মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, ডিম খাব না।’
‘যেতেই কি হবে? আর ক’টা দিন দেখে…’
‘দেড় বছর পরে যাচ্ছি মা, আর কত দিন দেখব? ওরা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য।’
‘ভয় করে। করোনা এখনও…’
‘আর তোমরা যে দিব্যি বেরোচ্ছ? মলেও গেলে, কফিশপ বাদ দাওনি নিশ্চয়ই। বেরোই এবার।’
‘আমাদের তো ভ্যাক্সিন নেওয়া আছে রে, তোদের যে…’
‘সে কি আমরা নিতে আপত্তি করেছি? তোমরাই তো দিয়ে উঠতে পারোনি, শুধু বড়রাই কেন ভ্যাক্সিন পাবে শুনি?’
‘মুখে মুখে তর্ক কোরো না…’
দিল্লির বহু ঘরে এই সুরের গান বেজেছে গত কয়েক দিন ধরে। উপলক্ষ্য: স্কুল খুলছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে যাওয়া যায়। অবশ্য রোজ নয়, সপ্তাহে এক বা দু’দিন বড়জোর। তাই বা কম কী! মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা মাসের পর মাস ঘর আর কম্পিউটার-স্ক্রিনবন্দি— শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই— আর বেশির ভাগ নিম্নবিত্তদের পক্ষে সে সব অসম্ভব বলে পড়াশোনা করার সুযোগই মেলেনি এই সময়ে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ের সমস্ত শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি, তাই চাপও ছিল না। তবু বাচ্চারা উত্তেজিত— কতদিন পর স্কুলে যাওয়া হবে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে!
কিন্তু অন্তত প্রথম দিন বিকেলে দেখা গেল, পড়ুয়ারা খুব বেশি সংখ্যায় পৌঁছয়নি। একে তো স্কুল যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়নি, ইচ্ছে আর বাড়ির অনুমতি (দ্বিতীয়টারই বেশি প্রয়োজন) থাকলে তবেই যাওয়া। তাছাড়া নিয়ম হচ্ছে সবাই রোজ যাবে না, পালা-পালা করে। এখন এই বিষয়ে বাবা-মাদের কী ইচ্ছে আর ছেলেমেয়েরাই বা কী চাইছে, দেখে নেওয়া যাক।
একদিকে, ‘দেখুন আমরা তো চাই, যাক। সারাদিন বাড়িতে কম্পিউটার আর ফোন নিয়ে বসে থাকে, সেটা কি কোনও কাজের কথা? পড়াশোনা হয়তো একরকম হচ্ছে, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুজনেরই মন কিংবা শরীর কোনওটাই ভাল নেই। কিন্তু যাওয়াটা কি নিরাপদ? আমরা না, ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবা-মার মন তো, ভয় করে।’
অন্যদিকে, ‘আর পারছি না, না যেতে দিলে কিছু একটা করে ফেলব।’ অথবা ‘কেন ভালই তো আছি, এক্ষুনি স্কুল যাওয়ার দরকার কী?’
এগুলো অবশ্য এক শ্রেণির লোকেদের কথা। কিন্তু যাদের বাড়িতে কম্পিউটার নেই, স্মার্টফোন নেই, যাদের সমস্ত আশা তাদের ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের অবস্থাই নয়, বাবা-মার অবস্থাতেও উন্নতি আনবে, তাদের কী বক্তব্য?
তাঁদের কথা অনুযায়ী, ‘বরবাদ হয়ে গেছি আমরা এই এক বছরে, বরবাদ হয়ে গেছি। ছেলে-মেয়ে কেউ স্কুলে যায়নি, পড়াশোনা করেনি, কিছুই করেনি। ওদের কী হবে? আমার বাচ্চারা তাও আমাদের কাছে আছে, আশেপাশের অনেকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। স্কুলে না যেতে পারলে এখানে আমাদের ওই ছোট ঘরে বসে বসে দিনরাত করবে কী? খালি বলে মোবাইল কিনে দাও, কোত্থেকে দেব? আমাদেরই তো রোজগারই নেই। ফোন চালানোর খরচা কে দেবে? এখন শুনছি স্কুল খুলছে, বাচ্চাদের পাঠাব। বড়জন তো গেছিল, বাড়ি এসে বলল রোজ যেতে চায়, কিন্তু স্কুলে বলেছে সপ্তাহে দু’দিন এখন, আস্তে আস্তে বাড়াবে। এবার কি পড়াশোনা হবে সেভাবে, জানেন?’
আর শিক্ষকেরা?
তাঁরা বলছেন, ‘ভীষণ ভয়ে-ভয়ে আছি। জানি যেতে হবে, কিন্তু আমাদের তো সপ্তাহে একদিন নয়, রোজ। এক-এক দিন এক-এক দল ছেলেমেয়ে আসবে, একজনের যদি করোনা থাকে সবার হয়ে যাবে, আমাদের তো হবেই। যতই চেষ্টা হোক, ক্লাসের ভেতর আবার সব নিয়ম মানা যায় নাকি? বড়জোর মাস্ক পরে থাকা যায় সারাটা সময়, সেও এক জ্বালা, ছ’সাত ঘণ্টা একটানা পরে থাকা। বাড়ি থেকে পড়ানোর অসুবিধে ছিল অনেক, কিন্তু ভয় তো ছিল না!’
কিন্তু তাও…
‘না না, আমার এটাই চাইছিলাম, বাচ্চারা ফেরত আসুক। কম্পিউটারে পড়াশোনা হয় না, সারাক্ষণ করোনা-করোনা বলে তটস্থ হয়ে থাকলে চলবে না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে।’
অর্থাৎ অভিভাবক-পড়ুয়া-শিক্ষক কেউ কেউ ধর্মে আছেন, কেউ কেউ জিরাফে।
আর ওদিকে বিকেলবেলা?
‘কেমন লাগল?’
‘জানি না মা, বন্ধুরা কেউ আসেনি।’
‘একজনও না? দেখেছ, সবাই মা-বাবার কথা শুনে যায়নি, তুমিই খালি…’
‘সকালেও বন্ধুদের গ্রুপে মেসেজ করেছিল আসবে।’
‘মাস্ক খোলোনি তো একবারও?’
‘না, আমারই ভয় ভয় করছিল। ভালও লাগছিল অবশ্য স্কুলে, কিন্তু পাশাপাশি বসা চলবে না, ক্লাসে ছেলেমেয়ে খুবই কম, মনে হচ্ছিল যাওয়ার জন্য যাওয়া শুধু।’
‘আর যারা আসেনি?’
‘রেকর্ডিং দেখবে। কিন্তু সামনের সপ্তাহ থেকে নাকি হাইব্রিড হবে, জুম চলবে, স্কুলও খোলা থাকবে, যেটা খুশি।’
‘তুমি বাবা জুমই করো।’
‘সেই বাকি দিনগুলো তো এমনিতেও জুম, এরকম ভাবে কি হয়?’
এবং যে-আলোচনা কখনও শোনা যাবে না, কেননা এই আলোচনা হয়ইনি এবং হবেও না—
‘মণীশ, কী বুঝছ?’
‘সবে তো দু’দিন হল অরবিন্দ, আরও ক’টা দিন যাক। আমি স্কুলে-স্কুলে ঘুরছি, মনমেজাজ ভাল সবারই।’
‘কিন্তু যদি এর ফলে কোভিডের কেস বাড়ে?’
‘আপনি তো বাজার করেন না নিজে, করলে বুঝতেন কেস ছড়ালে আগে ওখানে ছড়াবে, স্কুলে আমরা খুব সাবধানে এগোচ্ছি।’
‘ক’টা স্কুল তুমি নিজে সামলাবে মণীশ? সবাই কি সমান পরিমাণে যত্ন নেবে? আর কেস বাড়লে তো দোষ আমাদের ঘাড়েই পড়বে। আমাদের নয়, আমার।’
‘সারা দেশেই তো আস্তে আস্তে খুলছে, গন্ডগোল হলে শুধু আমাদেরই কেন দোষ হবে?’
‘সোশ্যাল মিডিয়া কী বলছে?’
‘যা বলে, ওসব আমি দেখি না, তুমিও দেখো না, যাদের গালাগালি দেবার তারা তো দেবেই।’
এবং শেষপর্যন্ত—
‘আঙ্কল, এবার কি তাহলে আবার পরীক্ষা শুরু হবে?’
‘ধুর, কে বলল তোকে, পরীক্ষা উঠে গেছে।’
‘হ্যাঁ, ওই আশাতেই বসে থাক। শোন, পরীক্ষা উঠে যাওয়া ভাল খবর না।’
‘কেন?’
‘দেখিসনি? বোর্ড এত এত নম্বর দিয়েছে যে, দিল্লি ইউনিভার্সিটির অনেকগুলো কলেজ এবার একশোর কম নম্বর পেলে নেবেই না!’
‘…’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র