বরফের রাজত্বে কিছুদিন কাটাতে পারলে যেন আর কোনও জাগতিক চাহিদা বাকি থাকে না। তাই পাহাড়ের প্রতি ভালবাসা থেকেই যাওয়া শুরু করেছিলাম হিমালয়ে। সেই ১৯৯২ সালে। প্রথমে ছোটখাটো ট্রেকিং। এরপর দিন-দিন বেড়েছে সেই ভালবাসা, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পর্বতাভিযান। ভারতীয় হিমালয়ের অসংখ্য শৃঙ্গ আরোহণ করে এক সময় স্বপ্ন দেখেছিলাম পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট অভিযানের। ২০১০ সালের ১৭ মে সকাল সাড়ে সাতটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। এরপর প্রতি বছর পা বাড়িয়েছি একের পর এক আটহাজারি শৃঙ্গে। আরোহণ করেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা, ধৌলাগিরি, মানাসলু, মাকালুর মতো সুউচ্চ শৃঙ্গে।
কিন্তু চাওয়াটাই সব নয়। চাইতে গেলেও পাহাড়ের জন্য তৈরি হতে হয়, নিজেকে তৈরি করতে হয়। আর এই তৈরি করাটা অনেক সময় ধরে একটু একটু করে করতে হয়। সচেতন হতে হয়, সচেতন করতে হয় অন্য পর্বতারোহীকে, সাধারণ মানুষকে। আমাদের জীবনে পাহাড়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে, পাহাড়ের উন্নয়নে সুযোগ এবং সীমাবদ্ধতাগুলি তুলে ধরতে এবং বিশ্বজুড়ে পাহাড়ের মানুষ এবং পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এমন জোট গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতি বছর ১১ ডিসেম্বর দিনটি আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস (International Mountain Day) হিসাবে পালিত হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (UN General Assembly) ২০০২ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক পর্বতবর্ষ (UN International Year of Mountains) ঘোষণা করে এবং এই উপলক্ষে, ২০০৩ সাল থেকে ১১ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসাবে মনোনীত করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (Food and Agriculture Organization) পাহাড়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দিনটির বার্ষিক উদযাপনের আয়োজন করে। ইদানীংকালে সাধারণের মধ্যে পাহাড়ে যাওয়ার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়লেও, পাহাড় সম্পর্কে সচেতনতার কিছুটা অভাব হয়তো রয়ে গেছে। তারই ফল হিসাবে বিগত দিনগুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বেশ কিছু দুর্ঘটনা, সঙ্গে কিছু মৃত্যু।
পর্বতারোহণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এক খেলা। বিপদের আশঙ্কা এখানে প্রতি পদে। সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝের ফাঁক এখানে খুবই সামান্য। খুবই তুচ্ছ কারণে কোনও অভিযান বাতিল করে ফিরে আসতে হতে পারে। তা সে গ্যাস স্টোভ বিগড়ে যাওয়া হোক কিংবা তাঁবুর কোনও পোল বা স্টিক ভেঙে যাওয়া। সেরকমই খুব ছোট কোনও কারণেও কোনও অভিযাত্রী একদম মৃত্যুমুখে পৌঁছে যেতে পারে।
হাতের গ্লাভস ছিঁড়ে গেলে বা পড়ে গেলে আঙুল এবং হাতে তুষারক্ষত অনিবার্য। তুষারক্ষতর মাত্রা বেশি হলে, সেই হাত দিয়ে কিছু ধরাও সম্ভব নয়। সেই পরিস্থিতিতে নীচে নামাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে কিংবা হঠাৎ দমকা হাওয়ায় চোখের সানগ্লাস উড়ে গেলে চারপাশের পরিবেশ এক লহমায় পালটে যেতে পারে। এতক্ষণ যে-পথটা ছিল বেশ সুন্দর এবং চলার যোগ্য, সেটাই পুরোপুরি অন্যরূপ নিয়ে নেয় তখন। বরফের এলাকায় সেই সময়ে চোখ খুলে রাখা অসম্ভব। আর চোখ-বন্ধ অবস্থায় ওই দুর্গম পথে কী করে নেমে আসা যাবে?
এত কিছু বলা এই কারণেই যে, পর্বতারোহণে মৃত্যু সবসময় আরোহীর দোষে না-ও হতে পারে। কেউ তো আর মারা যাবার জন্য পাহাড়ে যায় না! পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, সবাই তো ফিরে আসারই চেষ্টা করে। কেউ-কেউ সফল হয়, অনেকেই হয় না। যাঁরা কোনওদিনই ফিরে আসতে পারেন না, তারা শেষ মুহূর্তে ঠিক কী পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, কতটা চেষ্টা করেছিলেন ফিরে আসার, কেন ব্যর্থ হলেন, তা আর জানার কোনও উপায় থাকে না। খুব বেশি হলে আমরা কল্পনা করে নিতে পারি। ওইটুকুই।
পর্বতারোহণের তুলনায় কিন্তু ট্রেকিং অনেক কম বিপজ্জনক। বেশির ভাগ ট্রেকিং-ই বেশ মজার এবং অবশ্যই নিরাপদ। ফলে ট্রেকিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কাও অনেকটাই কম। তাই কোনও ট্রেকারের মৃত্যুর খবর আমাদের একটু বেশিই বিচলিত করে।
ইদানীং ট্রেকিং করতে গিয়ে কয়েকজন অভিযাত্রী ভীষণ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। বেশ কিছু মৃত্যুর খবর এসেছে। যাঁরা চলে গেলেন, তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য তখনই যথাযথ হবে, যখন এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা আরও সাবধানী হয়ে পাহাড়ে যাব। প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটার পিছনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মূলত দায়ী, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, সে-সময়ে অসংখ্য ট্রেকার ছিলেন সেই একই অঞ্চলে। তাঁরাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রকৃতির সেই রুদ্ররূপ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নিজের জীবন বাঁচিয়ে নেমে আসতে পেরেছিলেন নীচে। শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন সুস্থভাবে নেমে আসতে পারেননি। রুদ্র প্রকৃতির কাছে আমরা অবশ্যই অসহায়, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে নিজেদের ভুলে যেন কোনও দুর্ঘটনায় না পড়ি। ট্রেক বা যে-কোনও ধরনের আ্যডভেঞ্চারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হয়— কোথায় যাচ্ছি, কখন যাচ্ছি এবং কাদের সঙ্গে যাচ্ছি, দলে কোনও অভিজ্ঞ ট্রেকার আছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাহাড়কে ভালবাসুন। কিন্তু ভালবাসা মানে দুঃসাহস কখনওই নয়। এবং পাহাড় কখনওই চ্যালেঞ্জের জায়গা হতে পারে না। পাহাড় চলে পাহাড়ের নিয়মে, আপনার বা আমার নিয়মে নয়। তাই পাহাড়কে সম্মান করুন আর সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে তবেই পাহাড়ে যান। পাহাড়ে যাওয়ার সঠিক সময় নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। মনে রাখতে হবে, নিজের সময়মতন নয়, পাহাড়ের সময়ে পাহাড়ে যেতে হবে। ট্রেকারদের অফিস কিংবা ব্যবসা সামলাতে গিয়ে সময়টা যদি ফিক্সড হয়েই থাকে, তাহলে বাছতে হবে সেই সময়ে উপযুক্ত কোনও ট্রেক-রুট।
ট্রেকিং-এ যাওয়ার আগে কয়েকটা প্রাথমিক বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেমন, দলের প্রত্যেক সদস্যের যথাযথ শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি। স্টেজে মেরে দেব, এমন ভাবনা বিপদ ডেকে আনতে পারে। যেখানে যাচ্ছি সেই এলাকা, ট্রেকিং-রুট, সেখানকার আবহাওয়া সম্বন্ধে বিশদ পড়াশোনা প্রয়োজন। সেই পথে এর আগে যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা অবশ্যই জরুরি। অতীতে সেই পথে কোনও বিপদ হয়েছে কি না তার জ্ঞান থাকা আবশ্যক, কেননা সেই রকম বিপদের মুখে ফের পড়লে কীভাবে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে তার একটা রূপরেখা মনে-মনে তৈরি করে রাখতে হবে। পথের বিপদ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হবে। কোথায় থাকতে হবে, কখন ফিরে আসতে হবে— সেটা জানতে হবে। যে-কোনও ট্রেকিং একটা টিম গেম। দলের সবার সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা অবশ্যই জরুরি। দলের সকল সদস্যের দক্ষতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। ট্রেকিং অনুযায়ী পর্বতারোহণের সাজসরঞ্জাম অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাহাড় যে-কোনও দিন তার সৌন্দর্য পাল্টে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্ল্যান-বি কী হবে, সেটা আগে থেকেই ভেবে রাখা উচিত। সাধারণ ট্রেকারদের পক্ষে এত কিছু জানা হয়তো সম্ভব না। এসব বেশির ভাগই আসে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তাই প্রত্যেক হাই অল্টিটিউড টিমে অবশ্যই দু-একজন অভিজ্ঞ সদস্য থাকা একান্ত জরুরি।
অ্যাডভেঞ্চারে রিস্ক সবসময়ই থেকে যায়। তাই রিস্কের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য দলের দু’একজনের অল্পবিস্তর পর্বতারোহণের জ্ঞান থাকা নিতান্তই আবশ্যক। আইস অ্যাক্স, ক্র্যাম্পন, রোপ ইত্যাদির ব্যবহার জানাটা খুব জরুরি। দলের কারো পর্বতারোহণের বেসিক কিংবা অ্যাডভান্স কোর্স করা থাকলে, বিপদের সময় সেটা দলের উপকারে লাগে।
দলনেতার সবচেয়ে জরুরি কাজ কোথা থেকে ফিরতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। সঠিক সময়ে, সঠিক ভাবে। তবে দুর্যোগের সময় কখনও-কখনও আগে যাওয়া কিংবা ফেরা দুটোই ঝুঁকি হয়ে যেতে পারে। তখন একই জায়গায় চুপচাপ অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ পাহাড়ে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ অনন্তকাল ধরে চলে না। সেটা হয়তো বড়জোর দু’একদিন পরেই ঠিক হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে এদিক-ওদিক না গিয়ে এক জায়গায় বসে থেকে ভাল আবহাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আর এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারে একজন দক্ষ দলনেতাই। এবারের উত্তরাখন্ডে যে-দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার একটায় দেখা গেছে বিভিন্ন সদস্যদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে বিভিন্ন জায়গায়। এমনকী একটি পাসের দু’পাশ থেকেই তাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। এটা থেকে বোঝা যায়, বিপদের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা উদভ্রান্ত হয়ে গেছিলেন।
প্রতি মুহূর্তে নিজেকে যাচাই করে চলতে হয়। শরীরের কথা সবসময় শোনা উচিত। আপনি হয়তো আগে বিশ-ত্রিশটা ট্রেকিং সাফল্যের সঙ্গে করে এসেছেন, কখনও আপনার বিপদ হয়নি। তা বলে আগামী ট্রেকিং-এও আপনার কোনও বিপদ হবে না, এটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। যে-কোনও ট্রেকিং-এ যাওয়ার আগে ঠিক সেই দিন মানসিক এবং শারীরিক ভাবে কতটা ফিট রয়েছেন সেই বিষয়টাকে সবথেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এরকম দেখেছি, কোনও অভিজ্ঞ ট্রেকার হয়তো আগে অসংখ্য ট্রেকিং করেছেন, কিন্তু নতুন ট্রেকিং-এ যাবার সময় করোনাজনিত অসুস্থতায় তাঁর শরীর অনেকটাই দুর্বল ছিল। সেই দুর্বলতা নিয়েই তিনি পা বাড়িয়েছিলেন হিমালয়ের দুর্গম এলাকায় এবং বিপদে পড়েছিলেন। সুস্থভাবে নেমে আসতে পারেননি। কে বলতে পারে করোনাজনিত শারীরিক দুর্বলতা তার দুর্ঘটনার পিছনে মূল দায়ী ছিল না!
এখন অনেক সাইট থেকে আবহাওয়ার খবর দেখা যায়। কোনও পথে রওনা হওয়ার আগে সেসব সাইট থেকে আগামী সাত-আট দিনের ওয়েদার রিপোর্ট দেখে নেওয়া উচিত। নিজের মনের কথা শুনতে ও বুঝতে যেমন ভালবাসি সকলে, ঠিক তেমনই প্রকৃতির বলা কথাও শোনার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাতে বিপদের সম্ভাবনা কমানো যায়।
পশ্চিমবঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস দেখার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের যুব কল্যাণ দপ্তরের। কোনও দল পাহাড়ে যাওয়ার আগে প্রাথমিক তথ্য যুব কল্যাণ দপ্তরকে জানিয়ে রাখা দরকার। এছাড়াও যখন যে-এলাকায় যাচ্ছেন, সেখানকার প্রশাসনকে নিয়মমতো জানিয়ে উপরে উঠলে সেই এলাকায় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় আসলে সেখানকার প্রশাসন জানতে পারবে কতজন ট্রেকার উপরে কোথায় রয়েছে। সেক্ষেত্রে উদ্ধারকার্যে অনেকটাই সুবিধা হয়।
এত কিছুর পরেও কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অ্যাডভেঞ্চারে বিপদ আসবে না এটা কেউ লিখে দিতে পারে না। অ্যাডভেঞ্চারের মজা তো তার অনিশ্চয়তায়। দুর্ঘটনা তো কলকাতার রাস্তাতেও হামেশাই ঘটে, তা বলে তো রাস্তায় বেরোনো বন্ধ হয় না! আর অ্যাডভেঞ্চারের স্পৃহা তো বাঙালির রক্তে! সুতরাং কোনও কিছুই বাঙালিকে অ্যাডভেঞ্চার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, যেন নিজেদের দোষে আমরা আমাদের অমূল্য জীবনটা খুইয়ে না ফেলি।
ছবি সৌজন্যে: লেখক