ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ৭


    শুভময় মিত্র (October 17, 2021)
     

    সিকিউরিটি
     

    চাঁদনিতে রেডিমেড উর্দির দোকানে ড্রেস পেয়ে গেলাম। নানা রকম রঙিন সুতোয় বোনা ব্যাজ, বুকপকেটের ওপর, কাঁধের ফ্ল্যাপে। চকচকে স্টার আছে। ‘সিকিউরিটি’ লেখা। টি-শার্টের ওপরে চাপিয়ে নিলাম। এই জামার জন্য আমি যে ফিট, সেটা পরামাত্র বুঝতে পারলাম। দোকানের লোক বলল, ‘বেল্ট লাগবে, বাজেট মাল দিচ্ছি।’ নীল ফুল প্যান্ট পেলাম গ্র্যান্ড হোটেলের তলার ফুটপাথে। বুটজুতো ছিলই, দেখতে ভাল নয়, ভোঁতা মতো, এবারে কাজে লাগবে। সুলভ শৌচালয়ে এক টাকা ফেললাম, প্যান্ট বদলে বেরিয়ে এলাম। মুখ দেখার আয়নাতে চলবে না, একেবারে পা থেকে মাথা অবধি দেখা যাবে এমন চাই। মেট্রোগলিতে পর পর অনেক কাচের দোকান। ঠিক পেয়ে গেলাম পছন্দের আয়না। শেষ কবে নিজেকে আপাদমস্তক জরিপ করেছি মনে নেই। খুব ভিড়। যেন চুল ঠিক করছি এমন ভাব করে কেটে পড়লাম। এই চত্বরে একসময় আসা-যাওয়া করতাম, চেনে অনেকে। দেখতে পেলে মুশকিল, তাই ছোটা ব্রিস্টলে একবার ঢুঁ মারার লোভ সামলে সোজা বেরিয়ে এলাম চৌরঙ্গিতে। লাফাতে লাফাতে নেমে গেলাম মেট্রো-র সিঁড়িতে।

    যে-কাজের জন্য এইসব, সেটা ঠিক কোথায়, কবে থেকে ডিউটি, জানা ছিল। পই পই করে বলা আছে, কোনও অশান্তিতে যেন না জড়াই। গণ্ডগোল হলে, মার খেলেও ক্ষতি নেই। এতে নাকি পরে সুবিধেই হবে। আমার নতুন কাজের জায়গা খুঁজে নিতে অসুবিধে হল না। দু’পাশে নানা চেহারার, বারান্দায় কাপড় ঝোলা, বক্স-গ্রিলে ফুলগাছ ভরা, রং-বেরঙের নতুন-পুরনো বাড়ির মধ্যে এটি চোখে পড়তে বাধ্য। পাঁচতলা বাড়ি। কংক্রিটের কলামের ওপর ফ্লোর, সিঁড়ি সবই আছে। দেওয়াল আছে, দরজা-জানালা নেই। পাঁচ বললে ভুল হবে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইললিগাল কনস্ট্রাকশন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি। কোর্টের ঘুমচোখ হঠাৎ লাল হয়ে খুলে যাওয়ায় থেমে গেছে সব কাজ। কংক্রিটের হরপ্পার মালিকের ক্ষয়ক্ষতি, কী হবে এরপর, জানা নেই। জমি-বাড়ি তো আর চিপসের প্যাকেটের মতো ফেলে দেওয়া যায় না। অন্য লোক দখল করে বেচে দেবে তা হয়তো নয়, তবে বেওয়ারিশ বাড়ি দেখলে অবাঞ্ছিত, নোংরা লোকেরা আসবেই। রোহিঙ্গা, আফগান যে কেউ হতে পারে। সেসব আটকানোর জন্য প্রহরীর প্রয়োজন। ওই কাজ ধরে নিয়েছি আমি, আমার বন্ধুর কল্যাণে। ও-ই তো এ-বাড়ির প্রোমোটার। খুব ভাল মন ওর। ছোটবেলায় খেলতাম একসঙ্গে। আমাকে ইন্টারনেট লাগানো ফোন দিয়েছে, রিচার্জও করে দেবে। দুটো ব্যাপার, এখানে আমি চব্বিশ ঘণ্টা থাকব। আলো-পাখার গল্প নেই। রাতে কোনও ভাবে আলো জ্বালা চলবে না। প্রফেশনাল হ্যাজার্ড কিছু থাকবেই। ওর আপিসে, কাছেই, ফোনটা মাঝে মাঝে চার্জ করা যাবে। কাছের বস্তিতে পরিষ্কার ফ্রি বাথরুম আছে। আজকের দিনটা শুভ। টানা বৃষ্টির পর ঝলমল করছে আকাশ। অর্ধসমাপ্ত, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বাড়িটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বাজেট ফুরিয়ে যাওয়া প্যান্ডেলের মতো। টঙের বেরিয়ে থাকা লোহার রড, উঠে থাকা কলামগুলো দেখে মনে হল টেনশনে তার চুল দাঁড়িয়ে গেছে। জয়েন করে গেলাম কাজে, গ্রাউন্ডফ্লোরে পায়চারি করতে শুরু করলাম। ফোন এল, ‘তুই কোথায় রে ?’ ‘এই তো, আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে।’ ‘অ।’

    জমি-বাড়ি তো আর চিপসের প্যাকেটের মতো ফেলে দেওয়া যায় না। অন্য লোক দখল করে বেচে দেবে তা হয়তো নয়, তবে বেওয়ারিশ বাড়ি দেখলে অবাঞ্ছিত, নোংরা লোকেরা আসবেই। রোহিঙ্গা, আফগান যে কেউ হতে পারে। সেসব আটকানোর জন্য প্রহরীর প্রয়োজন। ওই কাজ ধরে নিয়েছি আমি, আমার বন্ধুর কল্যাণে।

    পাড়ার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিই?’, আর কেউ আমাকে নিয়ে মাথা দিল না। প্রথম দিন একতলাতে, যেখানে গ্যারেজ হবার কথা, ওখানে বসে রইলাম। একটা প্যাকিং-বাক্স জোগাড় হয়েছে। সামনে দিয়ে এর-ওর যাওয়া-আসা দেখলাম। রাস্তার ওপর কোনওদিন ঘুমোইনি, তাই রাতে দোতলার সামনের ঘরে ঘুমোলাম। সব তলার চেহারা একদম এক। ছাদে গিয়ে নতুন পাড়াতে নিজের অবস্থানটা স্পষ্ট হল। এলিভেটরের চৌকো কুয়োটা দেখেই সরে এলাম। কেমন যেন! এসব দু’একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। বারান্দায় দেদার রোদ্দুর। দাঁড়ানো যাবে না। রেলিং নেই, এমনি দাঁড়ালে দেখে লোক হাসবে। বাজারে সস্তার ভাতের হোটেল দেখে নিয়েছি। সকালে আলু-বেগুন, রাতে বেগুন-আলু। চলবে। মাইনে পেলে ডিম চালু করব। পাবলিক টয়লেটে বন্ধু হয়েছে কিছু, রোজ দেখা হয়। কেউ আমাকে ব্যক্তিগত, অস্বস্তিকর কোনও প্রশ্ন করে না। একমাত্র দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করলেই আমি আমতা-আমতা করি। এর মধ্যে টুকটুক করে আরও প্যাকিং-বাক্স জুটিয়ে এনেছি। আমার কিছু জিনিস আছে, রাখি সেখানে। বইগুলো পরে আনা যাবেখন। চারতলাটা আমার বেশি পছন্দ। ওখানে বেশ হাওয়া খেলে। তিন দিকে বাড়ি। সেগুলো তিনতলার বেশি নয়। সারাদিন নীচে থাকি। সূর্য গুড়গুড় করে ছাদের ওপর দিয়ে পশ্চিমে যায়। আকাশ থেকে শহরের রাস্তায়, আমার ফ্ল্যাটে, একইসঙ্গে সন্ধে নামে। রাত হলে ওপরে উঠে যাই। টর্চ লাগে না। এখন সব দেখতে পাই। রাতে মাঝে মাঝে একতলায় নেমে পায়চারি করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিই। সারাদিন তিন পাশের বিভিন্ন তলা থেকে থেকে ফিনাইল, মাংস, ধূপ, এমনকী পারফিউমের গন্ধ পেলে অনেক ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্ধকার জমলে জানলায় নয়, দেওয়ালে কিছু জায়গায় ইঁটের মধ্যে গ্যাপ আছে, সেখানে চোখ রাখি। পাশের ফ্ল্যাটগুলোতে আলো জ্বলে, কত কী দেখা যায়। অনেকে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, আমিও দেখি। পশ্চিম দোতলার চ্যানেল পছন্দ না হলে দক্ষিণ চারতলায় উঠে যাই। প্রত্যেক পরিবারের জীবন, তাদের সম্পর্ক, এমনকী ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো এখন আমার জানা হয়ে গেছে। কার এখন আর চা নয়, একটু কফি খাবার ইচ্ছে করছে তাও বুঝতে পারি। দরজা বন্ধ করে একটা ছেলে ল্যাপটপ খুলে, খুব সাবধানে কী যেন দেখে মাঝে মাঝে। স্ক্রিন দেখতে পাই না, মুখ দেখে একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করি। এই যে আমি দেখছি, তা ওরা জানলে মুশকিল। তাই লুকিয়ে, অনেকটা ভেতর থেকে নজর রাখি। সব থেকে সেফ জানলা হল পাশের বাড়ির বাথরুমের উল্টোদিক। কারণ সেটা বন্ধ থাকে, ঘষা কাচ। আমি আবিষ্কার করেছি যে, তার মধ্যে কারুর আবছা ছায়া পড়লে, তা স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং। সে তো আর আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, এটাই দারুণ স্বস্তি। তবুও, সাবধানে থাকি। 

    এই যে আমার তিন পাশে এত লোক, আমি কিন্তু কারুর প্রতিবেশী নই। ভেবেছিলাম খুব একা লাগবে, তা একেবারেই হচ্ছে না। একতলায় দু’একটা চেনা কুকুর আসে, যায়, একটা রাতে ঘুমোয়। উত্তরের একটা খুপরি ঘর, রান্নাঘর হতে পারে, বা বাথরুম, তার এগজস্টের জন্য রাখা গোল ফুটোতে পায়রা বসে, দুপুরে বুক-মুচড়োনো ডাক শুনি। পিঁপড়েরা অবিরাম হেঁটে চলে। কয়েক মিলিমিটারের প্রাণী, মেঝে থেকে সিলিং অবধি পৌঁছানো মানে আমাদের জন্য সেটা কতখানি? ডিলান কি আসলে ওদের দেখে সেই গানটা লিখেছিলেন? এদের সবার পরিপূর্ণ, গোছানো জীবন, কাজ, সংসার অথচ কারুর একটা প্যাকিং-বাক্সও নেই। আমার সঙ্গে মিল প্রচুর, ভেবেই ভাল লাগে। ক’দিন ধরে একটা ব্যাপারে মুস্কিলে পড়েছি। পুবের দোতলায় থাকে, হামাগুড়ি দেওয়া একটা বাচ্চা, হিসু করে তার ওপরেই থাবড়ায় নিশ্চিন্তে। তারপর লুকিয়ে থাকা আমার দিকে আঙুল তুলে দেখায় আর হাসে। নিজের ভাষায় বলে চলে অনেক কথা। ওর বাবা-মা বোঝে না। আমি বুঝি। ওই কম্মের প্রয়োজন হলে আমাকে কিছুদূর যেতে তো হয়ই। ওর সেই অসুবিধে নেই। রাতে আমি ভেতরের ঘরে ঢুকে লুকিয়ে সিগারেট খাই, ছোটবেলার মতো। চারপাশে কেউ যেন খেয়াল না করে যে, জন্মেই পরিত্যক্ত এক বাড়িতে কেউ আলো জ্বালছে।

    রাতে মাঝে মাঝে একতলায় নেমে পায়চারি করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিই। সারাদিন তিন পাশের বিভিন্ন তলা থেকে থেকে ফিনাইল, মাংস, ধূপ, এমনকী পারফিউমের গন্ধ পেলে অনেক ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্ধকার জমলে জানলায় নয়, দেওয়ালে কিছু জায়গায় ইঁটের মধ্যে গ্যাপ আছে, সেখানে চোখ রাখি।

    সকাল থেকে রাস্তায় কিছু লোক নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়া-আসা করে। ফেরিওয়ালার ডাকগুলো ঘড়ির ঘণ্টার মতো কাজ করে। আরও আছে, চেহারা দেখে বোঝা যায় না কে কেন পথে নেমেছে। এটুকু বুঝি, কারুর কাছে এই রাস্তাটাই তার আপিস-দোকান। বাকিদের কাছে ছোট-বড় হাইফেন। একজন সকাল এগারোটা নাগাদ আসে, বিকেল তিনটের সময় আর একবার। ট্র্যাফিকের তোয়াক্কা না করে এঁকেবেঁকে হাঁটে। কাগজ, রাবিশ কুড়োনেওয়ালা। উলিও হতে পারে। জেন্ডার ঘেঁটে গেছে অনন্ত পরিশ্রমে। চলার ছন্দে কিছু বোঝার উপায় নেই। সরু চেহারা, তার থেকেই বেরিয়েছে বিশাল বস্তা, বাঁকা শরীরের ওপরের প্রায় অদৃশ্য মাথাটা নামতে-নামতে প্রায় রাস্তার কাছাকাছি। উদ্ভ্রান্ত চোখ ডাইনে-বাঁয়ে খুঁজে চলে বিবিধ রতন। এইসময় আমি একতলায় ডিউটি করি। একে নজরে রাখি, এরা সুবিধের নয়। একজন ফেরিওয়ালার ডাক শুনে অবাক হলাম। সবে ভাত খেয়ে ফিরেছি। খুব ছোটবেলায় এই ডাক শুনতে পেতাম, ‘আগেয়া, বোলেগা’। সাদা ধুতি-শার্ট। সঙ্গে কাপড়বাঁধা বাক্স, ওপরে বড় ঢাকনা। কী আছে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত না। ওপরের দিকেই তাকিয়ে ওই একই কথা হেঁকে-হেঁকে চলে যেত ধীরেসুস্থে। এবারে ধরলাম। সেই একই উদাসীনতা। বাড়ির সিকিউরিটিকে সম্ভাব্য খদ্দের মানতে চাইছে না। সরাসরি ‘কত করে?’ জিজ্ঞেস করায়, আমাকে জরিপ করে বলল, ‘দশ’। অনেকটাই, কী আছে তাও জানি না। নোট এগিয়ে দেবার পর উল্টোদিকে ঘুরে কীসব বের করে শেষপর্যন্ত একটা কাগজে মুড়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর, দূরে আর একবার শুনলাম সেই ডাক। মোড়ক খুলে দেখি, মশলা জাতীয় কিছু একটা, গুঁড়ো-গুঁড়ো। জিভে দিলাম। চুরণ। অ্যাসিড দেওয়া কালো নুন নয়। মিথ্যে বেদানার লাল গুঁড়ো আর ছাতুর মিক্সচার নয়। ঝাল-লাল নুন নয়। বিটনুনও নয়। এটা আমচুর বা শুখা তেঁতুলের গুঁড়োর সঙ্গে ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামের সংমিশ্রণ। দাম বেশি হবারই কথা। গোপনীয়তাও জরুরি। প্যাকিং-বাক্সের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে সিকিউরিটি চুরণ চাটছে, ভাল দেখায় না। একটা থামের আড়ালে চলে গেলাম। জিভটা বদলে গেল একটু-একটু করে। মাথাটাও। একসময় মনে হচ্ছিল, আমার মুখের ভেতরটা যেন লিফটের ফোকরের মতো অন্ধকার, ভয়াবহ। 

    অনেকদিন যাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, হয়তো কিছু ঝামেলা হয়েছিল, বা এমনি, টুকটাক তাদের ফোন আসতে লাগল। শেষ যখন এদের সঙ্গে দেখা হত তখনকার কথা বলা, বিষয়, অনেকটাই বদলে গেছে। কেউ কেউ দম দেওয়া পুতুলের মতো নিজেই বলতে শুরু করে, অনেক কথা বুঝিও না। অনেকে প্রথমেই বলে, ‘বল।’ হয়তো এটা-সেটা বলি কিছু, চুপ করে শোনে। কথার মধ্যে হড়বড় করে অন্য কথা গুঁজে দেয় না। থামলেই বলে, ‘আর বল।’ সেলসের সাধারণ লোকেরা বাজারে দোকানদারের কাছে অর্ডার নেওয়ার সময় আর কী লাগবে জানতে চায়। এই চাওয়া শেষ হয় না। যারা অন্যের মাল বেচে তারা এরকম হয়ে যায়। যারা সারাক্ষণ কেনে তারা ঠিক উল্টো। আমার দুটোই পছন্দ। বলা-শোনা সব কথাই অবান্তর। ক্ষতিও নেই। আমার কয়েকটা বই এনেছি। পড়তে পারছি না। ডিউটির সময় রাস্তায় বসে বই পড়াটা চুরণ খাওয়ার মতোই অদ্ভুত। ওপরে, আড়ালে গিয়ে বই পড়াও বোকা-বোকা। রাতে তো সম্ভবই নয়। দু’বেলার খাওয়া ছাড়া মুড়ি থাকে আমার, সেদিন দেখলাম ইঁদুরে প্যাকেট কেটে দিয়েছে। শশা-পেঁয়াজ-লঙ্কা নিয়ে তৈরি হচ্ছিলাম। দেওয়ালে অনেক রড বেরিয়ে আছে এদিক-ওদিক, নতুন প্যাকেট কিনে সেখানে ঝুলিয়ে দিলাম। সর্বত্র এত রড যে, একসময় আমি নিজে ছাড়া আমার আর যা কিছু সবই বাঘের মাথার মতো চড়ে গেল চারপাশে। নয় নয় করে অনেক কিছুই বেড়ে গেছে। আর বাড়াবাড়ি চলবে না। অনেক কাণ্ডের পর জীবনে একটু থিতু হয়েছি। এ-বাড়ি পুরো ভাঙা হবে না কোনওদিন। ফিনিশ করে বিক্কিরিও নয়। এমনি থাকবে। আমার চাকরি যাবে না। কাউকে যদি বলি আমার ফ্ল্যাট চারতলায়, সেটা ভুলও নয়। যদি না সে এসে পড়ে। বা দেখে ফেলে। সবাইকে যা যা মুশকিল লুকিয়ে চলতে হয় তার একটাও আমার নেই। মাথার ওপর একাধিক শক্তপোক্ত চাল আছে। চুলো সামলায় হিন্দু ভোজনালয়। সুভদ্র বাঙালি খাবারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে খাই আমি। আজ অবধি শরীর খারাপ হয়নি। আপাতত একটাই অসুবিধে। উগ্রপন্থী লোকরা এই জায়গা নিশানা করলে লড়ে যাওয়ার সাহস আছে আমার। ইঁদুরকে কীভাবে ম্যানেজ করব সেটা বুঝতে পারছি না। সেদিন রাবিশ কুড়োনোর লোক থেমেছিল একবার, বাড়িটা দেখছিল। সবটা ঝেড়ে দিলে এক খেপে অনেকটা প্রাপ্তি। যতক্ষণ না যায়, আমিও কড়া চোখে তাকিয়েছিলাম। মেয়ে ওটা।

    এটাও খেয়াল করলাম, এখন বিকেলে মাত্র একবার যায় তাকাতে-তাকাতে। ওই সময় রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসে কিছুক্ষণের জন্য। তিনতলার বারান্দার একটু ভেতর থেকে আমার ছোট আয়না দিয়ে রিফ্লেক্ট করলে একটু দূরে রাস্তার উল্টোদিকের ডাস্টবিনটা ঝলসে ওঠে। এটা করাও ঠিক নয়। কিন্তু একদিন আমি একটা কাজ করব বলে তৈরি হয়েই ছিলাম। সময়মতো এল মেয়েটা, চলেও যাচ্ছিল দেখতে-দেখতে। যেই না মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়েছে, অমনি আমিও আলো ফেলেছি টিপ করে। চলেছে ও। ওর সামনে কালো রাস্তার ওপর একটা ঝলসানিকে গড়িয়ে-গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি। দেখে থেমে যাবার আগেই আমি সরিয়ে নিলাম ঝট করে। একতলায় নেমে আড়চোখে দেখলাম, দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, একই জায়গায়। এদিক-ওদিক দেখছে। একটু যেন এগিয়ে এল আমার দিকে। আবার ঘুরে চলে গেল। পরের দিন ওসব করিনি আর। শীর্ষেন্দুর ‘ঘুণপোকা’-তে এইরকম একটা ব্যাপার ছিল, মারাত্মক কাণ্ড হয়েছিল। মেয়েটা বেশ কয়েকদিন এল না। আজকাল আবর্জনা পাওয়া শক্ত হয়ে উঠছে। আগেই সেসব তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে সরকারি গাড়ি। একদিন দেখি সে আসছে, তবে মাঝদুপুরে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্পিড কমে গেল। একটু দূরে ফুটপাথে উঠে বোঝা নামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। খুঁজে-খুঁজে কী একটা বের করল। পরমুহূর্তে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সামলে নিয়ে দেখি, সে হাওয়া। অনেকক্ষণ অবধি আমার সামনে কীসব যেন বুদ্বুদের মতো ঝিলমিল করল।

    সবাইকে যা যা মুশকিল লুকিয়ে চলতে হয় তার একটাও আমার নেই। মাথার ওপর একাধিক শক্তপোক্ত চাল আছে। চুলো সামলায় হিন্দু ভোজনালয়। সুভদ্র বাঙালি খাবারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে খাই আমি। আজ অবধি শরীর খারাপ হয়নি। আপাতত একটাই অসুবিধে। উগ্রপন্থী লোকরা এই জায়গা নিশানা করলে লড়ে যাওয়ার সাহস আছে আমার।

    ফোন চার্জ করতে গিয়েছিলাম। গেলে চা-বিস্কুট দেয় আমাকে। ঝলমলে মুখে আমার প্রোমোটার বন্ধু বলল, ‘শোন, অল ক্লিয়ার।’ আমি জানতাম একদিন না একদিন এটা শুনতে হতেও পারে। আমার কালো হয়ে যাওয়া মুখটা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। হ্যা-হ্যা করে হেসে একটা নোটের বান্ডিল ফেলে বলল, ‘এই নে, পুজোর বোনাস। সামনের মাস থেকে ফিনিশিং শুরু, প্রচুর মিস্তিরি মাল ঢুকবে। তোর কাজ বাড়ল, মাইনেও বাড়বে। তারপর ওনাররা এসে গেলে তুই হবি চিফ সিকিউরিটি অফিসার, তোর আলাদা ঘর থাকবে, সিসিটিভিতে দেখবি সব। কী?’ ভাগ্যিস আর কেউ ছিল না ঘরে। আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। ওদিকে হাসি চলতেই থাকল। মুখ থেকে থিন অ্যারারুট বিস্কুটের টুকরো পড়তে লাগল আমার মাথায়। আমি কিছুতেই টেবিল থেকে মাথা তুলতে পারছিলাম না। আবার সেই বুদ্বুদগুলো এলোপাথাড়ি উড়তে শুরু করল চোখের মধ্যে। সেখানে আমার চারতলার ফ্ল্যাটের অন্ধকার ব্যাকড্রপ। ‘প্রপার্টিটা তুই বলেই এভাবে আগলে রেখেছিলি। আই অ্যাম রিয়ালি থ্যাংকফুল।’ আমি প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। 

    পর পর কয়েকটা ঘটনা ঘটল ক’দিনে। ‘আগেয়া বোলেগা’ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করল। নিজের দেশের অনেক কথা বলল। এ-পাড়াতে  তেমন নামকরা পুজো হয় না, কিন্তু আলোর মালা লাগে বরাবরই। রাস্তায় ঝলমলে জামাপরা অনেকের দৌড়োদৌড়ি, চ্যাঁ-ভ্যাঁ, দূরে কোথাও কড়মড় করে ঢাক বেজে ওঠা, সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছিল। আমাকে জোর করে ছুটি দেওয়া হল, ‘যা একটু ঠাকুর তো দেখবি, নাকি?’ সকালে রাস্তার উল্টোদিকের দোকানের লোক একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, ‘আপনাকে দিতে বলেছে।’ খুলে দেখি, নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি। ভেতরে একটা চিরকুট, লেখা আছে, ‘তোর বসের বৌ দিয়েছে, আমি না।’ একদিন সন্ধেবেলা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি একটা মেয়ে এসে আমার সামনে চুপ করে দাঁড়াল। এত রোগা, সিড়িঙ্গে শরীর যে, জ্যালজ্যালে সেমিজের মতো জামাটা ঝুলে প্রায় রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে। এ তো সেই পাবলিক। চোখে কাজল। ঠোঁটে কষে লিপস্টিক। খালি পা। এই পা-কে যে-কোনও রাস্তা-পাথর-ফুটপাথ-আস্তাকুঁড় ভয় পায়। কোথা থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমাকে দিল সে। বলল, ‘দিচ্ছিল না, আমি খিস্তি করে বললুম কেন দেবে না? আমার কি ভোগ খাওয়ানোর আর কেউ নেই নাকি? নাও, খেয়ে নাও, দেরি কোরো না, সেই সকালের মাল।’ বলে চলে গেল। একটু পরে মনে হল, যদি একটা চটি কিনে দেবার সুযোগ পেতাম! আমি কী করে জানব এসব হবে!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook