সমালোচনা— সিনেমা; ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’
মুখ্য চরিত্রে— নিমীষা সাজায়ন, সূরয ভেঞ্জারামূডু, টি সুরেশ বাবু, অজিথা ভি এম, রামা দেবী, সিদ্ধার্থ সিভা
পরিচালক— জিও বেবি
সঙ্গীত— সূরয কুরুপ
আমার প্রজন্মের বাঙালিদের মতো আমিও ভাল খেয়েদেয়েই মানুষ। বাড়িতে দুটো হেঁশেল ছিল। নিরামিষটার দায়িত্বে ছিলেন আমার ঠাকুরমা আর আমিষটার দেখভাল করতেন রাঁধুনিদিদি, যিনি ছিলেন সহায়িকাও। চাকরির জন্য মাকে বেরোতে হত, তাই রোজকার ঘরকন্নার কাজ তাঁকে টানত না। শুধু আমরা কখনও বিশেষ কোনও পদ খেতে চাইলে আর রাঁধুনিদিদি লম্বা ছুটি নিলে মাকে রান্নাঘরে ঢুকতে হত। তখন অবশ্য একাই সব সামলাতে হত। এতে মায়ের চাপ বহুগুণ বেড়ে গেলেও, এই ব্যবস্থা শোধরানোর কথা কারও মনে হয়নি। এমনকী, সেই প্রজন্মের তুলনায় অনেক উদারমনা, আমার বাবাও এই ব্যবস্থায় কোনও ভুল দেখেননি। বাজার করা, সবজি কাটা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা, মায়ের রোজকার এই পাহাড়প্রমাণ রুটিন দেখে ছোটবেলা থেকেই রান্নাঘরের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। হাজার ঠেলা মারলেও আমি কিছুতেই হেঁশেলমুখো হতাম না। রান্না শেখার কোনও ইচ্ছেই ছিল না যে! এক কাপ চা করার সময়ও মনে হত, ইস, এটাও যদি কেউ রোজ বানিয়ে দিত! কফিটা অবশ্য তখনও ভাল বানাতে পারতাম, আজও পারি। কারণ সেটা ছিল আমার আর দাদার বড় পছন্দের জিনিস। এই নিয়ে মা-ঠাকুরমা মাঝে মাঝে বকাবকি করতেন বটে, কিন্তু ক্লাসের পরীক্ষায় ভাল নম্বর আনলেই সব কথা ধামাচাপা পড়ে যেত।
বিয়ের সময়ই আভাস পেয়েছিলাম, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভোজনবিলাসী হিসেবে বেশ গর্ববোধ করেন। কিন্তু আমার চামড়া এতই মোটা যে, তাতে বিশেষ আমল দিইনি! রান্নাঘরে পাচক ও জোগাড়ে, দুই-ই থাকায়, টালমাটাল অবস্থাটা মোটামুটি সামলে নিয়েছিলাম। আর্থিক সঙ্গতি তখন না থাকা সত্ত্বেও। পরে প্রায়ই বাইরে যাওয়ার বিলাসিতা দেখালেও, বিদেশে একটানা কখনওই থাকিনি। তবে যেসব বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য গর্ববোধ হত। তবু আমার কাছে রান্নাঘর আজও গার্হস্থ্য বিরক্তির এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। হয়তো এটা অন্যায়, কিন্তু এই ভাবনাটা এতদিন নিজের মধ্যেই পুষে রেখেছিলাম।
এইভাবেই চলছিল। তারপর একদিন রাত্রে দেখলাম ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’। রান্নাঘরে নিত্যদিন গৃহিণীরা যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হন, তাই নিয়ে এর আগে কোনও ছবি এমনভাবে পর্দাফাঁস করেনি। রান্নাঘরে যে সুখী সংসারের ছবি আঁকা হয়, তা যে আসলে সোনার পাথরবাটি এবং পিতৃতন্ত্রের মুখোশে ঢাকা দাসত্ব, এই ছবি তা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। ছবি দেখতে দেখতে আমার পারা চড়ছিল। চোখটাও কেমন জ্বালা-জ্বালা করতে লাগল।
গল্পটা এইরকম। এক শিক্ষিত, প্রগতিশীল নৃত্যশিল্পীর (নিমীষা সাজায়ন) সঙ্গে সম্বন্ধ করে বিয়ে হল এক শিক্ষকের (সূরয ভেঞ্জারামুডু), যাঁর পরিবার সনাতনী রীতিনীতি পালনেই অভ্যস্ত। বিয়ের প্রথম ক’টা দিন ভালই চলছিল। তারপরেই তাল কাটার শুরু।
নববধূ দেখলেন তিনি এমন এক পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে এসে পড়েছেন যেখানে প্রতিদিন সকালে তাঁর শ্বশুরকে টুথব্রাশটাও ধরিয়ে দিতে হয় শাশুড়ি ঠাকরুনকে। এ এমন এক বাড়ি, যেখানে বাড়ির পুরুষরা ফেলে ছড়িয়ে খেয়ে, টেবিল নোংরা করে উঠে পড়ে আর সেই টেবিলেই খেতে হয় পতিব্রতাদের। টেবিল পরিষ্কার করার দায়ও তাঁদেরই। তাঁদের কাছে বার্তা দেওয়াই আছে, বাড়ির পুরুষদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবার আগে। তাই ছবিতে দেখি, বাড়ির গিন্নিরা যখন বাসন মাজছেন, ময়লা ফেলছেন, লিক হওয়া পাইপ মেরামত করছেন, রান্নাঘর পরিষ্কার করছেন— তখন পুরুষরা ব্যস্ত ফোন, খবরের কাগজ আর যোগ ব্যায়ামে।
পারিবারিক কাজে যখন শাশুড়িকে তাঁর মেয়ের বাড়ি যেতে হয়, তখন এ বাড়ির সব দায়িত্ব এসে পড়ে নতুন বউয়ের উপর। রান্নাবান্না, ঝাড়পোঁছ ছাড়াও আরও অনেক কিছু। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রতি রাতে স্বামীর সঙ্গে যৌন মিলন। তাতে না থাকে তার কোনও ইচ্ছের দাম, না থাকে রতিক্রীড়ার আনন্দ। তার চাকরি করার ইচ্ছেও দমিয়ে রাখা হয়, কারণ সে বাইরে গেলে ঘর-সংসার চলবে কী করে? পরিবারের সমৃদ্ধিই বা হবে কী করে? অথচ সে যখন রজস্বলা, শোওয়ার জন্য একটা ভাল বিছানাও তার জোটে না। গল্পের সঙ্গে সবরীমালা মন্দিরের রাজনীতি ভালভাবেই বুনে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে ঋতুমতী হলেই কেউ অপবিত্র হয় না এবং সেই অবস্থায় আয়াপ্পার মন্দিরে তাদের ঢোকা বন্ধ করা যাবে না।
নববধূর শ্বশুরবাড়ির অনেকেই এই রায় মেনে নিতে পারেন না। অন্যদিকে তার উপর অন্যায়-অবিচারের পাল্লা ভারীই হতে থাকে। শেষে একদিন আর থাকতে না পেরে স্বামী আর শ্বশুরকে ময়লা জলে চুবিয়ে মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। স্বাধীনতা, সম্মান আর নতুন জীবনের আশায়।
অসাধারণ এই ছবিতে খাবারকে অত্যাচারের রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ময়লা টেবিল, বুজে যাওয়া সিঙ্ক, পাইপ থেকে চুঁইয়ে পড়া নোংরা জল, ভাবলেশহীন যৌনমিলন, অবস্থাপন্ন ভারতীয় পরিবারগুলিতে এই হল বিবাহিত দম্পতিদের হাল। এই চিত্র কিছুটা নির্মম ভাবেই দেখিয়েছেন পরিচালক জিও বেবি। ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে নির্মিত এই ছবিতে ভারতের শহরে-গ্রামে চূড়ান্ত লিঙ্গ-বৈষম্যের এক দলিল তুলে ধরার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য মূল চরিত্রের ভূমিকায় থাকা দুই শিল্পী, নিমীষা সাজায়ন ও সূরয ভেঞ্জারামুডুর।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তথাকথিত হিটগুলির তুলনায় এই ছবি আমার অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। ‘বম্বে বেগম’-এ রজোনিবৃত্তিকাল (মেনোপজ) এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এলেও, গভীরতার অভাব ছিল। ‘তাণ্ডব’ বা ‘ত্রিভঙ্গ’তেও সেই অভিঘাত উঠে আসেনি। কারণ প্রথমটিতে ছিল আত্মিক যোগের অভাব। দ্বিতীয়টিতে প্লটের খামতি নিয়ে আসে বিয়োগান্তক পরিণতি। যদি কেউ মনে করেন কেরালা এমন এক রাজ্য যেখানে মহিলাদের সম্মান বেশি, দয়া করে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ দেখুন। ভাবছি, শুধু কেরালা কেন, ভারতের যে কোনও রাজ্যে, এমনকী বিশ্বের বহু দেশে মহিলাদের এমনই অবস্থা। এর পর আমিও আমার বিশ্বাসে স্থির থাকার আরেকটা কারণ খুঁজে পেলাম।