রক্তকরবী— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নাটক বাংলা সাহিত্য ও সমাজের ইতিহাসে কাল্ট। সাধারণ বাঙালির কাছে শম্ভু মিত্রের হাত ধরে এই নাটক বাঙালির মননে গেঁথে গিয়েছে গভীরে। কিন্তু রক্তকরবী নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছে অনেক আগে। রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকাকালীন একবার মঞ্চস্থ হয়েছিল। নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এক কিশোর, নাম জগমোহন মুখোপাধ্যায়। সালটা ১৯৩৪। এরপরে রক্তকরবী অভিনীত হয় গীতবিতান স্কুলের উদ্যোগে ১৯৪৭-এ। পরিচালনা করেছিলেন শ্রী কালিদাস নাগ। সেই অভিনয় আমাদের কাছে বিশেষ কৌতূহল জাগায়। কারণ, বিশু পাগলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস আর নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর একটি অন্য পরিচয়ও আছে। তিনি কবীর সুমনের মা।
কবীর সুমনের স্মৃতি অনুযায়ী, স্বয়ং উমা চট্টোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন এই অভিনয় রজনীর কথা। এর প্রথম অভিনয় হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার ‘কালিকা’-য়। উমা চট্টোপাধ্যায় কবীর সুমনকে বলেছিলেন, ‘সে সময়ে জর্জ যে কী গান গাইত, সে তোরা এখন ভাবতেও পারবি না, খালি গলায় বিশু পাগলের গানগুলো জর্জ গাইছেন, মঞ্চ জুড়ে শুধু মনে হচ্ছে আকাশ, বাতাস জুড়ে জর্জের গাওয়া গান’। কবীর সুমনের কাছেও দেবব্রত বিশ্বাসের সেই তরুণ বয়সের গান অনেক বেশি প্রিয়। যখন তিনি ‘যেতে যেতে একলা পথে’ গেয়ে উদ্বেল করে তুলছেন আপামর বাঙালিকে।
আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, দেবব্রত বিশ্বাস জীবনবীমার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর তাঁর কাছে প্রথম পলিসি করান কবীর সুমনের মা-বাবা, উমা চট্টোপাধ্যায় ও সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের।
দেবব্রত বিশ্বাস মূলত দু’বার ‘রক্তকরবী’-তে অভিনয় করেছিলেন, একটি ১৯৪৭-এ, আর-একটি ১৯৪৯-এ। প্রথম প্রযোজনাটির পরিচালক ছিলেন, ডাঃ কালিদাস নাগ, সহ পরিচালনায় অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্য। প্রযোজনাটির সামগ্রিক সংগীতায়োজনের দায়িত্বে ছিল ‘গীতবতান’ শিক্ষায়তন, যা বিশ্বভারতীর বাইরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম রবীন্দ্রগানের শিক্ষায়তন হিসেবেও পরিচিত। ‘গীতবিতান’-এর তরফে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন অনাদিকুমার দস্তিদার। এছাড়াও আবহ পরিকল্পনার জন্য দায়িত্বে ছিলেন, দ্বিজেন চৌধুরী, অর্ধেন্দু ঘোষ। নাটকটির রূপসজ্জা ও মঞ্চপরিকল্পনা করেছিলেন, সুনীতি মিত্র। এই সুনীতি মিত্রই পরবর্তীকালে ‘কাবুলিওয়ালা’ সহ নানা বিখ্যাত চলচ্চিত্রের শিল্প-নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন।
দেবব্রত বিশ্বাস আবার ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৪৯-এ। এ-বছর তিনিই প্রযোজনাটির পরিচালক। ‘শ্রীরঙ্গম’-এ(পরবর্তীকালের ‘বিশ্বরূপা’-য়) অভিনয় আয়োজিত হয়; কিন্তু বদলে গেল পূর্বের অভিনয়ের সঙ্গে অভিনয় লিপি, রাজার ভূমিকায় অভিনয় করলেন শম্ভু মিত্র, নন্দিনী, কণিকা মজুমদার, চন্দ্রা, তৃপ্তি মিত্র। খালেদ চৌধুরীর বয়ান থেকে জানা যায়, “দেবব্রত বিশ্বাস মানে জর্জদা আমাকে বললেন, ‘তুমি একটা সেট কইব়্যা দাও।— আমি তো সেট জানি না। কোনোও দিন নাটক করিনি, কী করে করব। বললেন, ‘তোমার লগে একজন আছে, সূর্য রায়। তার লগে তুমি গিয়া কামটা কইব়্যা দাও।’…তারপর যখন শম্ভু মিত্র আমাকে বললেন, ‘রক্তকরবী পড়েছ?’ হ্যাঁ পড়েছি। ‘আর একবার পড়ে দেখো তো।’ তখন তো আমার বয়স বেড়ে গেছে। ওই রক্তকরবীর প্রয়োজনা ১৯৪৯ সালে আর শম্ভু মিত্রের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, তখন ১৯৫৩।’’ অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাসের নির্দেশনায় অভিনয় করছেন শম্ভু মিত্র! এ-ঘটনা কল্পনাতীত। এবং ইতিহাসের দিক থেকে ধরলে গুরুত্বপূর্ণও বটে। অথচ রক্তকরবীর শতবর্ষে এই ইতিহাস নিয়ে তেমন হেলদোল নেই, অনেকেই আজও জানেন, শম্ভু মিত্র-ই প্রথম ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করেন কিন্তু তা তো তথ্য হিসেবে ভুল! এই উদাসীনতায় এই প্রযোজনা সংক্রান্ত কত তথ্য, নথিও হারিয়ে গেল সময়ের গর্ভে। নীচে ১৯৪৭-এর প্রযোজনার বিজ্ঞাপন, আর অভিনয়পত্রীর কিছু অংশ দেওয়া রইল…



