ওদিকে আউট-ডোরের সেট-এ তখন সব বিপর্যস্ত অবস্থা। গুরুস্বামী, ক্যামেরাম্যান মূর্তি, প্রোডাকশনের শ্যাম— তারা সবাই হতবাক। শুটিং হবে না? গুরু কি তবে এ-ছবি করবে না। সাত রিল ফিল্ম যে তোলা হয়ে গেছে। এখন কি হবে? আর গীতা? গীতাও তখন মেক-আপ মুছে ফেলেছে। সেও জানে না গুরু তাদের সবাইকে ফেলে কোথায় চলে গেছে। তখনও কেউ জানে না গুরু বোম্বাইতে ওয়াহিদা রেহমানকে ট্রাঙ্ককলে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছে!
সেদিন রাত্রে যদি বোম্বাই থেকে ওয়াহিদা রেহমান কলকাতায় না এসে পড়ত, তো কি হত বলা যায় না। সেদিন দুজনের মধ্যে কি কথা হয়েছিল, তা ওরা দুজন ছাড়া কেউই জানে না। কিন্তু দল-বল সবাই চলে গেল কলকাতার ছেড়ে। গীতাও চলে গেল বোম্বাই। একটা বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছিল বোম্বাই থেকে, তাও বন্ধ হয়ে গেল। গুরু যে আসলে বাঙালি, সে যে বাঙালির মতোই গড়গড় করে বাংলা বলতে পারে, তাও কেউ জানতে পারল না।
পরদিন রামু আবার এল হোটেলে।
গুরু বলল— রামু, তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ কাল। ওয়াহিদা যদি কাল না আসত তো আমি কি করতুম বলা যায় না—
রামু সারিয়া আজও এই কলকাতার শহরে আছে। আজও সে-কাহিনী বলতে- বলতেরামুর চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে।
রামু সারিয়া এক অদ্ভুত ছেলে। কলকাতার সমাজে রামু সারিয়ার নাম আছে। চৌরঙ্গীর ‘অটো ডিসট্রিবিউটার্স’ অফিসের সে হল মালিকপক্ষ। তার সঙ্গে গুরু দত্তের প্রথম পরিচয় হয় বেইরুট এয়ারপোর্টে। গুরু তখন গীতার সঙ্গে ইন্ডিয়া থেকে ইংল্যান্ড যাচ্ছে। ওই এয়ারপোর্টেই দুজনের সঙ্গে রামু সারিয়ার দেখা। তখন সবে নতুন বিয়ে হয়েছে। গীতারই নাম তখন বেশি, গুরুর তেমন বিশেষ নাম নেই। রামু গীতাকে চিনতে পেরে পকেট থেকে একটা অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে তার সামনে ধরলে— দয়া করে সই দিন—
গীতা সই করে দিলে। দিয়ে বলল— এই আমার হাজব্যান্ড ‘গুরু দত্ত’-র সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই—
গুরু দত্ত নমস্কার করলে। বললে— আপনি কি পাঞ্জাবি?
রামু বললে— না মাড়োয়াড়ি—
সেই দিনই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। তখন থেকেই রামুর সঙ্গে গুরু দত্তের পরিচয়, সেদিন গুরু আর গীতা লন্ডনে চলে গেল। আর রামু লন্ডন থেকে ফিরে এলো ইন্ডিয়াতে। কিন্তু সম্পর্ক সেখানেই শেষ হল না। চিঠিপত্র চলতে লাগল। রামুও নিজের পারিবারিক ব্যবসার খাতিরে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। ছোটবেলা থেকে লন্ডন গিয়ে গিয়ে লন্ডন তার কাছে নিজের ঘর-বাড়ি হয়ে গেছে। তাঁর কাছেই শুনেছি বিয়ের প্রথম ছবছর ওদের খুবই মিল ছিল দুজনে। গীতাকে না হলে গুরুর এক মিনিটও চলত না। গীতা কোথাও গান গাইতে গেলে গুরুও সঙ্গে যেত। গীতা তখন হাজার-হাজার টাকা ইনকাম-ট্যাক্স দিয়েছে বছরে, আর গুরু তখন মাইনে পায় মাত্র সাতশো টাকা।
কিন্তু গ্রহ বল গ্রহ, ভাগ্য বল ভাগ্য, দুজনের জীবনেই একদিন অন্ধকার নেমে এল অকস্মাৎ। সে অন্ধকার ওয়াহিদা রেহমান নয়। সে-অন্ধকার দুজনের মনে। দুজনের মনের মধ্যেই তখন একঘেয়েমির যন্ত্রণা। গীতা শিল্পী, সে গান-পাগল মেয়ে। আর ওদিকে গুরুও শিল্পী। সে সিনেমা-পাগল মানুষ। একদিন নেশার ঝোঁকে গীতাকে বিয়ে করে ফেলেছিল সকলের অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে। তারপর যা হয়, ক্লান্তি নেমে এল। এ ক্লান্তি শিল্পীর ক্লান্তি। প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে নতুন করে নবজন্ম লাভ করতে চায় প্রত্যেক শিল্পী। যা কিছু পুরনো তা সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে যায়। তাই একদিন গীতা দেখলে গুরু তাকে পিছনে ফেলে আবার অন্য দিকে ছুটেছে।
কিন্তু তখন আর ছাড়াছাড়ি হবার উপায় নেই।
তখন গুরু দত্তের খ্যাতি গীতার খ্যাতিকে ছাড়িয়ে গেছে। তখন জীবনের জুয়াখেলায় গীতা হেরে ফিরে এসেছে। আর গুরুর কপালে কেবল জয়, কেবল অভিনন্দন, কেবল উন্নতি। গুরুর তখন সুন্দর বাড়ি হয়েছে পালি-হিলের মাথার ওপর। গুরুর বিরাট স্টুডিও হয়েছে। গুরুর সুনাম ছড়িয়ে গেছে সারা ইন্ডিয়াতে। গুরুর সঙ্গে দেখা করাই এক সমস্যা। গুরু সেই সকালবেলা সাতটার সময় স্টুডিওয় বেরিয়ে যায়, আর আসে রাত্রে। তখনও গীতা জেগে বসে থাকে বাড়িতে। জেগে বসে থাকতে থাকতে তার চোখ ঢুলে আসে।
কিন্তু যখন গুরু আসে তখন সে মানুষটাও আর প্রকৃতিস্থ নয়। তখন অনেক হুইস্কি পেটের ভেতর সেঁধিয়েছে। তখন মুখের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, পা টলছে, হাত কাঁপছে। ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতে হয় তাকে।
এইসব দিনের ঘটনা দেখিনি, শুনেছি।
বললাম— তারপর?
রামু বললে— তারপর আর একটা ঘটনা ঘটল—
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত