অপরাধের ধরনটি নতুন না হলেও, অপরাধী ধরার কায়দা এখনও রপ্ত হয়নি। না পুলিশের, না ইনটেলিজেন্স-এর। শব্দটার সঙ্গে আমরা ভারী পরিচিত ইদানীং কালে– সাইবার ক্রাইম। অর্থাৎ আন্তর্জালের অসীম বিশ্বের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে থাকা অপরাধ। অজস্র, অগুন্তি। ঠিক যেমন মহাবিশ্বের অগুন্তি তারা, গ্রহ, নক্ষত্র– বিজ্ঞানীরা এখনও ঠিক করে ঠাওর করে উঠতে পারেননি। কেবল হাতড়ে চলেছেন। ঠিক তেমনই এই সাইবার ক্রাইম দুনিয়া। এবং সেই সাইবার ক্রাইম নিয়েই এস হুসেন জাইদি-র নতুন বই ‘জিরো ডে’, যাঁর লেখা মাফিয়া কুইনস অফ মুম্বই থেকে সদ্য হওয়া চলচ্চিত্র গাঙ্গুবাই নিয়ে হইচই করছেন জনগণ।
পাঠকের কাছে যে ভাবে পরতে পরতে উন্মুক্ত হয়েছে বইটি, তা প্রশংসনীয়। শার্লক হোমস থেকে ব্যোমকেশ, কিংবা আগাথা ক্রিস্টি থেকে সত্যজিৎ রায় পড়ে বড় হয়ে ওঠা পাঠকের কাছে অপরাধের ধরন কিংবা অপরাধীর মন খানিক চেনা হয়ে উঠলেও, সাইবার ক্রাইমের খুঁটিনাটি বিশেষ চেনা নয়। হ্যাঁ কিছু কিছু নিষিদ্ধ গেম-এর দৌলতে এই ধরনের অপরাধের ভয়াবহতা আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে। কিন্তু আদত ব্য়াপারটা ঠিক কী, তা বোধগম্য হওয়ার মতো টেকনিক্য়াল জ্ঞান কিংবা তার পদ্ধতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। সেই দিক থেকে জাইদি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এই বইয়ে। তিনি বেশ সহজ-সরল করে টেকনিক্যাল টার্মগুলিকে বোঝাতে বোঝাতে এগিয়েছেন, যাতে সাধারণ মানুষও বেশ ভালই বুঝতে পারে।
গল্প প্রথম থেকে তরতর করে এগোতে থাকে। ঘটনার ঘনঘটা এমন ভাবে একের পর এক জট পাকায় ও খোলার চেষ্টা করে তা প্রায় নাগরদোলায় চড়িয়ে ঘোরানোরই সামিল। এ অপরাধ কোনও ভাবেই শেষ দৃশ্যে একটু ঘরের মধ্যে একের পর এক যুক্তি দিয়ে অপরাধ উন্মোচন করে না। এ অপরাধকে সঙ্গে সঙ্গে কলার চেপে না ধরলে, ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। এবং ছোট, বড়, মাঝারি–কোন ক্ষতিটি এর পরে হবে, সে ধারণা করাই মুশকিল। ফলে অপরাধের সঙ্গে তালে তাল দিয়ে চলতে হয় খানিক।
গল্প শুরু হয়, এক বিকেলে মুম্বইয়ের সমস্ত ট্রাফিক সিগন্যাল খারাপ হওয়া থেকে, যার ফলস্বরূপ গোটা মুম্বইয়ে এক লন্ডভন্ড কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সাইবার শাখা বহুক্ষণ সময় নিয়েও বুঝতেই পারে না, ফাঁকটা কোথায়, এবং তা কী ভাবে সারাবে। এই যে ইন্টারনেটের ফাঁক বা কমজোর জায়গা, যা ডোমেন অথরিটিও বুঝতে পারে না, একেই বলে জিরো ডে। এই জিরো ডে-র অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে সাইবার ক্রাইমের মহারথীরা। এবং সর্বনাশ করে দেয় মানুষের, ঢুকে পড়ে ইন্টেলিজেন্সের তথ্যভাণ্ডারে কিংবা পাচার করে দেয় মহামূল্যবান কোড। মুম্বইয়ের অ্যন্টি-টেররিজম বিভাগের প্রধান শাহওয়াজ আলি মির্জার কাছে একটি মেল আসে, যে ইমেল-এ বলা হয় যে এ অপরাধ সেই করেছে। নিজেকে পরিচয় দেয় মুন্তাকিম নামে। সে এ-ও জানায় আরও বড় ধরনের ক্ষতি তারা করতে পারে।
মির্জা তার সবচেয়ে তুখোড় অফিসার আইজি বিক্রান্ত সিং এবং তার টিম নিয়ে কাজে নামে। এবং বইয়ের পাতায় পাতায় আমরা বুঝতে পারি আমরা সাধারণ মানুষরাও কত বিপন্ন। আমাদের ফেসবুক, আমাদের ইমেল আমাদের সত্তা কতটা বিপন্ন। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি। কিন্তু যে কোনও দিন সাইবার হ্য়াকিং-এর খপ্পড়ে পড়ে আমার আইপি ঠিকানা দ্বারা সাধিত হতে পারে বড় ধরনের অপরাধ। গল্পে এর পর মুন্তাকিম আক্রমণ করে মুম্বই জনজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ব্য়বস্থা মুম্বইয়ের লোকান ট্রেন সংযোগ। গল্পে আরো নানা রকম চরিত্র যোগ হয়, এবং গল্প শেষ হয় বেশ পরিতৃপ্তি সহযোগে।
ক্রাইম-থ্রিলার হিসেবে এই বইয়ের মুন্সিয়ানার ছাপ বেশ ভালই। তবে, বইয়ের চরিত্ররা একটু বেশিই একরৈখিক। চরিত্রের আরও কয়েকটি পরত থাকলে অন্য সবপ্লটের সঙ্গে বেশ মানাত। কিন্তু এ যেন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম-এ যতটুকু প্রতিভাত হয়েছে তাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। এখন ক্রাইম রাইটিং-এর ধারা অনেক বদলে গেছে। মনোজগতের গভীরে গিয়ে আপরাধ ও অপরাধীর উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা হয়, এখানে ঠিক তেমন গভীরতা নেই। তা থাকতেই হবে এমন মানে নেই। কিন্তু তা হলে বইটির বিষয় নতুন হলেও, লেখার ধারাটি কিছুটা অনাধুনিক হয়ে যায়। রোমাঞ্চ তাতে কিছু কমে না, কিন্তু বইটি বন্ধ করলে ভাবনার গণ্ডি সীমাবদ্ধ থাকে সাইবার অপরাধের আতঙ্কের গহ্বরে। পড়তে পড়তে অবশ্য মনে হচ্ছিল, হয়তো মনোজ বাজপায়ী কিংবা কে কে মেনন বা তেমন কোনও দুঁদে চরিত্রাভিনেতা মুম্বইয়ের কোনও এক গলি থেকে বেরিয়ে এসে এই আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেন।
জিরো ডে
লেখক: এস. হুসেন জাইদি
প্রকাশক: হারপার কলিনস