পরিপাটি বসন্ত নয়। ভাল, এলোমেলো বসন্ত। উপচে-পড়া ফুলের পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে, একটা সংযমী, গভীর ভাললাগার রেশ নিয়ে ফিরে আসার ইচ্ছে আমাদের বেশির ভাগেরই সম্ভবত নেই। কেন নেই, সত্যি সত্যি আমি জানি না! শুধু অভ্যাস নয়, এ একটা রুচির ব্যাপার। এই রুচি আমাদের অনেকেরই যে কেন তৈরি হয়নি কে জানে! সকলের রুচি একরকম হবে তেমনও নয়। কিন্তু মোটের উপর ভাবটা যেন এরকমই।
বসন্ত আসবে, মন উতলা। ভিতরটা ফাঁকা-ফাঁকা। কী একটা নেই, কী একটা নেই! কিন্তু সোজা কথা— আমরা ফুল দেখতে শিখিনি। ফুল থাকবে গাছে, আমরা থাকব আমাদের জায়গায়। এত সহজ এই ব্যাপারটা যেন ভাল লাগে না আমাদের। বটের ঝুরি ধরে ঝুলতে, গাছের পাতা ছিঁড়তে, নির্বিচারে ডালপালা ভাঙতে আর কিছু ফুল তুলে আনার মধ্যেই যেন আনন্দটা বেশি। বসন্তকে, আরও অনেক কিছুর মতো, আমরা চাই গলার মালায়, কানের দুলে। তাই এত ফুল তোলা। শান্তিনিকেতনের বসন্তে তাই ফুটতে না ফুটতেই পলাশের ডাল শূন্য। ভাগ্যিস কাগজফুলের মালা হয় না, আর গাছটাও কাঁটায় ভর্তি। রংবেরঙের ব্যুগেনভিলিয়াই তাই আজকাল বাঁচিয়ে রাখে শান্তিনিকেতনের বসন্তকে।
চারপাশে অবাঞ্ছিত বর্জ্য আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। শুধু ঝরে পড়া পাতা আর ফুল না সরালে যেন আমাদের পথ আর ‘পরিচ্ছন্ন’ হয় না। ঝরা পাতাও আমরা বুঝতে শিখিনি। এই সব ভাবতে ভাবতে, শান্তিনিকেতনের এলোমেলো বসন্তে, আমার জাপানের কথা মনে পড়ে যায়। ওখানে ফুল দেখা আর বসন্ত যেন একটা রূপকথাই। মনে দাগ রেখে যাওয়া দু’একটা গল্প বলার আগে বলছি, শান্তিনিকেতনের মাটি রুক্ষ। কাছাকাছি নদী বলতে একটাই— কোপাই। সেটাকে এখন মরা নদী বলা চলে। মাটিতে লোহা বেশি। মাটির রং তাই মোটের উপর লাল। এত কঠিন, একটা গর্ত খুঁড়তে ঘাম ছুটে যায়। তৃষ্ণার্ত মাটি এক বালতি জল শুষে নেয় মুহূর্তেই। কিন্তু এই জমিতেই গাছগাছালির অন্ত নেই। এখানে যেমন বিশ্বের মানুষের আনাগোনা, একই ভাবে এসেছে কত গাছপালা। দেশ-বিদেশের গাছগাছালি লুকিয়ে আছে শান্তিনিকেতনের আনাচে-কানাচে, বিশেষ করে আশ্রমচত্বর আর তার পূর্বপ্রান্তের বাড়িগুলোর ছায়াঘেরা, বিস্তৃত, নিরালা বাগানগুলোয়। মাটি রুক্ষ বলে এই অঞ্চলের গাছের দরকার নিয়মিত জলের। এক সময় শান্তিনিকেতনে জলের প্রবল কষ্ট ছিল। এখন বাড়ি বাড়ি গভীর নলকূপ। অভাব শুধু কাজ-জানা, বাগান-বোঝা, গাছ-ভালবাসা মালির। শান্তিনিকেতনে এখন আর উদ্যান-শিল্পী নেই। মালি মানে, গাছ আনবে, ফুল ফোটাবে, ঝাঁট দেবে পাতা। কোথাও আবার গাছ ছেঁটে হাতি-ঘোড়া, সারস, বক অথবা ডায়নোসর বানাবে।
শান্তিনিকেতনের বসন্ত কেমন ছবি দেখায়? একটা ব্যাপার ইদানীং বেশ চোখ টানার মতো। একটা সময় শান্তিনিকেতনের বসন্ত বললেই ভেসে উঠত সার সার গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশের ছবি। লাল আর হলুদ, দু’রকমের। শান্তিনিকেতনে লাল পলাশই বেশি। হলুদটা প্রায় চোখেই পড়ে না। ভাবনার ব্যাপার, যেসব গাছ এ যাবৎ শান্তিনিকেতনের বসন্তকে চিনিয়েছে তাদের বেশির ভাগই গজিয়ে উঠেছিল নিজে নিজে, অবহেলায়, অনেকটা যেন আগাছা হিসেবেই। নিয়মিত তাদের কেউ জল দেয়নি। তারা আমাদের ফুল আর বসন্ত দিয়ে গেছে। পলাশ কুড়িয়ে, জলে ফুটিয়ে এক সময় আমরা জামাকাপড় রং করেছি। পলাশের নীচটা কালো, উপরটা কমলা। ভিতরে হাতির দাঁতের মতো একটা সরু বাঁশি সুপ্ত। যারা জানে, তারা জানে। অনেকেই এক সময় পলাশের বাঁশি বাজিয়েছে। লাল স্প্যাথোডিয়ার পিচকিরি নিয়ে খেলা করেছি আমরা।
তুলতে তুলতে, ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে শান্তিনিকেতনে পলাশ প্রায় উধাও। পলাশ গাছ ভালবেসে কেউ বাড়ি এনে আদর করেছে— বেশি শুনিনি। এর কারণ সম্ভবত ধৈর্যের অভাব। একটা পলাশ গাছ বড় হতে আর ফুল দিতে বেশ কিছু বছর নিয়ে চলে যায়। কত অপেক্ষার পর পলাশ গাছ বাড়ির বাগানে বসন্ত এনে দেবে তা কেউ বলতে পারে না। আমার বাগানে শখ করে বাবার হাত দিয়ে দুটো পলাশ লাগিয়েছিলাম। একটা লাল আর একটা হলুদ। প্রতি বসন্তে তাদের কাছে যাই, ফিরে আসি শুধু কচি পাতা দেখে। আমি থাকি, না-থাকি, জানি, একদিন ফুল আসবে। সম্পর্কের মতো পলাশ এত আতুসী নয়।
কিন্তু শান্তিনিকেতনের পলাশকে ছাপিয়ে গেছে কাগজফুল। লাল, গোলাপি, সাদা, হলুদ, কমলা, আর কত রঙের ব্যুগেনভিলিয়া। বিশেষত পূর্বপল্লীর বাড়িগুলোর বেড়ায় বেড়ায় উপচে পড়ছে নানা বাহারের কাগজফুল। পলাশ যত কমেছে, পাল্লা দিয়ে কাগজফুল বেড়েছে যেন তেমনই। নামমাত্র জল আর একটু কড়া রোদ পেলে নিজেকে মেলে দেবে এই গাছ— রঙে ভেজা কোমল, ভঙ্গুর, ক্ষণিকের পলাতকা সব প্রজাপতির মতো। চলে যেতে যেতে অল্প আদরে নিজেকে বসন্তে এতটা উজাড় করে দেওয়া যায়, শান্তিনিকেতনের কাগজফুল যেন সে কথাই বলে।
আর আছে হলুদ ফুল। যেমন মায়াবী গাছে, তেমনই স্নিগ্ধ ঝরে ঝরে ঘন হওয়া ফুলের গালিচায়। বসন্তে হলুদ ফুলে ভরে থাকা একটা গাছকে আমরা অনেকে প্রায়ই ভুল নামে ডেকেছি। এখনও ডাকছি। ফাগুন-বউ নয়, ফুলটা কিন্তু ট্যাবেবুইয়া। চলতি নাম বসন্তবাহার। এটাই বেশি দেখা যায় শান্তিনিকেতনের প্রায় সর্বত্র। পলাশ ঝরে না অত বেশি, যত বেশি এই ফুল ঝরে যায়। ফাগুন-বউও আছে। তুলনায় অনেক কম, পাপড়ি কিছুটা পুরু। ঠিক যেন হলুদ শিমুল ফুল। কিছু রক্তিম ফুল বসন্ত মাত করে দেয়। রক্তরাগ, সুপ্তি, গিরিকমল, স্প্যাথোডিয়া, পাখিফুল, পালতে মাদার, অশোক আর ঘোর লেগে যাওয়া পারিজাত। অপরূপা লাল ফুলগুলো প্রায় সৌরভহীন। তাহলে বসন্ত কি রেখে যায় না সৌরভের স্মৃতি? পেল্লায় গাছগুলোর নীচে স্তূপীকৃত পড়ে থাকে মুচকুন্দ। তবে তার খুব কাছে না গেলে আশ্চর্য গন্ধটা পাওয়া ভার। নিঝুম সন্ধ্যায় কুড়িয়ে আনা মুচকুন্দ, বন্ধ দু’চোখের পল্লবের উপর রাখলে, মনে হয় যেন হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার ফিরে আসার স্পর্শ, শরীরে যার মায়ার সৌরভ। তবে বসন্তের শান্তিনিকেতনে লতানো ফুলের রানি যেন নীলমণিলতা।
বসন্তে মিষ্টি গন্ধ যাদের, সেই সব ফুলের বেশির ভাগই সাদা। তার মধ্যে কালেভদ্রে চোখে পড়ে লতানো ইস্টার লিলি ভাইন। মন ভাল করে দেওয়া গন্ধ যাদের, তাদের সেরা নাগকেশর আর বনপুলক। শান্তিনিকেতনে আমার বসন্তের সঙ্গে জড়িয়ে এদের হৃদয়-হরা সৌরভ। শীতে এসেও জেগে থাকা কিছু হ্যামিল্টনিয়া বসন্তে তার উদার গন্ধে মিশিয়ে দেয় বিষাদ। আর আছে বৃষ্টি। রুক্ষ শীতের পর হঠাৎ বৃষ্টি পাঠায় চেনা মাটির ভেজা গন্ধ। দমকা বাতাস, উড়ে আসা হলদেটে বাঁশপাতা, ছাতিমের বুক-চিরে যাওয়া ফল, শালফুলের ঘ্রাণ, ঝরা পাতায় আমফুলের মধুর দাগ আর সোঁদা মাটির গন্ধে ভিতরটা হু হু করে ওঠে। ঝরা পাতার রাশে মিশে দেবদারু, পেয়ারা, শাল, আর সেগুনের পাতা আর ফল। কোথাও বহরা, কখনও পাখির পালক। কোথাও কারও ছেড়ে যাওয়া চপ্পল, হারানো সেফটিপিন।
মনে হচ্ছিল, এই সময় জাপানের আনাচে-কানাচে মানুষের স্রোত, গোটা একটা দেশ আলো করে ফুটে থাকে ক্ষণকালের চেরিফুল দেখার অছিলায়। ফিরে আসব জাপানের সেই গল্প দুটোয়। চা-উৎসবের আচার্যকে এক প্রতাপশালী, একরোখা শাসক বললেন, তিনি দেখতে চান আসাগাওয়া ফুল। আদেশ শিরোধার্য করে চা-গৃহের চারপাশে উদ্যান রচনা করলেন আচার্য। রাশি রাশি আসাগাওয়া ফুল। অতিথির আসার কথা যেদিন, সেইদিন ভোরে আচার্য সরিয়ে দিলেন বাগানের সব ফুল। ফুল দেখতে এসে শূন্যতা দেখে ক্রুদ্ধ শাসক। প্রথায় মাথা নীচু করে তিনি প্রবেশ করলেন চা-উৎসবের ক্ষুদ্র কুটিরে। কিন্তু কোথায় তাঁর আক্রোশ! আসবাবহীন গৃহে, মায়াবী আলোয় ধ্যানের ভঙ্গিতে তাঁর অপেক্ষায় উপবিষ্ট আচার্য। উদ্বেগের লেশমাত্র নেই, মুখে তাঁর আশ্চর্য প্রসন্নতা। এক কোণে শুধু সাজানো একটা সামান্য ফুলদানি আর তাতেই বছরের সেরা একটা আসাগাওয়া ফুল। বহুর ভিড়ে এক-কে এত নিবিড়ভাবে পাওয়ার এও তো এক পথ!
এই আচার্যই একবার এক শিক্ষার্থীকে দিলেন বাগানের ভিতর দিয়ে চা-গৃহে পৌঁছানোর রাস্তা পরিষ্কার করার ভার। রাস্তা ধুয়ে-মুছে তক্তকে করে, এক সময় সেই শিক্ষার্থী চাইলেন গুরুর মতামত। আচার্য কিছু ভাবলেন। ধীরে স্পর্শ করলেন মাথার উপর ঝুঁকে থাকা একটা বাঁশ গাছের ডাল। তারপর তাঁর হাত সরিয়ে নেওয়ার মৃদু আন্দোলনে রাস্তায় ঝরে পড়ল কিছু বিবর্ণ বাঁশপাতা। স্মিত হেসে এগিয়ে গেলেন আচার্য। সেই বিব্রত নীরবতায় শিক্ষার্থী পেলেন এক অনন্ত, সুন্দর পথের সন্ধান। একেবারে আমার একটা এলোমেলো বসন্তের মতো।