ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫১


    বিমল মিত্র (February 25, 2022)
     

    পর্ব ৫০

    বার্লিনে যখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি নিয়ে গুরু যায়, তখন যে-কটা স্লিপিং পিল নিয়ে গিয়েছিল, তা কাজে লেগেছে। সেখান থেকে লন্ডনে গিয়ে ডাঃ প্যাটেলের বাড়িতে উঠেছিল। ডাঃ প্যাটেল হচ্ছে সতীশ ভাটনগরের শ্বশুর। ডাঃ প্যাটেলের মেয়ে শিরিনকে বিয়ে করেছিল সতীশ ভাটনগর তখন বোম্বাইতে।

    গুরু যখনই লন্ডনে যেত তখন তার ভাই আত্মারামের কাছে গিয়ে উঠত। আত্মারাম তখন বার্মা-শেল কোম্পানির ডকুমেন্টারি ফিল্মের ডাইরেক্টর। আত্মার বন্ধু সতীশ। সতীশ ভাটনগর। গুরু লন্ডনে গিয়ে ভাটনগরের সঙ্গে আড্ডা দেয়। খুব খানদানি মানুষ সতীশ। সতীশ আর স্ত্রী শিরিন। একদিন সতীশ বললে— সে লন্ডনে আর থাকতে চায় না, ইন্ডিয়ায় ফিরে যেতে চায়—

    গুরু বললে— বেশ তো, আমার কোম্পানিতে গিয়ে চাকরি করো। কাজ স্ক্রিপ্ট লেখা। হিন্দি স্ক্রিপ্ট। সেই সূত্রে শিরিনদের বাড়িতে গিয়ে শিরিনের বাবার সঙ্গেও পরিচয় হল। খুব অমায়িক মানুষ ডাঃ প্যাটেল। লন্ডনেই প্র্যাক্টিস করেন। স্ত্রী ছিল ইংরেজ। সেই স্ত্রী তখন মারা গেছে।

    গুরু ফেস্টিভ্যাল থেকে ফেরার পথে ডাঃ প্যাটেলের বাড়িতে গিয়ে উঠল। গুরুর কাছে ডাঃ প্যাটেলের অবারিত দ্বার। গুরু উঠল সেখানে। বেশ আরাম সেখানে। আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি নেই। যতদিন ইচ্ছে থাকো, খাও, দাও, ঘুমোও, আমার আপত্তি নেই।
    কিন্তু প্রথম রাত্রে ঘুম এল না। গুরুর মনে হল পরের রাত্রে ঠিক ঘুম আসবে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে রাত্রে বিছানায় শুতে গেল। একটুও ঘুম নেই। আটচল্লিশ ঘন্টা বিনিদ্র। তার পরের রাতেও তাই। শেষকালে মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল। আগুন বললে কম বলা হবে। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘দাবদাহ’।

    গুরু বললে— আমার মনে হল আমি পাগল হয়ে যাব।

    কিন্তু তখন আর কি-বা উপায়। অত ঠান্ডার দেশ লন্ডন তখন গুরুর কাছে আফ্রিকাতে পরিণত হয়েছে। শেষকালে যখন মাথা ঘুরছে, পা টলছে, তখন কেঁদে গিয়ে পড়ল ডাঃ প্যাটেলের কাছে। গিয়ে বললে—ডাক্তার, আমার স্লিপিং-পিল খাওয়ার নেশা আছে, আপনি যে-কোনও রকমে আমাকে স্লিপিং-পিল জোগাড় করে দিন, নইলে আমি মরে যাব—
    ডাঃ প্যাটেল হাসলেন। বললেন— এতে তোমার লজ্জা করবার কি আছে, স্লিপিং-পিল তো মডার্ন পৃথিবীতে সবাই খায়। আমি তোমাকে এখুনি জোগাড় করে দিচ্ছি—

    সেই পিল কটা তখনই মুখে পুরে এক গ্লাস জল খেয়ে ফেলে গুরু। তারপর সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ঘরের বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। আর কখন যে ঘুম এসে গেছে ঠিক নেই।

    বললাম— তারপর?

    গুরু বললে— তারপর তিন দিন, তিন রাত আমি আর উঠিনি বিছানা ছেড়ে। কোথা দিয়ে সূর্য উঠেছে, কোথা দিয়ে সূর্য ডুবেছে, তাও টের পাইনি। আকটানা বাহাত্তর ঘন্টা ঘুমিয়ে আমি তবে আবার সুস্থ হয়ে উঠলাম।

    বললাম— আপনার ঘুম হয় নাই বা কেন?

    গুরু হাসতে লাগল। বললে—ও-কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। জিজ্ঞেস করুন আধুনিক সভ্যতাকে। সে হয়তো সঠিক জবাব দিতে পারবে, আর কেউ পারবে না এর উত্তর দিতে—

    হয়তো গুরুর কথাই সত্যি! বর্তমান সভ্যতাকেই হয়তো দায়ী করা উচিত অনিদ্রার জন্যে। আরো খ্যাতি, আরো টাকা, আরোও রিস্ক, আরও প্রতিযোগিতা, আরো প্রতিষ্ঠা চাই। চব্বিশ ঘন্টার দিন হয়। যেন তাতেও কুলোয় না আমাদের, আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘন্টায় দিন হলেও যেন কুলোত না আমাদের। আমরা সব পেয়েও অতৃপ্ত! সব ভোগ করেও অসুখী। এক-এক সময়ে মনে হয় অতকাল আগে ভারতবর্ষের মুনি-ঋষিরা বোধহয় আজকের কথা ভেবেই লিখেছিলেন—ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। ত্যাগ করে তারপর ভোগ করো। সুখে বিগতস্পৃহ থাকো, দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা হও।

    কিন্তু এও বোধহয় আর সম্ভব নয়। আমরা অনিদ্রায় ভুগব আর স্লিপিং পিল খাবো, এই-ই আমাদের অবধারিত নিয়তি। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি আমি এ-সব ব্যাপার নিয়ে যত ভাবতুম, এখন ও-নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি। ঠিক করে নিয়েছি ওই সব সঙ্গে নিয়েই জীবন চালিয়ে নিতে হবে? ওর থেকে আর আমার মুক্তি নেই—

    হয়তো গুরুর কথাই সত্যি! বর্তমান সভ্যতাকেই হয়তো দায়ী করা উচিত অনিদ্রার জন্যে। আরো খ্যাতি, আরো টাকা, আরোও রিস্ক, আরও প্রতিযোগিতা, আরো প্রতিষ্ঠা চাই। চব্বিশ ঘন্টার দিন হয়। যেন তাতেও কুলোয় না আমাদের, আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘন্টায় দিন হলেও যেন কুলোত না আমাদের। আমরা সব পেয়েও অতৃপ্ত! সব ভোগ করেও অসুখী। এক-এক সময়ে মনে হয় অতকাল আগে ভারতবর্ষের মুনি-ঋষিরা বোধহয় আজকের কথা ভেবেই লিখেছিলেন—ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। ত্যাগ করে তারপর ভোগ করো।


    সেইজন্যেই বোধহয় গুরু অত বেপরোয়া হতে পেরেছিল, সেই জন্যেই বোধহয় গুরু মাত্রা অতিক্রম করে মদ খেত! রাতের পর রাত আড্ডা দিয়ে কাটাতো, লাখ-লাখ টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারত। আর সেই জন্যেই গুরুকে আমার অত বেশি ভালো লাগত।
    যেমন বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র। একদিন কে যেন বলেছিলেন— বলছ কি হে? বখে যাওয়া কি অত সহজ? সংসারে বুদ্ধদেবের মতো রাজ্য ছেড়ে অরণ্যে যাওয়াও যেমন শক্ত, লজ্জা-সঙ্কোচ ট্যাগ করে বখে যাওয়াও ঠিক তেমনি শক্ত। কিন্তু সংসারে বাস করে পুরোপুরি নিরাসক্ত হওয়াও সহজ নয়, তাই মাঝে মাঝে ইনকামট্যাক্স নিয়ে, উকিল-অ্যাটর্নি নিয়ে বিব্রতও হত খুব।

    একদিন সেই ইনকামট্যাক্সের উকিল মিস্টার গোলে সেই কারণেই এলেন মহাবলীপুরম্-এ। গুরুর টাকা-কড়ি, আয়-ব্যয়ের হিসেব তদারক করতে। গুরুর মাদ্রাজের ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনের কথাবার্তা বলতে। আমি কিন্তু তখন খুব বিব্রত হয়ে পড়লাম। ‘একক দশক শতকে’র শেষ কিস্তি তখন পাঠাতে হবে ‘ঘরোয়া’র জন্য। শেষটাই তো গল্পের আসল।

    গুরুকে বললাম— আমি এবার আমার উপন্যাসের শেষটা লিখে তারপর আপনারটা লিখব—
    গুরু বললে— কদিন লাগবে লিখতে?

    বললাম— দুদিন—

    গুরু বললে— লিখুন, ততক্ষণে আমি মিস্টার গোলের সঙ্গে আমার ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করে ফেলি—

    ওই ইনকাম ট্যাক্সই ছিল গুরুর একটা জ্বালা। যখন গল্পের কথা ভাবছে, ছবির কথা ভাবছে, হঠাৎ তখন ইনকাম ট্যাক্সের চিঠি এলে বড় বিরক্ত হতে হত। তার সমস্ত স্বপ্ন-কল্পনা ভেঙে ছত্রাখান হয়ে পড়ত। একবার তেষট্টি সালে আমি যথারীতি গিয়েছি। কদিন ধরে গল্প নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছে, হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা গুরু বললে— আজ রাত্রে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে—

    আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, বললাম— কিসের কষ্ট?

    গুরু বললে— আপনাকে একটু একলা থাকতে হবে আজ—

    আমি তো অবাক। একলা থাকা আবার কষ্টকর নাকি? চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বেশিক্ষণই তো লিখতে-পড়তে হয়। লেখা-পড়ার কাজটা এমনই যে একলা না থাকলে করা যায় না।

    বললাম— একলা থাকতে আমার কষ্ট নেই, আমার জন্যে কাজের ক্ষতি করবেন না। আমার জন্যে আপনার ক্ষতি হলে বরং আমিই কষ্ট পাব—

    গুরু বললে— না, আজকে সন্ধেবেলা মিস্টার গোলের কাছে একবার যেতে হবে, ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে—

    মনে আছে গুরু সন্ধেবেলা আমাকে বাড়িতে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল। দু-ঘন্টা পরে যখন ফিরল তখন মুখটা গম্ভীর-গম্ভীর। বাড়িতে ফিরে সোজা আমার ঘরে এল। বললে— জানেন, উকিল-অ্যাটর্নিতেই আমাকে খেয়ে ফেলবে। আসছে মার্চের মধ্যে কোম্পানির তরফ থেকে তিন লাখ, আর আমার তরফ থেকে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে এরা সবাই মিলে—

    যা হোক, সেই মিস্টার গোলে এলেন মহাবলীপুরম্-এ। তাঁকে নিয়ে গুরু সমস্ত দিন স্টুডিওতে ব্যস্ত রইল। আর সেই ফাঁকে আমি আমার ‘একক দশক শতক’-এর শেষ কিস্তিটা লিখতে লাগলাম। কিন্তু একদিনে সবটা লেখা সম্ভব হল না। পরের দিনটা সময় পেলেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই মিস্টার গোলে গল্প করতে লাগলেন। আসরে আমাকেও থাকতে হল। দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে পোস্ট না করলে সে-সপ্তাহের ‘ঘরোয়া’তে বেরোবে না। আমি হাঁক-পাঁক করছি। গুরুরও সেদিন শুটিং বন্ধ। বেলা নটার সময় মিস্টার গোলে কাজ-কর্ম সেরে চলে গেলেন। পড়ে রইলুম আমি আর
    গুরু।

    গুরু বললে— আপনার লেখা হয়ে গেছে?

    বললাম— আর দুটো পাতা লিখলেই উপন্যাসটা শেষ হয়ে যাবে—

    –তাহলে লিখে নিন। আমি বসে আছি—

    সামনে একজন উদ্গ্রীব হয়ে বসে আছে কখন আমার লেখা শেষ হবে? অমন করলে কি লেখা ভালো হয়?

    আমি লিখতে লাগলাম। কিন্তু মনে তৃপ্তি হচ্ছে না।

    গুরু অধৈর্য হয়ে উঠছে। একলা থাকা তার কোষ্ঠিতে নেই। একটা বই নিয়ে পড়ছে আর আমার দিকে চেয়ে বলছে— হল?

    শেষ পর্যন্ত যখন ঘড়িতে বারোটা বাজে তখন লেখা শেষ হল। ‘একক দশক শতকে’র লেখা শেষ পরিচ্ছেদ। মনটা খুঁত-খুঁত করতে লাগল। যেন ঠিক মনের মতো হল না। তবু খামে এঁটে পোস্টাফিসে পাঠালাম ‘ঘরোয়া’র ঠিকানায়।

    গুরু এতক্ষণে কাছে এল। এবার গল্প করতে পেরে সে যেন বাঁচবে।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook