ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সুরকারের সুরকার


    পূর্বায়ন চ্যাটার্জী (October 18, 2021)
     

    তাঁর মার্জিত, নম্র স্বভাবের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক ডানপিটে হৃদয়, যা নিজের সাঙ্গীতিক কল্পনার সাহায্যে যে কোনও শক্তির সাথে লড়তে সদাই তৈরি। সমসাময়িক সব বাঘা-বাঘা কিংবদন্তিদের ভিড়ের মধ্যেও নিখিল ব্যানার্জি নিজের এক আশ্চর্য স্টাইলের সৃষ্টি করেছিলেন। এবং সেতার বাজানোর শিল্পের ও মুন্সিয়ানার সব গুণ বজায় রেখেই (যে সব গুণ অন্যান্য শিল্পীরাও আয়ত্ত করেছিলেন)  তাঁর অভিনবত্ব কোথাও আলাদা করে রেখেছিল তাঁকে।  

    এই অসামান্য প্রতিভাধর বিরাট মানুষটির সাথে আমার প্রথম আলাপের স্মৃতিগুলো একটু ঘোলাটে হয়ে এসেছে, কারণ তখন বয়সটা খুব কম ছিল। আবার অন্যদিক থেকে সে স্মৃতিগুলো স্পষ্টও হয়ে রয়েছে, কারণ তাঁর বাজনা ছিল আমার ভাবনা-চিন্তার এক বিপুল রসদ। আমার যখন সাত বছর বয়স, সবে রবীন্দ্রনাথের দুটি গান এবং যন্ত্রসঙ্গীতের একটি গৎ বাজাতে শিখেছি, তখন আমার বাবা আমায় নিয়ে গেছিলেন মানুষটির কাছে। হাই পাওয়ারের মোটা কাচের চশমার ভিতর দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন আমার ডান এবং বাঁ-হাতের চলন। তারপরে বাবাকে এক রাশ আনন্দ উপহার দিলেন। কী উপহার? তিনি কথা দিলেন— আমি কৈশোরে পদার্পণ করলে, তাঁর বাড়িতে থেকে তাঁর পৃষ্ঠপোষণে খাওয়া-পরার বয়স হওয়ার পর তিনি সাবেকি গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আমাকে শিক্ষা দেবেন। কিন্তু হায়, সে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হওয়ার ছিল না! আমার যখন ন’বছর বয়স, তখন পঞ্চাশের মাঝামাঝি বয়সে তিনি অকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

    সেদিন থেকে আমি পরোক্ষ ভাবেই চেষ্টা করেছি তাঁর প্রকৃত শিষ্য হয়ে ওঠার। আমার বাবার সঙ্গীতচিন্তার সাহায্যে, এবং কোনও মন্ত্রবলে নানা জায়গা থেকে জোগাড় করা বিভিন্ন ক্যাসেটের সাহায্যে, তাঁর সঙ্গীতচিন্তাকে অনুসরণ করেছি। আমার বাবার কথা না বলে নিখিলজীর কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। বাবার মধ্যে দেখেছি তাঁর সঙ্গীত সংগ্রহ করার এক তীব্র বাসনা, মাঝে মাঝেই এস-ফোর্টিন বাসে বাড়ি ফেরার সময়ে তাঁকে দেখেছি তেহাই গুনতে। সে সব সময় মোবাইল ফোন বা ভয়েস নোট পাঠানোর যুগ ছিল না।

    নিখিল ব্যানার্জির সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। বাজনার একটিও চলন শুনে একঘেয়ে বা আগে থেকে মাপজোখ করে বাজানো মনে হত না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অভিনবত্বই হচ্ছে , খানিকটা নিয়মমাফিক বেঁধে দেওয়া একটা গণ্ডির ভিতরে অনেকটা স্বাধীন ভাবে খেলার জায়গা করে দেয়। আগে থেকে বাঁধা নিয়মের মধ্যেই নতুনত্ব খুঁজে নেওয়া— একেই শিল্প বলে। সমস্ত মহান শিল্পীদের মতোই নিখিলজীরও দর্শন ছিল এক-একটি মুহূর্তের মধ্যে সঙ্গীতের অন্তরাত্মার সন্ধান করা। লয়ের ব্যাপারে তাঁর দর্শন উপজ অঙ্গে সমান ভাবে এসে মিশত। তানগুলো প্রায়ই গিয়ে শেষ হত তেহাইতে, যা উঠে আসত তানের ভিতর থেকেই। তাঁর সেতারের পরিবর্তিত, রাউন্ডেড আওয়াজে চমৎকার খেলত খেয়াল আর ঠুমরি গায়কীর ভাষ্য। মৌলিকত্বের সন্ধানেই তিনি সেতারে ব্যবহার করতে শুরু করেন একটু মোটা তার, যাতে আওয়াজটা আরও খানিকক্ষণ বেশি গমগম করে।

    মাঝে মাঝে ভাবি, কীভাবে কিছু রাগ আমি শিখেছিলাম! বাবার মুখে খালি শুনতাম, ‘দাদা এই বলতেন, দাদা ওই বলতেন।’ আর আমিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের সাথে বকবক করে যেতাম মহান শিল্পীর সাথে এক কাল্পনিক কথোপকথনে। তাতে আশেপাশের লোকজনের অবশ্য আমাকে পাগল ভাবার সম্ভাবনা ছিল ষোলো আনা।

    সমস্ত মহান শিল্পীদের মতোই নিখিলজীরও দর্শন ছিল এক-একটি মুহূর্তের মধ্যে সঙ্গীতের অন্তরাত্মার সন্ধান করা। লয়ের ব্যাপারে তাঁর দর্শন উপজ অঙ্গে সমান ভাবে এসে মিশত। তানগুলো প্রায়ই গিয়ে শেষ হত তেহাইতে, যা উঠে আসত তানের ভিতর থেকেই। তাঁর সেতারের পরিবর্তিত, রাউন্ডেড আওয়াজে চমৎকার খেলত খেয়াল আর ঠুমরি গায়কীর ভাষ্য। 

    আজ না জানি, কতজন সেতারবাদকের মনে এক অন্তহীন প্রভাব ফেলে গেছেন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি। যদি কারও বাসনা হয়, বাজনায় একাধারে উদ্দীপনা, ভাবমূর্ছনা, সাংগঠনিক অখণ্ডতা, ধ্রুপদিয়ানা, অন্তর্ভুক্তি এবং সততাকে আয়ত্ত করবেন, তবে তাঁর সঙ্গীতচিন্তাকে ধ্রুবতারা করে এগোনো ছাড়া কোনও রাস্তা নেই। 

    মারওয়া রাগের একটি পরিবেশনার কথা না বলে পারব না, যা নিখিলজী বাজিয়েছিলেন আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকে। সেই বাজনা আমার কাছে হয়ে উঠেছিল হিন্দুস্তানি সঙ্গীতজগতের এক আশ্চর্য হাতছানি। অথবা অ্যামস্টারডামে বাজানো তাঁর খামাজ, যা আমাকে দেখিয়েছিল কী করে গণ্ডিগুলোকে হেলায় ডিঙিয়ে গিয়েও রাগের প্রতি অনুগত থাকা যায়। এমন আরও কত রয়েছে, যা নিয়ে বাবা আর আমি একসাথে গবেষণা করেছি, শিক্ষালাভ করেছি তার থেকে।

    ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ এবং পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি

    ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে নিখিলজীর বাজনা ছিল অতুলনীয়, বিপুল, বিমূর্ত সঙ্গীতজগতে ঢোকার দরজা, যে জগৎটা তখন উজ্জ্বল লাগত, তবে ঠিক ধরতে পারতাম না। কিন্তু ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের বাজনা তখনও মগজে তত ঢুকত না। খাঁ সাহেবের সঙ্গীত যখন আবার শুনি, বা নিখিলজীর সাথে তাঁর দ্বৈত বাজনা যখন শোনার সুযোগ হয়, কল্পনার দৃষ্টিতে যেন দেখতে পাই এই দুই মহান পণ্ডিতের জীবন, তাঁরা সৃষ্টি করছেন অভিব্যক্তির এক সাঙ্গীতিক প্রথা, যা চিরকাল প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। তাঁদের সঙ্গীতে তাঁরা যাপন করছেন কালোত্তীর্ণ এক সজীবতা, যার ব্যাপ্তি বাখ্‌, বিঠোফেন, মাইলস ডেভিস, চিক কোরিয়া, অথবা বিটল্‌স বা কিশোর কুমার বা লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গীত পর্যন্ত। কালের সাগরে পাড়ি দিতে দিতে আমি প্রতি যুগেই নানা মহান সঙ্গীতের সাক্ষাৎ পাব বটে, তবে কোনও কোনও নক্ষত্রপুঞ্জ চিরকালই সহস্র কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে উজ্জ্বল ভাবে আমাদের আলো দিয়ে যাবে।

    আমার সাঙ্গীতিক যাত্রার একটা সময়ে বুঝতে পারলাম, এবার নিজের মতো করে আমাকে ডানা মেলতে হবে। তার মানে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং নিজের মতো করে কথা বলার ভাষা খুঁজে নেওয়া। একজন মানুষের ভাষ্য কখনওই অন্য একজনের গল্পটা পুরোটা বলতে পারে না, তা সে-ভাষ্যের ব্যাপ্তি যতই বিরাট হোক। খুঁজতে শুরু করলাম সেই পথের প্রদীপগুলোকে, যারা আমাকে আমার নিজের রাস্তাটা চিনিয়ে দেবে। এমন একটা দিন আসে, যখন বোঝা যায় যে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা গাছের উপর বসে রয়েছি, সামনে আমার নিজের রাস্তাটাকে অনেক ভাল করে দেখতে পারছি। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকবার নিজে ওড়ার সময়ে মনে পড়তে বাধ্য, নিজের ডানাগুলো প্রথমবার ঝাপটাতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন কারা।

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook