গুরুর বোধহয় সত্যিই অনুশোচনা হল। এর আগে অন্য অনেক লেখককে নিয়ে কাজ করেছে গুরু। মাসে–মাসে প্রচুর টাকা দিয়ে গেছে। বলেছে— আপনার মনের মতো করে বই লিখুন একটা, আমি সিনেমা করব সে–বই নিয়ে। এমন কোনও লেখক নেই বোম্বাই শহরে যাদের কাছে সে যায়নি, যাদের সঙ্গে বসে সে গল্প নিয়ে আলোচনা করেনি। কিন্তু এমন কথা সে এই–ই প্রথম শুনল। তারপর দিন স্টুডিও থেকে ফিরল খুব সকাল-সকাল। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম।
বললাম— কি হল? এত সকাল-সকাল? শুটিং শেষ হয়ে গেল নাকি?
গুরু বললে— আর একটা জায়গার খবর পেয়েছি। এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে। গাড়িতে যেতে বড় জোর এক ঘন্টা সময় লাগবে। জায়গাটার নাম মহাবলীপুরম্। একবার গিয়ে দেখে আসি চলুন—
বললাম— তাই চলুন—
তাই চললাম। সেদিন আর হোটেলে খেলাম না। বরাবর পাকা পিচ–ঢালা রাস্তা। এক–ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ‘মহাবলীপুরম্’ নাম শোনা ছিল জায়গাটার। এককালে ছিল পহ্লবীদের একটা বিখ্যাত বন্দর। তারপর আছে লাইট–হাউস তারপর পক্ষীতীর্থ। আমরা দেশ–ভ্রমণ করতে আসিনি। একটা নিরিবিলি জায়গা শুধু খুঁজছিলাম, যেখানে দুজন মুখোমুখি বসে গল্প করা যায়। গল্প মানে সিনেমার গল্প। এমন গল্প, মহৎ শিল্প নয়, কিন্তু যা দেখতে এসে লোকের ভালো লাগবে। পারবেন এমন কোনও গল্প লিখতে? রঙিন ছবি হবে। অর্থাৎ দৃশ্যগুলোর বেশির ভাগই হবে ঘরের বাইরে!
বললাম— আপনার যদি প্রয়োজন হয় তাও লিখতে পারি। আপনি বলেছেন বলেই লিখব, তবে সাধারনত ও–সব লিখতে আমার ঘেন্না হয়। বিশেষ করে ঘেন্না হয় ক্রাইম-স্টোরি লিখতে—
গুরু বললে— কিন্তু আপনি তো ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়েছেন?
বললাম— না—
—ছোটবেলায় তো পড়েছেন—
বললাম— না, জীবনে কখনও ক্রাইম স্টোরি পড়িনি। তবে আপনার উপকার হলে আমি তাও লিখতে পারি—
গুরু তখন একটা ইংরেজি গল্প মুখে মুখে বললে। শুনলাম সবটা। যেমন সাধাসিধে খুন-খারাবি রহস্য গল্প হয় আর কি, তেমনি।
বললাম— আপনি কি সত্যিই মনে করেন, এ-গল্প ছবি করলে আপনার কোম্পানির খুব লাভ হবে?
গুরু বললে— হবে।
বললাম— তাহলে আমিও লিখব—
গুরু বললে— তাহলে চলুন এখানকার রেস্ট-হাউসে যাই, দেখি সেখানে খাওয়া-থাকার কেমন ব্যবস্থা!
বাইরে থেকে তো দেখতে বেশ। বেশ সিনেমার ছবি ওঠে, লাখ-লাখ টাকা উপায় করে। আর কি চাই মানুষের? আর কিসের প্রয়োজন থাকতে পারে? ছবি দেখে লোকে হাসে, কাঁদে, হাততালি দেয়। নানা কাগজে ছবি বেরোয়। সারা ভারতবর্ষের সব জায়গার লোক দেখলেই চিনতে পারে। আর কি মানুষ কামনা করে? মহাবলীপুরমের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও কান্না পায়। এত দীন, এত হতভাগ্য আবার এত মহান, এত উদার মানুষও আমি জীবনে বোধহয় দুটো দেখিনি।
গেলাম খুঁজে–খুঁজে মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট–হাউসে। দেখে চমকে গেলাম, মুগ্ধ হয়ে গেলাম, এমন অপূর্ব জায়গা জীবনে কটা দেখেছি মনে করতে পারলাম না। সামনে অসংখ্য সাইপ্রাস গাছের সার। গাছের তলাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারদিকে বালি। আর সামনেই বিশাল সমুদ্র। কেবল সমুদ্র আর সমুদ্র। কেবল জল আর জল।
বললাম— এখান থেকে শুটিং করতে যেতে অসুবিধা হবে না তো?
গুরু বললে— আমার তো সব–সময় গাড়ি থাকবে। সকালবেলা চলে যাব আর বিকেলবেলা চলে আসব। তা তাই ঠিক হল। একটা মাদ্রাজী হোটেল থেকে খেয়ে নিয়ে ফিরে গেলাম মাদ্রাজে। পরদিনই সেখান থেকে তল্পি–তল্পা গুটিয়ে চলে গেলাম মহাবলীপুরম্-এ। একবার ভাবলাম আমার না হয় জায়গাটা ভালো লাগল, কিন্তু গুরু কি এই নির্জন জায়গায় থাকতে পারবে? তার যে অনেক সমস্যা, গীতা লন্ডনে গেছে গান গাইতে। গুরুর এক বছর বয়সের মেয়ে নীনা রয়েছে বোম্বাইতে। গুরুর মা তাকে দেখছেন।
এক ছেলে অরুণ সে আছে হাসপাতালে। সে নেফ্রাইটিসে ভুগছে। তার ওপর আছে স্টুডিওর মাস-কাবারি খরচা চল্লিশ হাজার টাকা। তার ওপর ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা। আর তারও ওপর আছে মাদ্রাজী হিন্দি ছবিতে নাচ-গান-লাফ! আর তার সঙ্গে আছে নানা–রকম আত্মিক সমস্যা, যার কোনো সমাধান নেই।
অথচ বাইরে থেকে তো দেখতে বেশ। বেশ সিনেমার ছবি ওঠে, লাখ–লাখ টাকা উপায় করে। আর কি চাই মানুষের? আর কিসের প্রয়োজন থাকতে পারে? ছবি দেখে লোকে হাসে, কাঁদে, হাততালি দেয়। নানা কাগজে ছবি বেরোয়। সারা ভারতবর্ষের সব জায়গার লোক দেখলেই চিনতে পারে। আর কি মানুষ কামনা করে? মহাবলীপুরমের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও কান্না পায়। এত দীন, এত হতভাগ্য আবার এত মহান, এত উদার মানুষও আমি জীবনে বোধহয় দুটো দেখিনি। সেই কথাই এবার বলি।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত