বেশ কিছু লেখা এক সঙ্গে পাঠ করা গেলে কী ভাল হত। এক সঙ্গে বলতে এই উপন্যাসের একটি পরিচ্ছেদ, তারপর অমুক নাটকের একটি অধ্যায়, তমুক কবিতার দুটি স্তবক – তেমনটা নয়। সময়রেখা ধরে একের পর এক না সাজিয়ে যদি ছবির মতো কোলাজ করা যেত, এলোপাথাড়ি, একটার ওপর আরেকটা চাপিয়ে – কোনোটা পূর্ণাঙ্গে, কোনোটার এক টুকরো, হাতে ছেঁড়া, কখনো সময়রেখার সমান্তরালে, কখনো বা সময়কে কালক্রমে সাজিয়ে একটা সংযোগ টানা যায়, একটা পূর্ণ ছবি তৈরি হয় আমাদের সামনে, ঠিক তেমন ভাবে। কিছুদিন আগে ‘সমূহ’র নাটক ‘অথ হিড়িম্বা কথা’ দেখতে দেখতে এমনই একটা ছবি চোখের সামনে ভাসছিল। মহাভারতের ‘রাক্ষসীর’ সঙ্গে যেন কথোপকথন চলছিল শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্টের ‘ডাইনি’ সিকোর্যাক্সের, ঘটৎকচের সঙ্গে ক্যালিবানের। ইতিহাস রচয়িতারা একে অপরের সঙ্গে চোখাচোখি করছিলেন দুশ্চিন্তায়। প্রান্তিকতার অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে মহাকাব্যের দুঃসাহসী পুনর্কল্পনা পদে পদে প্রমাণ করছিল ‘মূলগ্রন্থ’ কতটা ঠুনকো।
পয়লা বৈশাখে হিন্দুস্তান রোডের এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারিতে অথ হিড়িম্বা কথা দেখার সুযোগ হয়েছিল। অথ হিড়িম্বা কথা যাঁদের এখনও দেখা হয়নি, এই কাজটির সঙ্গে তাঁদের সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। সমূহ একটি নারীবাদী ও কুইয়ার শিল্পী গোষ্ঠী যারা মূলত শহরতলীতে বিভিন্ন প্রান্তিক ন্যারেটিভ নিয়ে কাজ করে। ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে আদি পর্বে জতুগৃহ দাহের পর গভীর অরণ্যের মধ্যে হিড়িম্বা ‘রাক্ষসী’ হিসেবে অবতীর্ণ হন। তাঁর দাদা, হিড়িম্বর হাত থেকে পাণ্ডবদের বাঁচানোর পর, ভীমকে বিয়ে করার উৎসাহ প্রকাশ করেন হিড়িম্বা। প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও কুন্তীর উপদেশে ভীম হিড়িম্বাকে বিয়ে করেন আর তাঁদের সন্তান, ঘটৎকচের জন্ম হয়। এর পর থেকে মহাকাব্যে কোথাও হিড়িম্বার উল্লেখ পাওয়া যায় না, এমনকী ঘটৎকচের মৃত্যুর সময়েও না। সমূহর নাটকে আমরা হিড়িম্বার দৃষ্টিকোণ থেকে ভীম এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে জানতে পারি – বলাই বাহুল্য পাণ্ডবদের ন্যারাটিভের সঙ্গে তার ফারাক অনেকটাই।
ফলে হিড়িম্বার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখাটাকে কি ‘রি-টেলিং’ বলা যেতে পারে? কালানুক্রমিকভাবে পূর্ব-রচিত হলেও ব্যাসের মহাভারত ও তার পরবর্তী অনুবাদকে ‘মূলগ্রন্থ’ হিসাবে গণ্য করার কোনো কারণ দেখা যায় না। একটি দল, বংশ বা গোষ্ঠীর ন্যারেটিভের মধ্যে একটি গোটা দেশের সকল মানুষকে সমান জায়গা করে দেওয়া যেমন অসম্ভব, তেমন কোনো মহাকাব্যে পক্ষপাতিত্ব অগ্রাহ্য করে তাকে ‘মূলগ্রন্থ’ বলাটা সমীচীন নয়, কারণ তাহলে মহাকাব্য়ের সমস্ত অপ্রধান চরিত্রদের জাতীয় সাংস্কৃতিক-কল্পনার প্রান্তে সরিয়ে দেওয়া হয়, সকল পরিসরে তাদের জায়গা হয় না। মহাকাব্যের মূলগ্রন্থ বলে যদি আদৌ কিছু হয়, আমার মতে তা হল সেই কাল্পনিক টেক্সট (নাকি হাইপারটেক্সট?) যা ক্রমাগত রচিত হচ্ছে প্রতিবাদ প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে – যার মূল আদর্শ সামাজিক ও দার্শনিক বহুত্ব ও সমতা।
আদি পর্বের পর ব্যাসের মহাভারতে হিড়িম্বার উল্লেখ পাওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর ওড়িয়া কবি, সরলা দাসের মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে ইন্দ্রপ্রস্থে হিড়িম্বা ও দ্রৌপদীর মধ্যে সাংঘাতিক বিবাদ ঘটে। (দুজনের মধ্যে অভিশাপ আদান প্রদান চলে কিছুক্ষণ যার ফলে কুরুক্ষেত্রে ঘটৎকচ ও দ্রৌপদীর সমস্ত সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়।) এই ঘটনার উল্লেখ আমরা অথ হিড়িম্বা কথা-তেও পাই। অম্রুতা পাটিলের মহাভারত-অনুপ্রাণিত গ্র্যাফিক নভেলের দ্বিতীয় খণ্ড, সৌপ্তিক-এও হিড়িম্বা ও ভীমের প্রেমের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। তাঁর মতে দ্রৌপদীর সঙ্গে ভীমের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও হিড়িম্বাই ছিলেন তাঁর প্রাণের সঙ্গী:
‘সারল্যে, শক্তিতে, এবং প্রাণবন্ততায় ভীম ও হিড়িম্বা ছিলেন সমান। হিড়িম্বা ভীমকে তাঁর গোষ্ঠীর যাবতীয় ছল-কৌশল শেখান ও তাঁর সন্তান ধারণ করেন। পাণ্ডব ও পৃথা তাঁদের সম্পর্ক মেনে নিলেও সকলেই বুঝেছিলেন তা বেশিদিন টিকবে না। পাণ্ডবদের নিয়তির পথ তাঁদের জঙ্গল থেকে বহু দূরে নিয়ে যাবে।’
খুঁজলে হিড়িম্বার আরও নানা গল্প হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সে এখন থাক। অম্রুতা পাটিলের ব্যাখ্যায় হিড়িম্বা-ভীমের সম্পর্ক আইডিয়ালাইস করা হয়েছে, সমাজে উভয়ের স্থান উপেক্ষা করে।
কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সহজ? হয়তো। কিন্তু সমূহ অন্য কথা বলছে। তাঁদের হিড়িম্বা ভীমের প্রেমে পড়লেও হিড়িম্বকে বধ করার কুবুদ্ধি কখনই দেবেন না। তাঁদের হিড়িম্বা ভীমকে মল্লযুদ্ধে অনায়াসেই পরাজিত করেন অথচ ভীমের শিশুসুলভ আচার-আচরণ সহজে ক্ষমা করে দেন। যখন পাণ্ডবরা হিড়িম্বকে হত্যা করেন, হিড়িম্বা ও তাঁর দলের বাকিরা একবারও তাঁদের অবিশ্বাস করেন না। তাদের ‘মিত্র’ করে নেওয়ার নামে পাণ্ডবরা যখন সেই সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, ব্যাসের রচনা অমান্য করে অরণ্যবাসীরা ঘুরে দাঁড়ান। আসলে, এ শুধু হিড়িম্বার একার গল্প নয়,বহু যুগের ঔপনিবেশিক অত্যাচারেরও ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে পাল্টে ফেলা কি মুখের কথা?
বিশেষত উল্লেখযোগ্য অথ হিড়িম্বা কথা নাটকে হাস্যরসের প্রয়োগ। বাংলায় পৌরাণিক চরিত্রদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কির নমুনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই পাওয়া যায়, লেখায় ও ছবিতে – উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেদের মহাভারত থেকে শুরু করে পরশুরামের ‘তৃতীয় দ্যূতসভা’, সুকুমার রায়ের লক্ষ্মণের শক্তিশেল, এমনকী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় নাটক ভীম বধ পর্যন্ত। (যমালয়ে জীবন্ত মানুষের কথা ভুললেও চলবে না।) দেবতাদের মানুষ সুলভ ব্যবহার ও তার আনুষঙ্গিক নানা মজাদার, আজগুবি পরিস্থিতির থেকে এই ধরনের গল্পে হাসির উদ্রেক হয়। তবে অথ হিড়িম্বা কথা তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে। ভীমের সংলাপে, পাণ্ডবদের হাস্যকর আচার-আচরণে, এমন কি কিছু মেটা-থিয়্যাট্রিকাল কথাবার্তায় হাসি পায় ঠিকই, কিন্তু সে হাসি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। নাটকের সম্পাদক, তিতাস দত্তের মতে এই প্রয়োগকৌশলের অনুপ্রেরণা ইতালীয় ‘সোশ্যাল গ্রোটেস্ক’, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পিরান্দেলো প্রমুখ নাট্যকারের কাজে দেখা যায়। এই অস্বস্তিকর হাসির উৎসে রয়েছে দুটি অসম শক্তিশালী সমাজের মধ্যে সংঘর্ষ, যার ফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আর্য সভ্যতার কতকগুলো ভয়ানক দ্বিচারিতা।
অনুপস্থিত নারী চরিত্রের প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সিকোর্যাক্সের কথা। শেক্সপিয়রের শেষ নাটক দ্য টেম্পেস্টে প্রস্পেরো অজানা সেই দ্বীপ দখল করে ক্যালিবানকে তাঁর ক্রীতদাস করে নেন। ক্যালিবান তাঁকে মনে করিয়ে দেন দ্বীপের পূর্ব-বাসিন্দা তিনি ও তাঁর মা, সিকোর্যাক্স, যাঁকে অ্যালজিয়ার্স থেকে ‘ডাইনি’ হওয়ার অভিযোগে গর্ভবতী অবস্থায় দ্বীপান্তরিত করা হয়। তাঁর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল সে বিষয়ে নাটকের চরিত্রদের মধ্যে মতবিরোধ নেই, কিন্তু তিনি সেই শক্তি কী কাজে লাগাতেন বলা কঠিন। প্রস্পেরোর মতে সিকোর্যাক্স এরিয়েলকে কারারূদ্ধ করে রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর কথাই বা বিশ্বাস করা যায় কেমন করে, যখন তিনি নিজেই জাদুমন্ত্রবলে ক্যালিব্যানের ওপর শারীরিক অত্যাচার চালাতেন? কোনো চরিত্রকে অ-মানুষ প্রমাণ করতে মূলধারার সাহিত্যে অনেক সময়ই তাঁদের কিছু অলৌকিক শক্তির মালিক হিসাবে দেখানো হয়ে থাকে যা প্রধান চরিত্রদের – তথা প্রত্যাশিত পাঠকের – যৌক্তিকতার ঊর্ধ্বে। হিড়িম্ব, হিড়িম্বা, সিকোর্যাক্স তিনজনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তাঁরা জাদুমন্ত্রে অশুভ শক্তি সঞ্চালন করতে পারেন।
অরণ্যবাসীর প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কেও সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। হিড়িম্বা ও তাঁর উপজাতির মানুষ জঙ্গলে শান্তিতে জীবনযাপন করেন। শুধু দরকার মতো ফলমূল, নদীর মাছ, গাছের পাখি, বা বন্য পশু শিকার করে খান। এ বিষয়ে তাঁরা অত্যন্ত সচেতন যে, জঙ্গলের থেকে তাঁদের অস্তিত্ব কোনো ভাবে আলাদা নয়। মৃত্যুর পর তাঁরাও ওই মাটিতেই মিশে যাবেন। দ্বীপের সঙ্গে এরকম সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই দ্য টেম্পেস্টের দুজন চরিত্রের মধ্যে – এরিয়েল ও ক্যালিবান। ইতালীয় রাজবংশের কন্যা, মিরান্দার কিন্তু প্রকৃতির থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন:
‘মিরান্দাকে আমরা তরঙ্গঘাতমুখর শৈলবন্ধুর জনহীন দ্বীপের মধ্যে দেখিয়াছি, কিন্তু সেই দ্বীপপ্রকৃতির সঙ্গে তাহার কোনো ঘনিষ্ঠতা নাই। তাহার সেই আশৈশবধাত্রীভূমি হইতে তাহাকে তুলিয়া আনিতে গেলে তাহার কোনো জায়গায় টান পড়িবে না।’
অন্যদিকে, শকুন্তলা:
‘তাহার চতুর্দিকের সহিত একাত্মভাবে বিজড়িত। তাহার মধুর চরিত্রখানি অরণ্যের ছায়া ও মাধবীলতার পুষ্পমঞ্জরীর সহিত ব্যাপ্ত ও বিকশিত, পশুপক্ষীদের অকৃত্রিম সৌহার্দ্যর সহিত নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট।’
সম্ভবত অথ হিড়িম্বা কথার অন্যতম স্নেহপূর্ণ দৃশ্যে আমরা দেখি হিড়িম্বা ঘটৎকচকে শিকার করতে শেখাচ্ছেন। বন্য একটি পশুকে নিস্তব্ধে ঘিরে ফেলে, বাণ নিক্ষেপ করার ঠিক আগের মুহূর্তে হিড়িম্বা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপর আঙুল তুলে দেখান, জন্তুটি গর্ভধারী। তাই তাঁকে মারা অন্যায়। নাটকে বারবার ফিরে আসে প্রকৃতির প্রতি পাণ্ডব ও অরণ্যবাসীদের এই দার্শনিক বৈপরীত্য।
উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে দ্য টেম্পেস্ট নাটকটি বহুবার ফিরে এসেছে নতুন নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন লেখক নাটকটি পাঠ করেছেন তাঁদের সময়ে, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে। ক্যালিবান হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবিরোধী অনেক সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বা প্রতীক। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যখন বাংলা সাহিত্যজগৎ শেক্সপিয়র নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, ক্যালিবান চরিত্রটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ ও নিহিতার্থ বিশ্লেষণ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুপ্রিয়া চৌধুরী ‘দি অ্যাবসেন্স অফ ক্যালিবান’ নামের একটি প্রবন্ধে। কপালকুণ্ডলার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখছেন, প্রাচীনা ও নবীনা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ইত্যাদি নিয়ে যখন বাংলা পাবলিক স্ফিয়ারে প্রবল তর্কবিতর্ক চলছে, বঙ্কিমচন্দ্র চটোপাধ্যায় এই প্রশ্নগুলোর কথা ভাবছেন মিরান্দার মতো চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে। ‘শকুন্তলা, মিরান্দা এবং দেস্দিমোনা’ নামের তুলনামূলক প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরছেন সরল, আধুনিকতা-বিমুখ নারী চরিত্রের আদর্শ রূপ – ‘উভয়ই (শকুন্তলা ও মিরান্দা) অরণ্যমধ্যে প্রতিপালিত; সরলতার যা কিছু মোহমন্ত্র আছে, উভয়েই তাহাতে সিদ্ধ।’ (‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে, সুপ্রিয়া চৌধুরীর মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও মূল প্রশ্ন নারী এবং তাঁর শিক্ষা কেন্দ্র করেই।) বঙ্কিমের উপন্যাসে, সুপ্রিয়া চৌধুরী লিখছেন, ‘তিনি (কপালকুণ্ডলা) শুধু প্রস্পেরোর কন্যা, মিরান্দাই নন। তিনি একই সঙ্গে সিকোর্যাক্সের সন্তান, ক্যালিবান, প্রকৃতির দ্যূত, এরিয়েল।’ ক্যালিবান এই আলোচনার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে কারণ জাতিগত যে প্রশ্নগুলো ক্যারিবীয় বা আফ্রিকার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য, বাংলায় তা কিছুটা অন্যরকম। ‘কিন্তু এই ন্যারেটিভে কেউই বিশেষাধিকার দাবি করতে পারেন না’, সুপ্রিয়া চৌধুরী মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
সিকোর্যাক্স বা ক্যালিবানের খোঁজ সত্যিই হয়তো বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ বা শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের আলচনায় পাওয়া সম্ভব নয়। ঔপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে তাঁরা যে ‘নেটিভ সাব্জেক্টের’ (ও পাঠকের) কথা এই প্রবন্ধ বা উপন্যাসগুলোতে তুলে ধরছেন, তারা ‘আধুনিকতার’ বৃহত্তর প্রজেক্টের অংশ। সাহিত্যচর্চা ও তার মধ্যে দিয়ে সমাজচেতনা চলছে কিছুটা বাইরে দাঁড়িয়ে – নারীর অভিজ্ঞতাকে আলোচনা কেন্দ্র থেকে দূরে রেখে। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অথ হিড়িম্বা কথা নাটকটির স্রষ্টারা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে, তার মাধ্যমে মহাভারত পাঠ করেছেন, মহাকাব্যের সার্বিকতার দাবিকে ভেঙে দিয়েছে (নাটকের শেষে দর্শকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তরে শিল্পীরা সে কথা বলেন।)
কিন্তু সেই একান্ত ব্যক্তিসত্তার, রাজনৈতিক আকার গ্রহণ করতে বেশি সময় লাগে না। তার সঙ্গে উঠে আসে বনভূমি দখলের রাজনীতি, ইতিহাসের পক্ষপাতিত্ব ও ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র সমালোচনা। হিড়িম্বা বা সিকোর্যাক্স, ঘটৎকচ বা ক্যালিবান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আমরা যখন ঔপনিবেশিক, প্রাক-ঔপনিবেশিক, বা উত্তর-ঔপনিবেশিক – অর্থাৎ সমস্ত ইতিহাস জুড়েই একান্ত প্রান্তিক গোষ্ঠি গুলোর কথা ভাবি, যাদের বৈপরীত্যে ‘আধুনিকতার’ সংজ্ঞা স্থাপন করা হয়ে থাকে। ব্যক্তি বা চরিত্র হিসাবে পরাজিত হলেও তাঁরা কালজয়ী। তাঁরা ফিরে আসেন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কল্পনায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তে, প্রতিরোধের নির্ভীক প্রতীক হিসাবে।
(কৃতজ্ঞতা জানাই সমূহর সঙ্গে যুক্ত সকলকে।)
References:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬)।
শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, ‘মিরান্দা ও কপালকুণ্ডলা’ (১৮৮০)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শকুন্তলা’ (১৯০২)।
Supriya Chaudhuri, ‘The Absence of Caliban: Shakespeare and Colonial Modernity’ in Shakespeare’s World/World Shakespeares, ed. R. S. White, Christa Jansohn, and Richard Fotheringham (University of Delaware Press, 2008), 223-36.
B. N. Patnaik, ‘When Hidimbaki and Draupadi Met…’, Sarala Mahabharat blog (2008). https://saralamahabharat.blogspot.com/2008/05/when-hidimbaki-and-draupadi-met.html
ঘরে বাইরে প্রদর্শনীতে অথ হিড়িম্বা কথার পার্ফর্মেন্সের ছবি সৌজন্য দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ড্যাগ); ছবি তুলেছেন লেখক।