বলব কী মশাই, একেবারে মাটি হতে বসেছিল নবদ্বীপের রাস। কোভিড-১৯ ভুরু কুঁচকে আছে। আর রাস মানেই তো পোটেনশিয়াল সুপার-স্প্রেডার! রাত এগারোটার পর নাইট কার্ফু জারি আছে। খোদ নবান্নে চিফ সেক্রেটারির কাছে দাবি-দরবার করেও শিথিল হচ্ছে না। তারপর পুলিশের নজরদারি। ভিড়ভাট্টা যেন না হয়। মাস্ক না পরে ত্রিসীমানায় আসা যাবে না। এ-পাড়া ও-পাড়ায় বাদ্যি বাজিয়ে চমক লাগিয়ে নেত্য করার পাট— যাকে বলে ‘নবমী করা’— সেটা তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকী রাসের পরদিন চাকা-লাগানো গাড়িতে চড়িয়ে নবদ্বীপের এ-মুড়ো থেকে সে-মুড়ো প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা করার যে পুরনো রেওয়াজ— স্থানীয় লোকে যাকে বলেন ‘আড়ং’— সেটাও নাকি বাতিল! রাসের তবে বাকি রইল কী?
বাকি রইল রাস-বোধ। এই যেমন ধরুন, বাইরের লোকে জানে রাস মানেই রাধাকৃষ্ণের ব্যাপারস্যাপার। অষ্টপ্রহর নামকীর্তন। তিলক-পরা কণ্ঠীধারী বৈষ্ণবদের উৎসব। নবদ্বীপে না থাকলে বা না এলে বোঝাই যাবে না যে, এখানকার রাস ব্যাপারটা আদপে তা নয়। পূর্ণিমা পড়ার আগেই মঠ-মন্দিরের জারিজুরি খতম। এমনকী রানির ঘাটে রাধারানির মন্দিরে পালাকীর্তন-লীলাকীর্তনের যে-মাতন চলে এক মাস ধরে, সেটাও মিলিয়ে যায় রাসের আগের দিন। শ্রীবাস অঙ্গনকে ঘিরে একটা ভক্তসমাগম হয়। হরিসভা মন্দিরের মতো তিন-চারটে জায়গায় চক্ররাস হয়। তাতে রাধাকৃষ্ণর মূর্তিকে ঘিরে নেচে চলেন বৃন্দা-বিশাখা-চন্দ্রাবলী-সহ যতেক গোপবালা। বড়জোর মহাপ্রভু পাড়ায় ধামেশ্বর মহাপ্রভুর অঙ্গে নতুন বস্ত্র ওঠে। হরিধ্বনি নেই। গুড়ের বাতাসার হরির লুট নেই। রাসের সময় শুনশান সব ভজন-কুটির। কারণ, এখানকার রাস শাক্ত রীতি-রেওয়াজ মেনে চলে। তা গোস্বামী-শাসিত নয়। বারোয়ারির দাপটে চলে। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহ পেয়ে আড়াইশো বছর আগে যেটা মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছিল, নবদ্বীপের মাটির ওপর শাক্ত মতাবলম্বীদের মৌরসি পাট্টা কায়েম করতে কাজে লেগেছিল, সেটা আজ কার্নিভালের চেহারা নিয়েছে। গঙ্গার ওপারের শহর কৃষ্ণনগরের সুধীর চক্রবর্তী গেল বছর চলে গেলেন। বছর পঁচিশ আগে খানিক ফিল্ড-সার্ভে করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ তা (নবদ্বীপের রাস) রূপান্তরিত হয়ে গেছে জন-উৎসবে, রঙ্গরসে, নাচেগানে, হুজুগে আর হাল্কা বিনোদনে। যুবসমাজ তাতে মত্ত ও আসক্ত। পেছনে আছে ব্যবসাদারদের অঢেল টাকা।’ কথাগুলো আজও সত্যি। শেষের কথাটা আরও। বছরের পনেরো আনা সময় ঝিমিয়ে থাকা নবদ্বীপের কবজি আর ট্যাঁকের জোর যে কত, সেটা মালুম হয় এই ক’দিনে।
শহরের দক্ষিণে তেঘরিপাড়া এক প্রাচীন এলাকা। শ্যামাপুজোর আদি পীঠ। বড়, মেজ, সেজ, ছোট সব শ্যামাই সেখানে পুজো পান। নামেই মালুম যে এঁদের বয়স, বর্ণ, কৌলীন্য, সঙ্গতি আলাদা-আলাদা। আকারের কম-বেশি আছে। ‘জাগ্রত’ বলে ডাকসাইটে বড়শ্যামার পুজোয় উপচে পড়ে দর্শনার্থী। প্রতিমার গায়ে যে সোনার গহনা ঝোলে, তা তারাপীঠ-কালীঘাটের ঈর্ষার উদ্রেক করে। এবারেও করোনার জুজুকে কাঁচকলা দেখিয়ে যথাবিহিত পুজোআর্চা হল সকাল ন’টা থেকে। সারাদিন ধরে হাজার দেড়েক শাড়ির পাহাড় হল দীর্ঘাঙ্গী প্রতিমার সামনে। সন্ধেবেলায় একে-একে ৪২টা পাঁঠার বলি হল যূপকাষ্ঠে। শুধু তো নবদ্বীপের লোক নয়, সারা নদিয়া জেলা, লাগোয়া বর্ধমান, এমনকী ২৪ পরগনা, মেদিনীপুরের পুণ্যার্থীরা এসে জমিয়ে দিলেন উৎসব।
কত পুজো হল এবারে? খাস খবর নেওয়ার জন্য গেলাম রাজার বাজারের ভেতর গোঁসাইগলিতে। সেখানে বিকোয় মঠ (স্থানীয় উচ্চারণে ‘মট’)। স্রেফ চিনি দিয়ে এক আশ্চর্য মেঠাই। ছুঁচলো শঙ্কুর মতো দেখতে। যত বড়, তত দেখনদার। চারিচারা বাজারে যে ভদ্রকালী পুজো হয়, তার ভোগ সাজানোর নামডাক আছে। সেখানে অন্তত দু’ডজন বড় মঠ দেখেছি এবারেও। নানান রঙের। ‘কেমন বিক্রি হল এবার?’ দোকানে রয়ে যাওয়া একটা মাত্র বড় মঠের দিকে তাকিয়ে দোকানি বললেন, ‘বড় মট দেড় হাজারের মতো গেছে!’ দেড় হাজার! মানে কত পুজো হল এবার? দোকানি হেসে বললেন, ‘পাঁচশোর ওপর।’
এই পাঁচশোর মধ্যে গোটা কুড়ির বয়স একশোর ওপর। বাকি সবই অর্বাচীন। পুরনো বাসিন্দারা সবই জানেন। বোঝেন। ক’জনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে বুঝলাম যে, শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গিনী মাতার উচ্চতা এবারে কমাতে হয়েছে বলে অনেকেই মুহ্যমান। যোগনাথতলার গৌরাঙ্গিনী জোড়া সিংহের ওপর আসীন হয়ে ১০০ বেয়ারার কাঁধে চেপে হই হই করে গঙ্গায় যাবেন, এটাই নবদ্বীপ জানে। তার জন্য ওভারহেডের তার সব কেটে দেওয়া হয়। শহর নিষ্প্রদীপ থাকে। সব সই। এবারে পুলিশ পারমিশন মেলেনি। আয়োজকরা রেগেমেগে ছোট করে দিয়েছেন প্রতিমা। হপ্তা তিনের আগেও বড় করে কাঠামো গড়া হচ্ছিল। সাতদিন আগে সব বদলে ফেলা হয়েছে।
এটা নবদ্বীপেই সম্ভব, কারণ কলকাতার মতো মাসের পর মাস ধরে এখানে প্রতিমা তৈরি হয় না। দিন সাতেকের মধ্যে কাজ সারা। রাসের আগের রাতে গেলাম দেয়ারাপাড়ায় এলানিয়া কালীর প্রস্তুতি দেখতে। পনেরো আনা কাজ শেষ। ভাড়া বেঁধে প্রতিমা সাজানোর কাজ চলছে। সামনের ফ্লেক্সে লেখা ‘কৃষ্ণচন্দ্র রাজার অনুপ্রেরণায় শঙ্কর তর্কবাগীশ প্রতিষ্ঠিত ভৃগুরাম পূজিত নবদ্বীপের সর্বপ্রথম শ্যামা পূজা’। এলানিয়া কালীর দিন গেছে। তবে কৌলীন্য অটুট।
যেমন অটুট দণ্ডপাণিতলার মুক্তকেশীর। পাড়ার লোকেরাই ‘মেম্বারশিপ’ দিয়ে আয়োজন করেন। সাত্ত্বিক ভাবে। পুরুতঠাকুর মানিক ভট্টাচার্য। শুধোই, ‘ওই ব্যাদরাপাড়ার দিকে বাড়ি না?’ প্রবীণ মেম্বার বলেন, ‘হ্যাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজার সময় থেকেই করছেন।’ এর অর্থ, ওই পরিবারের সদস্যরাই আড়াইশো বছর ধরে এখানে পৌরোহিত্য করছেন। রাজমহিমা যে কী বিচিত্র বস্তু, এইসব পুরনো পুজোর ম্যারাপে দাঁড়ালে মালুম হয়। নগরদেবী পোড়ামার মন্দিরে পশুবলি রদ রয়েছে কিছুকাল হল, মানেকা গান্ধীর হুড়ো খেয়ে। কিন্তু মন্দিরের গায়ে কী লেখা আছে জানেন? ‘আগামী ১৪১৪ সাল – ১লা বৈশাখ থেকে কোন পশুবলি হইবে না। আদেশানুসারে – কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি’।
পোড়ামাতলা নবদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র। সেখানে কাঁসারি শ্যামার পুজো হয়। আগে নদিয়ার রাজার নামে সংকল্প হত। এখন হয় না বটে, তবে ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশ অনুসারে’ই এ-পুজোর সূচনা, সে-কথা জানান দিতে ভোলেন না আয়োজকরা। সে-আমল থেকেই উঁচু-উঁচু প্রতিমা গড়ার চল। তাই যদি হবে, শিবের মাথায় ছোঁয়ানো বিল্বপত্র ‘বড়ঠাকরুণ শ্যামা মাতা’র মাথা স্পর্শ করবে কীভাবে? নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন। জোগাড় হল ফুট তিরিশের লম্বা একটা লগা। লগার ডগা বাখারি দিয়ে চিরে লাগানো হল বেলপাতা। তিনজন ভক্ত মিলে সেটাকে উপরে তুলে ছুঁইয়ে দিলেন মায়ের কপালে! কেল্লা ফতে!
এ-দৃশ্য দেখতে এবারও শত-শত লোক খাড়া থাকলেন। তবে তারা বহিরাগত। শহরের খাস বাসিন্দারা সপরিবার বেরোলেন আগের দিন রাতে।
রাত সাড়ে বারোটা। রাধাবাজার মোড়ে নবদ্বীপ গোল্ডেন ক্লাবের ‘শ্রী শ্রী মহিরাবণ বধ’ পুজোর প্যান্ডেলে এসে ভিড়লেন পাঞ্জাবি-পাজামা পরা এক বৃদ্ধ। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবির বাটনহোলে চোখ গেল। সোনার বোতাম। বনেদিয়ানার অভ্রান্ত অভিজ্ঞান। ঘণ্টা কয়েক আগেই মেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরেছে, পাঁচ বছরের নাতনিকে নিয়ে। রাতের খাওয়া সেরেই বাড়ির সবাইকে নিয়ে ‘ঠাকুর’ দেখতে বেরিয়েছেন বৃদ্ধ। রামায়ণের এক দুষ্প্রাপ্য পরিচ্ছদ নিয়ে তৈরি এই প্রতিমাতে কালীমূর্তির পায়ের তলায় খাঁড়ার ঘায়ে ঘায়েল হচ্ছেন মহিরাবণ। এক কোপে ধড় থেকে আলাদা হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মহিরাবণের মুণ্ডু। দেখেশুনে একরত্তি মেয়ের জিজ্ঞাসা, ‘মহিরাবণ কে দাদু?’ দাদু জানালেন, ‘একটা রাজা।’ পাল্টা প্রশ্ন, ‘মহিরাবণকে কেটে ফেলেছে কেন?’ দাদু পড়লেন ফাঁপরে। শেষটায় কী উত্তর দিলেন কোলাহলে তা ঢাকা পড়ে গেল। শুধু বুঝলাম যে, এ-বিশ্বচরাচর যে হত্যার মহালীলা, তাতে হাতেখড়ি হয়ে গেল সেই ছোট্ট মেয়ের। ছোটদের রামায়ণের সিধেসাধা বয়ান বা দিল্লি দরবারের মোহর-লাগানো রামায়ণের বাইরেও যে রামায়ণ আছে, তার ধরতাই ছড়ানো থাকল শিশুমনে।
একটু দূরে আলোছায়া সিনেমার গলির মুখে কয়েতবেলতলায় ‘সর্বজনীন শ্রীশ্রী গঙ্গামাতা পূজা’। প্রতিমার সামনে যেতে দেখি, শিশুপুত্রকে কাঁধে চড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক পিতা প্রতিমা চেনাচ্ছেন। ‘ওই দেখো, জোড়া মকরের ওপর মা গঙ্গা দাঁড়িয়ে আছেন। এক পাশে ব্রহ্মা, আরেক পাশে বিষ্ণু। আর ওই নীচে এদিকে জহ্নুমুনি, ওদিকে মহাদেব। আর ঘণ্টা হাতে যিনি পুজো করছেন তিনি ভগীরথ।’ শিশু শুনল। মন দিয়েই শুনল। তারপর শুধোল, ‘আর লায়ন কোথায় বাবা?’ মা শুনে হেসে কুটিপাটি। মাসির দরদ উথলে উঠল, ‘শিবের নিচে নন্দীকে দেখেছে তো, তাই বলছে!’ মনে-মনে ভাবি, মহিষমর্দিনী মূর্তিতে ছয়লাপ পথেঘাটে শিশুর মনে দাগ কেটে গেছে কেশর-ফোলানো সিংহের দাপট। আপাতত চোখে হারানোর দশা চলছে। দীনেশ স্মৃতি সঙ্ঘের এ-পুজোর শুরু ১৯০৭ সালে। চোখে হারানো আর চেনাশোনার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
আসলে রাস মানেই ট্র্যাডিশনের সঙ্গে ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টের এনতার মিলমিশ। মিলজুল আছে শাস্ত্রীয় থেকে লৌকিক সব পরম্পরার। নইলে শাক্ত উৎসবের আঙিনায় হরেক রকম পৌরাণিক দেবদেবীর ঠাঁই হয় কী করে? চণ্ডী আছেন, চণ্ডীমঙ্গলও আছে। উডবার্ন রোডের মুখে কমলেকামিনীর পুজো হচ্ছে। শ্রীমন্ত সওদাগরের উত্তরসাধকদের বদান্যতার কোনও ঘাটতি নেই সেখানে। অন্নদামঙ্গলের গপ্পো এখন আর ক’জন জানে! তা বলে অন্নপূর্ণার পুজো হবে না, তাও কি হয়? ওদিকে শৈব-পরম্পরা বয়ে চলেছে সন্তর্পণে। গণেশজননীকে রথে চাপিয়ে কৈলাসে নিয়ে চলেছেন শিব। সতীকে কাঁধে চাপিয়ে শিব তাণ্ডব নাচছেন। আগমেশ্বরী পাড়ায় রয়েল ক্লাবের পুজো মানেই আলোকসজ্জার ধুম। উপচে পড়া ভিড়। সব আকর্ষণের কেন্দ্রে পার্থসারথি পুজো। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে রথারূঢ় অর্জুনকে শলা দিচ্ছেন কৃষ্ণ। পূজাপ্রাঙ্গণ জুড়ে ক্যানভাসে আঁকা আছে মহাভারতের নানান এপিসোড।
এখানকার হিন্দু স্কুলের প্রাক্তনী, কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী যে আদতে নবদ্বীপের লোক, এটা খুব কম লোক জানেন। একবার মজার ছলে তিনি লিখেছিলেন, ‘নবদ্বীপ শহরকে লোকে চৈতন্যের দেশ বলে ভুল করে। চৈতন্যদেব ছিলেন সিলেটি বাঙাল, বহিরাগত টুলো পণ্ডিতদের এই শহরে জগাই-মাধাইদের সংখ্যা ও দাপট চিরদিনই বেশি।’ পুলিশ-আইন-কার্ফু দিয়েও জগাই-মাধাইয়ের ঠেকিয়ে রাখা গেছে এমনটা নয়। কেবল অত রাতে মাইক বাজানো হয়নি। অবিশ্যি দরকারটা কী! বায়না করে আনা বাজনদারের দল থাকতে কে আর রেকর্ডেড মিউজিকের ধার ধারে!
বেস্পতিবার সারা রাত ধরে রামসীতাপাড়ার বামাকালীর পুজো চলল। ঢাক বাজছে, কাঁসি বাজছে, পুরুতঠাকুরের মন্তর চলছে, উপোস করে থাকা এয়োর দল পাটভাঙা শাড়ি পরে উপচার সাজিয়ে বসে আছেন। সবার নাকের ডগায় তাসাপার্টিও বাজছে। টপ ভুজঙ্গ হয়ে নেচে চলেছেন কেউকেটা গোছের একজন। মায়ের দয়া কি তার ওপর কিছু কম পড়েছে? মোটেই না!
তবে বাজনার মতো বাজনা শুনতে চান তো আসতে হবে গানতলা রোডে। কাছাকাছি দুটো পুজো— লায়ন্স স্পোর্টিং ক্লাবের গঙ্গামাতা আর অমর ভারতী ক্লাবের গণেশজননী। দ্বিতীয়টা এবারে ১০০ পেরোল। প্যান্ডেলের সামনে মাচা বাঁধা হয়েছে। রাসের সন্ধেয় গিয়ে দেখি কলকাতার ১০৪ মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে পাঞ্জাব ব্যান্ডের বাজনদারেরা পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে রোয়াকে বসে ঝিমোচ্ছেন। ‘কী ব্যাপার? কখন বাজনা হবে?’ এঁরা বাংলা বোঝেন না। উর্দুতে ‘কুছ ওয়াক্ত বাদ হোগা’ বলে রুঠা হুয়া নজর ঘোরালেন গোবিন্দ বাড়ির দিকে। সেখানে লায়ন্স স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো। রাস্তা জুড়ে জলসাঘর! তাতে বরাবরের প্রধান আকর্ষণ চিৎপুরের ব্যান্ডপার্টি। হেঁকেডেকে আনতে হয় না। আগে পোস্টকার্ড ছেড়ে দিলেই চলে আসত। এখন ফোন যায়। এবারে ২৫ জনের দল নিয়ে এসেছে ওল্ড ক্যালকাটা ব্যান্ড আর ২০ জনের ইন্ডিয়া ব্যান্ড। আগের রাতে যোগনাথতলা মোড়ে আড্ডা মারতে-মারতে দেখছিলাম নগর সংকীর্তনের ধাঁচে আশপাশের রাস্তায় চক্কর কাটছেন তাঁরা। কী বাজাচ্ছেন? এককালে নির্ঘাত ‘গড সেভ দ্য কিং’ বাজাতেন। তা বলে এখন ন্যাশনাল অ্যান্থেম বাজে না। বাজছিল ‘ইন হি লোগো নে, লে লিয়া দুপাট্টা মেরা।’ সেই কবেকার ‘পাকিজা’র গান। আহা! ষাট-সত্তর দশকের হিন্দি ফিল্মের গানে চিৎপুর ব্যান্ডপার্টির সিদ্ধি অবিসংবাদিত হলেও দু’চারটে মান্না দে বা হাল আমলের ‘রঙ্গবতী রে রঙ্গবতী’ তারা বাজাতে পারেন না এমনটা নয়। হাজার-হাজার লোক— মূলত খাস নবদ্বীপের— ভিড় করে শুনতে এসেছেন। গোবিন্দবাড়ির চওড়া সিঁড়ি হয়ে গেছে গ্যালারি। বাদবাকিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েই আছেন। ঠাসা ভিড়। টোটো দূরে থাক, একটা বাইক অবধি গলতে পারবে না। সব চোখ মাচার দিকে। সেখানে মধ্যমণি অবশ্যই ব্যান্ডমাস্টারের হাতে থাকা ট্রামপেট। মাঝে মাঝে ছোট-ছোট কাউন্টার পার্ট বাজছে ক্ল্যারিওনেটে। কামাল করছে একটা-দুটো টেনর স্যাক্সোফোন। তাল ঠুকছে দুটো ড্রাম। ধুয়ো ধরার জন্য আছে এক সারি করনেট, যাকে এরা বলেন ‘ব্রাস’। ওল্ড ক্যালকাটার দলে বাড়তি বলতে দুটো গম্ভীর-নিনাদী ফ্রেঞ্চ হর্ন। ‘হোঁঠো মে অ্যায়সি বাত’-এর এক-একটা কলির শেষে গাল ফুলিয়ে একবারটি ভোঁ করলেই কামাল! আজকের নবদ্বীপ ‘জুয়েল থিফ’ দেখেনি। নদিয়া টকিজের মতো পুরনো সিনেমা কবেই মার্কেট হয়ে গেছে। কিন্তু গানগুলো রয়ে গেছে। এমনিতে ইতি-উতি পান্নালাল ভট্টাচার্যের গান বেজেছে। সারা দিনমান। বিকেলবেলায় দেয়ারাপাড়ার এক গলি থেকে শ্যামাসঙ্গীতের চেনা সুর কানে আসতে থমকে গেলাম। প্যান্ডেলের সামনে গিয়ে দেখি ছোটখাটো ক্যাসিও কি-বোর্ডে আঙুল চালিয়ে ‘আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’ বাজাচ্ছেন তাসাপার্টির লিডার। চোখ বুজে। কার ধ্যান করছেন? শ্যামা মায়ের? কে জানে! অথচ সামনে যে ঠাকুর সাজানো হচ্ছে সেটা গঙ্গামাতার!
এই সমন্বয়ের চেতনাই নবদ্বীপের রাসের তুরুপের তাস। দিনে-দিনে তা বাড়ছে বই কমছে না! সারাদিন ধরে যে ভোগ বিলোনো হল, তা তো জাত-বেজাতের মুখে নুড়ো জ্বালিয়েই হল। ভরদুপুরে রানির ঘাট থেকে শহরের দিকে যেতে দেখি কাতারে-কাতারে লোক দাঁড়িয়ে প্রসাদের জন্য। মহিষমর্দিনী পুজোর প্যান্ডেলের সামনে থেকে লাইন চলে গেছে প্রায় দুশো মিটার দূরের রানি রাসমণির পুজোবাড়ি অবধি। হিন্দু-মুসলমান সবাই ‘মহাপ্রসাদ’ হাতে তুলে নিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। পৌরসভার জলের গাড়িতে হাত ধুয়ে আঁচিয়ে ফের পথে নামছেন। শালপাতায় বড় থালায় করে কী খাওয়ানো হচ্ছে দেখি? কাজু-কিশমিশ দেওয়া পুষ্পান্ন, নতুন ফুলকপি আর ডুমো-ডুমো করে কাটা আলুর তরকারি আর ঘন দুধের পায়েস। চিনতে পেরে এক আয়োজক শুধোলেন, ‘স্যার, প্রসাদ খাবেন?’ মাথা নাড়তেই হল।
এই উদারতার সামনে বছর-বছর শুধু মাথা নাড়ানো নয়, মাথা নামাতেও আমি রাজি।
ছবি সৌজন্যে: লেখক