এই যে মানুষটা, যাঁর সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ পেয়েছিলাম, প্রশ্রয় আর স্নেহ দুটোই পেয়েছিলাম, তাঁর চরিত্রের অন্য একটা দিকের কথা কিছুটা না বললে, অন্তত এক-আধটা নমুনা পেশ না করলে, অন্যায় হবে। সেটা হল ওঁর তুলনাহীন রসবোধ। আর, ‘সেন্স অফ টাইমিং।’
একদিন, মনে আছে, ফ্লোরে শুটিং করতে করতে ঘেমে উঠছে সবাই— এমনই দারুণ গরম পড়েছে সেদিন। ছবিদা কাজ করছেন আমাদের সঙ্গে, সারাদিন একটা কথা বলেননি। বিকেলের দিকে থাকতে না পেরে বললেন, ‘আর থাকা যাচ্ছে না, বুঝলি! মিনিট দশেকের জন্যে ছাড়বি? বাইরে গিয়ে ছায়ায় একটু বসি। কে যেন এসে বলল যে বাইরে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।’
আমরা প্রথা ভেঙে মিনিট পনেরোর একটা টি-ব্রেক দিলাম।
বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় কয়েকটা চেয়ার পাতা। ছবিদা গিয়ে বসলেন। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবেন এমন সময় কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে পাহাড়ীদা, অর্থাৎ পাহাড়ী সান্যাল এসে হাজির— গরমে ছটফট করতে করতে। ঝপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘উ! শান্তি নেই কোথাও।’
ছবিদা, যিনি কিনা পাহাড়ীদার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, টুক করে আড়চোখে চেয়ে জবাব দিলেন, ‘এতক্ষণ ছিল, এর পর আর থাকবে না।’
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
আরেক বারের কথা।
‘কাঁচের স্বর্গ’ সবে রিলিজ করেছে। কাগজে ভাল রিভিউ বেরিয়েছে আর হাউস ফুলও যাচ্ছে পর পর।
গিয়ে ছবিদাকে ধরলাম।
— ‘একদিন এসে দেখবেন না ছবিটা? সাপ-ব্যাঙ কী বানালাম।’
জবাব এল, ‘সাপ আর ব্যাঙ কোনওটাই আমার পছন্দের জিনিস নয়। একটা ছোবল মারে আর অন্যটার রস গায়ে লাগলেই চুলকোনি বেরোয়।’
কিন্তু আমরা নাছোড়বান্দা। বারবার অনুরোধ করতে লাগলাম৷
শেষে ছবিদা বলে উঠলেন,
— ‘বুঝেছি বুঝেছি। চাই-না-চাই আমাকে গিয়ে কষ্ট করে ছবিটা দেখতে বলছিস, এই তো?’
— ‘হ্যাঁ ছবিদা।’
— ‘কিন্তু আমার যে একটি ধর্মমতে বিবাহিতা পত্নী আছেন, তাঁকে বলবি না?’
— ‘কী কথা! বউদিও যাবেন বইকি।’
— ‘আর তাঁর দুটি অপোগণ্ড পুত্র আছে।’
— ‘তাঁরাও যাবেন।’
— ‘এবং তারা দুজনেই বিবাহিত।’
লিস্ট ক্রমশ বাড়ছে। আমরা তো দারুণ খুশি।
শেষ পর্যন্ত এক সন্ধেয় দলবল নিয়ে ছবিদা এলেন। সর্বসাকুল্যে ষোলো জন। ছবির শেষে নীচে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম। হঠাৎ আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন,
— ‘ভাল রোল করতে বড্ড ইচ্ছে করে, বুঝলি। ভাল রোল থাকলেই আমাকে ডাকিস, কেমন?’
এর থেকে বড় কমপ্লিমেন্ট, এমন স্নেহের স্পর্শ, জীবনে খুব কমই পেয়েছি।
গাড়ি ড্রাইভ করে ছবিদা চলে গেলেন।
তখন যদি জানতাম এই আমাদের শেষ দেখা!
১১ জুন, ১৯৬২। নিজেই গাড়ি চালিয়ে যশোর রোড ধরে ছবিদা যাচ্ছিলেন ছোট জাগুলিয়ায় ওঁর পৈতৃক বাড়িতে।
হঠাৎ আমাদের কাছে খবর এল, মাঝপথে একটা মোটর ভ্যানের ধাক্কায় উনি মারাত্মক আহত। ওঁকে আনা হচ্ছে আর.জি.কর হাসপাতালে।
ছুটে গিয়ে শুনি সব শেষ। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে জনারণ্য। ফিল্ম জগতের সবাই হাজির। কেউ কেউ চোখের জল মুছছেন, কেউ বা হাউ হাউ করে কাঁদছেন।
আমরা বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে।
একটু পরে ‘ছায়াবাণী’ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অসিত চৌধুরি এসে আমাদের হাতে একগোছা টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এক্ষুনি একটা ট্রাক ভাড়া করে বউবাজার স্ট্রিট চলে যান। একটা ভাল ফার্নিচারের দোকান থেকে ভাল একটা খাট কিনে যত তাড়াতাড়ি হয় ফিরে আসুন।’
সেই খাটে শুয়েই ছবিদার শেষ যাত্রা। ফুলে ঢেকে গেছে তাঁর শরীর। আরও ফুল, আরও মালা আসছে— রাখবার জায়গা নেই। রাস্তার দু’পাশে ভেঙে পড়া ভিড়। বারান্দা, ব্যালকনি, ছাদ লোকে লোকারণ্য। চারদিকে শুধু দীর্ঘশ্বাস আর ‘হায় হায়’ শব্দ।
সত্যিকার সম্রাটের মতো সেই পথ বেয়ে চলে গেলেন উনি।
যতটুকু বাকি ছিল, শ্মশানের আগুন সেটা সম্পন্ন করল।
না। এখানেই ছবিদার গল্প শেষ নয়।
এ লেখার এখানে-ওখানে তিনি পর্দা সরিয়ে হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভূত হবেন। এমনকী ‘চাওয়া-পাওয়া’ আর ‘কাঁচের স্বর্গ’-র মাঝখানে যে ছবিটা আমরা করেছিলাম— ‘স্মৃতিটুকু থাক’— তাতে ছবিদা শুধু অভিনয়ই করেননি। গল্পটাও বলতে গেলে তাঁরই দেওয়া।
‘চাওয়া-পাওয়া’ রমরম করে চলছে। পরের ছবির জন্যে তাগাদা আসছে মিতালী ফিল্মস্-এর অমরবাবু আর রোহিণীবাবুর তরফ থেকে। কিন্তু জুতসই গল্প খুঁজে পাচ্ছি না। নৃপেনদার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। অতএব, ওঁকে এ সময় বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না।
এমন সময় একদিন ছবিদার ডাক, ‘একবার দেখা করিস তো।’
গেলাম। ওঁর বাড়িতেই। একটা মোটা বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতা আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘একবার পড়ে দেখিস তো।’
— ‘কী এ?’ জানতে চাইলাম।
— ‘আর বলিস কেন? আমার কাছে থেকে-থেকেই এখান-ওখান থেকে গল্প আসে, বুঝলি! বেশির ভাগই অখাদ্য। কিন্তু ওদের ধারণা, দুর্দান্ত গল্প। আমি বলে দিলেই যে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিল্ম বানাবে।’
— ‘তো?’
— ‘এ গল্পটা এসেছে মেদিনীপুরের কোনও একটা জায়গা থেকে। কী এক ‘মালবিকা রায়’— তার লেখা। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী মনে হতে খানিকটা চোখ বোলালাম। তারপর একটানে শেষ। পাকা লিখিয়ে হয়তো নয়। তবে মনে হল বেশ মালমশলা আছে। গুছিয়ে স্ক্রিপ্ট করতে পারলে ভালই দাঁড়াবে।’
— ‘কিন্তু কে লিখবে ছবিদা? নৃপেনদার তো এই অবস্থা।’
— ‘হুম্। তাহলে এক কাজ কর। প্রেমেনের কাছে চলে যা— প্রেমেন মিত্তির। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে থাকে। গিয়ে আমার নাম বলবি। করে দেবে।’
— ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র!’
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওর কথাই বলছি। ‘নাসায় যাহার অগ্নি স্ফূরিছে বিজলি ঠিকরে ক্ষুরে, আমি শুনিয়াছি সে হয়রাজের হ্রেষা’৷পড়েছিস তো? ঠিক আছে আমি ফোন করে বলে দেব।’
শুনলাম কালীঘাটের পোটোপাড়ায় খাল-ঘেঁষা একটা রাস্তাই হল হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট।
ছবিদার দেওয়া খাতাখানা বগলদাবা করে এক সকালে ঢুকে পড়লাম সেই রাস্তায়।
খালে দু’একটা নৌকো। ধার ঘেঁষে পর পর চালাঘর। টালির আড়ত। খুঁজে খুঁজে শেষকালে ডানদিকের একটা বাড়ির কড়া নাড়লাম।
এক মহিলা খুলে দিলেন। সামনেই উঠোন। সেটা পেরিয়ে নানা ঘোরপ্যাঁচের রাস্তা দিয়ে অবশেষে আমাদের ঢুকিয়ে দিলেন দোতলার একটা ঘরে।
ঘর নয় তো, একখানা আস্ত লাইব্রেরি যেন।
দেয়ালে ফাঁকফোকর নেই কোনও। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বইয়ের তাক। বই আর বই। সামনের টেবিলেও তাই।
টেবিলের ওপাশের চেয়ারে গৃহস্বামী তখনও অনুপস্থিত। আমরা তিনজন বসে রইলাম চুপচাপ।
বেশ কিছুক্ষণ পরে পাশের ঘর থেকে গলা ভেসে এল, ‘আসছি এক্ষুনি। তোমরা চা-টা খাও তো?’
চা আর গৃহকর্তা প্রায় একই সঙ্গে দু’দিক থেকে হাজির হলেন।
চোখে চশমা, ছোটখাটো চেহারার প্রেমেন্দ্র মিত্র চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘ছবি ফোনে সবই বলেছে। দেখি খাতাখানা।’
নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি সময়মতো পড়ে নেব। ছবিকে জানাব। তোমরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।’
সেদিনকার মতো ওখানেই সভাভঙ্গ।
ফিরে এসে দু’দিন বাদে ছবিদাকে সব জানালাম। উনি বললেন, ‘ও নিজে কত বড় সাহিত্যিক। পড়ুক গপ্পোটা ভাল করে। তারপর দেখছি।’
ক’দিন পরে প্রেমেনদা জানালেন, গল্পে অনেক ফাঁকফোকর আছে। সেগুলো ভরাট করে চিত্রনাট্য দাঁড় করাতে হবে। তবে, দাঁড়িয়ে যাবে।
ভালই তো। আমরা গিয়ে ক’দিন বাদে ওঁকে অ্যাডভান্স দিয়ে চলে এলাম।
কিন্তু কোথায় কী? দিন যায়, সপ্তাহ যায়, প্রায় এক মাস কেটে গেল— ওদিক থেকে কোনও খবর নেই। ছবিদাকে এ নিয়ে বার বার বিরক্ত করা যায় না— এতই কাজে ব্যস্ত মানুষটা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল নিজেরাই আরেক বার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুঁ মারব।
আমাদের দেখে প্রেমেনদা এক গাল হাসলেন।
— ‘এসেছ? খুব ভালো হয়েছে। শুটিং কবে থেকে রাখছ?’
— ‘আপনার চিত্রনাট্য হাতে পেলেই ওটা ঠিক করব। ওদিক থেকে চাপ আসছে বড্ড।’ বলে, আমাদের পরিস্থিতিটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
— ‘উঁহু উঁহু, চাপ যতই আসুক, এদিকটা পারফেক্ট না হলে খবরদার এগোবে না। আমি তো দিনরাত ওটা নিয়েই আছি।’ প্রেমেনদা ভরসা দিলেন, ‘তবে ভাল কথাটা হচ্ছে এই যে, আমার দিকটা মনে মনে আমি গুছিয়ে এনেছি। এখন শুধু কাগজে লিখে ফেলা। তোমরা যাও, স্টুডিয়ো আর্টিস্ট এসব বুক করে ফেলো।’
— ‘সময়টা?’ দারুণ খুশি হয়ে আমাদের প্রশ্ন৷
— ‘কত আর? এক মাস, বড়জোর দেড় মাস।’ জবাব এল।
আমরা গিয়ে স্টুডিয়োর ডেট বুক করে ফেললাম।
এবার আর্টিস্ট।
এ ছবিতে উত্তমকে রাখা গেল না। নায়কের চরিত্রটাই অন্য রকম। তবে হ্যাঁ, মিসেস সেন থাকবেন— একেবারে ডবল রোলে। দুই বোন উৎপলা আর শোভনা— ভাগ্যের ফেরে কী করে দুজনের ললাটলিপি ওলট-পালট হয়ে গেল এই হচ্ছে গল্প। ‘দ্বৈত-ভূমিকায় সুচিত্রা সেন’— এইরকম একটা ক্যাপশন থাকলে আমাদের মারে কে?
মিসেস সেনের কাছে যেতেই উনি ওঁর ডায়েরি খুলে বসলেন। অনেকগুলো ডেট চাই। একে ডবল রোল, তার ওপর একই সঙ্গে পর্দায় দু’বোনকে দেখাতে হলে ক্যামেরার কারসাজি— সেটাও খুবই সময়সাপেক্ষ। আজকাল ‘ডিজিট্যাল’ এসে এসব জলভাত হয়ে গেছে। কিন্তু তখনকার যুগ ছিল আলাদা। সেলুলয়েড ফিল্মের যুগ। ক্যামেরাও আজকের মতো নয়। একই শটে ‘মাস্কিং’ করে দুই বোনের উপস্থিতি দেখানো মানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়ের বরবাদি।
তবু মিসেস সেন যথেষ্ট করলেন আমাদের জন্যে। অন্য যে-ছবিতে ডেট দেওয়া আছে সেগুলোর সামান্য এপাশ-ওপাশ করে আমাদের প্রোগ্রামে পাকা কথা দিলেন। একটা বড় সমস্যা কেটে গেল।
ছবিদাও আছেন এ ছবিতে। অনিল, অর্থাৎ অনিল চট্টোপাধ্যায়ও। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দৌলতে ওদের ডেট-ও পেয়ে গেলাম।
এবার নায়ক।
দিলীপবাবু বললেন, ‘এর জন্যে কালোদা-কে ধরা যাক। অর্থাৎ অসিতবরণ।’
অসিতবরণ নিউ থিয়েটার্সের আবিষ্কার। ওদের ‘ওয়াপ্স’, ‘প্রতিশ্রুতি’— এসব ছবিতে নায়কের ভূমিকায় কাজ করে খুবই জনপ্রিয়। মানুষ হিসেবেও স্নেহপ্রবণ, নরম-সরম, আটপৌরে। আড্ডাবাজও। বসুশ্রী সিনেমার ওপর তলায় প্রয়াত মন্টু বোসের উদ্যোগে ওঁদের একটা জমজমাট আড্ডা ছিল। তাতে শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ফিল্ম দুনিয়ার ছোট-বড় অনেকেই ভিড় জমাতেন। ফি-বছর পয়লা বৈশাখ সকালের দিকে বসুশ্রী হলে একটা বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান হত— আজকের মতো হেঁজিপেজি অনুষ্ঠান নয়— রীতিমতো জাতের অনুষ্ঠান। তাতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উত্তমকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কে না হাজির হতেন! সেই সঙ্গে আমাদের কালোদা অর্থাৎ অসিতবরণও।
বসুশ্রীতে গিয়ে কালোদাকে ধরলাম। উনি বললেন, ‘এখানে যা ভিড়, এসব কথাবার্তা হওয়া মুশকিল। এক কাজ করতে পারবি?’
— ‘বলুন।’
— ‘কাল ভোর-ভোর, এই ধর সকাল পাঁচটা নাগাদ, একটা জায়গায় আসতে পারবি? তাহলে আমিও আমার ডায়েরিটা নিয়ে আসব’খন।’
— ‘কটায়?’ অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
— ‘পাঁচটায়, পাঁচটায়। রাধুবাবুর দোকানে।’
— ‘কোথায় সেটা? কোন রাধুবাবু?’
— ‘আরে! কলকাতায় থাকিস আর রাধুবাবুর দোকান চিনিস না?’
— ‘না।’
— ‘তাহলে মফস্সলে গিয়ে থাক গে যা। আরে, ও তো কলকাতার একটা ল্যান্ডমার্ক রে। বিশেষ করে সাউথ ক্যালকাটার। লেক মার্কেটের পাশের গলি— ওখানে গিয়ে যাকে জিগ্যেস করবি বলে দেবে।’
অতএব যেতে হল।
ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে পাঁচটার মধ্যেই আমরা জায়গামতো হাজির।
লেক মার্কেটের দু’পাশ দিয়ে দুটো গলি। কিন্তু দোকানটার নাম বলতেই একজন স্থানীয় মর্নিং-ওয়াকার বলে দিলেন, ‘এটা নয়। পরের গলিটায় যান। দেখবেন, বহু লোক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। সেটা।’
সত্যিসত্যিই তাই। পাশের গলিটায় কোনও দোকানই খোলেনি। কিন্তু দূরে একটা দোকানের সামনে জটলা। ভেতর থেকে কয়লার ধোঁয়া গলগল করে বেরোচ্ছে।
কাছে গিয়ে দেখি, কালোদা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। হাতে চায়ের কাপ। আয়েশে চুমুক দিচ্ছেন।
আমাদের দেখে বললেন, ‘এই তো। এসে গেছিস?’ তারপর ধোঁয়ায় ভরা ছোট্ট দোকানের ভেতরে কাকে যেন ডেকে বললেন, ‘আরও তিন কাপ চা এদিকে।’
পরে বুঝলাম, এই দোকানটা একটা ইনস্টিটিউশন গোছের। বহু দূর দূর থেকে লোক আসে এখানে চা খেতে। অনেকেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া পছন্দ করেন। কারণ, এর মধ্যে নাকি অন্য রকম একটা আভিজাত্য আছে। কালোদাও তাই।
— ‘বুঝলি’, কালোদা বললেন, ‘উনুনে আঁচ দিয়ে এরা যে প্রথম চা-টা বানায় না— জবাব নেই তার। খা, খা—খেলেই বুঝবি।’
চমৎকার চা। কিন্তু তার চেয়েও চমৎকার কালোদার ব্যবহার। ডেট, পারিশ্রমিক, কোনও কিছু নিয়েই আটকাল না। চা খেতে খেতেই সব সমস্যার সমাধান।
ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে বসে আমরা পুরো শুটিং-শিডিউলটা ছকে ফেললাম। এখন শুধু প্রেমেনদার চিত্রনাট্যটা হাতে এলেই হয়।
মাসখানেকও হয়নি, প্রেমেনদার ফোন।
— ‘চলে এসো কালই। আমার কাগজ রেডি। তোমাদের হাতে দিয়ে দেব।’
উল্লসিত আমরা সেদিনই প্রেমেনদার কাছে। যাবার পথে মোড়ের মিষ্টির দোকান থেকে এক প্যাকেট মিষ্টিও নিলাম ওঁর জন্যে।
আবার সেই ভুবন-ভোলানো হাসি।
চা এল।
কিন্তু আমরা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আসল কাজের জন্যে। আমাদের চিত্রনাট্য। সেটা কোথায়? প্রেমেনদার টেবিলে তো দেখছি না।
তাহলে কোথায় থাকতে পারে? বইয়ের র্যাকে? না তো, সেখানেও নেই।
আগ্রহ চেপে না রাখতে পেরে বলে ফেললাম, ‘ইয়ে… মানে স্ক্রিপ্ঢ্টা?’
— ‘আছে আছে, ও ঘরে আছে। এতক্ষণ তো ওগুলোই রিভাইস্ করছিলাম। তার আগে আরেকপ্রস্থ চা হোক, কী বলো?’
চা এল। সঙ্গে বিস্কুট।
দেখলাম, প্রেমেনদার মুড আজ বেজায় ভাল। বিশ্ব-সাহিত্যের এটা-ওটা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। অগাধ জ্ঞান, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের তখন ‘চোরের মন বোঁচকার দিকে’।
থাকতে না পেরে একটা মিথ্যে কথাই বলে ফেললাম,
— ‘একটু তাড়া ছিল প্রেমেনদা। আরেকজনকে টাইম দেওয়া আছে। এখানকার কাজ সেরে তার কাছে পৌঁছতে হবে। পৌঁছতেই হবে। যদি এবার—’
— ‘হচ্ছে হচ্ছে। ও! তোমরা যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ।’
প্রেমেনদা এবার উঠলেন। পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন।
আমাদের তখন আর পায় কে! এই তো বেরিয়ে এলেন বলে, হাতে গোটাকতক মোটা মোটা ফাইল নিয়ে। চিত্রনাট্য বলে কথা।
কিন্তু এ কী? হাতে ওগুলো কী?
সামান্য কয়েকটা কাগজ, আলপিন দিয়ে গাঁথা। সাকুল্যে দশ-বারোটা হবে। আমাদের সামনে ফেললেন।
কাগজগুলোও হরেক সাইজের। কোনওটা ফুলস্ক্যাপ, কোনওটা এক্সারসাইজ খাতার ছেঁড়া পাতা, গোলাপি রঙের একটা ক্যাশমেমোর উল্টোপিঠ, এমনকী ট্রাম-টিকেটও আছে।
— ‘ভালো করে দেখে নাও। কোনও অসুবিধে হলে বোলো।’
দেখব কী? এ তো সব ইংরিজিতে লেখা— যথাসম্ভব খুদে খুদে অক্ষরে৷‘S an U two sisters. Twist of destiny, One leaves village, Hard struggles’— অনেকটা এইরকম। হুবহু মনে নেই, তবে এই গোছের তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা তো অথৈ জলে।
— ‘এসব কী প্রেমেনদা?’
— ‘কেন? জলের মতো সোজা। পুরো ছকটাই তো করে দেওয়া রইল। এই ধরো ‘S’ হচ্ছে শোভনা আর ‘U’ উৎপলা। দুই বোন। ‘Twist of destiny’ মানে ভাগ্যের ফেরে আর ‘Leaves village’ মানে একজনকে গাঁ ছাড়তে হল। আর কী চাই? ভাল করে পড়ো, দেখবে স-ব আছে। যেটুকু নেই সেটুকু আমি ইচ্ছে করেই স্পেস্ ছেড়েছি। তোমরা ডিরেক্টার, তোমাদেরও তো কিছু ভাবনা থাকতে পারে। সেগুলো ঢুকিয়ে দিয়ো।’
অসহায়ের মতো বললাম, ‘আর সংলাপ? একটাও তো নেই দেখছি!’
প্রেমেনদা হাসলেন। মিষ্টি, ক্ষমাসুন্দর হাসি।
— ‘বোকা, ওগুলো কি আগে থেকে লিখতে আছে? একেবারে লাস্ট মোমেন্টে, অর্থাৎ শুটিংয়ের আগের দিন ওগুলো লিখব। মানে আমার মাথায় শেষ পর্যন্ত যদি কোনও ‘স্পার্ক’ আসে, সেগুলো ঢোকাতে হবে তো?’
প্রণম্য মানুষ, আর কোনও কথা বলতে পারলাম না।