ছোটবেলা কাটিয়ে বড় হওয়ার সময়টা নিষেধ আর বারণে টইটম্বুর থাকে। এটা খাবে না, ওটা করবে না, বাইরে বেরিয়ে কিছু চাইবে না, চাইলেও পাবে না, বায়না করবে না, মুখে-মুখে কথা বলবে না, বড়দের সঙ্গে তর্ক করবে না, ছেলে হলে মেয়েদের মতো কাঁদবে না ও বড় চুল রাখবে না, গালাগাল দেবে না এবং মেয়ে হলে আয়নার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না, সাজুনি হবে না এবং সবচেয়ে বেশি যেটা ছিল এবং বোধ হয় ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল তা হল— গুলি খেলবে না (ওটা বাজে ছেলেরা খেলে), হিন্দি সিনেমা দেখবে না আর বাপি লাহিড়ীর গান গাইবে না আর গানের সঙ্গে নাচ তো নৈব নৈব চ।
আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, সময়টা গনগনে আশির দশক। প্রথম দিকে ‘সিলসিলা’ এসে বাজার মাত করে গেছে এবং তার পরের বড় ধামাকা— ‘নমকহালাল’ সিনেমার বেশ কয়েকটি গান। সে-জোয়ার সামলাতে না সামলাতে আছড়ে পড়ল— ‘ডিস্কো ডান্সার’। এবং বিশ্বকর্মাপুজো, ক্যাসেটের দোকানের বক্স আর ভাসানের ক্ল্যারিনেটে উপচে পড়ল ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ডান্সার’ আর ‘জিমি জিমি জিমি/আজা আজা আজা’। যুবসম্প্রদায় ম্যাগিহাতা গেঞ্জি পরে ভেসে গেল মিঠুন ও বাপি লাহিড়ীর স্রোতে।
কিন্তু আমরা যারা গোবেচারা এবং মায়ের কটমট চাউনিতে বন্দি, তাদের কাছে ডিস্কো-কিং, মিঠুনদা আর হিন্দি সিনেমা অধরাই থেকে গেল। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বাপি লাহিড়ীর ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘তোফা তোফা’ কিংবা ‘তাকি ও তাকি’ বাজলে মা আমাদের দিকেই এমন কটমট করে তাকাত যেন আমিই বাপি লাহিড়ীকে বলেছি এমন গান তৈরি করে যুবসমাজকে অধঃপাতে নিয়ে যেতে। অথচ সেই সময়ও এমন উদার বাড়ি ছিল, যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের হিন্দি সিনেমা দেখার পারমিশন ছিল। এবং তারা সেই সময় ‘ডিস্কো ডান্সার’ দেখেছে এবং ক্লাসে এসে সেই গল্প, সঙ্গে সিনেমার গল্প করে আমাদের মন আরও উচাটন করে তুলছে।
আমরা তখনও বাপি লাহিড়ীকে ওই নামেই চিনি, তখন দ্বিতীয় ‘প’ যুক্ত হয়ে বাপ্পি হয়ে যাননি, অথবা বাঙালি জিভ তখনও তাঁকে ওই নামে অভিহিত করতে শুরু করেননি। এর পর বাংলায় একটা প্রায় রেকর্ড-ভাঙা হিট হল ‘অমরসঙ্গী’ সিনেমার ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ গানটি। এই গানটা একটা প্রায় উন্মাদনায় দাঁড়িয়ে গেল। পাড়ার জলসা থেকে মাচার অনুষ্ঠান, পুজোর প্যান্ডেল থেকে বিয়েবাড়ি— সব জায়গায় শুধু এই গানটাই বাজতে থাকল।
কিন্তু, হ্যাঁ, জনপ্রিয়তার সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ীর সমালোচনাও চলতে থাকল সমান তালে। বাপ্পি লাহিড়ী কত খারাপ সুর দেয়, তাঁর সুরের কোনও গভীরতা নেই, বাপ্পি লাহিড়ীর সব সুর চুরি করা (এ মহৎ কাজ তো আর কোনও শিল্পী আগে করেননি!) ইত্যাদি ইত্য়াদি। এবং শুধু তাই নয়, বাপ্পি লাহিড়ীর গান ‘লোফার’ ছেলেরা, বস্তির ছেলেরা গায়, বাজায় এবং নাচে।
অথচ বাপ্পি লাহিড়ী যখন ‘মানা হো তুম’, ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত’ কিংবা ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়’— এসব গানের সুর দিয়েছেন, তখন কিন্তু কেউ পোঁছেনি। তখন তিনি সাইডলাইনড, তখন তিনি ভাল সুরকার হিসেবে একেবারেই পরিগণিত নন বোদ্ধা মহলে। তখন তাঁর প্রশস্তি বা নিন্দা কোনওটাই কেউ শোনেননি। অথচ, সেই বাপ্পি লাহিড়ী যখন ‘তাকি ও তাকি’ কিংবা ‘ডিস্কো ডান্সার’ তৈরি করছেন তখন জনগণ উত্তাল আনন্দে আর সমালোচকরা উত্তাল নিন্দায় মুখর। সেই সমালোচনায় কিন্তু শুচিবায়ুগ্রস্ত মধ্যবিত্তও পড়ে এবং কেবল বাঙালি মধ্যবিত্ত নয়, গোটা ভারতের মধ্যবিত্ত। আসলে, বাপ্পি লাহিড়ী-মিঠুন চক্রবর্তী জুটি যেটা করতে পেরেছিল, তা হল অমিতাভ বচ্চনের লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজের থেকে ঈষৎ তফাতে ধরাছোঁয়ার মধ্যে রক্ত-মাংসের মানুষের অনুভূতির সঙ্গে, তাদের মতো করে গান, তাদের মতো করে নাচ। তাদের মধ্যে মিশে যাওয়ার একটা সংযোগ তাঁরা তৈরি করেছিলেন। আর মধ্যবিত্ত যেটা বুঝতে পারেনি, তা হল সমাজের বিভেদটা তখন থেকেই একটু-একটু মুছতে শুরু করেছিল। বিশ্বায়ন এসে সব ওলট-পালট করে দেওয়ার আগে থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল।
মধ্যবিত্ত ভাবত, শিল্প-সংস্কৃতিতে কেবল তাদেরই অধিকার আছে আর কারও নেই, বিশেষত নীচের তলার মানুষদের। সুতরাং তারাই ঠিক করে দেবে রুচি কেমন হবে, রুচিশীল কী করে হওয়া যায়। কিন্তু সময়ের বদল, হাতের কাছে সহজলভ্য উপকরণ (টেপ রেকর্ডার, সস্তার রেডিও, টেলিভিশন) আর সামাজিক অবস্থা বদলে যেতে থাকলে যে পিরামিডের তলার দিকের লোকজনও ছিটেফোঁটা করে কিছু না কিছু পেতে শুরু করে, তাদেরও মতামত তৈরি হয়, তাদের ভাল লাগা-মন্দ লাগা একটা বড় প্রেক্ষিতের জন্ম দেয়, তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। যারা এতদিন ছড়ি ঘুরিয়েছে, সিনেমা-সংস্কৃতি, গানের মানদণ্ড ঠিক করেছে, সেই পরিচিত মানদণ্ডকেই একটা শ্রেণি এসে অস্বীকার করেছিল, আর ঠিক সেই কারণেই মধ্যবিত্তের কালচার-মাপকাঠি নির্ণয়ের জায়গাটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। মাস্তানি বজায় থাকে না। রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন থাকলে তো মুশকিল! তখন রাজাকে তো তরপাতে হবেই। গল্প পড়ে টুনটুনির সঙ্গে যতই তাল মেলাক না কেন, আদতে মনোভাবটা তো রাজারই। আর সেই মনোভাবেই আঘাত হানল এই ঢিক-চিক ডিস্কো ট্রেন্ড ওরফে বাপ্পি লাহিড়ী জমানা।
সুতরাং, প্রত্যাঘাত তো করতেই হয়। শুরু হয় বাপ্পি লাহিড়ীকে আক্রমণ করা। উপহাসের মধ্যে দিয়ে, কঠোর সমালোচনা করে। বলা শুরু হল, বাপ্পি লাহিড়ী এমন নিম্নমানের গান বানায়, যে-গান মনকে ঋদ্ধ করার বদলে মন ও মস্তিষ্ককে ফোঁপড়া করে দেয়। বাপ্পির সুরের মধ্যে মনে রাখার মতো কোনও উপকরণ নেই। সাময়িক উত্তেজনা ওসব। মোদ্দা কথা, উচ্চমানের সংস্কৃতিতে বাপ্পি লাহিড়ীর স্থান নেই। তা হলে কর্তব্য? বাপ্পি লাহিড়ীর গানকে, তাঁর গলা ও গায়কীকে উপহাস করো, তাহলে বন্ধুমহলে-শিক্ষিতমহলে নম্বর বাড়বে তোমার। নিজেকে সুস্থ-সংস্কৃতির দলে ফেলতে পারবে। ছেলেমেয়েরা লোফার-কালচার থেকে বিরত থাকবে। বয়ে যাবে না। আফশোসের ব্যাপার একটাই, মধ্যবিত্ত নিজের সংস্কৃতির ভিতটাকে এতটাও শক্ত করতে পারেনি যে, তাতে খারাপ কিছু এসে পড়লেও তার প্রভাব পড়বে না। আগে ভাল করে বুঝে দেখি, খারাপ হলে তখন না হয় পরিত্যাগ করব— এ-সাহস ছিল না কারও। ভয় ছিল যে, ওই জোয়ার যদি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা হলে কুলীন-সংস্কৃতির জ্যাঠারা হেয় করবে। সুতরাং তফাতে থাক।
তবু বাপ্পি লাহিড়ী জিতে গেলেন। কেন? কারণ তিনি পরোয়া করলেন না। না পরোয়া করলেন তাঁর প্রতি বিদ্রূপের, না পরোয়া করলেন তাঁর গলা নিয়ে নিন্দুকের মন্তব্যের আর না পরোয়া করলেন তাঁর জীবনযাপনের দিকে ধেয়ে আসা বাক্যবাণের (যার মধ্যে স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে উঠেছিল সোনার প্রতি তাঁর ভালবাসা)। তিনি নিজের স্বগর্ব উপস্থিতি ঘোষণা করলেন নিজের যাপনের মধ্যে দিয়েই। আর মুশকিলটা হল সেখানেই। মানুষজন যখন দেখল যে সমালোচনা, বিদ্রূপ, উপহাস কোনওটাই তাঁকে টলাতে পারল না, তিনি নিজের মতোই থেকে গেলেন, তখন ধীরে ধীরে বাপ্পিদার আলোকবৃত্তে ঢুকে তাঁর জৌলুস বোঝার চেষ্টা করলেন। অবশ্য, আরও একটা কারণ আছে। বাপ্পিদাকে যখন মানুষজন গ্রহণ করতে শুরু করল, তখন বলিউড তাকে বর্জন করতে শুরু করেছে। হিন্দি সিনেমার জগতে তিনি আর তত পপুলার রইলেন না, অন্যান্য সুরকাররা চলে এলেন কালের নিয়মে, ঠিক যেমনটা আগের দিকপাল সুরকারদের সরিয়ে নতুন সুরকাররা জায়গা করে নিয়েছিলেন। আর তাই ‘আহারে!’ সম্বোধনে বাপ্পিদাকে কাছে টেনে নেওয়া সহজ হল হেরে যাওয়া মধ্যবিত্তের কাছে।
এখন বাপ্পি লাহিড়ীকে নিয়ে অনেক রকম প্রশস্তি হচ্ছে, তাঁর স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যেও একটু হাসির-খোরাক, একটু পাগলাটে, একটু অদ্ভুত যেন— এমন একটা মনোভাব মিশেই আছে। নিখাদ সুরকার হিসেবে আমরা বাপ্পি লাহিড়ীকে মনে রাখব কি?