সদ্য বিশ্বকাপ-জয়ী ভারতের কোচ অমল মজুমদার তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘সিম্পলি ওয়ার্ল্ড ক্লাস; ওয়ার্ল্ড বিটার!’ টিম ইন্ডিয়া-র অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌরেরও তাঁর দলের উইকেটকিপার-ব্যাটারের ওপর রয়েছে অগাধ আস্থা। নিছক ‘পাওয়ার-হিটিং’, ‘ফিনিশার’, স্ট্রাইক রেট, ছক্কার সংখ্যা— ক্রিকেটার রিচা ঘোষের মূল্যায়ন করতে গেলে আপনাকে এইসব পরিভাষা বা পরিসংখ্যানের কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বে উঠতে হবে! এই বঙ্গতনয়াই কিন্তু বছরদুয়েক আগে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নিজের অভিষেক টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৫২ রান করে ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসেন; দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পরের টেস্টেও করেছিলেন ৮৬ রান। আবার এই বিশ্বকাপেই দেখুন, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে লিগ পর্বের ম্যাচে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৭৭ বলে ৯৪ রানের ঝকঝকে ইনিংস। যে-কোনও ফরম্যাটের ক্রিকেটে, যে-কোনও পরিস্থিতিতে, দলের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে মেলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী রিচা। এতটাই পরিণত বঙ্গ-ক্রিকেটের নতুন সেনসেশন। সেজন্যই শিলিগুড়ির বাইশ বছরের তরুণীর মুকুটে ইতিমধ্যেই রয়েছে জুনিয়র ও সিনিয়র পর্যায়ের দু’-দুটো বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমসের সোনার পদক ও ডব্লুপিএল জয়ের পালক। রিচা ঘোষ মানেই ম্যাচ-উইনার, রিচা ঘোষ আর চ্যাম্পিয়ন এখন সমার্থক শব্দ!
‘ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করেছিলাম যে, ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে ও ভীষণ সিরিয়াস।’ বলছেন রিচা-র বাবা ও প্রথম কোচ মানবেন্দ্র ঘোষ, রিচার উত্থানপর্বে যাঁর ভূমিকার কথা পিটার গ্রাফ-স্টেফি গ্রাফের কাহিনির সঙ্গে তুলনা করছে ক্রিকেটমহল। ‘আর ক্রিকেট-সংক্রান্ত কোনও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে ও বরাবরই ফিয়ারলেস, অকুতোভয়। জানেন, মাত্র ১৩ বছর বয়সে বেলগাঁওয়ে এনসিএ ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য ওকে একা প্লেনে তুলে দিয়ে এসেছিলাম। বাংলা থেকে ওই একমাত্র নির্বাচিত হয়েছিল। আমার একটু টেনশন হচ্ছিল, ও কিন্তু দিব্যি একাই উড়ে গেল বেলগাঁও। যদিও বিসিসিআই ওখানে প্রতিটা মেয়ের জন্য আলাদা করে গাড়ি পাঠিয়েছিল বিমানবন্দরে। এটা জানার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত হই, আরও যোগ করেন মানবেন্দ্রবাবু।
আরও পড়ুন: জেমাইমা রডরিগেজের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?
লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…
বাংলার ক্রীড়াক্ষেত্রের আকাশে বহু নক্ষত্র এসেছেন। কিন্তু সিনিয়র পর্যায়ে একমাত্র বাঙালি বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নের নাম রিচা ঘোষ। আর তাই বাংলার জেন-জেডের সামনে তিনি এখন এক যুব-আইকন। একান্ত সাক্ষাৎকারে ডাকবাংলা.কম-কে জানালেন নিজের ক্রিকেটজীবন-সংক্রান্ত নানা কথা।

১৯৮৩ সালে কপিল দেবের টিমের বিশ্বজয়ের গল্প কি বাবার কাছে শুনেছিলে? ভারতে ক্রিকেটের জোয়ার এনেছিল ওই জয়। এবার তোমরা চ্যাম্পিয়ন হলে; মহিলা ক্রিকেটে ও সামগ্রিক মহিলা-ক্রীড়ায় কি একইরকম জোয়ার আসবে মনে হয়?
না, ওই গল্প সেভাবে শুনিনি। তবে হ্যাঁ, আমাদের এই জয় বহু মেয়েকে সিরিয়াসলি ক্রিকেট সহ অন্যান্য খেলা খেলতে উদ্বুদ্ধ করবে মনে হয়; অভিভাবকরাও উৎসাহিত হবেন মেয়েদের খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।
সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তো প্রবল চাপে পড়ে গিয়েছিল টিম। শেষ পর্যন্ত ওই ম্যাচ বের করলে তোমরা; জেমাইমা দারুণ খেললেন ঠিকই। কিন্তু মোক্ষম সময় ঝলসে উঠল রিচা ঘোষের ব্যাট— ১৬ বলে ছাব্বিশ রানের ক্যামিও ইনিংসটা বদলে দিল সব সমীকরণ। এই ইনিংসটা কি তোমার সেরা গুরুত্বের নিরিখে?
দল জেতায় আমি তৃপ্ত, বিশেষ করে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ওই ইনিংসটা খেলতে পেরে। সেরা কি না জানি না; সেটা দর্শকরাই বিচার করবেন।

স্মৃতি মন্ধানার ব্যক্তিগত দুঃসময় অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে না গিয়ে পাশে রইলেন জেমাইমা রডরিগেজ। আজকের পেশাদারি দুনিয়ায় যা অবিশ্বাস্য! এরকমই কি তোমাদের সামগ্রিক দলটার টিম স্পিরিট, না এটা শুধুই ওদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের নজির?
প্রথম অংশ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারব না, ওদের দু’জনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে টিম স্পিরিটের প্রশ্নে বলব, এই বিশ্বকাপে সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে এই টিম স্পিরিটের। তিনটে ম্যাচ হারার পর প্রচণ্ড চাপে পড়ে গিয়েছিল টিম। তখন আমরা একে-অপরের পাশে থেকেছি প্রবলভাবে; দোষারোপ করিনি কাউকে। বিশ্বাস ছিল যে, দু’বছরের মেহনত বৃথা যাবে না। তাই ওই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইনালে উঠতে সক্ষম হই।
ভারতের মহিলা দল এখন শিখরে। বাংলার মহিলা ক্রিকেটের পরিস্থিতি কেমন?
বর্তমান বাংলায় মহিলা ক্রিকেটের পরিস্থিতি ভাল। বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিময়ী ক্রিকেটার রয়েছে।
ঝুলন গোস্বামীর উপস্থিতি, দীর্ঘ কেরিয়ার তোমাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে?
ঝুলুদির উপস্থিতি সবসময় দারুণ মোটিভেট করেছে। আমার যখন ভারতের হয়ে অভিষেক হয়, তখন ও দলে ছিল। সেই সময় তো বটেই। আবার ঝুলুদিদের সাফল্যের জন্যই আমরা আজ রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধে পাই। তাই সবসময় মাথায় রাখি আমরা ভাল করলে, পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েরা সিএবি থেকে আরও উন্নত সুযোগ-সুবিধে পাবে।
প্র্যাকটিস বা ম্যাচের পর অবসর সময় কী করতে ভালবাসো? এই ইন্ডিয়া টিমে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পার?
গান শুনি; সিনেমা দেখি। নতুন কোনও ভাল সিনেমা রিলিজ করলে প্রথম দিনই দেখে ফেলার চেষ্টা করি। এছাড়া ব্যাডমিন্টন-সহ অন্যান্য খেলা খেলতেও আমি খুব ভালবাসি। শিলিগুড়িতে থাকলে বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেও ভাল লাগে। সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব আছে, শেয়ারও করি অনেক বিষয়।
মহেন্দ্র সিং ধোনিও এরকম বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন রাঁচির অলিগলিতে। তোমার খেলার মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনি-র ছায়া দেখছেন বহু বিশেষজ্ঞ। এই আগ্রাসী ব্যাটিং স্টাইল কি তোমার সহজাত, না কোনও সুপারস্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত?
দেখুন, ধোনি স্যরের খেলা আমার ভাল লাগত। তবে আমি নিজের ব্যাটিংকে অ্যাডজাস্ট করি নির্দিষ্ট ম্যাচ-পরিস্থিতিতে দলের প্রয়োজন অনুযায়ী। যেমন, বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল বা ফাইনালে, ম্যাচ-পরিস্থিতি মাথায় রেখে মাইন্ডসেট ঠিক করেছিলাম; ক্রিকেটে এই মাইন্ডসেট বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেইমতো শট নির্বাচন করি; তাই ওই দু’দিন বড় শটের ওপর জোর দিয়েছিলাম। শট-নির্বাচন ঠিক হলে টাইমিং ও দারুণ হয়। আবার লিগ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমি কিন্তু একটা ৯৪ রানের লম্বা ইনিংসও খেলেছিলাম। দুর্ভাগ্য, ম্যাচটা হেরে যাই।
নিছক আগ্রাসী বা পাওয়ার-হিটার বলে দেওয়াটা ঠিক হবে না। বাকিটা ক্রিকেটপ্রেমীদের বিচারের ওপর ছেড়ে দিলাম।
টিম স্পিরিটের প্রশ্নে বলব, এই বিশ্বকাপে সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে এই টিম স্পিরিটের। তিনটে ম্যাচ হারার পর প্রচণ্ড চাপে পড়ে গিয়েছিল টিম। তখন আমরা একে-অপরের পাশে থেকেছি প্রবলভাবে; দোষারোপ করিনি কাউকে। বিশ্বাস ছিল যে, দু’বছরের মেহনত বৃথা যাবে না। তাই ওই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইনালে উঠতে সক্ষম হই।
রিচা ঘোষ ব্যাট করতে নামলেই তো তৈরি হয়ে যায় আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা— টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে সাধারণ দর্শক, সবাই দেখতে চান বিস্ফোরক ইনিংস! বিষয়টা একটা বাড়তি চাপ তৈরি করে না?
চাপ বলব না, বরং টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে সাধারণ দর্শকদের এই আস্থা আমাকে আত্মবিশ্বাস জোগায়।
বাংলার প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন— রিচা ঘোষ এখন বাংলার ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন যুব-আইকন! তোমাকে দেখে বড় হয়ে উঠছে বহু ইস্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা। ব্যাপারটা কীরকম লাগছে, তাদের কী বলবে?
যদি তাই হয়, তো ওদের বলব কঠোর পরিশ্রম করতে; নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলায় ফাঁক রেখো না, ও ঠিকমতো ফোকাস করো নিজের লক্ষ্যে। জীবনের কঠিন বাঁকগুলোয় সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কিন্তু আজকের রিচা ঘোষ উঠে এসেছে!
বাবার কাছে ক্রিকেটে হাতেখড়ি। এরপর মিঠু মুখার্জি, শিবশঙ্কর পাল, চরঞ্জিত সিং, ঝুলন গোস্বামী থেকে অমল মজুমদার— ক্রিকেটের এই জার্নিতে কার তত্ত্বাবধানের সময়টা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল? অমল মজুমদারের কোচিংয়ে কি ক্রিকেটার রিচা ঘোষ অন্য স্তরে বিবর্তিত হয়েছে?
সবক’টা পর্বই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে বাবা যদি কলকাতায় এনে না প্র্যাকটিস করাত, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট কাকে বলে জানতেই পারতাম না— তার উপযোগীও হয়ে ওঠা তো দূর অস্ত। শিলিগুড়ির ক্লাবে তো শুরুতে ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম; মেয়েদের যে আলাদা ক্রিকেট আছে, তখন জানতামই না! তখন আমাদের জেলাস্তরেও মেয়েদের টিম ছিল না; পরে হল। আস্তে আস্তে জানতে পারলাম আন্তর্জাতিক, জাতীয়, এমনকী, জেলাস্তরেও মেয়েদের জন্য আলাদা ক্রিকেট রয়েছে। আর অমল স্যর ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দু’বছরে আমাদের ফিটনেস, পাওয়ার, ফিল্ডিং প্রভৃতি বিভাগে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আমার খেলাতেও তার প্রভাব পড়েছে।
বাঁ-হাতে ভাঙা আঙুল নিয়ে কিপিং করলে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ও ফাইনালে— রেণুকা সিং ঠাকুরের মতো ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে স্টাম্পে দাঁড়িয়ে কিপিং; ব্যাপারটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ নয়?
ডিজে স্যর, আকাঙ্ক্ষা ম্যামের মতো ফিজিওরা খুব সাহায্য করেছিলেন। সেমিফাইনালের আগে একটা ম্যাচ আমাকে বসতে হয় এইজন্য। দলের প্রয়োজনে যে-কোনও ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একশো শতাংশ দেওয়ার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখি।
ক্রিকেটের জন্য তুমি খুব ছোট থেকে অন্য শহরে বিভিন্ন ক্যাম্পে; পরে জুনিয়র ইন্ডিয়া খেলার সময় থেকেই নানা বিদেশ সফরে; কখনও ভিনরাজ্যের মেয়েদের সঙ্গে, বা অস্ট্রেলিয়ায় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলার সময় বিদেশি প্লেয়ারদের সঙ্গে— ক্রিকেট তোমাকে এই মোবিলিটি দিয়েছে, যা সমবয়সি স্কুল-কলেজের মেয়েরা ভাবতেই পারে না। ব্যাপারটা কীরকম লাগে?
দারুণ উপভোগ করি। ক্রিকেটের সঙ্গে এটাও এনজয় করে যেতে চাই; এই বিশ্বকাপটা খুব ভাল গেল। সামনে লক্ষ্য, টি-২০ বিশ্বকাপ। এটাই তো পেশাদার ক্রিকেটারের জীবন! তাই না?



