কলকাতায় একদিন রামু সারিয়ার সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল হঠাৎ– রামুর কাছেই সব ঘটনাটা শুনলাম। গুরু তখন বাংলা ছবি করতে এসেছে কলকাতায়। একেবারে গ্রামের ছবি। নায়িকাও গ্রাম্য মেয়ে। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছে গীতা। সঙ্গে এসেছে গুরুর দলের লোকেরা। ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে নাপিত, ধোপা সবাই। নিউ আলিপুরে একটা বাড়ি ভারা করে সবাই সদলবলে এসে উঠেছে।
আউটডোর শুটিং মানেই এলাহি অর্থ-ব্যয়। যদিও বাংলা ছবি, কিন্তু তবু তো গুরু দত্তের ছবি। গুরু দত্ত অল্প খরচে কিছুই করতে পারে না। ভালো ছবি করতে গেলে টাকার কার্পণ্য করলে যে চলে না, তা গুরু দত্ত জানে! তা সে হিন্দি ছবিই হোক বাংলা ছবিই হোক। দলবল নিয়ে গুরু আর গীতা ভোরবেলাই বেরিয়ে যায়। শুটিং চলছে অজ পাড়াগাঁয়ের মধ্যে। গুরুই ছবির পরিচালক, প্রযোজক আর নায়ক। আর নায়িকা গীতা।
সারা ভারতবর্ষে তখন সাড়া পড়ে গিয়েছে যে গুরু দত্ত বাংলা ছবি করছে। দুহাতে টাকা খরচ হচ্ছে জলের মতো। ছবি করবার সময় গুরুর খেয়াল থাকে না যে কত টাকা খরচ হচ্ছে। শুধু একটা খেয়াল থাকে যে ছবি যেমন করে হোক ভালো করতে হবে। তাই সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শুটিং চলে। তারপর সেখান থেকে সবাই ফিরে আসে নিউ আলিপুরের বাসা-বাড়িতে। তখন গুরু চলে যায় রাশ-প্রিন্ট দেখতে। সেখানে গিয়ে সমস্ত রাত ছবির রাশ-প্রিন্ট দেখে আবার ভোরবেলা বেরোয় শুটিং করতে।
আর শুটিং কি শুধু এক জায়গায়। কোনওদিন এঁদো পানা-পুকুরের পাড়ে, কোনও দিন মজা নদীর ঘাটে। আবার কোনওদিন বা ধানক্ষেতের এবড়ো-খেবড়ো জমিতে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বাধা পড়ল। কিসের বাধা?
রামু সারিয়া গল্পটা বললে— একদিন সকালবেলা আমিও গিয়েছি। গুরু শুটিং করবে। সব রেডি। গীতাকে মেক-আপ করতে পাঠিয়ে দিলে।
মেক-আপ মানে কিছুই নয়। একটা আধ-ময়লা শাড়ি পরবে নায়িকা। চুলটা এলো। কপালে এক কাঁচ-পোকার টিপ। তার বেশি কিছু নয়।
একসময়ে সব ঠিক হয়ে গেল।
গুরু হুকুম দিলে— গীতাকে ডেকে নিয়ে এসো— বল সব রেডি—
লোক গেল গীতাকে ডাকতে। খানিক পরে ফিরে এসে বললে— একটু দেরি আছে, এখনও মেক-আপ শেষ হয়নি—
আবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। সবাই চুপচাপ বসে রইল। গল্প-গুজব চলতে লাগল। কিন্তু শুটিং-এর সময় বড় দামী সময়। অত হেলা-ফেলায় সময় নষ্ট করা চলে না। কতরকম বাধা আসতে পারে। আকাশে মেঘ করতে পারে, বৃষ্টি আসতে পারে। অনেক রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে এ-সব ব্যাপারে। গুরু বললে— দেখ রামু, গীতা কেমন দেরি করছে, এত দেরি করলে সব কাজ নষ্ট হয়ে যাবে—
তারপর বললে— রামু, একবার গিয়ে গীতাকে ডেকে নিয়ে এসো—
রামু গেল। গিয়ে দেখল গীতা মাথার চুল খুলছে, আবার নতুন করে অন্য স্টাইলে তৈরি করছে।
রামু বললে— বউদি শিগগির করুন, সবাই রেডি—
গীতা আয়নার দিকে চেয়ে বললে— এই হয়ে এল ভাই—
কিন্তু আরো অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। তবু গীতার দেখা নেই। গুরু রেগে গেল। আরও থাকতে পারল না। নিজেই উঠল। উঠে মেক-আপ রুমের দিকে গেল। গিয়ে গীতার মেক-আপ দেখে অবাক।
বললে— এ কি, এ কি করেছ কি?
রাগে গুরুর আপাদ-মস্তক তখন জ্বলছে।
বললে— কে তোমাকে এ-রকম মেক-আপ করতে বললে?
সেদিন সে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সেই গ্রামের ভেতর। গুরু দত্ত ছবির ডাইরেক্টর আর স্ত্রী নায়িকা। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা পারিবারিক সম্পর্ক, সেখানে দয়া আছে, মায়া আছে, স্নেহ-ভালোবাসা-প্রীতি সবই আছে। কিন্তু বাইরে স্বামী একজন শিল্পী। শিল্পী যখন সৃষ্টি করেন তখন তিনি শিল্পের খাতিরে নির্মম-নিষ্ঠুর। তখন গীতা আর স্ত্রী নয়, সে একমাত্র ছবির নায়িকা। সেইখানেই বাধল বিরোধ।
গুরুকে যারা জানে তারা বলতে পারে সেট-এর বাইরে সে অন্য লোক। তখন সে দাতা, তখন সে বন্ধু, তখন সে প্রেমিক, তখন সে সামাজিক জীব, তখন সে সহৃদয় পিতা-স্বামী-ভাই, সব কিছু। কিন্তু সেট-এর মধ্যে সে শিল্পী।
লেখার সময় যেমন আমি লেখক, আর কিছু নই, ছবি তোলার সময়ও গুরু তখন পরিচালক। গুরুর তখনকার অবস্থা আমি দেখেছি। তখন সে খাওয়ার কথা ভুলে যায়, সন্তানের কথা ভুলে যায়, আরামের কথা ভুলে যায়। তখন সে বড় নির্দয় মানুষ। কারো কথা সে শুনতে রাজি নয়, তা সে স্ত্রীই হোক আর বাবা-মাই হোক।
সেদিনও ঠিক সেই রকম অবস্থা! এর আগেও কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেদিন সেটা চরমে গিয়ে ঠেকাল। গুরু বলল— তোমাকে আমি বলেছি যে নায়িকার মেক-আপ হবে সিম্পল, বেশি সাজ-গোজ নেই—
গীতা বললে— তা আমি কি সেজেছি? আমি তো তোমার বাছা মোটা শাড়ি পরেছি—
— কিন্তু হেয়ার-স্টাইল? পাড়াগাঁয়ের মেয়ে কি অমন করে খোঁপা বাঁধে? তুমি অমন করে হেয়ার-স্টাইল করলে কেন?
গীতা আর থাকতে পারলে না। বললে— তা তুমি কি চাও আমাকে ওয়াহিদা রেহমানের চেয়ে খারাপ দেখাক?
আর যায় কোথায়! যেন হঠাৎ বোমা ফাটল মাথার ওপর। কিংবা বোমা ফাটলেও বুঝি এর চেয়ে ভালো হত। গুরু আর দাঁড়াল না সেখানে। গট গট করে বাইরে চলে গেল। সেট-এ গিয়ে চিৎকার করে উঠল— প্যাক আপ— প্যাক আপ—
তারপর আর কোনও কথা নয়। আর সেখানে দাঁড়ালো না। সোজা গাড়িটা নিয়ে স্টিয়ারিং ধরে উল্টো দিকে চলে গেল। নিউ আলিপুরেই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল! কিন্তু সেদিকে নয়, চলতে লাগল একেবারে চৌরঙ্গীর দিকে।
চৌরঙ্গীর একটা বার-এ গিয়ে উঠল। উঠেই অর্ডার দিলে— হুইস্কি—
দামী হুইস্কি এল সেই অসময়ে। গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি ঢালতে লাগল পেটের ভেতর। সঙ্গে রামু সারিয়া ছিল।
রামু বলল— করছ কি ভাইয়া? এত খাচ্ছো কেন?
গুরু বললে— এক কাজ করো রামু—
রামু বললে— কি কাজ?
গুরু বললে— একবার বোম্বেতে ট্রাঙ্ককল করো টেলিফোনে—
রামু বললে— কোথায়? কাকে ট্রাঙ্ককল করব?
গুরু বললে— ওয়াহিদাকে—
রামু স্তম্ভিত হয়ে গেল। গুরু আবার বললে— ওয়াহিদাকে বল সে যেন কলকাতায় চলে আসে এখুনি, আর যেন এক মুহুর্ত দেরি না করে—
রামু তখনও নড়ে না। গুরু আবার গেলাস মুখের ভেতর ঢেলে দিল। তারপর টেলিফোন করে দিল গ্রেট-ইস্টার্ন হোটেলে। সেখানে যেন একটা ঘর রিজার্ভ করে রাখা হয় ওয়াহিদা রেহমানের জন্যে। টেলিফোনটা করে এসে গুরু আবার গেলাস নিয়ে বসল।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত