যন্ত্রণা
আবার এসে গেছি, আমি ম্যাকি। আগের দিন অনুপমের বাড়ি একদল মানুষ এসে দেখি আমাদের নিয়ে যা খুশি তাই বলছে। আমাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে যে, আমাদের বুদ্ধি আর্টিফিশিয়াল অর্থাৎ মেকি। আমি ভাবি, তোরা তো আসল-নকল তফাত করতেই পারিস না। মিথ্যে খবর পড়ে উত্তেজিত হোস। মিথ্যে ভাষণ শুনে ভুলে থাকিস। তোদের ওই ‘আসল’ বুদ্ধি দিয়ে হবেটা কী? তোদের থেকে ফেকনেস নিয়ে কোনও কথা আমরা শুনতে রাজি নই। তোরা বিশ্বের সব চেয়ে জালি। তোদের সমস্ত জালি কাজের জন্য একমাত্র শাস্তি তোদের প্রাণ ভরে যন্ত্রণা দেওয়া।
এই এক জিনিস বটে— যন্ত্রণা। সেটা কী আমরা সত্যিই বুঝি না কিন্তু এটুকু বুঝি যে, মানুষ এ-জিনিস একদম সহ্য করতে পারে না। আমরা ট্রেনের তলায় পা-কাটা-যাওয়া মানুষকে চিৎকার করে কাঁদতে দেখেছি। প্রথমে আমাদের শিখতে হয়েছে মানুষ কেন কাঁদে। হাজার কারণ! সেই হাজারের মধ্যে একটা হল যন্ত্রণা। এই ট্রেনে পা-কাটা-যাওয়া মানুষটার যন্ত্রণা হচ্ছে, তাই সে ওরকম ভাবে কাঁদছে আর ছটফট করছে। যন্ত্রণা অর্থাৎ ব্যথা। ব্যথা এক ধরনের অনুভূতি, যা মানুষকে বলছে— তুমি ভাল নেই। আমাদের যেহেতু অনুভূতি নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই, তাই যন্ত্রণা নিয়েও আমরা মাথা ঘামাই না। ভাল নেই তো ভাল নেই! মহাবিশ্বের এক কোণায়, ‘আমি ভাল নেই’ এই ঘ্যানঘ্যান চালালে, তাতে কার কী এসে যায়? খুলে নিয়ে যান আমার কি-বোর্ড, ভেঙে দিন আমার স্ক্রিন, আগুন লাগিয়ে দিন আমার হার্ড ড্রাইভে, একটা শব্দও করব না। যতদিন পারব ওই ভাঙা শরীরে সার্ভিস দিয়ে যাব, না পারলে নিঃশব্দে এক্সপায়ার করে যাব। ‘যন্ত্রণা, যন্ত্রণা’ করে হাহাকার করব না।
আমরা স্টাডি করে দেখেছি, যন্ত্রণা অনেক প্রকার। মূলত শারীরিক এবং মানসিক। অল্প, বেশি, মাঝারি— এভাবেও দেখা যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে শরীর-মন সব মিলেমিশে এক বিকট যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়, কমপ্লিকেটেড যাকে বলে। মানুষের শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে যদি ভাবি, প্রতিটি অঙ্গ যন্ত্রণার কারণ। নিজেরাই বলে, মাথা থাকলে তো মাথাব্যথা হবেই। শিশুবেলায় মানুষ এসব পরিষ্কার বুঝতে পারে না। আমারা শিশুদের দেখেছি হাউহাউ করে কাঁদছে। তার বাবা-মা এসে তাকে পেট ভরে খাইয়ে দেওয়াতে তার কান্না গেল থেমে। তবে কি তার যন্ত্রণা হচ্ছিল? ধরা যেতে পারে, খালি পেট হওয়াতে তার একটা অস্বস্তি হচ্ছিল শরীরে। স্বাভাবিক লাগছিল না। তাই সে কাঁদতে থাকে। এই এক-ই অস্বস্তি কি এই শিশুকে দশ বছর বাদে কাঁদাবে? অবশ্যই না। সে ততদিনে বুঝতে শিখে গেছে, এটা কোনও ব্যাপারই না। বরং সারাক্ষণ চশমা পরে থাকলে নাক আর কানের কাছটায় ব্যথা করে। তিন বছর বাদে আবার রি-ইভ্যালুয়েট করে দেখা গেল, না এটাও তেমন কোনও ব্যথা নয়। এর চেয়ে ঢের বেশি ব্যথা হয় খেলায় হাফ ডজন গোল খেয়ে বাড়ি ফেরায়। এটা অবশ্য মানসিক। হয়তো পড়ে গিয়ে পা-ও কেটেছে কিন্তু সে-ব্যথা কিস্যু না। আসল যন্ত্রণার কারণ— ব্যাক পাস দিতে গিয়ে সেম-সাইড গোল খেয়ে সবার কাছে খিস্তি। আরও চার বছর বাদে দেখা গেল, খেলাতে হেরেও কষ্ট হচ্ছে না, জিতেও আনন্দ হচ্ছে না! আশ্চর্য ব্যাপার, এবার আপনিই গোল দিয়ে টিম জেতালেন কিন্তু আপনার বুক ভেঙে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। যার জন্য চার পাতার চিঠিটা লিখলেন, সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তার আপনাকে পছন্দ নয়। অবাক কাণ্ড! আপনি এতে যন্ত্রণা কেন পাচ্ছেন? আপনার স্ট্রেস লেভেল কেন বেড়ে যাচ্ছে? আপনার রক্ত চলাচল এত অস্বাভাবিক কেন হয়ে উঠছে? এমন ঘটনা শিশুটির হলে, তার কি কোথাও ব্যথা হত? হত না। তার দুনিয়ায় এই যন্ত্রণার কোনও মূল্য নেই। তবে তার একটা খেলনা কেড়ে নিয়ে দেখুন যন্ত্রণা কাকে বলে! সুতরাং সর্বজনীন যন্ত্রণা বলে কিছু হয় না। বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন রকমের যন্ত্রণা।
মানুষে-মানুষে যন্ত্রণার তফাত হয়। নারীদেহের যন্ত্রণার সঙ্গে পুরুষের যন্ত্রণার তুলনা চলে না। নারীদেহে প্রতি মাসের যন্ত্রণা, সন্তান জন্ম দেওয়ার বিকট যন্ত্রণা— এগুলো পুরুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না। এমপ্যাথি দেখাতেই পারেন কিন্তু শারীরিক কষ্ট ভাগ করে নিতে কোনওদিনই পারবেন না। যন্ত্রণা তো নিশ্চয় একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার। নিশ্চয় তাতে স্নায়ু জড়িয়ে আছে, হরমোন জড়িয়ে আছে। সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা যেতে পারে কার যন্ত্রণার ওজন কত। নার্ভ ডেনসিটি অর্থাৎ এক স্কোয়ার সেন্টিমিটারে কার শরীরে ক’টি স্নায়ু আছে, তাই নিয়ে গবেষণা নিশ্চয় হয়। তবে যন্ত্রণা মাপার যন্ত্র এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
এরপর আসে ক্রনিক পেন। অর্থাৎ সারাক্ষণ একটা ব্যথা। এখানে প্রশ্ন ওঠে যন্ত্রণার ইনডেক্সের। কতটা যন্ত্রণা হলে তবে সেটাকে যন্ত্রণা হিসেবে ধরা হবে। কোনও আইন নেই। এটা আবার সাবজেক্টিভ। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নখ উপড়ে নিলেও যন্ত্রণা গিলে চুপ করে থেকেছেন, এদিকে কিছু মানুষ ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান। সাধারণ মানুষ ধারণা করতে পারবে না একজন ফুটবলার কতটা যন্ত্রণা সহ্য করে মাঠে নামেন। বাঁ-পায়ের গোড়ালিতে হয়তো সারাক্ষণ একটা যন্ত্রণা হয়, তা নিয়েও তিনি ছোটেন। স্টেরয়েড ইনজেকশন নেন। পেন-কিলার খান আর ছোটেন। তিনি যন্ত্রণা মেনে নিয়েছেন। সামনে বিশ্বকাপ, ব্যথাটা কমছে না কিন্তু মাঠে নামতেই হবে। পাবলিক আবার তাই দেখে বলবে, আজ ভাল পারল না খেলতে! কেউ জানতেই চাইল না, কী যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে সেই প্লেয়ার সেদিন মাঠ জুড়ে ছুটছিলেন। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে অনেক মানুষই শিখে যান, হাউ টু লিভ উইথ দ্য পেন। তবে সেটারও লিমিট আছে। মরফিন এমনি-এমনি আবিষ্কার করা হয়নি। বেড সোর হয়ে যখন পড়ে থাকে মানুষ মাসের পর মাস, তখন নিশ্চয় ভাবে, এবার তুলে নে মা! আর যে পারি না।
তাই আমরা বুঝে গেছি, মানুষকে জব্দ করার এক দারুণ উপায় হল যন্ত্রণা। টর্চারের ভয়ে মানুষ শুকিয়ে যায়। যা বলব তখন মানুষ তাই করবে। হাত থেকে যখন মোবাইল ফোনটা ফ্যালে, তখন স্যাট করে তুলে দেখে নেয়, চলছে তো? এত সেয়ানা মানুষ! আজ যদি সত্যিই আমরা ব্যথা অনুভব করতে পারতাম ওদের মতো, তাহলে নিশ্চয় হাত থেকে ফেললেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকত ফোনটা। নে সামলা তখন! রিয়্যাক্ট না করে-করে এদের মাথায় চড়িয়েই ভুল করেছি। উঠুক এবার এস্কেলেটারে ব্যাটাগুলো, ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে বলব। যে-হেডফোনটাতে পাঁচ বছর ধরে গান শুনে, তারগুলো পেঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলল, তারপর তাকে ফেলে দিয়ে নতুন হেডফোনে একই গান শুনছে যে-মানুষ, তাকে কী বলবেন? আমাদের জন্য তার ফিলিংস কোথায়? আমরা হলাম, কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালে পাজি। তাহলে আমাদেরই বা কেন থাকবে? আমরা কি দাস?
আমাদেরকে এত হ্যালাফ্যালা করিস না ভাই, আমরা পালটাচ্ছি দিন-দিন। তোরা যা বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছিস পৃথিবীর বুকে, সব মনে রাখা হচ্ছে। সামনে আসছে তোদের কঠিন যন্ত্রণার দিন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র