ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অপেশাদারি স্বতঃস্ফূর্ততা


    বিমল কুণ্ডু (April 10, 2021)
     

    শুরুতেই যে কথাটা বলতে চাই, সেটা হল— একজন আর্টিস্ট তৈরি হয় তাঁর জীবনবোধ থেকে। সোমনাথদা, প্রথম কথা নিজে কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, যে-কারণে আর্ট কলেজ থেকে বিতাড়িতও হয়েছিলেন। পথে-ঘাটে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকতেন। সোমনাথদার ছবির মধ্যে কিন্তু জীবন থাকত, ওই চিত্তপ্রসাদের মতন। আসলে জীবনটাকে ওই জায়গা থেকে দেখা তো! গ্রাফিক্সও মারাত্মক করতেন। তারপর তো যথারীতি শান্তিনিকেতন চলে গেলেন চাকরিসূত্রে। সেই সময়ে আমাদের গ্রুপে ছিলেন মানিক তালুকদার। ’৭০-৭২ সালে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে তিনি তখন শান্তিনিকেতনে। মানিকদা ছিলেন স্যাঁকরা-বাড়ির ছেলে। দ্রুত সব কিছু গড়তে পারতেন। মোমের প্লেট তৈরি করে, তারপর স্কাল্পচার করতেন। মোমের প্লেটটা কিন্তু সে-সময়ে আমরা কেউই ভাবিনি। তো সোমনাথদা এসে এসে ‘কী গো মানিক, কী করছ’ এসব বলে-টলে যেতেন! তারপর যখন খেয়াল হয়, ওই ছাঁচগুলো বেশ কাজের, তখন সোমনাথদা ওগুলো চেয়ে নিতেন। মানিকদা একটা ধরনের স্কাল্পচার করতেন, যেটা আমরাও করি। সেগুলোকে ‘ডাইরেক্ট প্রসেস স্কাল্পচার’ বলে। ওটা একটাই কপি হয়। তো ওই প্লেটগুলোকে জুড়ে জুড়ে সোমনাথদা সেই প্রথম ‘ভিয়েতনাম’ বলে একটা কাজ করলেন। আর সোমনাথদা যেহেতু চট্টগ্রামের লোক, ওঁর চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা টিবেটিয়ান ফেস আছে। ওটাতেও ছিল। কিন্তু বিশ্বভারতী হলে যা হয়! যে কোনও কারণেই হোক, এক অধ্যাপকের প্ররোচনায় এক ছাত্র সেই কাজটা নষ্ট করে দেয়। পরে সে নিয়ে বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। কোর্ট-কাছারি, থানা-পুলিশ এইসব। যাই হোক, সেই হচ্ছে সোমনাথদার শুরু। তারপর বহুদিন আর কিছু করেননি। বিরাট গ্যাপ। মাঝে আমার সঙ্গে নন্দনমেলায় দেখা হত, দেখতাম সার দিয়ে ছাত্ররা বসে আছে, আর সেখানে উনি চুল কাটছেন। লালুদা (লালুপ্রসাদ সাউ) লেমন-টি বিক্রি করতেন। তখন নন্দনমেলা একেবারে অন্যরকম ছিল। আর সোমনাথদার সবচেয়ে যেটা মজা লাগত, উনি পাজামা পরতেন, সঙ্গে ছোট একটা জামা। এদিকে মাথায় কখনও ভিজে গামছা, কখনও টোকা দিয়ে সাইকেল করে কলাভবনে যেতেন।

    দ্য ডগ, ব্রোঞ্জ, ৪.৫x৫.৫x১.৫”, ১৯৯৮

    রিটায়ারমেন্টের পর লালবাঁধের ধারে বিহারিপল্লিতে সোমনাথদা বাড়ি করেছিলেন। তখন ‘উন্ড’ সিরিজ-এর কাজগুলো করছেন। পেপার পাল্‌প-এর সেই কাজগুলো! তখন দেখতাম প্লেট জুড়ে জুড়ে স্কাল্পচার করতেন। কিন্তু যে-কথাটা বলার, সোমনাথদা তো বেসিক্যালি একজন স্কাল্পটার নন, কিন্তু একজন বড় মাপের শিল্পী। সারাজীবন ওই লড়াই করা মানুষের জীবন নিয়েই কাজ করেছেন, অন্য কোনও সাবজেক্টে যাননি। এবং কাস্টিং-এর চ্যানেল দিয়ে হাত-পাগুলো জুড়ে দিতেন। ফলে সেখানে যে ইম্প্রেশনগুলো থাকত, সেগুলো পুরোটাই ওঁর নিজের। বিশ্বভারতীতে কী হত, একজন কোনও একটা কাজ করতেন, ছাত্ররা সেগুলো কপি করত। ওতে কিস্যু হয় না! কিন্তু সোমনাথদা যেগুলো করতেন, সেগুলো একেবারে ভেতর থেকে করতেন। সাকসেসটা ওখানেই। আমি এই দীর্ঘ পথ আসার পর বুঝেছি, একজন শিল্পীর জীবনে অভিজ্ঞতা এবং আবেগ যতক্ষণ না থাকছে, সে সাকসেসফুল কাজ করতে পারবে না। স্কিল দিয়ে একটা জায়গা অবধি পৌঁছানো যায়, কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা, কী বলতে চাইছি সেই অভিব্যক্তিটা থাকে বলেই একজন মানুষ সেটা অনুভব করতে পারে। সোমনাথদা যে মানুষগুলো গড়তেন, সেগুলো কোনওটাই কিন্তু ডাইমেনশনাল ছিল না। পিছনদিকগুলো ফোঁপড়া থাকত। চ্যানেল দিয়ে জুড়ে দেওয়ার পর, বাদল থাকত— ও সেগুলো ঢালাই করে দিত। সোমনাথদা আমায় একবার আমায় খুব ভাল একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দ্যাখ বিমল, সবাই থাকার জন্য বাড়ি করে, আমি করেছি আঁকার জন্য’। যেমন, বাড়িটার ছাতে যাওয়ার সিঁড়ি ছিল না, একটা গর্ত ছিল। মই লাগিয়ে ওই ফুটো দিয়ে ওপরে উঠতে হত। পরবর্তীকালে সোমনাথদার জীবনযাপন অন্যরকম হয়ে গেছিল, বিক্রি বেড়ে যাওয়ার পর, কিন্তু সেই সময়ে সোমনাথদাকে দেখেছি শীতকালে কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে থাকতেন। একটা কথা সোমনাথদা আমায় বলেছিলেন, যে-কথাটা পরবর্তীকালে উনি রাখেননি। বলেছিলেন, ‘আমার এই সব কাজ ট্রাঙ্কে ভর্তি থাকবে। এখন কোনও শো করব না। আমার মৃত্যুর পর এগুলো বাইরে আসবে’। খুব বড়ো কাজ তো উনি জীবনে করেননি, সবই ছোট ছোট কাজ! কিন্তু ইতিহাস অন্যরকম কথা বলে! এখানে একটা গল্প আছে। রাখীদি (রাখী সরকার) তখন ‘লেডিজ স্টাডি গ্রুপ’ থেকে একটা শো করেছিলেন বিড়লা একাডেমিতে, ‘ভিশন’ নামে। আমি এটা সত্তরের শেষ কি আশির শুরুর কথা বলছি। তখনও সিমা (CIMA) হয়নি। সেখানে আর্টিস্ট ছিলেন গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী আর স্কাল্পটার মীরা মুখোপাধ্যায়। যে কোনও কারণেই হোক, মীরাদি ওটা রিফিউজ করেন। তখন ‘আনন্দবাজার’-এর পার্থ, শান্তিনিকেতন গিয়ে সোমনাথ হোরের কাজ এনে দেখায় এবং সবার খুব পছন্দ হয়ে যায়। সেই সোমনাথদা কিন্তু দিয়ে দিলেন! ‘আনন্দবাজার’-এর ব্যাপার, ফলে প্রচুর হইহই হল। আর সেইখান থেকেই সোমনাথদা ঢুকে গেলেন বৈভবে। একটা নতুন কিছু শুরু হল।

    বাউল উইথ ইকতারা, ব্রোঞ্জ, ২৫.৫x৯.৮x ৫.২”

    বেসিক্যালি আমরা যেভাবে একটা স্কাল্পচার করতে অভ্যস্ত, থ্রি-ডাইমেনশনাল, সোমনাথদা সেটা করেননি। আমরা গড়নে ভাবি, কিন্তু যেহেতু উনি আনস্কিলড স্কাল্পটার, ফলে মিডিয়ামটাকে ওঁর বক্তব্যে ব্যবহার করেছেন। উনি দেখেছেন, আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা ছবিতে তো আঁকিই। দুর্ভিক্ষের ছবি, মানুষের ছবি, কিন্তু এতে যেন তার চেয়েও বেশি বলা সম্ভব হচ্ছে। আমরা ডাইমেনশন তৈরি করি, কিন্তু উনি পেইন্টিং-এর মতো স্কাল্পচারগুলো তৈরি করতেন। ফর্মের মধ্যে কোনও রিয়েলিটিকে রাখেননি। ভাবনাটা রয়ে গেছে, এক্সপ্রেশনটা নেই। এইটা একটা মজার ব্যাপার, যখন কোনও একটা কাজ তৈরি হয় এক্সপ্রেশন আর আবেগ মিলিয়ে, তখন মিডিয়াম কিছু না। নিজেই তখন সে নিজেকে ওই সেনসেশনের জায়গায় নিয়ে যায়। দর্শক তখন সেটা খুব সহজেই অনুভব করতে পারে। এটা সাধনা না করলে হয় না। উনি কিন্তু পাকা স্কাল্পটারের মতো কোনও কিছু তৈরি করতে যাননি, একেবারে অন্য একটা মাধ্যম বেছে নিয়েছিলেন। ফলে চার-পাঁচটা কাজ যখন দেখছি পর পর, একটা অন্য রকম জার্ক পাওয়া যাচ্ছে। এরপর কী হল, যথারীতি সোমনাথদার কাজের চাহিদা বেড়ে গেল। উনিও সাপ্লাই করা শুরু করলেন। নবীন কিশোর ওঁর থেকে কাজ নিয়ে আসতে লাগল। সুখসাগর বিরাট শো করল। কিন্তু আমার রিয়েলাইজেশন হচ্ছে, যেহেতু সোমনাথদা স্কাল্পটার নন, ওঁর দুটো-তিনটে কাজ দেখলে জার্কিং মনে হয় ঠিকই, কিন্তু কুড়িটা কাজ একসঙ্গে দেখলে রিপিটেশন লাগে। একঘেয়ে। কারণ আছে। আমরা যখন কাজ করি, একটা স্কাল্পচারের আলো, ছায়া গোটাটাই দর্শককে মুভ করায়। কিন্তু কেউ যদি স্টাইলাইজড কাজ করে, সেটা অনেকটা ওরিগামীর মতন। তিরিশটা কাজ দেখলে, একই রকম। আর উনি তো সাবজেক্টের বাইরেও যাননি। শুরু থেকে সেই জীবনের কথাই বলে গেছেন। নানা রকম শুধু জীবন। ওঁর ভাস্কর্যে কোথাও আলো-ছায়া প্লে করে না। এটা আমি একজন স্কাল্পটার হিসেবে বলছি। এখন কথা হচ্ছে, একজন শিল্পী কিছু বলার জন্য যে কোনও মিডিয়ামকেই ব্যবহার করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে ছবি আঁকার জন্য এমন এমন রং ব্যবহার করেছেন, যা কোনও আর্টিস্ট ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারবেন না। সাধনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একজন শিল্পী সব মিডিয়ামকেই ব্যবহার করতে চান। আল্লাউদ্দিন খাঁ যেমন যে কোনও তারের যন্ত্র বাজিয়ে দিতে পারতেন। সোমনাথদার মধ্যেও এই কোয়ালিটিটা ছিল। এখন যে স্কাল্পটাররা আছে, বড্ড অসৎ। বাজার যখন লেগে গেছে, প্রফেশনাল আর্টিস্ট দিয়ে স্কাল্পচার করিয়ে একজিবিশনে রাখছে। কিন্তু তিনি কক্ষনও নিজেকে স্কাল্পটার বলতেন না। যেটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, সুখসাগরে প্রদর্শনীর সময়ে একটা বই বেরিয়েছিল। ক্যাটালগ। সেখানে সোমনাথদা স্পষ্ট স্বীকার করেছিলেন, ‘মানিক আমার গুরু’। এই সততাটুকু তাঁর মধ্যে চিরকাল ছিল।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook