ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সিনেমাপ্রাণ তনুদা


    গৌতম ঘোষ (July 16, 2022)
     

    তরুণ মজুদার গত প্রজন্মের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পরিচালক। তিনি চলে যাওয়ায় খুব ব্যথিত হয়েছি। কেবল একজন ভাল পরিচালক চলে গেছেন বলে নয়, একজন ভাল মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ, পরিশ্রমী মানুষ, বিদ্বান মানুষ চলে গেছেন; একজন বিচক্ষণ মানুষ চলে গেছেন বলে। আমরা এখন খুব বেশি বিষয়কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। যাকে বলে এক্সপার্ট। নির্দিষ্ট বৃত্তের জ্ঞানের পরিধির বাইরে অন্য বৃত্তে পা রাখতে চাই না। কিন্তু ওই প্রজন্মের মানুষজন যে-কোনও বিষয় সম্পর্কে যতটা পারতেন জেনে নিতেন, তবেই তাঁরা এতটা ঋদ্ধ হতে পারতেন এবং যে-কাজই করুন না কেন, সেই কাজের ওপর তার প্রভাব পড়তই। তনুদা সেই রকম একজন মানুষ ছিলেন। 

    নিজের কাজের প্রতি কতটা একনিষ্ঠ থাকা যায় জীবনের শেষ দিন অবধি, ওঁকে দেখে বোঝা যায়। মুক্তোর মতো হাতের লেখায় তিনি মৃত্যুর কয়েক দিন আগে পর্যন্ত নিজের বইয়ের খসড়া কিংবা চিত্রনাট্য লিখেছেন।  সিনেমা করার পরিকল্পনা করেছেন। অর্থাৎ কিনা নিজের কাজ দিয়ে নিজের জীবনটাকে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন। এমন মনের জোর ক‘জনেরই বা থাকে! একটু বয়স হতে না হতেই শারীরিক অক্ষমতা আমাদের মন দখল করে নেয়। কিন্তু তনুদা চেয়েছিলেন, জীবনের শেষদিন অবধি কাজ করে যেতে। এটা শেখার। কিন্তু কী শেখার? সিনেমা শিখতে গেলে কি এই মানসিক প্রাবল্যের প্রয়োজন হয়? না; জীবনে কী করে বাঁচতে হয়, সেটা শেখার। 

    তনুদাকে বাইরে থেকে আপাতভাবে খুব গম্ভীর স্বভাবের মনে হয়, কিন্তু উনি আদৌ তেমন মানুষ ছিলেন না। আমুদে ছিলেন, অসম্ভব রসবোধ ছিল এবং হইহই করে আড্ডা দিতে পারতেন। অথচ, বেশির ভাগ মানুষকে, বয়সে বড় হোক বা ছোট, ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। আমি কত সময় বলেছি যে, ‘তনুদা, আমি আপনার থেকে কত ছোট, আপনি কেন আমায় আপনি করে সম্বোধন করেন?’ বলেছেন, ‘ কী বলছেন, আপনি এখন নামকরা পরিচালক, আপনাকে আমি, তুমি করে কী করে বলি?’ এই সম্মানের ব্যাপারটা আর্দশগত, শিক্ষাগত; কখন যে ওঁর মধ্যে গেঁথে গেছে উনি নিজেও জানতেন না। ফলে ওটাই ছিল তাঁর স্বাভাবিক আচরণ। একটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের বাড়িতে সোনা বা সোনার গয়না নিয়ে আদিখ্যেতা নেই। আমার স্ত্রীর-ও এ-ব্যাপারে কোনও বাড়াবাড়ি কখনওই নেই। একবার আড্ডা দিতে দিতে আমি বলেছি, ‘আরে আমি কখনও পরি না, কিন্তু একটা সোনার আংটি কিছুক্ষণের জন্য পরে আমার আঙুলে ব়্যাশ বেরিয়েছে।’ শুনে তনুদা বললেন, ‘আরে! আপনি তো রামকৃষ্ণ মশাই!’ ব্যস! ওইটুকুই। কী যে সেন্স অফ হিউমার ছিল! অবশ্য সে-কথা আমরা ওঁর চিত্রনাট্য থেকেই বুঝতে পারি। 

    চিত্রনাট্যের কথা উঠলে অবশ্যই ছবির কথা উঠবে। তনুদা ছিলেন আদ্যন্ত একজন সিনেমা-পাগল বাঙালি। বাঙালি দর্শকের জন্য, বাঙালিয়ানার জন্য, বাঙালিদের জন্য সিনেমা বানানো লোক। তিনি বরাবর বাণিজ্যিক ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু তাতে যে কী মাধুরী ধরা রয়েছে, তা অনুভব করতে হয়; ভাষায় ঠিক বোঝা যায় না। তার মানে কি, তাঁর সব ছবিই মিষ্টি প্রেমের গল্প? একেবারেই নয়। ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘কাঁচের স্বর্গ’— কত অন্যরকম ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু কোথাও মনে হয়নি, এই সিনেমাটার মধ্যে বাঙালিয়ানা মিশে নেই। ‘নিমন্ত্রণ’ ছবিটা আমি যখনই দেখি, তখনই মনে হয়, এমন বিষণ্ণ ছবি তনুদা বানিয়েছেন! কী বিষণ্ণতা ছবিটা জুড়ে! মনটা ভারী হয়ে থাকে। আবার, সেই মানুষটাই ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’র মতো ছবি বানিয়েছেন। তার মানে তাঁর বিস্তার কতটা ব্যাপক ছিল, তা ভাববার মতো। অথচ কোথাও কোনও দেখানেপনা নেই। তিনি যখন যাত্রিক গোষ্ঠীর হয়ে সিনেমা করেছেন, অর্থাৎ প্রথম ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’ থেকেই কিন্তু বেশির ভাগ ছবি হিট। ‘কাঁচের স্বর্গ’ তো পুরস্কারও পেয়েছিল। ফলে, হিট ছবি বানালে, বাণিজ্যিক ছবি বানালেই তা ভাল নয়, এসব বহু-ব্যবহৃত কথাবার্তা, তাঁর কাজের কাছে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছিল। তরুণ মজুমদার সবসময়ই সাহিত্যধর্মী ছবি করতে ভালবাসতেন বা করতেন। তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের অমন জটিল উপন্যাস ‘গণদেবতা’কে কীভাবে সিনেমার ভাষায়  অনবদ্য করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেটা দেখলেই তাঁর মুন্সিয়ানা বোঝা যায়।

    তনুদা ছিলেন আদ্যন্ত একজন সিনেমা-পাগল বাঙালি। বাঙালি দর্শকের জন্য, বাঙালিয়ানার জন্য, বাঙালিদের জন্য সিনেমা বানানো লোক। তিনি বরাবর বাণিজ্যিক ছবি বানিয়েছেন। কিন্তু তাতে যে কী মাধুরী ধরা রয়েছে, তা অনুভব করতে হয়; ভাষায় ঠিক বোঝা যায় না।  

    তনুদা যখন সিনেমা করছিলেন, তাঁর সমসাময়িক পরিচালকদের কথা একবার ভাবুন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা। যাঁদের ছবি ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয়। কিন্তু তনুদার এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। উনি কোনওদিন উদ্য়োগ নিয়ে নিজের ছবি ফেস্টিভ্যালে পাঠাবার কথা ভাবেননি। নিজের মতো করে সিনেমা করে তৃপ্ত ছিলেন। ওঁর কাছে মানদণ্ড ছিল দর্শক। দর্শকের পছন্দ হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে খুব ভাবতেন। ওঁর বেশির ভাগ ছবি মিনার-বিজলী-ছবিঘর, এই চেনে রিলিজ করত। উনি সিনেমাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞেস করতেন। তখন তো পরিচালকদের এত ছবি বেরোত না! ফলে অনেকেই তাঁর মুখ চিনতেন না। তাঁরা নিজেদের সৎ প্রতিক্রিয়া তনুদাকে জানাতেন এবং তনুদাও সে-কথা মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করতেন, কেন দর্শকের এই প্রতিক্রিয়া হল। তনুদার যেটা সবচেয়ে বড় গুণ, উনি নিজের ছবিটা জানতেন, কী করতে চান, কেন করতে চান, বা অন্য রকম করতে চান না কেন— এই ধারণাটা ওঁর কাছে খুব পরিষ্কার ছিল। এবং সেইজন্যই নিজের কাজটা এতটা দক্ষতার সঙ্গে করে যেতে পেরেছেন। 

    তনুদার ছবির জন্য বাঙালি দর্শক কত যে ভাল-ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রীকে পেয়েছেন, সে কথা আর নতুন করে কী বলার আছে! সন্ধ্যা রায় থেকে শুরু করে দেবশ্রী রায়, সবাইকে বাঙালির কাছে আপন করে তো তনুদাই তুলেছেন। আরও একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন রুমা গুহঠাকুরতা। তনুদা, রুমাদিকে এক-একটি ছবিতে এক-এক রকম ভাবে ব্যবহার করেছেন। কোনও  চরিত্রকে গভীর ভাবে জানা এবং সেজন্য কোন চরিত্রাভিনেতা মানানসই হবে, এটা ওঁর কাছে খুব পরিষ্কার এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওঁর ‘সংসার সীমান্তে’ ছবিতে সন্তু মুখোপাধ্য়ায়কে দিয়ে উনি কী অসাধারণ একটা চরিত্র করিয়েছিলেন। আমার মনে আছে, আমি যখন ‘দেখা’ ছবির জন্য দেবশ্রী রায়কে নিয়েছিলাম, তনুদা বলেছিলেন, ‘ওর স্কিন খুব সফ্‌ট, ওর স্কিনে খুব মেক-আপ লাগে না। আপনি ক্যামেরাম্যান মানুষ, আরওই ভাল বুঝবেন।’ সিনেমার সঙ্গেই উনি এমনই ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন যে, সিনেমাই ওর সত্তা হয়ে উঠেছিল। অথচ ওঁর মতো পরিচালকের সিনেমা সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ওঁর সিনেমাগুলো যদি আমরা সংরক্ষণ করতে পারি, সেটাই হবে ওঁর প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য।

    ছবি সৌজন্যে: সন্দীপ কুমার

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook