ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ২৬


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (March 12, 2022)
     

    লতা ও তরলতা

    লতা মঙ্গেশকর মারা যাওয়ার পর শোভা দে একটা লেখা লিখলেন তাঁকে নিয়ে, আর তা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হইহই, কারণ সেখানে লেখা: লতা জুয়া খেলতে খুব ভালবাসতেন, আর শোভা নিজে লতার চেয়ে আশার গলা বেশি পছন্দ করেন। যদি-বা পছন্দের ব্যাপারটায় লোকে কিঞ্চিৎ ছাড় দিতে পারে (কারণ ব্যক্তিস্বাধীনতা ইদানীং ‘ইন’, আর অনেকেই অন্তত বাড়ির আড্ডায় বলেন গীতা দত্তের কণ্ঠের আবেদন বা আশার কণ্ঠের বিচিত্রবিহার লতার স্বরের চেয়ে আকর্ষণীয়), কিন্তু জুয়ার ঘটনাটায় বিশ্বাস করবে কী করে? প্রখ্যাত মিডিয়া-লেখক সুভাষ কে ঝা প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন, লতা তাঁকে নিজে বলেছিলেন, জীবনে কক্ষনও জুয়া খেলেননি। এখানে পরিণতমনস্ক মানুষের বলা উচিত, ধুর বাবা, একজন গায়িকা জুয়া খেলেছেন কি খেলেননি তাতে কার কী এসে যায়? গানগুলোর ভিত্তিতে তাঁর মূল্যায়ন করুন না! কিন্তু ভারতে এহেন ঔদাসীন্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, সুভাষবাবুর কথায় সত্য থাক আর না-থাক, ভক্তির অন্ধতা আছে, যেখানে তিনি বলছেন লতার নামে নিন্দে করলে তা দেবীর নামে গালাগাল দেওয়ার মতোই বিশ্রী বিদ্রোহ ও অপরাধ (বলা ভাল, নাস্তিকতা)। কারণ, সুভাষবাবুর মতে, আমাদের কাছে লতাই ‘মাদার ইন্ডিয়া’, তাঁকে আমরা ঘরে ঘরে মা দুর্গার মতোই পুজো করি, তিনিই শক্তি, তিনিই মহিমা, জীবনকে যা কিছু বেঁচে থাকার যোগ্য করে তোলে লতা তার মূর্ত প্রতীক, এবং আমরা সব্বাই চাই আমাদের বাড়ির মেয়েরা লতার মতন হোক।

    এ কথা সত্যিই, ভারতে লতার কণ্ঠের মর্যাদা অবিশ্বাস্য উঁচু বেদিতে অবস্থিত, আমরা লতাকে অন্যতম গায়িকা মনে করি না, অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ গায়িকা মনে করি, আমরা বহু দশক ধরে বিশ্বাস করে এসেছি যে গায়িকা মানে লতা এবং অন্যান্য, কিন্তু তা বলে তাঁকে আমরা দেবী (বা দেশমাতৃকা) হিসেবে ঠাকুরঘরের সিংহাসনে ফোটো ঠেসে পুজো করি এবং তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বললেই তা সিডিশন— মেনে নেওয়া একটু শক্ত। আর আমাদের সব্বার বাড়ির মেয়েকে লতার মতো হতে হবে, এ আকাঙ্ক্ষার কথাটা একটু বাড়াবাড়ি, কেউ হয়তো চায় তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী হোক, কারও পছন্দ মারি কুরি, কারও দিল মাঙ্গে ঐশ্বর্যা রাই। আসল কথা: লতা ক্যাসিনোয় গিয়ে জুয়া খেলতেন কি না এবং খেললেও তা সুভাষবাবুকে অকপটে বলতেন কি না, তার চেয়ে অনেক বড় প্রশ্ন হল, কেন তাঁর সম্পর্কে কিছুই লেখা যাবে না, যা ততটা প্রশস্তিবাচক নয়? শোভা দে বিশাল চিন্তক নন, তিনি স্বাদু চটপটা ফিচার লেখেন যার মধ্যে কখনও-সখনও সমাজের খর নিন্দে থাকে। তিনি এই ঢালাও (ও সঙ্গত) লতাবন্দনার দিনকালে ইচ্ছে করেই স্বল্প বিপরীতবাজি হাঁকড়েছেন, যাতে ঠাস করে লাইমলাইট নিজপানে টেনে আনতে পারেন, আর আশার প্রতি মুগ্ধতার বশে একটা বাড়তি নৈবেদ্য অর্পণ করা যায়। তাঁর নিবন্ধে প্রকাশ, আশা শোভাকে নিজ হাতে রেঁধে খাইয়েছেন এবং লতার শিশু-শিশু কণ্ঠ নকল করে দেখিয়েছেন, তাঁর নড়াচড়াও। কিন্তু একজন টিটবিট-সরবরাহকারী ও সঙ্গীত-সম্পর্কহীন মানুষের সামান্য লেখায় এতটা উত্তেজিত হয়ে ওঠার কারণ হল, লতাও এবার ভারতের সেই পবিত্র লিস্টিতে ঢুকেছেন, যেখানে স্পর্শাতীত আইকনরা বাস করেন। তাঁদের নামে শুধু সিন্নি চড়ানো যায়, তাঁদের পা চেটে সাবানাতীত সাফ করতে হয়, তাঁদের সম্পর্কে রসিকতা করা চলে না, কখনও এমন বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায় না যা তাঁদের নশ্বর বা মানুষিক হিসেবে দাবি করে, আর নিন্দেমন্দ বা গালাগালের তো প্রশ্নই ওঠে না। মনে আছে নিশ্চয়, খুশবন্ত সিং একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন ‘উনি এমন কিছু লেখক নয়’, আর বাঙালিরা পাঁইপাঁই লাফিয়ে কী ক্যানক্যানে কলহ পাকিয়েছিল। সিপিএম-কংগ্রেস নির্বিশেষে (তখনও তৃণমূল তেড়েফুঁড়ে ওঠেনি) সব্বাই একত্রিত হয়ে খুশবন্তের বাপান্ত করতে ব্যস্ত, ‘ও নিজে কী লেখে?’ এবং ‘বাংলায় না পড়লে টেগোরকে বুঝিবে কেমনে?’ ইত্যাকার সহস্র শক্তিশেল, খুশবন্ত অবশ্য পরে বলেন যে তাঁকে ভুল উদ্ধৃত করা হয়েছিল, কিন্তু একইসঙ্গে বলেন, তাঁর যে কোনও লেখককে খারাপ বলার অধিকার আছে। এ কথা কেউ মেনে নেয়? লেখক আর রবীন্দ্রনাথ এক? চড়াইপাখি আর ধূমকেতু? গিরিশ কারনাড একবার বলেন, রবীন্দ্রনাথ অসামান্য কবি হলেও, নাট্যকার হিসেবে নিতান্ত মাঝারি। তখনও সমান হাঁউমাউ, তুড়ুক লাফ, রণহুঙ্কার, ক্রোধ ও তিরস্কারের বং-বন্যা। রবিবাবু ছাড়া সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, আর গোটা ভারতের ক্ষেত্রে গান্ধী, আম্বেদকর, ছত্রপতি শিবাজি, বচ্চন, রজনীকান্ত, কিশোরকুমার, তেন্ডুলকর, বজরঙ্গবলী ও গোমাতা হচ্ছেন এই তালিকার কিছু উজ্জ্বল ছবিছাবা। এখন সত্যজিৎও দ্রুত এ শিবিরে প্রবেশ করছেন, কারণ তাঁর জন্মশতবর্ষ চলছে, এবং অসংখ্য লেখায় শুধুই তাঁকে সাষ্টাঙ্গ স্যালুট ও ‘তোমার পানে চাহিয়া বিস্ময়ের সীমা নাই’ গদগদ কীর্তন ঘটছে, সামান্য কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ছবির ভালত্ব ও মন্দত্বের গাঢ় বিশ্লেষণ হচ্ছে, ধীরে ধীরে নির্ঘাত সে-স্রোত শুকিয়ে শুধু চপচপে নৈবেদ্য ভোগ দেওয়া হবে।

    কারণ এটা উদ্দাম পুজোর দেশ, বা, তারই অনুসিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রখর ঘৃণার ও পাথর-ছোড়ার দেশ। এদেশে এক-আধটা ছাড়া সব ধর্ম মনে করে, সে স্বতঃই মহান, সব চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে, আর অন্য-ধর্মের লোকগুলোকে কচুকাটা করা উচিত। রাজনীতির মাঠে আশা করা হয় একজন সাধারণ লোক একটা নির্দিষ্ট দলকেই পাঁড়-সমর্থন করবে এবং অন্য সব দলকে একেবারে নস্যাৎ করে দেবে।

    কী কারণে, ভারতে যাঁদের শ্রদ্ধা করা হয় তাঁদের সম্পর্কে শুধু একবগ্গা ও বেধড়ক প্রশংসাই একমাত্র গ্রহণীয়? ধর্মগুরু আর মসিহাদের ক্ষেত্রে তবু ব্যাপারটা বোঝা যায়, কারণ ধর্মের সংস্কৃতির মধ্যেই একটা অন্ধত্বের দাবি আছে, নিঃশর্ত আনুগত্য সেখানে প্রাথমিক প্রবেশপত্র, প্রশ্নহীনতা সেখানে ভক্তির সহোদর। কিন্তু সংস্কৃতির ধর্ম তো উল্টো। সেখানে মূল মজাটাই হল বহু মতের, বহু ব্যাখ্যার টগবগানি। একটা সিনেমা পাশাপাশি বসে দুজন দেখল, এর মনে হল অতুলনীয়, ওর মনে হল জঘন্য। তারপর তর্ক হল, দুজনেই যুক্তি দিল বা নিজের অনুভূতির কথা বলল, এবং আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল, একই দৃশ্য দুজনের মনে বিপরীত অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। না, ভুল হল, এতে কেউই আশ্চর্য হল না, কারণ সংস্কৃতিতে এ জিনিস অস্বাভাবিক নয়, বরঞ্চ নিতান্ত নর্মাল। কারও মনে হল দস্তয়েভস্কির উপন্যাসই শ্রেষ্ঠ, কারও মনে হল আর যে-ই লিখতে জানুন, দস্তয়েভস্কি জানেন না। আবার যার দস্তয়েভস্কির ধরনটা অসম্ভব পছন্দ, তারও ওঁর অমুক উপন্যাসটা প্রিয় আর তমুকটা একেবারে যাচ্ছেতাই লাগে। যে-লেখক বা চিত্রকর বা চলচ্চিত্রকার তাঁর জীবৎকালে সাংঘাতিক সমাদৃত হলেন, মারা যাওয়ার ৩০ বছরের মধ্যে হয়তো তাঁকে সামূহিক বাতিল করে দেওয়া হল, আবার যে-লোকটা ডবল মরতে মরতে জেনে গেল তার লেখা কেউ কখনও পড়ল না, তাকে মৃত্যুর ২০ বছর পরে উচ্চতম দেবতা বলে পুজো করা হল। এই সতত অস্থির পরিবর্তনশীল তরঙ্গরঙ্গী ঘনঘটাই সংস্কৃতি। ক্ষেত্রটা তাই প্রাণময়, ছটফটে আর বাধ্যতামূলক ভাবে উদার। তাহলে ভারতীয় সংস্কৃতির ময়দানে এতসংখ্যক আখাম্বা স্ট্যাচু কেন, তাদের পদতলে এমন আতিশয্যময় সাড়ম্বর মাথা ঠোকা কেন? অমিতাভ বচ্চন খারাপ অভিনেতা বললেই বা লতার গলা ভাল লাগে না বললেই ‘চুপ করো অবিশ্বাসী!’ ধমক কেন? এমনকী রবীন্দ্রনাথের মতো যে-শিল্পীরা নিজেদের কাজের মধ্যে প্রাণপণ অচলায়তন-বিরোধিতা করে গেছেন, তাঁদের ভক্তরাও তাঁদের অচলায়তনে পরিণত করলেন কোন বিভ্রান্তিতে?

    কারণ এটা উদ্দাম পুজোর দেশ, বা, তারই অনুসিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রখর ঘৃণার ও পাথর-ছোড়ার দেশ। এদেশে এক-আধটা ছাড়া সব ধর্ম মনে করে, সে স্বতঃই মহান, সব চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে, আর অন্য-ধর্মের লোকগুলোকে কচুকাটা করা উচিত। রাজনীতির মাঠে আশা করা হয় একজন সাধারণ লোক একটা নির্দিষ্ট দলকেই পাঁড়-সমর্থন করবে এবং অন্য সব দলকে একেবারে নস্যাৎ করে দেবে। কেউ যদি বলে কংগ্রেসের অমুক ভাল বিজেপির তমুক আর তৃণমূলেরও পজিটিভতা সুদে-আসলে জমুক— তাকে আড্ডায় নেওয়া হবে না। সেই জিনিসই সংস্কৃতিতে চুঁইয়ে জমেছে, একমেটে একঝোঁকা মানসিকতার ঠেলায় ও চাপে কয়েকজন গুরুঠাকুর (বা ঠাকুরানি) তৈরি করা হয়েছে, তাঁদের অনবরত ও শুধুমাত্র বাতাসা চড়িয়ে যেতে হবে। অথচ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে, কাছের লোককে অবধি অবিমিশ্র ভালবাসতে পারে না। দোষত্রুটি দেখে কখনও মনে হয় বাবাকে বারান্দা থেকে রামধাক্কায় ঠেলে ফেলে দিই, সন্তানের মুখ ছাইগাদায় ঠুসে দিই, বউকে অন্য স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসি। কেন বুঝব না, একজনকে শ্রদ্ধা করা মানে গোটাগুটি কড়াসুদ্ধু ছুলিসুদ্ধু শ্রদ্ধা করা নয়? আবার তাঁর দিকে তাকিয়ে এটা ভাবারও মানে নেই, কড়া-ছুলি আছে বলেই তাঁকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা দরকার? ‘ধুর সৌরভ গাঙ্গুলির ওই ইনিংসটা বাজে’ বললেই বোঝানো হয় না: সৌরভ খেলতে পারেন না। আবার ‘গুরু, ওই ম্যাচটায় সৌরভের জবাব নেই’ বললেই প্রকাশিত হয় না: সৌরভের প্রতিটি স্ট্রোকই লা-জবাব। কিন্তু যত যুক্তি আছড়াও, সব্বাই অন্তরে জানে, সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি ভাল। একটা গোষ্ঠীর কাছে ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি মাস্টারপিস। দেবব্রত বিশ্বাসের সব গান অলৌকিক। উত্তমকুমারের কোনও অভিনয়ের দিকে দুয়ো ছোড়া যাবে না। আর গরু খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তেমনই, নেতাজির বীরত্বের প্রশংসা করে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের নিন্দে করলে চলবে না। বিবেকানন্দের তেজ ও বাগ্মিতার প্রশস্তি গেয়ে তাঁর বাল্যবিবাহ-বিষয়ক ধারণার ব্যবচ্ছেদ করলে হবে না। গান্ধীর যৌনতা-বিরোধী তত্ত্বের বিরোধিতা করলে পাটকেল খাবে। অথচ মনে রাখতেই হবে, যাঁরা এমন কিছু কাজ করেছেন যা গোটা সমাজের সামনে উন্মোচিত, সে রাজনীতিই হোক আর ফুটবল খেলা, সাহিত্যই হোক আর ডাক্তারি, তার পূর্ণ ওজন করার, মতামত দেওয়ার অধিকার সমাজের সক্কলের রয়েছে, এবং হ্যাঁ তাঁদের পুরোপুরি নিন্দে করার ও সামগ্রিক কাজ-প্রোজেক্টটাকেই যাচ্ছেতাই বলার, সপাটে বাতিল করার অধিকারও রয়েছে। তবে, সেই নিন্দে যেন ভদ্রতার সীমা না লঙ্ঘন করে, তার পিছনে যেন চিন্তা মনোযোগ ও চর্চা থাকে, আর সর্বোপরি তা যেন যুক্তি মেনে চলে, তা খেয়াল রাখা দরকার। মানে, খেয়াল রাখলে ভাল। খেয়াল না-রেখেই তো সামাজিক মাধ্যম ফুলছে-ফলছে। কিন্তু ‘বলবি যদি জিভ ছিঁড়ে নেব’ পৌনঃপুনিক হুমকি ও ফতোয়া প্রমাণ করে, ভারতীয়রা (কিছু অন্য-দেশবাসীর মতো) রুদ্ধমনা, অপরিণত, সংস্কৃতিবুদ্ধু এবং অহেতুক-জঙ্গি। সংস্কৃতি যদি কাউকে সংকীর্ণ ও গোঁয়ার করে, খোলাচোখে যাচাই করার বদলে মোদাচোখে এড়িয়ে যেতে প্রণোদিত করে, তাহলে সে সংস্কৃতির গোড়ার পাঠটাই শেখেনি। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা ভুল টুকেছে।

    সংস্কৃতি এমন এক কাণ্ড, যেখানে একই জিনিসকে ক্রমাগত, বিরতিহীন, অক্লান্ত, নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে, ফেলে ঘুরিয়ে উল্টেপাল্টে মাপা হয়, আর সেই প্রক্রিয়াই সংস্কৃতির মহারথীদের চিরজীবিত রাখে।

    যাঁরা সংস্কৃতির মানচিত্রের ভগবান, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নির্ঘাত পিওর-প্রণম্য, এবং সুদীর্ঘ ও যুগ-যুগব্যাপী বিস্ময়ের যোগ্য, তাঁদের অনুরাগী ও ভক্ত হওয়া দিব্যি চমৎকার ঘটনা, জীবনের কেন্দ্রে তাঁদের অধিষ্ঠিত রেখে নিত্য জাগরণ এক শুদ্ধ ব্রত, কিন্তু তার সঙ্গে যেন এই বোধ থাকে: আমার দেবতাকেও কেউ এসে গাল দিতে পারে, সেই গালে যদি যাথার্থ্য থাকে আমি তা অনুধাবনের চেষ্টা করব, আর তা যদি অবান্তর হয় তবে তাকে অবহেলা করার ক্ষমতা আমার থাকবে। নিশ্চয়ই, সমালোচনার বারোয়ারি অধিকার অর্পণ মানেই বেনোজল হুড়হুড়িয়ে ঢোকার স্লুইস-গেট খুলে দেওয়া, তবু দ্বার বন্ধ করে দিয়ে অনধিকারীর খেউড়-দেয়ালা রুখতে গিয়ে তো আমি প্রকৃত বোদ্ধার সমঝদার বিশ্লেষণের ধারা হাটিয়ে দিতে পারি না। সংস্কৃতি এমন এক কাণ্ড, যেখানে একই জিনিসকে ক্রমাগত, বিরতিহীন, অক্লান্ত, নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে, ফেলে ঘুরিয়ে উল্টেপাল্টে মাপা হয়, আর সেই প্রক্রিয়াই সংস্কৃতির মহারথীদের চিরজীবিত রাখে। আমার দেবতা কাল জ্যোতি হারাতে পারেন, তাঁর মুন্ডুর মুকুট ভেঙে চুর হতে পারে, আবার তাঁর মহিমা-পরিধি বহুগুণ উদ্ভাসিতও হতে পারে, এই স্রোত-ধারণা মনের পিছনে রেখেই আমাকে তাঁর বিভায় স্নান করতে হবে, এ-ই হল সংস্কৃতির দীক্ষা। লতা জুয়া খেলতেন কি না, তা লতার শিল্পের বিচার নয়, তাই তাকে পাত্তা দেওয়ারই দরকার নেই, সে যত বিখ্যাত লোকই লিখুন না কেন। কিন্তু লতা নিয়ে নিবন্ধ শুধু হাতজোড় করেই লিখতে বসতে হবে, এ দাবির মধ্যে অসংস্কৃত অ-ভাবুক প্রণতি রয়েছে, যা কোনও অবিশ্বাস্য শিল্পীর প্রাপ্য নয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook