চিল্লা: পর্ব ৪
পরিকল্পনামাফিক শুভেচ্ছা-বার্তাটি পড়া হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রেক্ষাগৃহের আলো ফিকে করে দেওয়া হল, পর্দা সরে গেল, আর স্টেজের বাঁ-দিকে (দর্শকদের দিক থেকে দেখলে) একটি ডায়াসের উপর বসা সহযোগী বাজনদারদের উপর জ্বলে উঠল এক হলদেটে আলো। সূর্যমুখী ফুলের রঙের হলুদ কুর্তা আর মেডেল পরে গঙ্গাভাইয়া যেন ঝলমল করছিলেন, তবে আসর মাতানো শুরু করল বাজনদারদের সারিতে নিচে বসা পিঙ্কু— একটি ইলেকট্রিক তানপুরা অন করে, তার কাছে একটি মাইক রেখে আওয়াজটা বাড়িয়ে একের পর এক তিনখানা জবরদস্ত ‘ওম’ ছাড়ল সে! পিঙ্কু যখন গণপতি বন্দনা শুরু করছে, টুকটুকে লাল রঙে ভূষিতা হয়ে তখন ধীরে ধীরে মঞ্চে প্রবেশ করলেন নির্মলা। দর্শকদের মধ্যে আঁতকে ওঠার শব্দ কানে এল, নির্মলাকে হেলতে-দুলতে স্টেজে উঠতে দেখে বেশ কয়েকজনকে চেপে রাখতে না পেরে ফিক ফিক করে হাসতেও শোনা গেল স্পষ্ট।
এর পরের ছ’ঘণ্টা ধরে নির্মলার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাই হয়ে উঠল প্রহসন। যতবার এক পায়ের উপর ভর দিয়ে নানা মুদ্রা দেখানোর চেষ্টা করলেন, সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে— মাঝপথে হাল ছেড়ে দিতে হল, না হলে পড়েই যেতেন। প্রতিটি ‘টুকরা’-র সময়ে ভুল হয়ে গেল, তা-ও কোমর বেঁধে লড়ে গেলেন মহিলা। প্রত্যেক দু’ঘণ্টা অন্তর পালাবদল চলছিল, দু’ঘণ্টার শিফট যে শিল্পীদের শেষ হয়েছে, তাঁদের জায়গায় আসছিলেন নতুন একদল বাজনদার। যে বাজনদারদের কাজ ফুরিয়েছে, তাঁরা চটপট নগদ টাকায় নিজেদের পারিশ্রমিক বুঝে নিয়ে রসিদে সই করে সাত তাড়াতাড়ি গিয়ে বসে যাচ্ছিলেন দর্শকের আসনে। নির্মলা নতুন বাজনদারদের সঙ্গে তাঁর কাণ্ড কারখানা চালাবেন, সেসব দেখে বাকিদের সঙ্গে তাঁদেরও তো একটু হাসার অধিকার আছে!
এক সময়ে নির্মলা ঠিক করলেন, অভিনয়ে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করবেন। গায়ক যখন শ্রী রামচন্দ্রের শৈশবের বর্ণনা দিয়ে একটি ভজন গাইছেন, নির্মলা শিশুদের মতো স্টেজে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলেন। আবার আর একটি অভিনয়-নৃত্যের সময়ে ভগবান বিষ্ণুর শায়িত মূর্তি দেখাতে গিয়ে তিনি স্টেজের উপর মিনিট পনেরো চিত হয়ে শুয়ে রইলেন। এই শুয়ে থাকাটা যদি তাও হাস্যকর না হত, আসল রগড় হল হাঁচোড়-পাঁচোড় করে মাটি থেকে তাঁর নিজেকে টেনে উঠে দাঁড় করানোর সময়ে। বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর শেষমেশ যখন নির্মলা উঠে দাঁড়াতে পারলেন, দর্শকদের থেকে তখন ভেসে আসছে রসিকতার হাততালি আর শিস দেওয়ার শব্দ।
কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে, একবার বিশেষ রকমের উন্মত্ত ছন্দে বিনা দক্ষতায় একচোট পা চালানোর পরে নির্মলা প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। উইংসের কাছে বীণা দাঁড়িয়ে ছিল, টালমাটাল হয়ে সেদিকে যেতে যেতে যেন ইঙ্গিত করলেন— এক গ্লাস জল দরকার। বীণা শশব্যস্ত হয়ে নুন-চিনি মিশিয়ে এক গ্লাস জল এনে দিল, সেটা খেয়ে যেন একটু ধাতস্থ হলেন নির্মলা। কিন্তু ততক্ষণে অসম্ভব ঘামছেন তিনি, মুখ হাঁ করে হাঁফাচ্ছেন অসহায় ভাবে। তবলাবাদককে নির্দেশ দিলেন একটা ছোট একক ছন্দ বাজাতে, যাতে কেবল পায়ে তাল রেখে এই ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিতে পারেন। এতে তাঁকে পুরোপুরি থেমে যেতেও হচ্ছে না। কিন্তু একক সোলো শেষ হবার পর অবশ্য আবার নাচ না শুরু করে উপায় ছিল না। অগত্যা…
তখন প্রায় রাত দেড়টা বাজে, নির্মলা শুরু করলেন এক রাশ পির্যুয়েট বা ঘূর্ণি। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে দড়াম করে পড়ে গেলেন স্টেজের উপরে। প্রেক্ষাগৃহে ততক্ষণে ভিড় মোটামুটি পাতলা হয়ে গিয়েছিল। তবে রগড় দেখার জন্যই হোক বা ব্যক্তিগত আনুগত্যের জন্যই হোক, যে ক’জন ছিলেন সবাই মিলে আঁতকে উঠলেন। বীণা ছুটে গেল স্টেজে নির্মলার দিকে, ছুটে এলেন কয়েকজন বাজনদারও। নির্মলা তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তবে সে-যন্ত্রণা পড়ে গিয়ে চোট লাগায়, না হৃদ্যন্ত্রের সম্ভাব্য কোনও সমস্যার থেকে, কেউ ঠাহর করতে পারল না। এন কে সাজঘরে বসে এক কাপ চা খাচ্ছিলেন। বাজনদারদের একজনকে তাঁকে ডেকে আনতে পাঠিয়ে বীণা ফোন করল অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে।
সি.এ.টি.এস. অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার জন্য ১৫১ নম্বরে তখন মরিয়া হয়ে ফোন করছে বীণা, ভয়ে-দুশ্চিন্তায় তার হাত তখন কাঁপছে। ততক্ষণে এন কে এসে পৌঁছেছেন, স্ত্রীকে মাটির উপর ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখে দৃশ্যতই সাদা হয়ে গেল ভদ্রলোকের মুখ। এই ভয়টাই তিনি গোড়া থেকে করেছিলেন। নিজের সচিবকে ডেকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি নামি বেসরকারি হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করার হুকুম দিলেন। সচিব যখন ফোনে লাইন ধরার চেষ্টা করছেন, এন কে তখন ঝুঁকে বসে স্ত্রীর হাত ধরে নরম গলায় ডেকে বলছেন, ‘নিম্মো, নিম্মো এ কী করলে তুমি?’ স্বামীর দিকে তাকিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলেন নির্মলা, কথা বলার শক্তি তখন তাঁর নেই। এমন সময়ে একজন দৌড়ে এসে খবর দিল, অ্যাম্বুলেন্স এসে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্মলাকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলল আর্দালিরা। নির্মলার গায়ে তখনও স্টেজের পোশাক, মেক-আপ গলে ঘামের সঙ্গে গড়িয়ে পড়ছে মুখ থেকে, মাথার উপর গজের সাজ তখনও আটকানো। স্ট্রেচার যখন তাঁকে নিয়ে এগোচ্ছে, তাঁর পিছন পিছন একখানা ছোটখাটো মিছিল অনুসরণ করতে শুরু করল। সেই মিছিলের অগ্রভাগে এন কে, তাঁর পিছনে বীণা, এবং তাঁদের পায়ে পা মিলিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা রকম শলাপরামর্শরত একদল বাজনদার। নির্মলার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে গেলেন আর্দালিরা এবং এন কে নিজে। পিছন পিছন এন কে-র গাড়ি করে এলেন বীণা, এন কে-র সচিব এবং আর একজন কর্মচারী। লাল বাতি জ্বালিয়ে সাইরেনের আওয়াজে কান ঝালাপালা করে অ্যাম্বুলেন্স যখন হাসপাতালের দিকে রূদ্ধশ্বাসে ছুটেছে, নির্মলাকে তখন অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এন কে-র তখন যে ক’জন ভগবানের নাম মনে পড়ছে, প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে নীরবে প্রার্থনা জানাচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর আজ ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে না যায়, এই তাঁর আশঙ্কা।
এ প্রার্থনা কার্যকরী হল। হাসপাতালে পৌঁছে একগুচ্ছ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রাথমিক কিছু তদন্তে বোঝা গেল, প্রেক্ষাগৃহে ব্যাপারটা যত ভয়ানক মনে হয়েছিল, আসলে তা নয়। দু’জায়গায় হাড় ভেঙেছে নির্মলার— গোড়ালিতে, আর পড়ে যাবার সময়ে পড়াটা আটকাতে গিয়ে কবজিতে। জলের অভাবে ডিহাইড্রেশন হয়েছে, অসম্ভব হাঁফিয়ে পড়েছেন, কিন্তু যতদূর দেখা যাচ্ছে, হৃদ্যন্ত্র নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।
ততক্ষণে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বিশিষ্ট শিল্পী সবাই চতুর্দিক থেকে নির্মলার খবর জানতে ফোন করছেন, বীণাও বীরবিক্রমে সামাল দিয়ে যাচ্ছে তাঁদের হাজার জিজ্ঞাসাবাদ। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে উঠল, হাসপাতালে তখন হইচই পড়ে গিয়েছে, নির্মলাকে আরও নানা ভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে, এ-ঘর থেকে ও-ঘর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিবিধ রকমের চিকিৎসার জন্য। ইতিমধ্যে ঘটনার গন্ধ পেয়ে গিয়েছে সংবাদমাধ্যম, তারাও নির্মলা আর এন কে-কে অবিরাম ফোন করে যাচ্ছে। বেশ কিছু কাগজে রিপোর্ট বেরিয়ে গেল— কত্থক নৃত্যের একাগ্র সাধিকা নির্মলা মালব্য একটি চিল্লা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সহ্যশক্তির অদ্ভুত পরীক্ষায় তিনি পোড় খেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন! ভাঙা হাড় আস্তে আস্তে জোড়া লাগল। একটু শক্তি ফিরে যখন পেলেন নির্মলা, তখন তাঁর ঘর ভরে উঠল অতিথি ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড়ে। হাসিমুখে প্রত্যেককে স্বাগত জানালেন নির্মলা, প্রত্যেককেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনালেন সেই একই কথা— সেদিন রাতে যদি আমার মৃত্যুও হত, আমি সানন্দে মৃত্যুবরণ করতাম, কারণ এটুকু জেনে মরতাম যে, আমার ভালবাসার শিল্পের জন্যই নিজেকে বলি দিচ্ছি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র