মাস্কে ফোড়া গজাবে
কারণ মুখে টানা লেপটে থাকতে-থাকতে মাস্ক ভাববে, সে মুখেরই অংশ। কেনই বা ভাববে না? ক’দিন পরেই লোকে অফিস যাবে না, কারণ মাস্ক কনকন করছিল, বা টনটন, বা শিরশির। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের গাদা-গাদা ব্রণ গজাবে মাস্কে, এবং এই মানবেতিহাসে প্রথম, কান থেকে সুতো ছিঁড়ে একটি জিনিস টান মেরে ফেলে দিলেই গুচ্ছের ব্রণদাগ নিমেষে হাপিস। আবার উল্টোও হবে, ছেলে কলেজ যাওয়ার কালে হাঁকবে, মা! আমার ব্রণভরা মাস্কটা ফেলে দিয়েছ না কি! ওর ইউনিক ডিজাইনে স্টার্ট-আপের অফার পেয়েছিলাম! ইংলিশ ম্যাডাম অবধি বলেছেন, ওয়াও, ইউ ওন ইয়োর ব্লেমিশেস! মা: ধুর, দেখে তো ওয়াক আসছিল। ছেলে: ওয়াক নয়, woke।
চোর-পকেটমার সংগঠন বিদ্রোহ করবে
এমন অদ্ভুত যুগ, সব্বাই সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে, এবং রাত্রে বরং দিনের চেয়ে বেশি জাগে, কারণ ওটিটি-র থ্রিলার দেখতে দেখতে চক্ষু ভাঁটা। তাহলে চোর সিঁদ কাটবে কেমনে? পকেটমারই বা যাবে কোথায়, বাসে-ট্রামে তো দমঠাস ভিড়ের জায়গাই নেই, প্রত্যেকে সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনে টিপটপ বসে আছে। যদি বা উৎসব-টুৎসবে হইহই করে লোকে বেরিয়ে পড়ে, টিভিতে তাদের তক্ষুনি এমন খরখরে গাল দেওয়া হয়, বা থার্ড কি ফোর্থ ওয়েভ এসে এমন ঝাপড়া মারে, সব মিইয়ে পুনর্মূষিক। ফলে চোর ও পকেটমারের সংগঠন সরকারি সাহায্য চাইবে এবং সরকার তা দিতে অস্বীকার করলে (সে-ই বা কী করে অফিশিয়ালি বলে ‘বুকে আয় ধর্মভাই’), পথ অবরোধ করে হাঁকবে, হেল্প করুন, নইলে গ্যাঁড়ানো মানিব্যাগ থেকে জমিয়ে রাখা প্রেমপত্র ফেসবুকে আপলোড।
লোকে মোবাইলে ঢুকে পড়বে
ঝুঁকে স্ক্রিন গিলতে-গিলতে এক সময় টাল সামলাতে না পেরে গপাস করে ফোনের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে, তখন ওয়েব-সিরিজ বা সিরিয়াল বা সিনেমা বা রিয়েলিটি শো (যেটা সে দেখছিল) এক মুহূর্তের জন্য ‘ইইকস!’ শব্দে থেমে যাবে, কারণ নট-নটীরা ‘এ আবার কে রে!’ মর্মে আঁতকে আকুল, কিন্তু তারপরেই পেশাদারি নির্বিকারতায় তারা এটাকে দুরন্ত রসিকতা বা প্রযোজকের সারপ্রাইজ বাতলে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। লোকটা দিনের পর দিন ঘুরে-ঘুরে বেড়াবে এ-সিন থেকে ও-সিন, কোথাও মার খাবে কোথাও খ্যাঁকানি, প্রতিভা (বা রূপ) থাকলে সাইড-ক্যারেক্টারের রোলও করতে পারে ক’হপ্তা, কিন্তু সহস্র লম্ফেও নিজ-সোফায় ব্যাক করতে পারবে না। পরিবারের লোকেরা আচমকা একদিন সিরিয়ালে দেখতে পেয়ে ফের খোঁজ লাগাবে, কিন্তু তার নাম তো এন্ড ক্রেডিটেও নেই, ই.পি.-র খাতাতেও না। এক যদি বাড়ির ছোট্ট বাচ্চাটি বুদ্ধি করে মোবাইল স্ক্রিন থেকে তাকে ‘আরে, মেসো!’ (বা ‘আই আই মাম্মাম!’) চেঁচিয়ে তুরন্ত খর-নখে খুঁটে নেয় (কারণ ওদের বুদ্ধি বাস্তব-বাঁধা নয়), তবে মুক্তি।
গ্রিক অক্ষরে কুলোবে না
আগে যে ভাইরাসকে স্রেফ করোনা বলে ডাকা হচ্ছিল, তার বিভিন্ন পরিবর্তিত রূপ দেখে কোনওটাকে ডেলটা, কোনওটাকে ওমাইক্রন নাম দিতে দিতে গ্রিক অক্ষর ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, চট করে বোঝা যায়নি। বছরের মাঝামাঝি থেকে এত রকম ভেরিয়্যান্ট বেরোতে আরম্ভ করবে (কোনওটায় এক্সট্রা কাঁটা, কোনওটার ঝুঁটি বাঁধা, কোনওটার লুটোনো কান, কোনওটার বাঁ-দিকে টান), তাদের গায়ে উপসাইলন ফাই সিগমা টাও ওমেগা নয়া-লেবেল সাঁটতে-সাঁটতে, আবার এক-একটায় দুটো বা তিনটে ভাইরাস-মাকড়ের বৈশিষ্ট্যের বিবাহ লক্ষ করে (শুঁড়ে কাঁটা, ল্যাজে ঝুঁটি, মুখের জায়গায় সরলপুঁটি) থিটাসাইলন, ডেলমাইক্রন, ইটা-আয়োটা, সিগা-মেগা-কেয়া-হোগা জোড়কলম তৈরি করতে-করতে ক্লান্ত স্বাস্থ্যসংস্থা ওরেবাবাগো আর্তনাদে বিশ্ব ভাষা সমিতির কাছে আকুল সাহায্য চাইবে। তারা বলবে ‘বিশ্বের মিষ্টিতম ভাষা’ বাংলা-র শরণ নিতে। এবং তেএঁটে ভেরিয়্যান্টের নাম ‘ক্ষ’, বা দশাসই ভেরিয়্যান্টের নাম ‘ঢ়’ (এবং একেবারে কালান্তকটির নাম, স্বাভাবিক ভাবেই ‘চন্দ্রবিন্দু’) হওয়ায় বাঙালি সগর্বে নেত্য ও বাদ্য সহ মিছিল বার করবে, তাতে আদ্ধেকেরই মাস্ক থাকবে না, এবং বহু লোকের গ্যাদাড়ে ‘ক্ষ’ বা ‘হ্ম’ হবে, কিন্তু কিচ্ছু এসে যায় না, কারণ মূল মজাটা ঘটবে সাহেবরা এগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে অক্কা পাওয়ায় (কোভিডের কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ)।
গুপ্তধনের সূত্র ছড়াবে
২৩৬৫টা ওয়েব সিরিজ আর ১৬৯টা সিনেমায় ছোট্ট-ছোট্ট দু’লাইনের ছড়ায় গুপ্তধনের ক্লু দেখতে-দেখতে বাঙালি টি-শার্টে গ্রিটিংস-কার্ডে হোয়াটসঅ্যাপে আড্ডায় পরস্পরকে মিনি-হেঁয়ালি পরিবেশন করতে শুরু করবে। এই ফ্যাশন ভয়ানক ইন বলে বাংলা ব্যান্ডের হিট গান গজাবে ‘খুঁজব টাকা ধুমধড়াকা’, মদন মিত্র ট্রেজার-হান্টিং নিয়ে মিউজিক ভিডিও বানাবেন, শোভন-বৈশাখী এগুলোর মেডলের সঙ্গে নেচে বাজার মাত করবেন, কিন্তু আসল চক্কর বাধবে, যখন হাজারটা ক্লু-র মধ্যে এক-আধটা খটাং খেটে যাবে। টিউকলের পাশে তিনহাত গত্ত খুঁড়ে কেউ পাবে ছ’কপি চুটকির বই, কেউ ঠাকুরঘরের বেদি থেকে হেঁচড়ে বের করবে হাতির দাঁতের চিরুনি। তখন সব সূত্রেরই রইরই পুনর্তদন্ত শুরু হয়ে যাবে, কানাগলিতে দলে-দলে লোক কোদাল নিয়ে নেমে পড়ছে, বাড়ির ছাদে খন্তা নিয়ে ঢুকে পড়ছে, চিলেকোঠায় কাপড় ছাড়তে গিয়ে ছোটপিসি সহসা সার্চলাইটে, হুলুস্থুলু। অশ্লীলতা, না কি ছোটপিসিই ট্রেজার?
স্কুলে এ ওকে মিউট করবে
স্কুল খুললে বাচ্চারা যাবে বটে হইহই করে, তারপর অবিলম্বে ঝগড়া করবে পাশের বন্ধুর সঙ্গে (কারণ অ্যাদ্দিন পাশে মানুষ দেখার বা তার কনুইয়ের ঠেলা খাওয়ার অভ্যেস নেই), তারপর তার চ্যাঁচানি সহ্য না করতে পেরে তাকে মিউট করার চেষ্টা করবে, হচ্ছে না দেখে চেঁচিয়ে মা’কে ডাকবে, কিন্তু চমকে দেখবে পাশে খাটও নেই, মা’ও না, তখন নিজের ভিডিও অফ করার জন্য ঝাঁপাবে, কিন্তু টেবিলে চেয়ার প্রাণপণ ক্লিকালেও তা কিছুতে হচ্ছে না দেখে খুব ঘাবড়ে যাবে, যেন পৃথিবী আচমকা উদ্ভট অক্ষে বনবনাচ্ছে, শেষে মিটিং লিভ করে পালাতে দিয়ে দেখবে ম্যাম কটমটিয়ে তাকিয়ে, এবং তিনি একটি ছোট্ট চৌকোয় আবদ্ধ নন, বেশ বড়সড় এবং ভয়ানক। তখন বাচ্চা ভ্যাঁ দেবে এবং বলবে ‘দাও ফিরে সে অনলাইন’ কিন্তু হায়, দাঁত থাকতে দাঁতের এবং একলষেঁড়ে আশ্রয় থাকতে তার মর্ম বোঝা যায় না।
ভিখিরিরা বিটকয়েন চাইবে
ছোট কয়েন প্রত্যাখ্যান বহুদিন ধরেই ফ্যাশনে ছিল, এবার কলকাতার ভিখিরিরা জ্যামে-আটকা ট্যাক্সি ও গাড়িতে হাত বাড়িয়ে বিটকয়েন চাইবে। আদ্ধেকেই বুঝবেন না, জিনিসটা কী এবং কীভাবে দিতে হয়। যারা ডিজিটাল ঘাঁতঘোঁতে বেশ দড়, তারাও ভিখিরির কাছে তার ই-ওয়ালেটে ঢোকার রহস্য-নম্বর চাইতে-চাইতেই জ্যাম কেটে যাবে এবং গাড়ি ভোঁ। এদিকে ক্রমে ট্রেনে-বাসে-রাস্তায় গান গেয়ে বিলাপ করে নাকিসুরে আর্তনাদ বাগিয়ে ভিখিরিদের একই চাহিদা: বিট-বিট-বিট-কয়েন। কেউ বলবে এ সমষ্টিগত ছিট, কেউ বলবে জনগণকে ঢিট করার নয়া পন্থা, কেউ বলবে পুঁজিবাদী সামাজিক গিঁট। শেষে বোঝা যাবে, এ ছিল এক ক্রিপ্টো-কারেন্সি সংস্থার বিজ্ঞাপন, শহরের সমস্ত ভিখিরিকে তাতে শামিল করা এক আশ্চর্য পরিকল্পনা ও প্রয়োগ, যা ‘থ্রিপেনি অপেরা মডেল’ হিসেবে বিশ্বখ্যাত হবে, সেই সংস্থার জয়জয়কার তো ঘটবেই, তবে ভিখিরিদের প্রতিশ্রুত পয়সা ঠেকানো হয়নি বলে একটা রটনাও চলবে পাশাপাশি, কিন্তু সে তো বাধ্যতামূলক ব্রণ।
মিম ও ভোট বাড়বে
বারবার লকডাউনে মানুষের দিন আর কাটতে চাইছে না বলে অনেকগুলো নতুন গণভোটের টপিক তৈরি করা হবে, যেমন শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে, নর্দমাকে নালা বলা উচিত কি না, সদর দরজায় হাতি আঁকা উচিত না সিংহ, উড়ালপুলের তলায় গাড়ি থাকবে না গরিব, দামড়া বাঙালি পুরুষ হাফপ্যান্ট পরবে না পাজামা। ভোট হবে অনলাইনে, তার আগে মাসখানেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা সকাল-সন্ধে মাথা-ফাটাফাটি করবেন ইন্টারভিউ দেবেন, পাবলিকও ফুটকড়াইয়ের মতো ফুটবে। এবং লক্ষ করা যাবে: গাদা-গাদা বক্তৃতা দিতে গিয়ে আইকন-গণ যত স্লিপ খাচ্ছেন ভুল বকছেন, তত হররা বাড়ছে। কোনও নেতা তখন ইচ্ছে করেই কথা বলতে গিয়ে এর মুড়ো ওর ধড়ে কপি-পেস্ট, বা তৃণমূল-বিজেপি ক্রমাগত গুলিয়ে পাট, তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় টিআরপি তরতর করে বাড়ছে দেখে আলাদা মাইনে-করা লোক রাখবেন স্বেচ্ছা-ভুলচুক ও চুটকি সাপ্লাইয়ের। বোঝা যাবে, নেতারা এন্টারটেনারও বটে, তৈরি হবে সিরিও-কমিক নেতার হাইব্রিড, বা ইন্টেল-ক্লাউন কম্বো, আর কেউ রাজনীতি ছেড়ে পূর্ণ মিমেশ্বর হওয়ার দিকেই ডাইভ দেবেন সাষ্টাঙ্গে, হাতে ঘুঙুর পায়ে ঘড়ি গলায় হারমোনিয়াম (বা ঝালমুড়ির ঝাঁকা)।
ফার্স্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ম্যান্ডারিন
চিন সহসা বেঁকে বসবে, যদি ভারতের সব স্কুলে ম্যান্ডারিনকেই প্রথম ভাষা হিসেবে না শেখাও, কাল থেকে আর তারা সাপ্লাই দেবে না চিপ বা খোল বা ইঞ্জিন বা সার্কিট, মানে মোবাইল বন্ধ, কম্পিউটার বন্ধ, খেলনা কচ্ছপের হামাগুড়ি দেওয়া বন্ধ, মায় চাউমিন চিলি চিকেন বন্ধ। ভারত তাকিয়ে দেখবে, বহু আগেই সে আধুনিক জীবনের সব থাম গম্বুজ খিলানের দখলি-স্বত্ব চিনকেই দিয়ে বসে আছে। চিন না থাকলে সারাদিন একটা আঙুলও নাড়া যাবে না, কাউকে ফোন করা নেই ফেসবুক করা নেই, বিনোদন বলতে শুধু গাছে ওঠা আর নামা। তাই বাপ-বাপ বলে চিনের শর্ত মানতে হবে, কচি পড়ুয়ারা ম্যান্ডারিনে গলা সাধবে ফার্স্ট পিরিয়ডেই। ইংরিজি বা বাংলাও পড়া হবে বটে, কিন্তু সেগুলো দুধভাত, পরীক্ষায় নম্বর নেই। বাপ-মা’রা বলবেন, রেজাল্ট ভাল করতে গাঁতিয়ে ম্যান্ডারিন পড় বাপ, তাছাড়া এরাই তো পৃথিবীর রাজা হবে বছর তিনের মধ্যে, ভাষাটা জেনে রাখলে এদের চরণসেবী চাকর হয়ে বালিগঞ্জে বাড়ি হাঁকাতে পারবি।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী