বিনিদ্র: পর্ব ১৬

পর্ব ১৫

আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি করার মূলে এই-ই ছিল ইতিহাস।

তা সেই ছবি এই এতদিনে এই ১ জানুয়ারি, ১৯৬০ সালে শুরু হল। আমার বড় ভালো লাগল যে গীতা আর ওয়াহিদা রেহমান একাকার হতে পেরেছে। গুরুর মনটাও যেন অনেকটা শান্ত।

হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল স্টুডিও থেকে। আবার শুটিং শুরু হবে। গুরুর ডাক পড়ল। ওয়াহিদাজীরও ডাক পড়ল নিচেয়। ওরা দুজন চলে গেল। আমি আর গীতা তখন দুজনে বসে রইলাম।

বাইরে আবার ঘণ্টা পড়ল। ওপরের ঘর থেকে একতলার স্টুডিওর ঘণ্টা শোনা যায়। গীতার মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। এতদিন বোম্বাইতে এসেছি, কখনও গীতাকে এই স্টুডিওর ভেতরে ঢুকতে দেখিনি। অথচ এখানে ঢোকবার অধিকার তারও পুরোমাত্রায় আছে, গুরু দত্তের স্ত্রী সে। গুরুর বাড়ি, গুরুর সন্তান, গুরুর স্টুডিও সব কিছুর ওপরেই তার পুরোমাত্রায় অধিকার আছে। কিন্তু তবু যেন তার কিছুই নেই।

গীতা বললে— দেখুন, এককালে আমি বাসে চড়ে গানের টিউশনি করে বেড়িয়েছি, ছেঁড়া চটি পরে বাড়িতে বাড়িতে গান শিখিয়ে এসেছি, আর তারপর আবার এমন দিন এল যখন বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম-ট্যাক্স দিয়েছি, অথচ মনে হয় সেই দিনগুলোই ভালো ছিল, তখন যেন আরও খুশি ছিলাম—

গীতা যখন গল্প করত, নিজের দুঃখের কথা বলত, তখন আমি মন দিয়ে সব শুনতাম। মানুষ যা চায় তা পেলে খুশিই বা হয় না কেন? ছোটবেলা থেকে দেখেছি ছেলেমেয়েদের যা কিছু শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়, সবই তো টাকা উপায় করবার জন্যে, যাতে বড়ো হয়ে তাদের খাওয়ার অভাব না হয়।

অথচ গীতার তো তাই-ই হয়েছে। বিরাট গাড়ি নিজের ব্যবহারের জন্যে। শাড়ি, গয়না, ঐশ্বর্য, বিলাস কিছুরই কমতি নেই। বোম্বাই-এর যে-কোনও স্ত্রীদেরই গীতাকে ঈর্ষা করবার মতো। কার অত খ্যাতি গীতার মতো? গীতা লন্ডন যায় গান গাইতে, আবার ফিরে এসেই যায় হয়তো হায়দ্রাবাদে। তারপর দিনই হয়তো আবার যায় কলকাতায়। শুধু খ্যাতি নয়, অর্থেরই কি কিছু অভাব তার? স্বামীরও প্রচুর অর্থ, নিজেরও প্রচুর। আর ওদিকে ওয়াহিদা রেহমানও খ্যাতি ও অর্থ নিয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বভাব চরিত্রে দুজনেই অবিশ্বাস্য রকমের! ভদ্র, বিনয়ী আর গুণী। তিনজনে মিলেছিলও খুব ভালো। গুরুর জীবনে এরা দুজনেই সহযোগিতা দিয়েছে। গীতা দেখেছে গুরুর সংসার আর ওয়াহিদা দেখেছে গুরুর ছবি। আপাতভাবে বাইরে থেকে অসুখী হওয়ার কোনও কারণ কোথাও নেই। আর এদের মধ্যে ঘটনাচক্রে আমি গিয়ে পড়েছি একেবারে দর্শক হয়ে। আমি গল্প লিখছি বটে, কিন্তু আমার চোখ কোথায় পাবে? আমার দৃষ্টি যে মানুষের অন্তঃস্থল ভেদ না করতে পারলে তৃপ্তি পায় না। আমি যে মানুষকে জানতে চাই! মানুষই যে আমাকে চিরকাল আকর্ষণ করে।

খানিকক্ষণ চুপ করে ছিলাম। গীতা বললে— জানেন, আমি আসতুম না আজ। কিন্তু ও আমায় বিশেষ করে আসতে বললে তাই এলাম—

বললাম— আপনাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি আমি—

গীতা বললে— আমিও তো আসতে চাই। আগে আমি এখানে রোজ আসতুম, শুটিং দেখতুম, কিন্তু একদিন আর এলুম না—

— কেন?

গীতা বললে— মনে হল এই সব কিছুতেই আমার অধিকার নেই—

বললাম— সেটা আপনার মনের ভুল। আপনার সম্বন্ধে গুরুর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে, গুরু আপনার গুণগ্রাহী, আমার সামনে আপনার খুব প্রশংসা করেছে—

বোম্বাই-এর যে-কোনও স্ত্রীদেরই গীতাকে ঈর্ষা করবার মতো। কার অত খ্যাতি গীতার মতো? গীতা লন্ডন যায় গান গাইতে, আবার ফিরে এসেই যায় হয়তো হায়দ্রাবাদে। তারপর দিনই হয়তো আবার যায় কলকাতায়। শুধু খ্যাতি নয়, অর্থেরই কি কিছু অভাব তার? স্বামীরও প্রচুর অর্থ, নিজেরও প্রচুর। আর ওদিকে ওয়াহিদা রেহমানও খ্যাতি ও অর্থ নিয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বভাব চরিত্রে দুজনেই অবিশ্বাস্য রকমের! ভদ্র, বিনয়ী আর গুণী। তিনজনে মিলেছিলও খুব ভালো। গুরুর জীবনে এরা দুজনেই সহযোগিতা দিয়েছে। গীতা দেখেছে গুরুর সংসার আর ওয়াহিদা দেখেছে গুরুর ছবি।

গীতার যেন বিশ্বাস হল না। বললে— সত্যি বলছেন?

বললাম— সত্যি বলছি, আপনাকে মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ কী?

গীতা বললে— আমার এক-এক সময়ে মনে হয়, হয়তো আমি সুখী—

বললাম— নিশ্চয়ই আপনি সুখী। আপনাকে কত মেয়ে হিংসে করে, তা জানেন? সবাই জানে আপনার খুব নাম, খুব টাকা—

— তার যদি আমার মনের কথা জানত।

বললাম— দরকার নেই জানার। আপনার নাম হয়েছে, আপনার টাকা হয়েছে, সেইজন্য আপনাকে হিংসে করে। তারা আপনার মতো হতে চায়। তারা রান্নাঘরে ভাত রান্না করে, ছেলে মানুষ করে, জীবনের ওপর তাদের ঘেন্না ধরে গেছে—

গীতা বললে— এক-এক সময়ে মনে হয় সেই জীবনই হয়তো ভালো ছিল আমার। কিন্তু আমি গান ছাড়ি কী করে বলুন তো?

— কেন, গান ছেড়ে দেবেন কেন?

গীতা বললে— সেই কথাটা বলুন তো আমাকে। ও আমাকে কেবল গান গাওয়া ছেড়ে দিতে বলে—

— ছেড়ে দিতে বলে?
— হ্যাঁ। বলে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে সংসার দেখা-শোনা করতে। ও চায় না যে আমি গান গাই—

আমি অবাক হয়ে গেলাম গীতার কথা শুনে। বললাম— আপনি গান গাইলে গুরুর কীসের ক্ষতি?

গীতা বলেছে— ক্ষতি দূরের কথা, বরং লাভ। ওর লাভ না হোক, আমার লাভ না হোক, অন্য অনেকের তো লাভ হতে পারে—

তারপর একটু থেমে বলেছে— এই দেখুন না, চারিদিকে কত লোকের টাকা-কড়ির দরকার হয়। কত লোক টাকার অভাবে সংসার চালাতে পারে না। আমার টাকার দরকার না থাকলেও, তাদের তো আমি টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারি—

আমি তবু বুঝতে পারিনি। স্ত্রী গান গাইলে স্বামীর এত অমত কেন? স্ত্রীর খ্যাতিতে কি আর স্বামীর খ্যাতি বাড়ে না? স্ত্রীর গৌরবে কি স্বামী গৌরবান্বিত হয় না? অর্থ বা প্রতিষ্ঠার কথা ছেড়ে দিলেও স্ত্রীর নিজস্ব একটা শখও তো থাকতে পারে। আসলে স্ত্রী তো শুধু স্বামীর সংসারের গৃহিণীই নয়, সে যে একাধারে স্বামীর সংসারে সন্তানের মা, স্বামীর সংসারে কর্ত্রী। এ-সব ছাড়াও মানুষ হিসাবে সবাই-ই তো এক-একজন স্বতন্ত্র জীব। প্রত্যেক মানুষের নিজের-নিজের স্বাধীন প্রকাশ আছে। সেই আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজের মুক্তি খোঁজে। গীতা তো শুধু স্ত্রী নয়, মা নয়, সে যে আবার গায়িকা, বিখ্যাত গায়িকা, স্বাধীন উপার্জনশালী গায়িকা। গান গেয়ে সে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। সে অর্থ নিজের প্রয়োজনে না লাগলেও গরীব দুঃস্থ-স্বজনদের প্রয়োজনে লাগতে পারে তো!

— কিন্তু আপনাকে গান গাইতে বারণ করে কেন গুরু?
— আমি গান গাইলে নাকি ভালো করে সংসার দেখতে পারি না—

আমি বললাম— কিন্তু এতদিনে এতবার আপনার বাড়িতে এসেছি, কখনও তো আপনাকে গান গাইতে বা গান শিখতে দেখিনি। আপনি তো সংসারের অনেক কাজই করেন দেখেছি। আমি একসময়ে আপনাকে দেখেছি তরকারি কুটতে—

গীতার মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বললে— কিন্তু ওর মতে আমি সংসারের কাজ ফাঁকি দিয়ে গান গেয়ে বেড়াই। অথচ গান বাদ দিয়ে আমি থাকব কী নিয়ে? আমি যেটুকু গান গাই সে তো সংসারের সব কাজ-কর্ম বজায় রেখেই!

— আপনি কী উত্তর দিয়েছেন?

গীতা বললে— আমি বলেছি আমি গান গাওয়া ছাড়ব না—

বললাম— ঠিকই বলেছেন। আমাকেও যদি কেউ লেখা বন্ধ করতে বলে আমিও সেই একই উত্তর দিতাম। আপনি গান গাওয়া ছাড়বেন না—

গীতা বললে— আপনি একটু বলে দেবেন ওকে—

বললাম— নিশ্চয়ই আমি বলব—    

পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত