এককথায় বলতে গেলে বিরজু মহারাজ সত্যিই মহারাজ। প্রতিভার দিক থেকে, শিল্প শৈলীর দিক থেকে, সঙ্গীতের দিক থেকে তো বটেই, এমনকী রসবোধের দিক থেকেও তাঁর মেজাজ মহারাজার মতোই। ক্ষমতার পাল্লায় পড়ে ক্রোধের প্রকাশ করে যাঁরা মহারাজ খেতাব চিনিয়ে নেন, বিরজু মহারাজ তার থেকে অন্য মেরুতে অবস্থান করতেন। তিনি সত্যিকারের রাজা। জ্ঞানী, গুণী, বিনয়ী, রুচিশীল, পূর্ণ আত্মনিয়োগে বিশ্বাসী, শিক্ষায় আগ্রহী, শিক্ষাদানে ব্রতী।
এমন এক জন মানুষকে সম্পূর্ণ মানুষ বলা চলে। অবশ্য কেবল সম্পূর্ণ মানুষ বললে কম বলা হয়, সম্পূর্ণ সঙ্গীতজ্ঞ। মহারাজজী যেমন গাইতে পারতেন, তেমন তবলা বাজাতে পারতেন আর নাচের কথা তো ছেড়েই দিলাম। যখন গান শুনেছি মহারাজজীর গলায়, তখন মনে হয়েছে উনি কেন গান গাইলেন না? যখন তবলা বাজিয়েছেন, তখন মনে হয়েছে আহা! উনি তালবাদ্যের দুনিয়ায় তো থাকলে পারতেন। আমি পণ্ডিত রবিশঙ্করজীর কাছে শুনেছি, তিনি দিল্লতে লোদী রোডের বাড়িতে যখন থাকতেন, তখন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ প্রায়শই আসতেন পণ্ডিতজীর রেওয়াজের সঙ্গে সঙ্গত করতে। ভাবা যায়! এমন অনায়াস যাতায়াত এক শিল্প থেকে অন্য শিল্পে। শুনেছি আমজাদ আলী খাঁ সাহেবের সঙ্গেও নাকি মহারাজজী বাজিয়েছেন। পুরনো অনেক ইউটিউব ভিডিও ঘাঁটলে দেখা যায় যে মহারাজজী তবলা বাজাচ্ছেন কিংবা গান গাইছেন।
মহারাজজীর মধ্যে আশ্চর্য গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল। নতুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল। মহারাজজী কিন্তু বলিউডেও কোরিওগ্রাফি করেছেন। সে জন্য ফিল্মি পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু সেই পুরস্কার বা বলিউডের নাচকে তিনি কখনও ছোট করে দেখেননি। মনে করেছেন এটাও এক ধরনের শিল্প, প্রকাশের ভঙ্গিমা।
আর এই রকম একজন জ্যোতির্ময় পুরুষকে জীবন্ত করে তুলেছিল তাঁর রসবোধ। আমায় তো লোকজন চেনে বিশ্ব-ফিচেল বলেই। আমি ওঁর সামনেই ওঁকে ভেঙিয়ে নেচেছি আর উনি হোহো করে হেসে উঠেছেন। সে হাসির মধ্যে একটা প্রশ্রয় ছিল। যে প্রশ্রয় আরও উন্নততর সঙ্গীতসাধনার প্রতি আকৃষ্ট করে মানুষকে। জীবনকে উপভোগ করতে পারতেন তার সব রকম উপাদানের মধ্যে দিয়ে। কোনও বাঁধাগতে না রেখে মনকে, শিল্পকে অনেক বড় বৃত্তে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এবং সেই কারণেই তাঁর শিল্প ছিল এতটা প্রসারিত। এমন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, এমন ব্যক্তিত্ব এখন বিরলও নয় বোধহয়, অমিল। সত্যিই ধরাছোঁয়ার বাইরে।