ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হোজা নাসিরুদ্দিন এবং প্রতিবাদের গল্প


    প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (April 23, 2021)
     

    দশ ভলিউমের বই ‘সেয়াহাতনামে’। সপ্তদশ শতকের তুর্কি ভ্রমণরসিক এভলিয়া চেলেবি চল্লিশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ঘোরার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিলেন এ বই। তুর্কি ‘ভ্রমণসঙ্গী’ ঠিক নয়, পাতার পর পাতা ধরে শুধু নিরস নির্দেশিকা নেই। সেয়াহাতনামের পাতায় পাতায় রয়ে গেছে অফুরন্ত চুটকি, হাস্যরসাত্মক ছোট ছোট গল্প। এরকমই এক গল্পে আমরা পেয়ে যাই ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাতিতে যার জুড়ি মেলা ভার সেই তৈমুর লঙ-কে। এ গল্পে অবশ্য তৈমুর হাতে মাথা কাটছেন না মোটেই। বরং অনেক বুঝদার এক মানুষ তিনি। গল্পটি একবার শুনে নেওয়া যাক।

    ‘তৈমুর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হামামে ঢুকেছেন। হামামের উষ্ণতায় ঘামতে ঘামতে তৈমুর তাঁর বয়স্যকে বললেন ‘ওহে, হাতে তো এতটা সময়। কিছু খেলবে না কি?’ বয়স্য ঘাড় নাড়লেন, ‘যে আজ্ঞে জাঁহাপনা’ (সম্ভবত বলেছিলেন ‘খেলা হবে’, তবে এভলিয়া এরকম কিছু লিখে যাননি)। ‘তাহলে বলো দিকিন আমাদের প্রত্যেককে কিনতে গেলে কত দিনার করে দেবে তুমি?’ বয়স্য গম্ভীর মুখে এক এক করে সবার দাম বলে তৈমুরের যা দাম দিলেন ঠিক সেই দাম-ই ছিল তৈমুরের পরনের তোয়ালের। রাজকীয় তোয়ালে হলেও তৈমুর গেলেন বেজায় ক্ষেপে, ‘মাথাটা কি পুরোপুরিই গেছে তোমার নাকি খামোখা আমাকে চটাতে চাইছ?’ বয়স্য হাত জোড় করে বললেন, ‘ভেবে দেখুন শাহেনশাহ, ওই তোয়ালে খুলে নিলে আপনার আর রইল কী? আমআদমির কথা আমি থোড়াই বলছি!’ তৈমুর শুনে গলে জল, ফস করে সোনার চেন খুলে পরিয়ে দিলেন বয়স্যের গলায়।’

    এভলিয়া চেলেবি বয়স্যর নামও জানিয়েছেন। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম মোল্লা নাসিরুদ্দিন, যদিও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ জায়গায় তাঁকে হোজা নামেই মানুষ চেনে। এভলিয়ার আখ্যানে সবই ভাল, কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে কিছু সমস্যা আছে। তৈমুর লঙ ১৩৩৬ সালে জন্মেছিলেন অধুনা উজবেকিস্তানে, আর মারা যান তার প্রায় সত্তর বছর পর আজকের কাজাখস্তানে। এদিকে মোল্লার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা হয় নাসিরুদ্দিন ছিলেন আনাতোলিয়া অঞ্চলের মানুষ, চার হাজার কিলোমিটার দূরের জায়গা। অতএব? ডাহা গুল, আর কী! কিন্তু ডাহা গুল বললেও মিথ্যাচারণ হবে। মোল্লা নাসিরুদ্দিন এবং তাঁর বুদ্ধি, বা মোল্লা নাসিরুদ্দিন এবং তাঁর বোকামি, এক হিসাবে সারা মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ। প্রায় সাতশো বছর ধরে নাসিরুদ্দিনের গল্প নির্ভেজাল হাস্যকৌতুকের বেড়া টপকে কখন যেন একটা প্রতিবাদী সত্তা পেয়ে গেছে। সব থেকে জুলুমবাজ সুলতান, সব থেকে ভণ্ড ধর্মগুরু, সব থেকে হিংসুটে প্রতিবেশীদের ঢিট করার দরকার পড়লেই সারা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ মনে মনে শরণাপন্ন হয়েছেন মোল্লার। ইরান থেকে আর্মেনিয়া, আজেরবাইজান থেকে উজবেকিস্তান, সর্বত্রই তাই নাসিরুদ্দিন বিরাজমান। প্রায় ভগবান বা প্রায় কার্ল মার্ক্স।

    তুরস্কের আকশেহর-এ, যেখানে প্রতি বছর ঘটা করে নাসিরুদ্দিনের জন্মদিন পালন করা হয় (এবং আকশেহরিরা দাবি করেন নাসিরুদ্দিনের জন্মভিটে নাকি ও চত্বরেই), কান পাতলেই শোনা যাবে নিচের গল্পের একাধিক ভ্যারিয়েশন, ‘‘তোমার কী মনে হয় হোজা, গ্রামের আগা সাহেব স্বর্গে যাবে না নরকে?’, নাসিরুদ্দিনকে দেখে সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে উঠল। নাসিরুদ্দিন ভারিক্কি চালে জবাব দিল, ‘কোত্থাও না, এখানেই থাকবে।’ শুনে তো সবাই হাঁ, ‘সে কী করে হয়?’, মুচকি হাসল নাসিরুদ্দিন, ‘আরে কফিনে ঢোকার জন্য ঠিক একটা গরিবকে পেয়ে যাবে আগা, খুব চিনি ওঁকে’’।

    নাসিরুদ্দিনের গল্পের জনপ্রিয়তা এমনই যে আর্মেনিয়ার একাধিক লোককথাও গড়ে উঠেছে নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে। এবং মজার ব্যাপার এই যে, আর্মেনিয়া এবং অটোমান তুরস্কের ঘোরতর শত্রুতার দরুণ বহু সময়ই এসব গল্পে তুর্কি চরিত্রদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সময় সময় তার থেকেও বেশি কিছু। হোজাকে নিয়ে একখান আর্মেনিয়ান গপ্পো শুনে ফেলা যাক।  

    ‘‘হোজা, চট করে একবার বাজার যাও দিকিন। দুটো বেগুন দরকার’, বলল হোজার বউ। ‘বেগুন আবার কী বস্তু?’, মাথা চুলকে শুধল নাসিরুদ্দিন। বউয়ের গালে হাত, ‘ওমা, কেমনধারা লোক তুমি বাপু! বেগুনটুকু চেনো না? শোনো বাজারে যাও, দেখবে যার ওপরটুকু সবুজ, আর নিচটা কালচে নীল রঙের সেটাই বেগুন’। মাথা নাড়ল হোজা, ‘বেশ বেশ, এই গেলাম আর এলাম।’ সত্যিই খুব চটপট বাজার থেকে ঘুরে এল নাসিরুদ্দিন, ‘গিন্নি, বেগুন এনেছি। কোথায় তুমি?’
    ‘আমি রান্নাঘরে, আসছি। তুমি ততক্ষণে বেগুনের সবুজটুকু কেটে বাকিটা ঝুড়িতে ফেলো’, চেঁচিয়ে বলল বউ।
    কিছুক্ষণ পর হলুদ মাখা হাত শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল হোজার বউ। আরে না, এ কি বাঙালি রান্নাঘর পেয়েছেন নাকি! যাকগে! সামনের ঘরে ঢুকে হোজার বউয়ের ভির্মি খাওয়ার দশা, ‘হায় হায়! এ কী করেছ গো! আমাদের তো ফাঁসিতে চড়াবে এবার!’
    হোজা মাটিতে গড়াগড়ি যাওয়া তুর্কি শেখদের মাথার সবুজ পাগড়ি আর ধড়ের কালচে জোব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই তো ভাবছি, ঝুড়িতে ঢোকাব কী করে এদের। কিন্তু গোটা বাজারে ওপরে সবুজ আর নিচে কালো অন্য কিছু ছিল না’।’

    স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে আর্মেনিয়ানরা নিজেদের চেপে রাখা রাগটুকু দিব্যি উগরে দিয়েছেন এ গল্পে। অথচ নাসিরুদ্দিনের চরিত্রের সঙ্গে গপ্পোটি দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। নাসিরুদ্দিন জন্মবোকা না মিটমিটে চালাক, এ প্রশ্ন চিরকালের! তবে তুরস্কের গল্পগুলোতে দেখা যায় যতদিন গেছে নাসিরুদ্দিনের বুদ্ধি আরও ধারালো হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর নাসিরুদ্দিনকে ধর্মবোদ্ধা হিসাবে দেখানো শুরু হতে থাকে। হৃত সাম্রাজ্য ও হৃত সম্মানের জ্বালা ঘোচাতে নাসিরুদ্দিনকে যেন দ্বিতীয় জন্ম দেওয়া হয়। গাধার পিঠে উলটো করে বসে থাকা হোজার যে ছবি এককালে সারা তুরস্কের লোক দেখামাত্র চিনত, সেই ছবিও বাতিলের দাবি উঠল। তুর্কি নাসিরুদ্দিন গাধার পিঠে বসে থাকার মতন বোকা নয়, এ চক্রান্তের শেষ দেখা দরকার, এমনটাই বলতে শুরু করলেন একাধিক গবেষক ও ধর্মপ্রচারক। কিন্তু ততদিনে নাসিরুদ্দিনের গল্প ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া এবং ইউরোপের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে। হোজার তুর্কি মেকওভার খুব একটা ফলপ্রসূ হল না। বরঞ্চ তুরস্কেরই কিছু গবেষক উলটে বলতে শুরু করলেন বোকামি আর চালাকির টানা-পড়েনের ফলে নাসিরুদ্দিনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা যা পশ্চিমি দুনিয়ার পাঞ্চ-লাইন প্রিয় মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। নাসিরুদ্দিনের আপাতসারল্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অভিনব প্রতিবাদী সত্তা।

    কুড়ি-তিরিশেরর দশক জুড়ে যখন এই বিতর্ক চলছে, তখন প্রায় নিঃশব্দে ঘটে চলেছে আর এক বিপ্লব। রাশিয়ার হাত ধরে নাসিরুদ্দিন হয়ে উঠছেন মধ্য এশিয়ার দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রতীক। ১৯৩৫ সালে লিওনিড সোলোভিওভ দু’খণ্ডের একটি আস্ত উপন্যাস লিখে ফেললেন, যার নাম ‘নাসিরুদ্দিন হোজার গল্প’। এ গল্পে নাসিরুদ্দিন বুখারার মানুষ, কিন্তু নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত। নিজের বুদ্ধিবলে নাসিরুদ্দিন ইস্তানবুল থেকে বাগদাদ, বেইরুট থেকে বসরা যেখানেই গেছেন সেখানেই বিস্তর খ্যাতি পেয়েছেন। সেই খ্যাতি এবং নিজের বুদ্ধির ওপর ভরসা রেখে নাসিরুদ্দিন ফের বুখারায় ফিরে আসবেন, এবার তাঁর লক্ষ্য বুখারার রাজপ্রাসাদ থেকে অত্যাচারী শাসক খান-কে দূর করা। নাসিরুদ্দিনের জন্য গল্পের শেষে সুখস্মৃতি অপেক্ষা করে থাকলেও লেখক লিওনিড কিন্তু এত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। স্টালিনের সময়, ‘দ্য গ্রেট পার্জ’-এর সময়, শাসকের বিরুদ্ধে (কাল্পনিক শাসক তো কী!) কলম ধরার শাস্তি হিসাবে লিওনিডকে প্রথম খণ্ড লেখার পরপরেই জেলে পাঠানো হয়েছিল। তাতে না দমে দ্বিতীয় খণ্ডটি লিওনিড জেলের ভেতরে বসেই লেখেন। তুরস্ক বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্র যে নাসিরুদ্দিনকে আমরা পাই তিনি আদপেই এত অ্যাডভেঞ্চারাস নন। তবে লিওনিডের হোজার মধ্যেও আমাদের চেনা নাসিরুদ্দিনের কৌতুকপ্রিয় প্রতিবাদী সত্তাটিকে মাঝে মাঝেই খুঁজে পাই। নিচের আখ্যানটি যেমন।

    ‘বুখারায় ঢোকার সময় দেখা গেল যে ট্যাক্সো আদায় করছে সে ব্যাটা তার প্রভুর মতনই বদ। দেখছে নাসিরুদ্দিনের জীর্ণ জামাকাপড়, তার পরেও নাসিরুদ্দিনের কাছে চার চারটে বার সে টাকা চাইল। প্রথমবার বুখারায় ঢোকার জন্য, দ্বিতীয়বার বুখারায় ঢুকে ব্যবসা করতে পারে এই সম্ভাব্যতার জন্য, তৃতীয়বার মসজিদের জন্য চাঁদা। তিনবার আলাদা আলাদা কারণে টাকা দেওয়ার পরেও যখন ফের বদটা টাকা চাইল, হোজা যারপরনাই অবাক হলেন। ‘বা রে, তুমি ঢুকবে টাকা দিয়ে আর তোমার গাধা কি ফ্রি-তে ঢুকবে নাকি?’ কারণ শুনে নাসিরুদ্দিন গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন, ‘ঠিকই বলেছেন প্রভু। আমার মতন আমার গাধারও এ শহরে অগুনতি আত্মীয়। তারা আছে বলেই না আপনারা করেকম্মে খেতে পারছেন!’’ 

    নাসিরুদ্দিনের শুরুর গল্পগুলিতে কিন্তু হোজা এত প্রাজ্ঞ ছিলেন না। তাঁর অধিকাংশ গল্পই ছিল আদিরসাত্মক চুটকি। নাসিরুদ্দিনকে হোজা বানানোর তাগিদে সেসব গল্প প্রায় সবই বাদ পড়েছে। তবে বলকান দেশগুলি, বিশেষত বসনিয়ায় সেই আদি গল্পগুলি এখনও শোনা যায়। এবং মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় সে সব গল্পেও নাসিরুদ্দিন দস্তুরমতন খুঁচিয়েছেন। কখনও শাসক, কখনও ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে নাসিরুদ্দিন সমানে টিপ্পুনি কেটে যান। একটা গল্প শুনে ফেলা যাক। এ গল্পটি প্রথম পাওয়া যায় বুলগেরিয়ান লোকগাথা সংগ্রাহক পারতেভ নাইলি বোরাতাভ-এর বইয়ে।

    ‘নতুন গ্রামে ঢুকে নাসিরুদ্দিন দেখেন মসজিদ লাগোয়া একটি সুউচ্চ মিনার। এত লম্বা মিনার নাসিরুদ্দিনের নিজের গ্রামে নেই। কৌতূহলী হয়ে হোজা গ্রামবাসীদের শুধোলেন, ‘এ বস্তুটি কী হে?’ হোজার মূর্খতায় গ্রামবাসীরা অবাক। হাসতে হাসতে তারা রসিকতা করল, ‘আরে হোজা, এটাও বলে দিতে হবে? ও তো আমাদের গ্রামের পুরুষাঙ্গ’। সম্ভ্রমের সঙ্গে নাসিরুদ্দিন মাথা নাড়ল, ‘বলো কী! কিন্তু এর সঙ্গে মানানসই পশ্চাদ্দেশ তোমাদের আছে তো?’’

    হোজা নাসিরুদ্দিনের অধিকাংশ গল্প থেকে যেমন আদিরসও বাদ দেওয়া হয়েছে, তেমনভাবেই বাদ পড়েছে বহু গল্প যাতে সুফি দর্শনের ছোঁয়া আছে। সেসব গল্পে পাঞ্চ-লাইন নেই, প্রথমবার শুনলে মনে হতে পারে গল্পটা আদৌ তৈরি হল কেন! অথচ মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় এসব গল্পে রয়ে গেছে সূক্ষ্ম খোঁচা, তবে কোনও অত্যাচারী শাসক বা ধর্মগুরু লক্ষ্য নন, সে কৌতুকের লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য সাধারণ শ্রোতারাই। যেমন এই গল্পটি—

    ‘একদিন নিজের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে নাসিরুদ্দিন প্রাণপণে দেওয়াল পেটাচ্ছিল। সেই দেখে তার পড়শি হাঁ হাঁ করতে করতে ছুটে এল, ‘কর কী হোজা, কর কী!’, নাসিরুদ্দিন অম্লানবদনে জবাব দিল, ‘ছাদ থেকে যাতে বাঘ না নামে তাই শব্দ করছি’। পড়শি তো অবাক, ‘বলি, বাঘটা দেখলে কোথায়! এ গ্রামে তো বাঘ নেই’। ‘জানি তো’, বলে ফের দেওয়াল পেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হোজা নাসিরুদ্দিন।’

    নাসিরুদ্দিন গবেষকদের বক্তব্য, এ গল্পে নাসিরুদ্দিন কিন্তু কোনও নির্বোধ মানুষ নন। বরং গল্পের লুকোনো শ্লেষটি শ্রোতাদের জন্য তুলে রাখা— বাস্তব এবং কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের জ্ঞান কত কম সেটা বোঝানোই আসল উদ্দেশ্য। 

    বাস্তবজ্ঞান না থাকার খেসারত অবশ্য শুধু সাধারণ মানুষ নন, হাতে মাথা কাটা শাসকরাও দেন। পঞ্চাশের দশকে মার্কিনি কর্তারা যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে কমিউনিজমের প্রভাব হটাতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, তখন তাঁদের নজর পড়েছিল হোজার ওপর। তখনকার দিনে প্রায় চোদ্দ হাজার ডলার খরচ করে নাসিরুদ্দিনের ওপর সিনেমা বানিয়ে বাগদাদের মার্কিনি দূতাবাসের কর্মীরা ইরাকের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে সেই সিনেমা দেখাতেন। নাসিরুদ্দিনের মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাছাই করা কমিউনিজম বিরোধী সংলাপ। সে সিনেমায় অবশ্য রক্তমাংসের কলাকুশলীরা ছিলেন না, অভিনয় করেছিল সুতো বাঁধা পুতুল। দূতাবাসের কর্মীরাই পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এ প্রোজেক্ট ডাহা ফেল করেছিল। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল পুতুলের নাচনকোঁদন দেখতে গিয়ে মানুষ আসল বক্তব্যের দিকেই মনোনিবেশ করতে পারেননি। হতে পারে। তবে নাসিরুদ্দিনের গল্পের শ্লেষ কিন্তু পাখিপড়া করে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। এ শ্লেষের আবেদন যেহেতু চিরন্তন, তাই একটি নির্দিষ্ট দেশ, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ, একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ধাঁচের মধ্যে নাসিরুদ্দিনকে বাঁধতে চাওয়াটাই মূর্খামি। এবং গ্রামের মানুষরাও বোঝেন, সম্ভবত শহরের মানুষদের থেকে বেশিই বোঝেন, নাসিরুদ্দিনের গল্পে শ্লেষের ওপরের স্তরে কিন্তু রয়ে গেছে একটি সর্বজনীন ভদ্রতা, যাকে ছুঁড়ে ফেলতে শ্রোতাদের আদৌ সায় থাকে না। নাসিরুদ্দিনের ভদ্রতা এবং সৌজন্যবোধ প্রবাদপ্রতিম। ওই যে গাধার পিঠে উলটো মুখে বসে থাকা, তার পরিচিত কারণটি শুনলেই একটা ধারণা করা যায়। নাসিরুদ্দিন গ্রামের পথ ধরে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে যাবেন। মুশকিল হল, কীভাবে নিয়ে যাবেন। ছাত্ররা সামনে গেলে নাসিরুদ্দিনকে অসম্মান দেখানো হয়, নাসিরুদ্দিন সামনে থাকলে আবার ছাত্রদের অসম্মান দেখানো হয়। পশ্চাদ্দেশ দেখানো মোটেই সৌজন্যবোধের নমুনা নয়। বহু ভেবেচিন্তে তাই নাসিরুদ্দিন ঠিক করলেন গাধার পিঠে উলটো মুখে বসলেই এ সমস্যার সমাধান চলে আসবে।

    তৈমুর আর নাসিরুদ্দিনকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁদের দিয়েই শেষ করি। উজবেকিস্তানের জারাফশান পাহাড় শুরু যেখানে হচ্ছে, সেই অতি সঙ্কীর্ণ মুখটির নাম ‘তৈমুরের দরজা’। ওই সঙ্কীর্ণ গিরিপথে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে বহু হাজার, হয়তো বহু লাখ সৈন্যের মৃত্যু ঘটেছে কয়েকশো বছর ধরে। কারণ ওই গিরিপথ দখল করতে পারলেই উন্মুক্ত হয়ে যায় এক বিশাল সাম্রাজ্য। বুখারা, সমরকন্দ, আরও কতশত ছোটবড় শহর নিয়ে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্য। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, অতএব এহেন গিরিপথের নাম যে তৈমুরের নামে হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী! নাসিরুদ্দিন-ও ঠিক করলেন তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি আড়াল করে থাকবে এক দরজা, তৈমুরের স্মৃতিচিহ্ন আর তাঁর স্মৃতিচিহ্ন একই থাকুক। তুরস্কের আকশেহরে গেলে আজও দেখতে পাওয়া যায় সেই দরজা। বিশাল দরজা, বাইরের কড়া থেকে ঝুলছে এক ইয়াব্বড় তালা। সে তালা খোলার কোনও চাবি নেই। তাতে কোনও সমস্যা নেই অবশ্য। কারণ সে দরজা কোনও দেওয়ালের সঙ্গে জোড়া নয়, একাকী দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ দরজার পাশ দিয়ে ঘুরে গেলেই নাসিরুদ্দিনের সমাধিতে ঢুকে পড়তে পারবেন।  

    স্বৈরাচারের প্রতিবাদে ব্যঙ্গকৌতুকের থেকে বড় হাতিয়ার কমই আছে। নাসিরুদ্দিনের সমাধিতেও সে বার্তা রেখে গেছেন। কে রেখেছেন? নাসিরুদ্দিন নিজেই? হয়তো, হয়তো নয়। বড় কথাটা হল প্রায় সাতশো বছর পর মানুষ নাসিরুদ্দিনের দরজা দেখে হাসেন কিন্তু তৈমুরের দরজা দেখে ভয় পান না। হাতিয়ারের ধার শুধু অত্যাচারীর জীবদ্দশায়, কিন্তু কৌতুকের ধার চিরকালীন। জানা কথা, তাও এই বিক্ষুব্ধ সময়ে আর একবার মনে করিয়ে দিলে ক্ষতি কী? 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook