ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভাইফোঁটার চিঠি


    দোলন গঙ্গোপাধ্যায় (November 6, 2021)
     

    ডিয়ার দাদা, আজ এগারো মাস উনিশ দিন হল আমি বাড়ি ছেড়েছি। এই এগারো মাসে এমন একটা দিন যায়নি যে আমি তোদের কথা ভাবিনি। আজও তোদের কথা, তোর কথা খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, ছোটবেলায় মামাবাড়ি ডানকুনিতে ভাইফোঁটাগুলোর কথা। মায়ের সঙ্গে ভোরবেলা লোকাল ট্রেনে চেপে ডানকুনি যেতাম আমরা। শিয়ালদা স্টেশন থেকে বাবা আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে পিসির বাড়ি চলে যেত। তুই জানিস না দাদা, মামাবাড়ি পৌঁছেই আমি ছুট্টে বাগানে চলে যেতাম দুব্বো তুলতে। তুই আমার মাথায় যখন ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতিস, আমার গা-টা কেমন শিরশির করত রে, দাদা! মনে হত, তোর আশীর্বাদে অলৌকিক কিছু লুকিয়ে আছে!

    আমার চন্দন বাটতেও খুব ভাল লাগত। দিদা আমাকে একটা ছোট্ট চন্দন পিঁড়ি কিনে দিয়েছিল, তোর মনে আছে? খুব যত্ন করে তোর জন্য চন্দন বাটতাম আমি। প্রতিবার চন্দন কাঠ ঘোরাতে ঘোরাতে মনে মনে বলতাম, আমার দাদা যেন মস্ত বড় মানুষ হয়! আচ্ছা দাদা, আজ মনে হয়, ভাইফোঁটার সব কাজ আমি-ই করতাম কেন? দূর্বা বাছা, চন্দন বাটা, মিস্টির প্লেট সাজানো, আসন পাতা…সব কাজ আমিই করতাম আর তুই মহারাজার মত আসনে বসে আমাকে ধন্য করতিস। তোর জীবন প্রার্থনা ক’রে আমি ফোঁটা দিতাম, আমার দীর্ঘায়ু চেয়ে তুই কোনওদিন আমাকে ফোঁটা দিলি না কেন রে দাদা?

    যাক গে, বাদ দে পুরোনো কথা। আজ তোর জন্য আমার মন কেমন করছে। আচ্ছা দাদা, বাবা-মা, পিসি- পিসান, মাসিমনির কথা বাদ দিলাম, কিন্তু তুই এই এগারো মাস উনিশ দিনে আমাকে একবারও ফোন করলি না? আমার নম্বর কি তুই ডিলিট করে দিয়েছিস? আমাকে কি সত্যিই তোর আর মনে পড়ে না? পাড়ার বন্ধুদের মুখে খবর পাই, আমার নামে নাকি পাড়ায় ঢি ঢি পড়েছে। গাঙ্গুলি বাড়ির মেয়ে কী ভাবে একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি ক’রে পালিয়ে গেল? তোদের না কি পাড়ায় মুখ দেখানো মুশকিল হয়েছে। প্রথম ক’মাস তোরা বাড়ি থেকে বেরোলে লোকে নাকি টিটকিরি করত। জানি, তোদের বিপদে ফেলেছি আমি। কিন্তু কী করব বল, আমি যে সফিকে ভালবাসি। তোদেরও ভালবাসি খুব।তাই আমার শাঁখের করাতের দশা তখন। তোকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম দাদা। কিন্তু তুই আমাকে থাপ্পর মেরে যেদিন ঘরে আটকে দিলি, আমি অবাক হ’য়ে ভাবলাম, এ কোন দাদা! এই দাদাই ছোটবেলা থেকে আমাকে দেশবিদেশের গল্প বলেছে, প্রতি ভাইফোঁটায় ভাল ভাল বই উপহার দিয়েছে, মানুষে মানুষে ভালবাসার গল্প বলেছে! হাঁ হয়ে যাওয়া আমি ভাবলাম,মুসলমান ছেলেকে ভালবাসা কি মানুষে মানুষে ভালবাসার অভিধান বহির্ভূত? আমি তো ভালইবেসেছি, খুন তো করিনি! তাহলে আমাকে কেন অমন শাস্তি দিলি দাদা, যে আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলাম!

    কী ভাবছিস আমাকে ধর্ম পরিবর্তন করাবে সফি? আমাকে বুরখা পরতে বাধ্য করবে সফির পরিবার? তোরা ভেবেছিস, সফি ভুলিয়েভালিয়ে আমাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে যে কেমন একটা হিন্দু মেয়েকে মুসলমান করে নিলাম? দাদা, তুই ভুলে গেলি, আমি সারাজীবন পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছি। কোনও কোনও পরীক্ষায় তোর থেকেও বেশি নম্বর পেয়েছি। চাকরির পরীক্ষায় সফল হয়ে চাকরি পেয়েছি। সেই আমাকে সফি ভোলাতে পারবে? তোর নিজের বোনের প্রতি তোর এইটুকু ভরসাও নেই? আসলে তুই শুধু সফি এবং ওর পরিবারকে, ওর সম্প্রদায়কে ঘৃণা করিস না, তুই তোর মায়ের পেটের বোনকেও মানুষের মর্যাদা দিস না। কী বলতো, তুই একটা চলতি বৃত্তের মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভেতরের মানুষটাকেও মর্যাদা দিলি না, যাতে তোকে সবাই ব্রাত্য করে দেয়। সব দিক দিয়ে ভাল ছেলের তকমাটা তোর কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়ি

    আজ ভাইফোঁটা। তোকে কড়া কথা বলতে ভাল লাগছে না। কিন্তু বিশ্বাস কর, সফি আর আমি দুজনে দুজনকে ভালবাসি। সফির বাবা-মা, পুরো পরিবার আমার প্রতি বেশি সজাগ। আমাকে এখানে কেউ কোন কিছু করতে বাধ্য করেনা। আমার চাকরির পোস্টিং-ও হ’য়ে গেছে। আমি রোজ সকালে খেয়ে দেয়ে অফিস যাই। আমার আর সফির দুজনের টিফিন গুছিয়ে দেন সফির মা। আমি মোটের ওপর আদরেই আছি রে, দাদা। আসলে কী জানিস, তুইও যদি ওই গঙ্গোপাধ্যায় পুরুষের মুখোশ সরিয়ে সফিকে দেখতিস, আমাকে দেখতিস, তাহলে দেখতে পেতিস ধর্ম আলাদা হলেই মানুষ মন্দ হয় না। পৈতের অহমিকা ছেড়ে যদি কখনও বোনের বাড়ি আসিস, তবে দেখতে পাবি, মেলামেশার অভাব দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কেমনভাবে বিভেদের বেড়াজাল বুনেছে, একে অপরের সম্পর্কে অজ্ঞানতা কেমনভাবে মিথ্যের ইমারত গড়ে তুলেছে। জানি, তুই ভাবছিস, কী করতে পারিস তুই? পরিবারের সম্মানহানি হলে সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য বড় ছেলে হিসেবে আর কী-ই করার ছিল তোর?

    আজ ভাইফোঁটা। তোকে কড়া কথা বলতে ভাল লাগছে না। কিন্তু বিশ্বাস কর, সফি আর আমি দুজনে দুজনকে ভালবাসি। সফির বাবা-মা, পুরো পরিবার আমার প্রতি বেশি সজাগ। আমাকে এখানে কেউ কোন কিছু করতে বাধ্য করেনা। আমার চাকরির পোস্টিং-ও হ’য়ে গেছে। আমি রোজ সকালে খেয়ে দেয়ে অফিস যাই। আমার আর সফির দুজনের টিফিন গুছিয়ে দেন সফির মা। আমি মোটের ওপর আদরেই আছি রে, দাদা। আসলে কী জানিস, তুইও যদি ওই গঙ্গোপাধ্যায় পুরুষের মুখোশ সরিয়ে সফিকে দেখতিস, আমাকে দেখতিস, তাহলে দেখতে পেতিস ধর্ম আলাদা হলেই মানুষ মন্দ হয় না।

    আমি তোকে একটু অন্যভাবে ভেবে দেখতে বলি? বাড়ির মেয়ে অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করলে, তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে, তার সন্তান গর্ভে ধরলে, পরিবারের সম্মান যায় কীভাবে, সে প্রশ্নটা আগে কর নিজেকে? মেয়েদের ভালবাসা এবং যৌন পছন্দের সঙ্গে পরিবারের মানসম্মানের কী সত্যি কোনও সম্পর্ক আছে? পরিবার মানে ভালবাসার মানুষজন একসঙ্গে থাকবে, কিন্তু একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কেন বলতো?পরিবারের সম্মানের নামে তুই আমার ইচ্ছেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিলি ,দাদ! এ কেমন ভালবাসা! আমি একজন স্বাধীন স্বাবলম্বী নাগরিক দাদা,পরিবারের মান বাঁচানোর পুতুল নই। লজ্জার মাথা খেয়ে তোকে লিখছি (সামনাসামনি এ কথা বলতে পারতাম না তোকে), একটু ভেবে দেখ, গাঙ্গুলিবাড়ির সম্মান কি বাড়ির মেয়েদের যোনিতে লুকিয়ে আছে?

    অনেক কিছুই তুই করতে পারতিস,দাদা। এখনও পারিস। তুই বুক ফুলিয়ে আমার পাশে দাঁড়াতে পারতিস। বাবা-মার সঙ্গে আমার হ’য়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে পারতিস। পাড়ার লোকের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে পারতিস। তাদের বলতে পারতিস, ‘আমরা তোমাদের খাইও না, পরিও না, তবে আমার বোন কাকে বিয়ে করবে, তা নিয়ে তোমাদের এত মাথা ব্যথা কিসের?’ আমাকে আর সফিকে নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে দিতে পারতিস। সব থেকে বড় কথা হল, আমার ওপর ভরসা রাখতে পারতিস। আমাকে সম্মান করতে পারতিস।
    বুকের বোঝা হাল্কা করে অনেক কথা বললাম। রাগ করিস না, দাদা আমার। আজ ভাইফোঁটা। আমি তোর মঙ্গল কামনায় দেওয়ালে ফোঁটা দেব আজ। তুইও যদি আমাকে মনে ক’রে দেওয়ালে একটা চন্দনের টিপ দিস, যদি গাঙ্গুলিবাবুর মুখোশ ছেড়ে আমার কথা ভাবিস, সেটাই হবে আমার ভাইফোঁটার সেরা গিফট।
    ভাল থাকিস দাদা।
    ভালবাসায়,
    তোর পালিয়ে-যাওয়া বুনি

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook