ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • গোল্ডফিশেরা ঘৌ-ঘৌ করে না


    রাস্‌কিন বন্ড (Ruskin Bond) (April 14, 2023)
     

    গোল্ডফিশের ভাল দিকটা হল যে ওরা ঘৌ-ঘৌ করে না!’ ঠাম্মা বললেন, ট্যাঙ্কটায় সাতঁরে বেড়ানো সুন্দর সোনালি, কমলা, হলুদ ডোরাকাটা মাছগুলোকে দেখতে-দেখতে।  

    ‘ওরা কোনও শব্দই করে না’, ঠাম্মার নাতনি কোকি বলে উঠল, যে ততক্ষণে মাছের ট্যাঙ্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ওরা কুকুরদের মতো ঘৌ-ঘৌ করে না, গাধাদের মতো ঘ্যাঁকো-ঘ্যাঁকো করে না, পাখিদের মতো গান করে না। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে কী করে?’    

    ‘ওরা কথা ছাড়াই সব বোঝাতে পারে’, ঠাম্মা বললেন, ‘তুমি ওদের কখনও ধাক্কাধাক্কি করতে দেখেছ? মানুষেরা এত কথা বলে, কিন্তু তাও নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই আছে।’ 

    এই অ্যাকোয়ারিয়ামটা ঠাম্মা ক’দিন আগেই পেয়েছিলেন। এর আগে, এক মাসেরও বেশি সময়, ঠাম্মা একটা কুকুর পুষেছিলেন; একটু উসকোখুসকো দেখতে একটা টেরিয়ার। কিন্তু সেই কুকুর সারা দিন এবং সারা রাত ঘৌ-ঘৌ করত। অন্য কুকুর দেখলে ঘৌ-ঘৌ করত, কাঠবেড়ালি দেখলে ঘৌ-ঘৌ করত, ইঁদুর দেখলে ঘৌ-ঘৌ করত (কিন্তু কখনওই তাড়া করত না), ছায়া দেখলে ঘৌ-ঘৌ করত, দরজার ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শুনে ঘৌ-ঘৌ করত, শরৎকালে কাঠবাদাম গাছের পাতা পড়লে ঘৌ-ঘৌ করত।  

    ঠাম্মা ওই নিরন্তর চিৎকার সহ্য করতে পারলেন না, তাই সেই কুকুরটি তাঁর বোনকে দিয়ে দিলেন। ঠাম্মার বোন পাহাড়ের অন্য প্রান্তে বাস করতেন, এবং ঘৌ-ঘৌ করা কুকুরদের পছন্দ করতেন। অনেকে করে। ঠাম্মার পছন্দ ছিল গোল্ডফিশ।     

    ঠাম্মাকে দেখতে কেমন ছিল? সক্কলের সোনামণি ঠাম্মার মতো— দয়ালু, গোলগাল, একমাথা পাকা চুলের, একটি পুরনো চশমা পরা। আর ওঁর গায়ের গন্ধও ছিল সুন্দর, সদ্য সেঁকা রুটির মতো। 

    আর কোকি? তাকে কেমন দেখতে ছিল? সবার সবচেয়ে মিষ্টি, সবচেয়ে সুন্দর ছোটবোনের মতো। এর বেশি আর কী বলার আছে?

    কোকির দুটো বাড়ি ছিল— একটা শহরে, যেখানে সে থাকত তার মা-বাবার সঙ্গে, এবং অন্যটা এখানে, এই পাহাড়তলিতে। এখানে সে থাকত ঠাম্মার সঙ্গে, ছোট্ট কটেজে, হিমালয়ের ওক ও মেপল গাছের জঙ্গলের কোলে। কোকি যতটা সময় পারত তার ঠাম্মার সঙ্গে কাটাত— গরমের ছুটি, শীতের ছুটি, এমনকী হোলি বা দশেরা। ভারতে ছোটরা প্রচুর হোমওয়ার্ক পায়, কিন্তু প্রচুর ছুটিও পায় সেই হোমওয়ার্ক শেষ করতে!   

    কোকি হোমওয়ার্কই করছিল, যখন সে দেখে, খোলা জানলার ধারে বসে একটা বড়সড় বাদামি রঙের বেড়াল, ঘরের অন্য কোণে রাখা গোল্ডফিশ ট্যাঙ্কটার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। গরমের দিনে সাধারণত জানলাটা হাট করে খোলা থাকত। জানলার ঠিক বাইরেই গাছগাছালি, যা থেকে কখনও-সখনও জঙ্গলের পাখি— ওয়্যাগটেল, বুলবুল বা স্কারলেট মিনিভেট— উড়ে ঢুকে পড়ত এবং ঘরময় ঘুরেফিরে, জঙ্গলে ফিরে যেত। 

    ঠাম্মা কিচ্ছু মনে করতেন না, বরং এইসব অতিথিদের আপ্যায়নই করতেন, এমনকী বেড়ালটাকেও কখনও তাড়িয়ে দেননি; আর যা-ই হোক বেড়াল তো ঘৌ-ঘৌ করে না! 

    কিন্তু ঠাম্মা ভুলে গেছিলেন যে বেড়ালেরা মাছ পছন্দ করে— তারা সুন্দর বলে নয়, খেতে খুব ভাল লাগে বলে। হ্যাঁ, গোল্ডফিশের মতো ছোট্ট মাছও বেড়ালদের খুব সুস্বাদু মনে হয়।

    কোকি বেড়ালটাকে দেখেছিল, একটু আদরও করে দিয়েছিল। বেড়ালটা একটু পরে চলে গেলে কোকি জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। 

    পরের দিন ফেরত এসে বেড়ালটা জানলার পর্দার আড়ালে দিব্যি লুকিয়ে পড়েছিল। কোকি রান্নাঘরে গিয়েছিল, ঠাম্মাকে দুপুরের খাবার তৈরি করায় সাহায্য করতে। হঠাৎ বাইরের ঘর থেকে প্রচণ্ড শব্দ এবং বেড়ালের তারস্বরে ম্যাও-ম্যাও চিৎকার। 

    ঠাম্মা-নাতনি সব ফেলে ছুটে এল।  

    এসে দেখে বেড়াল বাবাজি মাছের ট্যাঙ্কে ঢুকে উপুড় হয়ে আটকে আছে, আধা জলের ভিতর ও আধা বাইরে! অ্যাকোয়ারিয়ামটার স্ট্যান্ড ধরে উঠে পড়লেও, ট্যাঙ্কটার কানায় টাল সামলাতে পারেনি, পড়ে গেছে। ট্যাঙ্কের অর্ধেক জল চলকে পড়ে, দুটো গোল্ডফিশ কার্পেটে অসহায় ভাবে দাপাচ্ছে।       

    কোকি বেশ কসরত করে বেড়ালটাকে অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে বার করল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরের কথা, বরং খানিকটা আশ্চর্য হয়ে আর অনেকটা রেগেমেগে, চিৎকার করতে-করতে সে একছুটে বাড়িটা থেকে পালাল। এরপর বহুদিন ব্যাটা আর ফেরত আসেনি। 

    কিন্তু ঠাম্মা দুটো গোল্ডফিশ হারালেন, ট্যাঙ্কে রইল মাত্র আর তিনটে। তাই পরের দিন, যখন ওরা মুসৌরি মল-এ গেল, তিনটে নতুন গোল্ডফিশ কিনে নিল। তাদের মধ্যে একজন, খুব সুন্দর গাঢ় গোলাপি রঙের, কোকির প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। 

    গরমকাল দ্রুত পেরিয়ে পাহাড় জুড়ে বর্ষার আগের বৃষ্টি নামল। পাহাড়ের গায়ের ফ্যাকাশে বাদামি ঘাস যেন হঠাৎ সতেজ সবুজ হয়ে উঠল। ছোট্ট-ছোট্ট পাহাড়ি নালা তোড়ে বইতে লাগল। পোকামাকড়ের জগৎ যেন জেগে উঠল। ওক গাছগুলো ভরে উঠল ঘুরঘুরে পোকার গানে; জানলার কানায় দেখা দিল সরু গঙ্গাফড়িং। রাতে বাইরের ঘরে উড়ে আসতে থাকল নানা ধরনের মথ— কখনও-সখনও তাদের কেউ কেউ গোল্ডফিশের ট্যাঙ্কে পড়ে, ডুবে যেত। 

    আর গুবরে পোকার তো কথাই ছিল না; গোল্ডফিশ ট্যাঙ্কের উপরে ঝোলানো বাল্ব যেন ছিল তাদের অমোঘ আকর্ষণ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে পড়ে যেত, এবং কোকিই তাদের উদ্ধার করত। প্রথমে, একটা অভিজাত ব্যাম্বু বিটল। তারপর, পরের সন্ধ্যায়, একটা আনাড়ি রাইনো বিটল, এবং তারপর একটা স্ট্যাগ বা হরিণ পোকা; যে ভাসছিল, ছটফটাচ্ছিল, ডুবছিল— যতক্ষণ না কোকি এসে উদ্ধার করল।  

    স্বভাবতই, গোল্ডফিশরা ঘাবড়ে যেত꞉ ধুপ! ঝুপ! প্রায়ই চিমনি থেকে গুবরে পোকাগুলো জলে পড়ে যেত এবং বেরোতে পারত না। গোল্ডফিশেরা অভ্যস্ত ছিল শান্তি, নীরবতায় আর নিস্তরঙ্গ জলে। গুবরের দল ছিল মহা আপদ, তাই সন্ধে নামলে এবং আলো জ্বালার সময় হলেই কোকিকে জানলা বন্ধ রাখতে হত।

    গোল্ডফিশদের দেখে মনে হত তারা কৃতজ্ঞ বোধ করছে। 

    কোকি ট্যাঙ্কের কাচে মুখ ঠেকাত, আর তার প্রিয় গোলাপি গোল্ডফিশ সাঁতরে তার কাছে চলে আসত, আর তাদের যেন নাকে নাক ঠেকে যেত। গোল্ডফিশটা হয়তো কিছু বলতে চাইত। কে জানে?

    এরপর কটেজে এল সেই কুকুরটা, যে একদমই ডাকত না। 

    ঠাম্মার একটা কুকুর অবশ্যই পোষা উচিত— এই কথা ভেবে, তাঁর বোন একটা অদ্ভুত দেখতে কুকুর পাঠালেন: লম্বা, রোগা আর খুব লোমওয়ালা। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিরকুট꞉ এ ডাকে না, কিন্তু শিয়ালদের দূরে রাখবে।

    কুকুরটা তিনদিন ওদের সঙ্গে থাকল, একবারও না চেঁচিয়ে। কাঠবেড়ালি দেখতে পেলে, একটু কুঁইকুঁই মতো করত আর তাড়া করার চেষ্টা করত। আর বেড়ালটাকে দেখলে গরগর করত, চেষ্টা করত হাবভাবটা বেশ বদমেজাজি ভয়ঙ্কর করে তুলতে। কিন্তু কক্ষনওই ডাকত না, এমনকী পিওন এলেও না।

    কুকুরটা তিনদিন ওদের সঙ্গে থাকল, একবারও না চেঁচিয়ে। কাঠবেড়ালি দেখতে পেলে, একটু কুঁইকুঁই মতো করত আর তাড়া করার চেষ্টা করত। আর বেড়ালটাকে দেখলে গরগর করত, চেষ্টা করত হাবভাবটা বেশ বদমেজাজি ভয়ঙ্কর করে তুলতে। কিন্তু কক্ষনওই ডাকত না, এমনকী পিওন এলেও না।

    তারপর এক রাতে, পাহাড়ের আড়াল থেকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দিতেই, কুকুর বাবাজি মাথা উঁচিয়ে, ভয়ঙ্কর এক চিৎকার ছাড়লেন। সঙ্গে-সঙ্গে আশেপাশের এবং জঙ্গলের যত কুকুর-শেয়াল-নেকড়ে ইত্যাদি ছিল সবাই গলা মেলাল! কেউ চেঁচাল সুগোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে, কেউ জাতভাইয়ের দিকে তাকিয়ে, আর কেউ চেঁচাল স্রেফ চেঁচাতে ভাল লাগছে বলে। 

    এই উৎকট চেঁচানি প্রায় মিনিট দশেক চলার পর হঠাৎ থেমে গেল। চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকোতেই কুকুরটা চুপ করে গেল, আর বাকি জন্তু-জানোয়ারেরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ল। গোল্ডফিশরা এসব যেন খেয়ালই করল না। 

    দয়ালু ঠাম্মা কুকুরটাকে বার করে দিলেন না। 

    ‘ওর যদি চাঁদটাকে নিয়েই অসুবিধা হয়’, ঠাম্মা বললেন, ‘চাঁদ উঠলে আমরা পর্দাগুলো টেনে রাখব!’ 

    ব্যাপারটা এতটাই সরলসিধে ছিল। 

    এবং কুকুরটা অনেক দিন অনেক মাস ঠাম্মার ভাল সঙ্গী হয়ে কাটাবে।  

    কোকির শহরের বাড়িতে ফেরার সময় এসে গেল। 

    সে গোল্ডফিশদের নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারল না— তার প্রিয় গোলাপি গোল্ডফিশকেও না। কিন্তু কোকি জানত যে সে শিগগিরই ফেরত আসবে— হয়তো শীতের ছুটিতেই।   

    কোকি বিদায় জানাল কুকুরটাকে, বেড়ালটাকে, ওক গাছের পাখিগুলোকে, আর ঠাম্মাকে অনেকক্ষণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকল। 

    তারপর গোল্ডফিশ ট্যাঙ্কের কাচে মুখ ঠেকিয়ে কোকি বিদায় জানাল তার সব সুন্দর, নির্বাক বন্ধুদের। তারা কিছু বলল না। গোল্ডফিশেরা কথা বলে না। কিন্তু সেই ছোট্ট, গোলাপি গোল্ডফিশ, কোকির প্রিয় গোল্ডফিশ, ট্যাঙ্কের কানায় সাঁতরে এসে কোকির নরম মুখের একদম কাছে তার ছোট্ট মুখটা কাচের গায়ে লাগিয়ে রাখল। দু’জনের মাঝে ছিল শুধু কাচটুকু। সে কি কিছু বলতে চাইছিল? কে জানে? 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook