ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ব্যাকস্টেজ: পর্ব ৬


    সুদেষ্ণা রায় (August 27, 2021)
     

    অসাধারণ মিঠুন

    সত্তরের দশকে মিঠুন চক্রবর্তী নিয়ে প্রথম উত্তেজনা। সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছি, শুনলাম আমাদেরই সহপাঠী মমতাশঙ্কর সুযোগ পেয়েছে মৃণাল সেন-এর ছবিতে। ওর বিপরীতে রয়েছে নতুন অভিনেতা, কলকাতার ছেলে, মিঠুন চক্রবর্তী। সে নাকি পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেছে। এক সময়ে নাকি সক্রিয় অতিবাম রাজনীতিও করেছে। মমতা আমাদের সহপাঠী। নাচের জন্য, উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্করের কন্যা হিসেবে, একটু অন্য ধরনের পেশায় যাবে, তা জানাই ছিল। আমার নিজের অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল, কিন্তু তখনও সিনেমায় অভিনয় করার কথা ভাবতেও পারিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারে অভিনয় পেশা হবে ভাবতে ভয় লাগত। মমতা মৃণালবাবুর ছবিতে অভিনয় করছে জেনে, মনে মনে ওর ভাগ্যের তারিফ না করে থাকতে পারিনি। কারণ মৃণাল সেন বা সত্যজিৎ রায়, কিংবা তপন সিংহ বা তরুণ মজুমদার আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় সমাদৃত। তারপর যখন ছবিতে দেখলাম মমতা ও মিঠুন চক্রবর্তীকে সাঁওতাল দম্পতি রূপে, তখন সপ্তদশীর মন আবার উদ্বেলিত। মমতার নায়কের সুঠাম দেহসৌষ্ঠব, অবিন্যস্ত চুল, যেন পাথরে খোদাই করা মুখ, পরনে শুধু ছোট ধুতি, চকচকে খালি গা। সতেরো প্রেমে পড়ার বয়স, আর মিঠুন চক্রবর্তী খালি-গায়ে আমাদের অনেকেরই চোখের ঘুম কেড়ে নেন। ওই সময়ে খুব কম নায়কই ছিলেন, যাঁরা অনাবৃত অবস্থায় পর্দায় বিকশিত হতে পারতেন।

    সত্তরের দশকে মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও, ওঁর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি। মমতার সঙ্গেও সে-সময় তেমন যোগাযোগ ছিল না। কলেজ, ডিবেট, কুইজ নিয়ে আমি ব্যস্ত। আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করি। অনেক সেলেব্রিটির সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কিন্তু মিঠুনদা অধরা থেকে যান। তারপর, যখন আমাদের পত্রিকায় ওঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ নিবন্ধ লেখা হয়, ‘রক থেকে প্রাসাদে’, তখন ফোন মারফত কথা হয়। মহিলাদের পত্রিকা বলেই মিঠুনদা ছিলেন প্রচ্ছদে। মহিলাদের জীবনেও তো থাকে স্বপ্ন-পুরুষ।

    দেখা হয় নব্বই দশকের প্রথমে। অমিতাভ বচ্চন ও মিঠুন চক্রবর্তী এসেছিলেন ‘অগ্নিপথ’ ছবির প্রোমোশনের জন্য। উঠেছিলেন তাজ বেঙ্গল-এ। আমি ও আমার সহকর্মী নিবেদিতা গেছি সাক্ষাৎকার নিতে। অমিতাভ বচ্চন ও মিঠুন চক্রবর্তী দুজনেরই। পৌঁছে গেলাম সময়মতো। অমিতাভ বচ্চনের সাক্ষাৎকারের শেষে, ওই ঘরেই চলে এলেন মিঠুন চক্রবর্তী। যেন রঙিন এক বাতাস । পরনে টিয়া-সবুজ পোশাক। নিবেদিতার ইচ্ছা পূর্ণ করতে মিঠুন চক্রবর্তী ও অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ছবি তোলার কথা বললাম। দুজনেই রাজি। দুজন লম্বা মানুষের মাঝে নিবেদিতা হারিয়ে যাবে ভেবে, মিঠুনদাই বললেন, ‘বসে তুলি’। সেই ছবি আজও আছে। আমারও ওঁদের সঙ্গে ছবি তোলার কথা ছিল, কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে ঠিক হল, অনুষ্ঠানের পরে তোলা হবে। কিন্তু নানা তালেগোলে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

    ‘মৃগয়া’ ছবির শুটিং-এ পরিচালক মৃণাল সেনের সঙ্গে মিঠুন চক্রবর্তী

    এরপর ফোনে বা চিঠিতে মিঠুনদার সঙ্গে যোগাযোগ হত, মাঝেমধ্যে কলকাতা এলে দেখা হত কাজ নিয়ে। এর মধ্যে আমি সাংবাদিকতা ছেড়ে অডিও-ভিস্যুয়াল জগতে চলে গেছি। সেই সূত্রে ছবির গল্প শোনাতেও গেছি মিঠুনদার কাছে। তবে বেশ পাকাপোক্ত ভাবে পরিচয় হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘তিতলি’ করতে গিয়ে। ২০০০ সাল। Y2K-র নতুন হাওয়ায় তখন চারিদিক উদ্বেলিত। ঋতুপর্ণর চিত্রনাট্য তৈরি। মা, মেয়ে এবং এক সুপারস্টার নিয়ে ছবি। মা ও মেয়ে অপর্ণা সেন ও তাঁর কন্যা কঙ্কনা। এবার চাই সুপারস্টার। বাঙালি সর্বভারতীয় স্তরে মিঠুনদা ছাড়া তখন আর কেউ নেই! যেমন বাণিজ্যিক ছবিতে, তেমনই অন্য ধারার ছবিতেও সফল। মিঠুনদার সঙ্গে দেখা করতে গেল ঋতুপর্ণ, সঙ্গে আমিও গেলাম। সব শুনে মিঠুনদার মন্তব্য, ‘করব। আর একটা জাতীয় পুরস্কার চাই। তিনটেতে মন ভরেনি।’ এই শুরু মিঠুনদার সঙ্গে যাত্রা।

    ওঁর লুক নিয়ে আলোচনায় ঋতু চায় জুলপি, কিন্তু মিঠুনদা তাঁর ‘outlook’ পরিবর্তন করতে অনিচ্ছুক। ‘এক বিদেশিনি স্টাইলিস্ট বলেছিলেন আমাকে জুলপি কেটে ফেলতে, তাতে চেহারায় অন্য মাত্রা আসবে।’ উনি তাই সেই মাত্রা খোয়াতে নারাজ। তবে ঋতুও ছাড়ার পাত্র নয়। অনেক কথা-কাটাকাটির পর, লুক টেস্ট-এ জুলপি লাগিয়ে দেখা গেল, ভালই লাগছে।  মিঠুনদা রাজি হলেন, কারণ বহু মহিলাই বললেন, অন্য রকম লাগছে। তার মধ্যে আমিও ছিলাম। যেহেতু একদিনের গল্প, তাই একটাই কস্টিউম। একেবারে সফিস্টিকেটেড সাদা পুলওভার আর কালো জিন্‌স। উপরের জ্যাকেটটা কী রঙের হবে, তাই নিয়ে আধবেলা আলোচনার পর, যখন দোকান থেকে দুরুদুরু বক্ষে ছাই-সাদা কম্বিনেশন নিয়ে এলাম, মিঠুনদার আনন্দ দেখে কে! সেই সঙ্গে বললেন, ডুপ্লিকেটও নিয়ে নে, এক পোশাক পরে ১০ দিন শুটিং করা অসম্ভব। ঋতু বোঝাতে চেষ্টা করল, লাভা-তে খুব ঠান্ডা, আর তোর শুটিং গাড়িতে বসে। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। দু’সেট পোশাক কেনা হল।

    এরপর শুটিং-পর্ব। উত্তরবঙ্গে লাভা-য় শুট। মিঠুনদার জন্য সেরা গেস্ট হাউসে ঠিক করা হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে, স্বয়ংসম্পূর্ণ রাত্রিবাস। সুন্দর কটেজ। বাইরে বারান্দা, তারপর বসা-খাওয়ার ঘর, ভিতরে শোওয়ার কামরা। বাকি আমরা সবাই রাস্তার ধারে হোটেলে। প্রথমে তো মিঠুনদা পুলকিত। তারপর যেই জানতে পারলেন শুটিংয়ের পর আমাদের সমাবেশ রাস্তার ধারের হোটেলের বসার ঘরে, কারণ হোটেলটি আমাদের লোকেই ভর্তি, অমনি মিঠুনদার কী দুঃখ। ‘আমাকে তোরা আলাদা করে দিলি!’ অনেক বুঝিয়ে বলা হল, আসরে চলে আসতে। এলেনও। আর হয় উঠলেন মধ্যমণি। ওঁর পুরনো প্রেমিকার গল্প। যে উত্তর কলকাতার গলিতে শীতকালের দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কমলালেবু ছাড়িয়ে খেত, আর মিঠুনদা দূর থেকে দেখতেন! ওঁর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার গল্প। কত বন্ধু পুলিশের গুলিতে শেষ, কত বন্ধু বিদেশে, আর উনি নিজে পুনেতে।

    ‘তিতলি’ ছবির একটি দৃশ্যে অপর্ণা সেনের সঙ্গে অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী

    তারপর অভিনয়-জগৎ ও মুম্বই ইন্ডাস্ট্রি। ‘মৃগয়া’য় অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে ভেবেছিলেন, মুম্বইতে সহজে জায়গা করে নেবেন। ‘তা আর হল কই? যেখানেই যাই, সবাই কাপড় খুলতে বলে, বডি দেখাতে বলে। তারপর কত পরামর্শ। বাইসেপ একটু বাড়াও, ট্রাইসেপ ঠিক নেই। পায়ের ব্যায়াম করো! আমি শুনি, আর বডি বিল্ডিং করতে থাকি। করতে করতে বডি organism-ই চেঞ্জ হয়ে যায়।’

    একদিন খেলা হল রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে গানের লড়াই। পরদিন মিঠুনদা বললেন, আজ ওঁর ঘরে আসর বসবে। সবাই চলে এসো। রান্না হবে পর্ক। গেলাম আমরা, আর সেদিন চলল মাঝরাত্তির অবধি হুল্লোড়, শুধু গল্প, নো গান, শুধু নাচ! আর মাঝে মাঝে পাহাড়ের কোনে গিয়ে টাওয়ার খুঁজে ফোন করা। 

    মিঠুনদা কোনও ছোট-বড় বাছবিচার করতেন না। সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। তাই নতুন সহকারী পরিচালক, বা চিত্রগ্রাহক, সবার সঙ্গে সমান বন্ধুত্ব। কাজের সময় কাজ, অন্য সময় হুল্লাট। রাত একটায় যখন ওঁর ঘরের পার্টি থেকে সবাই যে-যার ঘরে ফিরছি, প্রযোজক ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাল কি কল-টাইম পিছিয়ে দেওয়া হবে? মিঠুনদা বললেন, ‘কেন? এটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। মজাও আছে, ডিসসিপ্লিনও। কাল ভোর ছ’টাতেই দেখা হবে। আমাদের কোনও ক্লান্তি নেই।’ সত্যিই, প্রযোজক জানতেন না, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ভোর ছ’টা থেকে বিকেল চারটে অবধি শুটিং করে, সবাই পাঁচটা থেকে আটটা ঘুমিয়ে, তারপর পার্টি করে। মিঠুনদাও তা-ই করতেন, যখনই সুযোগ, তখনই রেস্ট।

    তবে যত বড় অভিনেতাই হোন না কেন, সবাই প্রশংসা শুনতে চায়। ঋতু কঙ্কনার উপর বেশি নজর দিচ্ছিল, কারণ ও ছোট, ও নতুন। অপর্ণা সেনের সঙ্গে ঋতুর বহুদিনের পরিচয়, তাই ঋতুপর্ণর কর্মপদ্ধতি ওঁর জানা। কিন্তু মিঠুনদা এই প্রথম কাজ করছেন। শটের পর শট হয়ে যাচ্ছে, ঋতু শুধু ‘Okay, next’ বলছে। আর কঙ্কনাকে মাঝেমধ্যে উৎসাহ দিচ্ছে। হঠাৎ মিঠুনদা বলে উঠলেন, ‘কী রে? আমিও তো অভিনেতা, আমাকে কেউ কিছু বলছে না…’ ঋতুর যুক্তি, ‘তুই তো ভাল, অভিজ্ঞ অভিনেতা। তাই তো তোকে নিয়েছি। তুই ভাল অভিনয় করবি, বলাই বাহুল্য।’ ‘কিন্তু কিছু রেসপন্স তো চাই’, মিঠুনদার আকুতি।

    পরের শট শুরু। মিঠুনদা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছেন। এই প্রথম তাঁকে দেখবে মা ও মেয়ে। হেঁটে এলেন মিঠুন, গাড়ির কাছে আসামাত্র, ‘কাট!’ আর সেই সঙ্গে সবাই মিলে বলে উঠলাম, ‘অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়, আশাতীত, অসাধারণ!’ সেদিন প্রতিটা শটের পর চলে এই কোরাস-ধ্বনি। একবারের জন্যও কিন্তু মিঠুনদা বিচলিত হননি। কারণ তাঁর মনোবল সত্যিই অকল্পনীয়, অসাধারণ…

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook