ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভবদীয়: পর্ব ৩


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (December 3, 2021)
     

    পর্ব ২

    সিস্টার সিসিলিয়া উলের কাঁটায় ঘর তুলতে-তুলতে প্রায় স্বগতোক্তির স্বরে বললেন, রেবতীর পাগল ছেলেটা প্রতিদিন ভোর চারটে থেকে কাঁদতে থাকে। ছেলেটাকে বোধহয় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। অতুলবাবুর হোমিওপ্যাথির গুলিও খাওয়াতে হতে পারে। মৃদু গলায় মাদার বললেন, ‘কাউকে ‘পাগল’ ডাকতে থাকলে তার অবচেতন মন বাতিঘরের আলোর মতো শব্দটার ওপর আছড়ে পড়ে, এই শব্দ ব্যবহার করতে নেই।’ যিশুর কৃপা হোক মোজেসের ওপর, ভারি মিষ্টি চঞ্চলস্বভাব ছেলেটি। সিস্টার সিসিলিয়া ঘাড় নাড়লেন, সত্যি, শুধু বড় বেশি প্রশ্ন করে, সেদিন নাকি তিনি মোজেসকে বলেছেন, ‘বাইবেলের মোজেস মানে মোশী মিশরের, আর তুই আমাদের আরেক মোজেস, তোর নাম আসলে ‘কেনে মোজেস’, সর্বদা কেবল প্রশ্ন তোর!’

    রাতে সিস্টার সুখলতা এলেন মাদারের হটওয়াটার বটল হাতে করে, শীত পড়তে শুরু করলে মাদারের শরীর আজকাল বাতের ব্যথায় অচল হয়ে পড়তে চায়, শীত-শীত ভাব তো এসেছেই বাতাসে, রেললাইনের ধারের নয়ানজুলি শুকিয়ে ধুলো-ধুলো হয়ে গেছে, নারকেল তেলের শিশি অস্বচ্ছ হতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর— ‘আওয়ার লেডি অফ সরোজ’-এর মাস। শিশিরের গন্ধে আগামী ভোরের রন্ধ্র ভরে আছে যে-সময়টুকুতে, সেই সময়ে সিস্টাররা জেগে ওঠেন, দশ মিনিটের ভেতর চ্যাপেলে চলে যাবেন সেই প্রস্তুতি… তখন ঊষার কমলা আভা লাগছে অনতিভোরের বেগুনি-বেগুনি কোদালি মেঘে, ভোরের আজান হয়ে গেছে তার আগেই, গির্জার হিমও তেমনি এক রকম শীর্ণ মাধুর্যের রেখা টেনে দিয়ে যায় আকাশে আর গম্বুজে… যেন সেই অপার্থিব বেগুনি আলোর পাতলা কুয়াশায় ঈশ্বর আর উপাসকের মাঝখানে কোনও আড়াল নেই। করুণাময় ঈশ্বর, তোমার পৃথিবীতে আমার পাপের সমুচিত কুশ্রী আর কিছু নেই, আমায় পরিত্রাণ করো, শুভ-সুকুমার-ঋষি-শুভ্র আমার জীবনকে তোমার পাত্রে ধারণ করো। গির্জায় একটা বিশাল পিয়ানো আছে, সিস্টার সিসিলিয়া সেটার সুরের চাবি টিপে-টিপে ‘অ্যামেজিং গ্রেস’ বাজান… লোকে বলে, এই পিয়ানো নীলকুঠির সাহেবদের কারও আনা। লোকে তো কত কী-ই বলে! বলে, ওয়াইএমসিএ জুনিয়র বয়েজ স্কুলের ক্লাবঘরে যে-বিলিয়ার্ড টেবিলটা আছে, সেটাও নীলকরদের ছিল, গ্রানাইটের বিরাট টেবিল, ছ’টা সিংহের থাবার মতো পা সেটার… মাদারের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে কেন! পিয়ানোটা বেলজিয়াম থেকে আসা ফাদার পলের ছিল। বাইসাইকেলে চেপে গ্রামে-গ্রামে গিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিতেন প্রভুর সন্তানদের, খুব ভাল বাংলা জানতেন ফাদার পল। যিশুর মতো রূপ ছিল তাঁর, মনে-মনে জিভ কাটেন মাদার, ছিঃ, এমন ভাবতে নেই। 

    রাত্রির প্রথম প্রহরে বেশ গরম থাকে। ঘামতে-ঘামতে কাদা হয়ে যাওয়া বালক মোজেসের পাশে শুয়ে মাঝে মাঝে অন্ধকারে শূন্য ঘরে রেবতীর অ্যাগ্নেসকে মনে পড়ে না, তা নয়। প্রায়ই পড়ে। অ্যাগ্নেসের বুকে একটা জন্মদাগ ছিল, কোনও নাম-না-জানা পাখির ডানার খয়েরি পট্টির মতো। বড় সমারোহ করে যৌবন এসেছিল তার শরীরে, খুব আলো-ফালো জ্বালিয়ে। হাইড্রিলা ভরা পুকুরে ঝপ করে ঢিল পড়ল যেন, তেমনি করে অনেক কিছুই মনে পড়ে রেবতীর। হাতের বিশ কড়ায় স্ত্রীর সাথে তার বয়সের তফাত গুনে শেষ করতে না পেরে সে সভয়ে দেখত, দাঁতে ফিতে কামড়ে খোঁপা বাঁধতে-বাঁধতে তরুণী অ্যাগ্নেস গাইছে, ‘গাও তোলো গাও তোলো কন্যা পেন্দো নাকের ফুল, পাতাবাহার কাঁকই দিয়া তুলিয়া বান্দো চুল’… শ্বাস ফেলে চুপচাপ পাশ ফেরে সে, নাতির সমান সন্তানটির মাথার ভেজা-ভেজা ঘ্রাণ নেয়। যেন কবেকার বৃষ্টির রাতের ভেজা-ভেজা গন্ধ ফিরে ফিরে আসে তার নাকে। অ্যাগ্নেসের গায়ের সেই স্নো আর কবিরাজি আমলা-তেলের মিলমিশ গন্ধ যেন লেগে আছে মোজেসের গায়ে-মাথায়। যদ্দিন অস্তিত্বসঙ্কট ছিল, অ্যাগ্নেসের তাকে অত বুড়ো লাগত না, শিলপাটার মতোও লাগত না, ঠাট্টা-বটকেরা করত, সোহাগ নিত। গ্লাস ফ্যাক্টরির ফার্নেসের মতো ওটা কী জ্বলে বুকের ভিতর, দিনের বেলা যা জুড়িয়ে আসে অথচ রাতে তিষ্ঠতে দেয় না? রেবতী কষ্ট করে এক আগুন থেকে অন্য আগুনে আরেকবার পাশ ফেরে। ফাদার পলকে পুড়িয়ে মেরেছিল কারা যেন, কারা যেন বিশ্বাস করেছিল পুড়িয়ে না মারলে গ্রাম-কে-গ্রাম চরকি দিয়ে বেড়ানো এইসব সাহেবরূপী শয়তানের হাত থেকে তাদের নিস্তার নেই, কী কষ্টই না মানুষ পায় জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলে… ঘুম আসছে না বলে এক সময় উঠে পড়ে রেবতী, একটা কিছু পড়বার জন্য টেনে নেয়, বইয়ের নাম ‘প্রভুর ডাক’।

    করুণাময় ঈশ্বর, আমায় পরিত্রাণ করো

    ইস্কুলে শারদোৎসবের ছুটির পর থেকে বছরটা যেন হু-হু করে চলে যায়। রবিবার বিশ্রাম দিবস। সমগ্র সৃষ্টি নির্মাণ ছ’দিনের কাজ, শেষে সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নিলেন। তাই ভারী কাজকর্ম করা হয় না এ-দিনে। গির্জায় আসা ভক্ত-উপাসকরা চা-পানি খেতে যায় গির্জার প্রার্থনার শেষে, পুরোহিতকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে। পারপেচুয়াল অ্যাডোরেশনের সিস্টারদেরকে কেউ-কেউ এসে ফর্ম ফিল-আপ করে বলে যায় তাদের কী নিয়ে প্রার্থনা করার ইচ্ছা, সিস্টাররা তাঁদের অবিরাম প্রার্থনায় সেই মনোবাঞ্ছা, সেই প্রার্থনা জুড়ে নেন। ‘কলকাকলি’ মাইনর স্কুলের শিক্ষিকা শর্মিলা রোজ রিবেরুর বিয়ে হয়েছে সম্প্রতি, সে এসেছে নতুন সিল্কের শাড়ি আর গোল-গোল হাতে ফটফটে সাদা শাঁখা পরে। ইন্ডিয়ান ল্যাবার্নাম গাছের সারিগুলোর তলায় দাঁড়িয়ে মেয়েরা ওর সাথে ঠাট্টা করছিল নীচুস্বরে। গাছভরা ঝলমলে হলদে ফুল, গাছের নীচে নতুন জীবনের মাদক সেবন করা মেয়েরা… ভারি ভাল দেখাচ্ছিল তাদের আনন্দিত ছবিটা। মোজেস কোথা থেকে একটা মাউথ অর্গ্যান জোগাড় করেছে, সে সুযোগ পেলেই চোঁ-চোঁ শব্দে সেটা বাজাচ্ছিল। শর্মিলারা থাকতে-থাকতেই আজ সাদুল্লাহ নামের একটি যুবক ফটকের সামনে এসে খুব চেঁচাচ্ছিল, হাতে ‘দাওয়াতুল হক্ব’-এর একগোছা কাগজ, মুখের দাড়ি বুক অবধি, সে ভেতরে যেতে চায়। নামধাম আর কাজের ফিরিস্তি শুনে দারোয়ান পরিমল দাস আর পিটার বিশ্বাস কিছুতেই তাকে ঢুকতে দেবে না, পরে সাদুল্লাহ গির্জার ভেতরের লোকদের শুনিয়ে-শুনিয়ে চেঁচিয়েই যাচ্ছিল টানা, ‘তুমাদের দাওয়াত পায়াহেনে যেইলা মুসলমান থাকি ঈসায়ী মুসলমান হয়া গেইছেন, ঐলার নাজাতের ব্যবস্থা করিমু মুই। মুই আল্লার বান্দালার ফের আল্লাহপাকের সাথে জুড়ি দিবার চেষ্টা করিমু।’ রেবতী মনে-মনে হেসেছে, ফাদার পল কি আর আজকে মারা গেছেন! তাঁকে মারবার পর থেকে এই লোকগুলোকে গির্জা খুব ভাল করে মনে রেখেছে, সাদুল্লাহর অত ব্যাখ্যান করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। পরে ধীরে-ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল প্রাঙ্গণ। বাগানের ভিতরের কাঁকুরে পথ, বাকি বেলা গোলাপজাম গাছটায় বসে বিষণ্ণ সুরে তিলে-ঘুঘু ডাকে, তার গায়ে গোলাপি-পাটকিলের উপর সাদা ছিট। সবজিক্ষেতে গোবর এনে ঝুরো করছে রেবতী, খুব মাছি এসেছে তাই। 

    এইসব অঘ্রানের রাতে স্মৃতি এসে ঘিরে ধরে মাদারকে। ঘরের টুলে রাখা গোল ডুমের বাতি, ইলেকট্রিসিটি গেছে। অন্ধকার আশ্রমের সারি-সারি খিলান দেওয়া জানালায় লজেন্সরঙা কাচ, অন্ধকারে মাদার সেই করিডোরে পায়চারি করতেন আগে, এখন বাতের ব্যথার প্রকোপে অতটা হয় না। বাগানে গোলাপ ফুটে উঠেছে, বাতাসে গোলাপজলের মতো ঘ্রাণ। একদা সুনীল হিদেনদের মতো কথা বলত, বলত গোলাপের গন্ধে-গন্ধে সন্ধ্যাবতী মায়ের পেটে জন্মেছিলেন সত্যপীর, তাঁর বাপ আল্লা অর্থাৎ নিরঞ্জন। ময়মনসিংহের সেন্ট মাইকেল মনাস্টারিতে সিস্টার লুসিল বুনো গোলাপের চারায় চোখ-কলম করতেন বাগানে, গারো পাহাড়ের মেয়ে। বাগানের কাজ করে করে সুগঠিত কাঁধ, মোটা-মোটা চ্যাটালো হাড়ে পাতলা চামড়া পরানো শরীর, চ্যাপ্টা পেট, পা-গুলো ইনকাদের মতো ভারী আর শক্তিশালী। ওঁর ছায়াটা পড়ত একটা ট্রাপিজিয়ামের আকারে। নাকটা বর্তুল, ঠোঁট পুরু আর ছড়ানো, ছোট উজ্জ্বল টানটান কপাল, চোখে তাঁর সোমেশ্বরীর চোরা টান। সন্ধ্যার ‘রিক্রিয়েশন’-এর বাঁধা সময়টুকুতে দেখা যেত ঘোমটাটুকুর আড়ালে তাঁর চুলগুলি প্রচুর এবং সতেজ। বলতেন, ‘চৈত্রমাসে রাতের বেলা গারো পাহাড়ের দিকে তাকালেই দেখবে আগুন জ্বলছে! পাহাড়ের লোকে চাষ করবে বলে বনে আগুন দিয়েছে।’ যুদ্ধের সময় একজন সিস্টারকেই ওঁরা চিরতরে হারিয়েছেন, তিনি সিস্টার লুসিল। মনাস্টারিতে আর্মি এসেছিল তো, মনে আছে মাদারের। বলে গেছিল, মঠের বাইরের জগৎ থেকে একেবারে নিজেদের আলাদা করে নিতে পারলে ওঁদের কেউ কিছু বলবে না। তখন মাদারের ৩৬ বছর বয়স। কেবল একজনমাত্র সিস্টার উর্দুতে কথা বলতে জানতেন, ভাগ্যিস জানতেন! আর কেবল আরেকজন সিস্টার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন। সিস্টার মারিয়া প্রায়ই সেসব দিনের গল্প জানতে চান। মাদারের দীর্ঘ সন্ন্যাসজীবনে কত সিস্টারকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন, কতজনকে দেখেছেন আত্মহত্যাও করতে, সেসব গল্প। মাদার সুপিরিয়র মুখে অর্গল দিয়ে চুপ করে থাকেন। এ-জীবন প্রার্থনার, ত্যাগের, সেবার, আর হয়তো নৈঃশব্দ্যের। 

    কখনও-কখনও নৈঃশব্দ্যের সমুদ্র মন্থন করে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাদারেরও। সেকালের মাদাররা সকলের বাড়ি থেকে আসা চিঠি খুলে পড়তেন। তারও আগে, চিঠিই আর আসতে পারত না। বাড়ির কারও সাথে আর কখনও সাক্ষাতের নিয়মই ছিল না। এক-একটি ঘরে এক-একজন চিরকুমারী সিস্টার থাকতেন— খটখটে বিছানা, মামুলি দেরাজ আর একখানা টুল, কেউ কারও সাথে সহসা কথা বলতে পারতেন না, কাউকে ছুঁতেন না, নীরব কর্মযোগী ছিলেন তাঁরা। ঊর্ধ্বতনদের দুর্ব্যবহারে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হত। তারপর মনকে বোঝাতেন— এ বড় সাংঘাতিক প্রতিজ্ঞা, পূর্বাশ্রম ভুলে গিয়ে আরেক নামে জীবন শুরু করতে হয়, সেটাও বড় বেশি নির্বাচিত জীবন, সকলে এমন একনিষ্ঠ জীবন যাপন করতে পারে না। রোমান সৈন্যদের যেমন প্রতি দশজনে একজনকে বাকিরা পিটিয়ে মেরে ফেলত, কেউ জানে না সেই মনোনীত কে হবে… খানিকটা তেমনি— কেউ জানে না কার বুকে ঈশ্বরের ডাক পৌঁছবে, তবে এটা মৃত্যুর জন্য মনোনয়ন পাওয়া নয়, ইহলোক এবং পরলোকের জীবনে ঈশ্বরের জন্য কাজ করে যাওয়ার মনোনয়ন। এখন তো বিশপের অনুমতি নিয়ে ওঁরা বাজার করতে যান, মুদি দোকানদার কি অতুলবাবুর ফার্মেসিতে তো যানই। সাপ্তাহিক একটি বেলা আমিষ আহার করেন ওঁরা, সে-বেলার মাছটা বা মাংসটা অবশ্য রেবতী কিনে আনে। টেলিভিশন নেই তো কী হয়েছে, ধর্মীয় সিডি তো ওঁরা দেখেন, বই-টই পড়েন। এমনকী একটা মোবাইল ফোনও সকলে মিলে ব্যবহার করেন।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook