অভিবাসন বা অভিপ্রয়াণের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্ক কী? আমরা যখন দেশান্তরী, তখন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা সামলাই কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল, তবে এটুকু আমরা জানি যে, ধীরে-ধীরে বিদেশি বা ‘বিজাতীয়’ খাওয়া-দাওয়ায় আমরা যেমন অভ্যস্ত হই, তেমনই আমাদের কমিউনিটির সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে আস্তে-আস্তে গড়ে তুলি বিদেশের মধ্যেই দেশের এক টুকরো দ্বীপ, সেখানে দোকানপাটে কিনতে পাওয়া যায় দিশি মশলা, দিশি আনাজ, দিশি মনিহারি জিনিস, এমনকী দিশি মাছমাংস— যেমন লন্ডনে ব্রিক লেন বা সাউথহল, নিউ ইয়র্কের কুইন্স অঞ্চলের জ্যাকসন হাইটস, বা শিকাগোর ডেভন অ্যাভিনিউ, যেসব অঞ্চলে ভারতীয় দোকানপাটের আধিক্য ‘লিটল ইন্ডিয়া’ অভিধা অর্জন করেছে। কানাডীয় খাদ্য-ইতিহাসবিদ ডোনা গাবাচ্চিয়া ২০০০ সালে We Are What We Eat: Ethnic Food and the Making of Americans নামে একটি বিখ্যাত বই লেখেন, যেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল ইতালীয়, চিনা, মেক্সিকান, মধ্য এশীয় ইহুদি, গ্রিক, আর দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের নিজস্ব রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া কীভাবে মার্কিন খাদ্যরুচিকে দশকের পর দশক ধরে প্রভাবিত করেছে, গড়ে তুলেছে এক বিমিশ্র আর ‘বর্ণসংকর’ খাদ্য-সংস্কৃতি। এই ইতিহাসও এক অকপট গ্রহণ-অভিযোজন এবং আদান-প্রদানেরই ইতিহাস।
আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বমাতারা উনিশ শতক থেকে পশ্চিমের দেশগুলিতে যাতায়াত শুরু করেন, কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে তাঁরা খেতেন কী? রামমোহনের সমস্যা ছিল না, তিনি ১৮৩১ সালের বিলেতযাত্রায় সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন পাচক শেখ বক্সকে। আর বাবুর্চি নিয়ে গেছিলেন দ্বারকানাথও, যদিও বেলগাছিয়া ভিলার নিয়মিত পার্টিতে বিলিতি খানা ও মদিরায় অভ্যস্ত প্রিন্সের এ-ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা ছিল না। একটু-আধটু অসুবিধে কাটিয়ে বিলিতি খাদ্যাখাদ্য— অর্থাৎ খোদ রোস্ট বিফ আর ইয়র্কশায়ার পুডিং না হলেও নিদেনপক্ষে মাংস বা মাছ, ম্যাশড পোট্যাটো, বাঁধাকপি, বিনস বা ব্রাসেলস স্প্রাউটস, আর মাঝেমধ্যে ফিশ অ্যান্ড চিপস— হজম করতেন প্রায় সবাই। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর অতুলনীয় স্মৃতিকথা ‘তরী হতে তীর’-এ তাঁর বাল্য ও কৈশোরে শহর কলকাতার খাদ্যরীতি নিয়ে অনেক কিছু লিখলেও ১৯২০-র দশকের শেষের দিকে বিলেত প্রবাসকালে তাঁর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রায় নীরব থেকেছেন, শুধু এইটুকু ছাড়া যে, ‘বিলাতে নিরামিষাশী ভারতীয়েরা অনেক সময় কেমন করে প্রায় হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকত জানি না।’ কিন্তু আমরা জানি। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ১৯০০ সালে বেদান্ত প্রচার করতে বিলেত গেছিলেন, সেই ভ্রমণ সম্পর্কে লেখা ‘বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি’–তে কবুল করেছিলেন যে, কপি আর আলুসিদ্ধই ছিল তাঁর ক্ষুন্নিবৃত্তির ভরসা। এও লিখেছিলেন যে, কেমব্রিজের গোটা দশেক বাঙালি ছাত্র তাদের মেম রাঁধুনিকে বাঙালি কায়দায় ভাত-ডাল-তরকারি রাঁধতে শিখিয়েছিল। বিলেতে ব্রহ্মবান্ধবের দৈনন্দিন আহার ছিল ব্রেকফাস্টে চার পিস পাঁউরুটি মাখন আর এক প্লেট পরিজ, লাঞ্চে ভাত-ডাল-আলুভাজা-কপির তরকারি-মাখন-পাঁউরুটি-ফল ইত্যাদি, বিকেলে চায়ের সঙ্গে টোস্ট আর কেক, আর ডিনারে আলু-বরবটি-কড়াইশুঁটির তরকারি, পাঁউরুটি, ও পুডিং। অবশেষে ঘরে ফিরে সজনেডাঁটার চচ্চড়ি, লাউডগা ভাতে, কচুর শাক, মোচার ঘণ্ট আর কচি আমড়ার টক খেয়ে তিনি মনস্থ করেন যে দেশ ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না।
ব্রহ্মবান্ধব জানলে খুশি হতেন যে, এখন এসব জিনিস বিলেতে পাওয়া নেহাতই নস্যি। তবে এই অবস্থা গড়ে উঠতে সময় লেগেছে একশো বছরেরও বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় যেখানে লন্ডনে গোটা কুড়ির বেশি ভারতীয় রেস্তোরাঁ ছিল না, সেখানে ১৯৬০ নাগাদ গোটা ব্রিটেনে এই সংখ্যা প্রায় তিনশো, আর ১৯৮০ নাগাদ প্রায় তিন হাজার, যার একটা বৃহৎ অংশ সিলেট অঞ্চল থেকে অভিবাসী বাঙালিদের হাতে তৈরি। অসচ্ছল ছাত্র আর মেহনতি মানুষদের সস্তায় খাবার জুগিয়েছে এই সব ‘কারি হাউজ’, কিন্তু ১৯৭৬ সালে লেখা অভিনেত্রী ও শেফ মধুর জাফ্রির An Invitation to Indian Cooking বইটিতে এই ভোজনশালাগুলির সম্পর্কে তীব্র তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। বিলেতের অভিবাসী ভারতীয়দের দিশি রান্নায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই বই, কিন্তু সেখানে— বাংলায় চিংড়িমাছের মালাইকারি খেয়ে মুগ্ধ হওয়ার বিবরণ থাকলেও— কোনও বাঙালি রান্নার রেসিপি নেই। সত্তর বা আশির দশক পর্যন্তও অনভিজ্ঞ অনাবাসী দম্পতিদের রান্নাঘরে একটু উচ্চাশী হতে গেলে একমাত্র রাস্তা ছিল মা-মাসি-পিসিদের কাছে থেকে নীল এয়ারোগ্রামে শুক্তো থেকে ধোকার ডালনা হয়ে মেথি-মুরগি অব্দি সব রেসিপি আনিয়ে নেওয়া। লেখক ও খাদ্য-ইতিহাসবিদ চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর The Hour of the Goddess: Memories of Women, Food and Ritual in Bengal বইটিতে ষাটের দশকের শেষে আমেরিকায় তাঁর ছাত্রীজীবনের শুরুতে এইরকম পত্রযোগে ‘লং ডিস্ট্যান্স কুকিং লেসন’ নেওয়ার এক চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। এয়ারোগ্রামের বাজার গেছে, সেলিব্রিটি টেলিভিশন শেফদের কুকারি শো, ইউটিউবে হাজার-হাজার রেসিপি-ভিডিও ইত্যাদি ছাড়াও এখন আছে শয়ে-শয়ে অনাবাসী বাঙালিদের রেসিপি আদান-প্রদানের ব্লগ, যার মাধ্যমে সাইবার-দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত তৈরি হতে থাকে অগণন বাংলার মুখ।
আর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লবের সুবাদে অনাবাসী বাঙালি রসুইকরদের কাছে খুলে গেছে বৃহৎবঙ্গের ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’। বস্তুতই, আজকাল শেষ রাতে মৎস্যজীবীদের জালে ধরা পড়ে যে অতুলনীয় পদ্মার ইলিশ, তার একটা বড় অংশ বরফচাপা হয়ে সঙ্গে-সঙ্গে পাড়ি দেয় এয়ারপোর্টে, আর বাংলাদেশ ও বিলেতের মধ্যে ছ’ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানের সুযোগ নিয়ে ওই দিনই গোধূলিলগ্নে পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনের সারি-সারি দোকানগুলিতে রাজকীয় রৌপ্যচ্ছটায় আবির্ভূত হয় বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় সেই ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মৎস্য-রফতানি সংস্থা ইবকোর (IBCO) মতো হোলসেল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সুবাদে বিলেতের আনাচে-কানাচে বাঙালির রান্নাঘরে ঢুকছে ইলিশ ছাড়াও চিংড়ি-কাঁচকি-চাপিলা-কই-খলসে-পাঙাস-পাবদা-ট্যাংরা থেকে শুরু করে হাজার কিসিমের মাছ। আর বিলেতে এসে পৌঁছলে অতলান্তিকের অন্য পারে মার্কিন মুলুকে পৌঁছতে আর কতক্ষণ? তাই, হয়তো আরেকটু বাসি হল, বিক্রির আগে বা কেনার পরে আরও বেশ কিছুদিন ডিপ ফ্রিজে হিমায়িত ও নিথর ‘জীবন’ কাটাতে হল, কিন্তু ওয়ায়োমিং-এর শেইন শহরের শহরতলিতে আপনার আস্তানা হলেও কুড়মুড়ে কাঁচকি মাছ ভাজা বা চিতল মাছের মুইঠ্যা সেখানেও এখন আর তেমন অধরা নয়।
আর স্থানীয় ‘সায়েব’ মাছকে যদি কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা-সর্ষেবাটার সস্নেহ আলিঙ্গনে মুড়ে নিতে পারেন, তা হলে তো এক সৃষ্টিশীল যথেচ্ছাচারের স্বাধীনতা হাতে এসে ধরা দেয়। The Migrant’s Table: Meals and Memories in Bengali-American Households নামের একটি অসামান্য বইয়ের লেখক খাদ্য-গবেষক কৃষ্ণেন্দু রায় লিখেছেন, মার্কিন মুলুকে প্রবাসী বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের মাছ হল মাগুর বা ক্যাটফিশ, চিংড়ি, স্যামন, কার্প, শ্যাড (ইলিশের দুয়োরানি সতীন টাইপের), ট্রাউট, কড, হ্যাডক বা পোলকের মতো মৃদু স্বাদের ‘হোয়াইটফিশ’ (যা সাধারণত ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস’-এ আপনারা খেয়েছেন), অরেঞ্জ রাফি, পার্চ, স্মেল্ট (আকৃতিতে ও স্বাদে অনেকটা আমাদের কাঁকলে বা বক মাছের মতো), ব্যাস (নামান্তরে বারামুন্ডি, গোত্রে ভেটকির সমতুল), রেড স্ন্যাপার, বাটারফিশ (সোজা বাংলায় পমফ্রেট), বা ফ্লাউন্ডার। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে তেলাপিয়া, যাকে গোড়ার দিকে বাংলায় ডাকাই হত ‘অ্যামেরিকান কই’ নামে। আর রইল টুনা, যে উৎকৃষ্ট মাছের চপ বিদেশে অসংখ্য বাঙালি বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে খেয়েছি (আর এখন এখানেও প্রায়ই খাই), একবার তো খেয়েদেয়ে তিন ঘণ্টা আড্ডা মারার পরেও হেঁটে ঘরে ফেরার সময় প্রায় এক মাইল আমাদের অনুসরণ করেছিল অবিকল চেশায়ার ক্যাটের মতো দেখতে এক হুমদো সাইজের বেড়াল। টুনার ‘অর্ধভোজনে’ মার্জারসায়েবের শান্তি মিলেছিল কি না, জানা নেই।
সৃষ্টিশীল অনাবাসী বাঙালি রাঁধিয়ে আর ভোজনবিলাসীরা বিলেতে বা আমেরিকায় দিশি শাকচচ্চড়ি আর নিরামিষ তরকারির স্বাদ পাওয়ার জন্য বিভুঁইয়ের নানান গুল্মলতা-শাকপাতা ওস্তাদি কায়দায় ব্যবহার করেছেন, যেমন কলমি, পাট, নটে, পুঁই, বা লাউশাকের অভাব মেটাতে বক চয়, চাইনিজ পালং বা য়িন চয়, কেল, ব্রকোলি রেব (যার সঙ্গে ব্রকোলির কোনও সম্পর্ক নেই), কলার্ড গ্রিনস, বা সুইস চার্ড। এখন অবশ্য পুঁইশাক ব্যাপক ভাবে ফ্লোরিডায় চাষ হয়, আর উপমহাদেশীয় অথবা চিনে গ্রোসারি স্টোরে অনেক জায়গাতেই তা পাওয়া যায়। আর পালং তো আছেই। কালোজিরে বা সর্ষের সঙ্গে শুকনো লঙ্কা (ফায়ার অ্যালার্ম বাঁচিয়ে) আর রসুন-ফোড়ন দিয়ে কষালে পাপোশও সুস্বাদু হয়ে ওঠে, আর আমাদের শাকপাতার বিদেশবাসী তুতো ভাইবোনেদের তো কথাই নেই। এঁচোড় মোচার বিকল্প হিসেবে অনেকে ব্যবহার করেন আর্টিচোক বা বিন স্প্রাউট (যদিও আজকাল দেখছি আমেরিকায় টিনে আমাদের সেই অকৃত্রিম কাঁঠাল পাতার ছবি দিয়ে ‘গ্রিন জ্যাকফ্রুট’ দিব্যি পাওয়া যাচ্ছে), কচুর শাকের পরিবর্ত হিসেবে আসরে নামে অ্যাসপারাগাস। আর চিংড়িমাছ দিয়ে অথবা ভাজা মুগের ডাল আর নারকোল ছড়ানো লাউয়ের ঘণ্টের বদলে বহুবার খেয়েছি সেই সবুজ আনাজের সুস্বাদু ঘণ্ট, যার নাম বিলেতে কুর্জেৎ আর আমেরিকায় জুক্কিনি। ওই এক পটলটুকুই… থুড়ি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেই কবেই মার্কিন মুলুকে কৌটোর পটল খেয়েছিলেন, তাই একেবারে পাওয়া যায় না বলি কী করে?
দেশের খাবার খাওয়ার এবং প্রিয়জনকে খাওয়ানোর জন্য কেউ-কেউ যে অবধি যেতে পারেন তা অকল্পনীয়। বিলেতবাসী এক উদারহৃদয় ডাক্তারকে চিনি, যিনি স্ত্রীর সঙ্গে একযোগে উইকেন্ডে বাড়িতে ডেকে পঁচিশ পদ ‘খাঁটি’ বাঙালি রান্না করে খাওয়াতেনই শুধু নয়, তাঁর পাড়ার একটি স্কুলের গ্রীষ্মাবকাশে তার বিস্তৃত পার্কিং লটটি ভাড়া নিয়ে সেখানে নিজের হাতে হাজার-হাজার বড়ি দিতেন। প্যাকেটবন্দি হয়ে বিউলির ডালের সেই হিং-গন্ধী বড়ি রয়্যাল মেল সার্ভিসে পৌঁছে যেত উত্তরে স্কটিশ হাইল্যান্ড থেকে দক্ষিণে ডেভন-কর্নওয়াল পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়বন্ধুদের বাড়ি। দিশি রান্না করতে গিয়ে কালোজিরে-শুকনো লঙ্কা-ফোড়নের ঝাঁঝে একাধিকবার বেজে গেছে আমাদের বাড়ির ফায়ার অ্যালার্ম। এক বন্ধুকে দেখেছি, কয়েকবার এই অভিজ্ঞতা হওয়ার পর, এক হ্যাঁচকা টানে অ্যালার্মটি খুলে দিতে। এক অরক্ষিত জতুগৃহে বাস করার ঝুঁকি তাদের বাড়ির শাকভাজা আর মুসুরির ডালে যোগ করত এক অনির্বচনীয় স্বাদ ও গন্ধ।
তবে, স্বীকার করে নেওয়া ভাল, বিভুঁইয়ের হেঁশেলে ‘দেশ / দ্যাশ’-কে নিরন্তর রচে নেওয়া সম্ভব হয় না, ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ কল্পনার রঙিন বুদ্বুদ ফেটে বাস্তবের জমিতে ভূপতিত হতেই হয়। অনাবাসী বাঙালি, বিশেষত যাঁরা সকাল-সকাল কাজে বেরোন, তাঁদের স্ট্যান্ডার্ড ব্রেকফাস্ট দুধ-সিরিয়াল-টোস্ট-ডিম-জুসের রকমফের, আর এই ব্যাপারে অন্তত আজকের বিশ্বায়নের দুনিয়ায় কর্মরত দেশবাসী আর দেশান্তরী নাগরিক বাঙালির মধ্যে খুব তফাত নেই। অভিবাসী বাঙালির ক্ষেত্রে গত পঞ্চাশ বছরে লাঞ্চের ব্যাপারটা বদলে গেছে, তাঁরা প্রায় কেউই কর্মস্থলে টিফিন কৌটোয় লাঞ্চ বেঁধে নিয়ে যান না, বরং কিনে নেন স্যান্ডউইচ, হ্যামবার্গার, বারিতো, বা এক স্লাইস পিৎজা। মুষ্টিমেয় যাঁরা লাঞ্চ প্যাক করে বাড়ি থেকে বেরোন, তাঁদের সঙ্গে হয়তো থাকে বাড়ির ফ্রিজে রাখা ‘কোল্ড কাট’ আর চিজের স্যান্ডউইচ। ব্রেকফাস্টের জন্য রান্না করার অবসর উইকেন্ডের আগে নয়, আর সেখানেও লুচি পরোটা কড়াইশুঁটির কচুরিকে পিছনে ফেলে অনেক সময়েই এগিয়ে আসে প্যানকেক বা ওয়াফলের দাবি, বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রজন্মের অনাবাসী বাঙালির কাছ থেকে। তাই একমাত্র ডিনারই হল সেই উপলক্ষ, যেখানে দিনাবসানে সারা পরিবার— অন্তত প্রথম প্রজন্মের অনাবাসীরা— তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে ‘দেশ’-এর সঙ্গে আত্মীয়তার নিবিড় বন্ধনকে ঝালিয়ে নেবেন আবারও। তাই ‘দেশি’ মশলার গন্ধে ভুরভুর সেই ডিনারের মেনু— সাধারণত ডাল-তরকারি-মাছের বা মাংসের ঝোল, আর মাঝেমধ্যে হয়তো দ্বিতীয় প্রজন্মের পছন্দের খাতিরে বাড়তি সংযোজন পাস্তা, স্যালাড, বা রোস্ট চিকেন। ওইটুকুর মাধ্যমেই অনাবাসীরাও, অল্পক্ষণের জন্য হলেও, ঢুকে যান এক ফেলে-আসা, নিকট কিন্তু দূরায়ত, স্বদেশে, যার স্বাদ গন্ধ স্মৃতিতে হৃদয় মন্থন করে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকে আমাদের দেশপ্রেম।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র