদা সূর্য সেন, দাদাঠাকুর-বিভূতিভূষণ-নজরুলের মতো জ্যোতিষ্করা, আর যেখানে কল্লোল যুগের কবিদের চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলার অবিস্মরণীয় আখ্যান লিখে গেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। সুতরাং, বাঙালির তর্কপ্রিয়তা ও প্রেম, এই দুইয়ের ইতিহাসেই – আমাদের দুটি কফি হাউসের মতোই – এই নিরভিমান ও প্রশ্রয়প্রবণ খাবার দোকানগুলির জায়গা পাওয়া নিয়ে কোনও কথা হবে না। ইতিহাসবিদ ভাস্বতী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক বই Much Ado Over Coffee: Indian Coffee House Then And Now (২০১৮)-তে রয়েছে এই ইতিহাসের সুললিত বিবরণ।
আমাদের বাইরে খাওয়ার সংস্কৃতিতে নিরভিমান এই সব জায়গার কথাই যখন উঠল, তখন কলকাতায় উনিশ শতক থেকেই গড়ে-ওঠা মেসবাড়িগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি-হওয়া অগণিত পাইস হোটেলগুলির কথা বলতেই হয়। ট্যাঁকের জোর যাঁদের কম, সেই ছাত্র, খুচরো দোকানদার, ব্যাচেলর কেরানি, ও আরও অনেক মেহনতি মানুষকে এঁরা এক সময়ে এক আনায় খাইয়েছেন ভাত ডাল তরকারি মাছের ঝোল, আজকের এই বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতির যুগেও এই ভোজনালয়গুলিতে পেট পুরে খেতে গেলে খরচের হিসেব সচরাচর তিন অঙ্কে পৌঁছবে না। সাশ্রয়ের পাশাপাশি বাড়তি পাওনা ব্ল্যাকবোর্ডে চকের সাহায্যে ‘মেনু’-র এক নিরন্তর, মন্ত্রমুগ্ধকর এডিটিং, আর ‘ওয়েটার’-এর মুখে র্যাপিডফায়ার সন্ধ্যাভাষায় আপনার ‘বিলিং’। অসংখ্য পাইস হোটেলের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার অব্যবহিত পরের দশকগুলিতে গড়ে-ওঠা এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নাগরিক সংস্কৃতির ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব, কম পয়সায় মেহনতি মানুষদের উদরপূর্তি করার পাশাপাশি তাঁরা নিছক রান্নার গুণে টেনে আনেন স্বাদসাধক ‘এপিকিওর’-দের। জানবাজারের সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম, বইপাড়া অঞ্চলের স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল বা জগন্নাথ আশ্রম, ভবানীপুরের পার্বতী, লেক মার্কেট অঞ্চলের তরুণ নিকেতন, বা খিদিরপুরের ইয়ং বেঙ্গলে ভাপা ইলিশ থেকে শুরু করে কাঁচকলা পেঁপে দিয়ে রুই মাছের ‘কবিরাজি’ ঝোল (স্থানাভাবে দুটি মাত্র দেবভোগ্য দৃষ্টান্তের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী) যাঁরা খাননি, শহরের পরিব্যাপ্ত খাদ্য-মানচিত্রে তাঁদের দিগভ্রষ্ট পথিক বলেই গণ্য করতে হবে।
নিঃসন্দেহে কলকাতায় রেস্টোর্যান্ট-পদবাচ্য বাঙালি খাবারের দোকানগুলির সূত্রপাত হয়েছিল এই পাইস হোটেলের ঘরানাকে খানিক ‘আপগ্রেড’ করে নিয়েই। বহুদিন পর্যন্ত এই ওই অনাড়ম্বর কিন্তু অসামান্য হোটেলগুলি বা ঘরোয়া হেঁসেলের চৌহদ্দির বাইরে বাঙালি রান্নার স্বাদ নেওয়া ছিল অসম্ভব, যদিও মোগলাই বা চিনে রান্নার স্বাদ নেওয়ার জন্য রেস্টোর্যান্টে ছুটতে বাঙালি কসুর করেনি। সেই শূন্যস্থান প্রথম পূর্ণ হতে শুরু করল ১৯৬৯ সালে, যখন দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংস্থা অল বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে তালতলার এলিয়ট রোডে প্রতিষ্ঠিত হল ‘সুরুচি।’ রেস্টোর্যান্টের বদলে হয়তো তাকে ক্যান্টিন বলাই ছিল বেশি সঙ্গত, কিন্তু বাড়ি ও পাইস হোটেলের বাইরে বাঙালিকে পটলের দোলমা, ‘গাছপাঁঠার’ কালিয়া, বা মোচার ঘন্ট থেকে শুরু করে ইলিশ ভাপা বা ভেটকি পাতুরি খাওয়ানোর ব্যাপারে এই স্বনিযুক্তি সংস্থাটিই পথিকৃৎ। তারও দু’দশক পরে, জনপ্রিয় The Calcutta Cookbook-এর লেখিকা মীনাক্ষী দাশগুপ্তের বাড়িতে তাঁরই স্মরণে (এবং ডাকনাম অনুসারে) ‘কিউপিজ কিচেন’-এর প্রতিষ্ঠা, আর সেই সঙ্গে ঘরোয়া বাঙালি খানাপিনাকে ‘ফাইন ডাইনিং’-এর পরিসরে নিয়ে আসার প্রচেষ্টার সূত্রপাত, আরও বছর চারেক পরে পিয়ারলেস হোটেলের ‘আহেলি’-র প্রতিষ্ঠা যে উদ্যোগের আরেক মাইলফলক। নতুন শতকে অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ওহ্ ক্যালকাটা,’ আর একডালিয়ার একটি গ্যারেজে বিভিন্ন পেশার পাঁচ রসনারসিক বন্ধুর সম্মিলিত উদ্যোগে ‘ভজহরি মান্না’-র প্রতিষ্ঠা এক অর্থে বাংলার ‘ইটিং আউট’ কালচারে বাঙালি ক্যুইজিন বা রন্ধনশৈলীর এই পুনর্বাসনের বিপ্লবটি সম্পূর্ণ করল, যার পুঁজি ভাঙিয়েই আজ আমরা হরেক অনাম্নী অঙ্গন থেকে পাঁচতারা রেস্টোর্যান্টে সগর্বে খেয়ে চলেছি আমাদের সাবেকি হেঁসেলের রান্না। বাঙালি রান্নার এই বঙ্গবিজয়ে একটু দেরি হলেও, তাতে খুব ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
সবিস্ময়ে, সহর্ষেও, দেখি যে এই বাঙালি ক্যুইজিনের রেস্টোর্যান্টের বিজয়যাত্রার মধ্যে দিয়ে এক নতুন কসমোপলিট্যান ব্র্যান্ডিং ঘটছে আমাদের চিরচেনা খাবারদাবারের, আমাদের অতীত ইতিহাসেরও। সমাজতত্ত্ববিদ রুনা দাস চৌধুরী তাঁর ‘Menus Matter’ নামে কলকাতার বাঙালি রেস্টোর্যান্টের মেনু সম্পর্কে একটি চমৎকার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, কী ভাবে মেনু-হীন পাইস হোটেলের ‘পাবদা সর্ষেবাটা’, ‘কই মাছের তেলঝোল’, বা ‘আড় মাছের কালিয়া’ বড় সাদাসাপ্টা, নিরাভরণ বলে আমাদের বাঙালি ফাইন ডাইনিং রেস্টোর্যান্টের মেনুতে রেলওয়ে মাটন কারি হয়ে ওঠে ‘mutton pieces with potatoes in a richly aromatic curry with pan-broiled coriander seeds, dry red chillies and a hint of tamarind as served in the Railway Canteen of the British Raj’. খাওয়াও হল, আবার আমাদের ‘ইতিহাস-মনস্কতা’ ও ‘বিশ্ববীক্ষা’ ইত্যাকার বৌদ্ধিক ক্যাটেগরির একটু আত্মকণ্ডূয়নও হল, অর্থাৎ ঠিক যে রেসিপি বিশ্বায়িত, কসমোপলিট্যান (এবং কিঞ্চিৎ রেস্ত-সম্পন্ন) বাঙালির কাছে অপ্রতিরোধ্য। ইংরেজিভাষী দুনিয়ার বাইরে আমরা বাঙালিরাই পৃথিবীর প্রথম জনগোষ্ঠী যারা ইংরেজি শিখেছিলাম, তাই ফিউশন আমাদের সর্বাঙ্গে, আমরা ছাড়া রেস্টোর্যান্টে গিয়ে হাসিমুখে একরাশ পয়সা খরচ করে ‘বেকড ডাব চিংড়ি অ্যালাস্কা’ খেয়ে আসার মুরোদ আর কার আছে, অ্যাঁ?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র