সংকেতের সান্ধ্যভাষা

Representative Image

স্কুলে তখন পরীক্ষা চলছে। ইতিহাস পরীক্ষা। আমরা সবাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখে চলেছি। খেয়ালই করিনি, কখন দেবাশিস (নামটি কাল্পনিক, যদিও ঘটনাটি সত্য) স্যরের অনুমতি নিয়ে বাইরে গিয়েছিল, কিন্তু ক্লাসে ফিরেই অনেকটা স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করল তিনটে শব্দ— শর্ণকন, সোয়িধন, টল্লবপন। না বোঝা গেল এই অদ্ভুত তিনটি শব্দের মানে, না বোঝা গেল কার প্রতি নিক্ষেপিত হল এই অনর্থক ধ্বনিগুচ্ছ। তবে আমরা তো ওকে চিনতাম, এইসব আবোলতাবোল কথা বলার ছেলে সে নয়, খুবই সেয়ানা। এই তো কিছুদিন আগেই বিকেলে আমার বাড়ি এল, তখন আমি, বাবা, মা বসে কথা বলছি, একটু পরেই যাব অঙ্কের টিচারের কাছে। এসে আমার থেকে একটা কাগজ চাইল, তারপর খসখস করে লিখে বলল, তিনটে চ্যাপ্টারের এই অঙ্কগুলো দেখে নিস, স্যর আজকের পরীক্ষা নেবে। ও চলে গেলে দেখলাম লেখা আছে (১৪, ১৫), (৩, ১২, ১, ১৯, ১৯), (৩, ৯, ১৪, ৫, ১৩, ১)। দুটো বিষয়ে খটকা লাগল। এক, চলে যাওয়ার সময়ে ওর হাসি, আর দুই, দ্বিতীয় ব্র্যাকেটে দু’বার ১৯। তারপর নির্দেশমতো পৌঁছে গেলাম যথাস্থানে। অঙ্কের প্রতিটি সংখ্যা আসলে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রম। ও বলেছিল: NO CLASS. CINEMA। এইরকম কোড তৈরি আর কোড ভাঙার কৌশল আমাদের মধ্যে খুবই চলত। তাই পরীক্ষার সময়ে ওই তিনটি শব্দ শুনেই বুঝে ফেলেছিলাম, ও বাইরে থেকে জোগাড় করে এনেছে উত্তর। প্রথমেই প্রতিটি শব্দের প্রথম আর শেষ বর্ণ ফেলে দিলাম, তারপর যেটা শেষ বর্ণ, তাকে সামনে নিয়ে আসতেই পেয়ে গেলাম উত্তর: কর্ণ (কর্ণওয়ালিশ), ধোয়ী, পহ্লব।

জানি না, আমার সে-বন্ধু পরবর্তী জীবনে গুপ্তচরবৃত্তি বেছে নিয়েছে কি না, কিন্তু সারা পৃথিবীর সমস্ত গুপ্তচর নিশ্চিতভাবেই দক্ষ হয় এই কোড তৈরি আর কোড ভাঙার খেলায়। এই যে আমাদের শিক্ষক আর আমার অভিভাবকের সামনে সে গোপন তথ্য পাচার করে দিল যথাস্থানে— ঠিক এইভাবেই চোখের সামনে কিছু বুঝতে না দিয়ে গোপন প্রশাসনিক খবরাখবর চলে যায় বিভিন্ন জায়গায়, এমনকী, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। প্রাচীন সময় থেকেই প্রচলন ছিল এই গুপ্তচরবৃত্তির। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অন্যতম অদৃশ্য ধারালো হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই বৃত্তি।

আরও পড়ুন : গুপ্তচরদের ওপরেও হত গুপ্তচরবৃত্তি? ‘স্পাই’ সংখ্যায় লিখছেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত…

তবে শুধু কোড নয়, এই পেশার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকই হল ভাষাগত দক্ষতা। যথাযথ ভাষার ট্রেনিং না থাকলে কোনওভাবেই সম্ভব নয় এই কাজ করা। আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অফ জাসটিস’-এর অধীনে ‘ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ (FBI) লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে রীতিমতো ঘোষণা করে বলে যে, বিদেশি ভাষায় দক্ষতা এবং নানা দেশের সংস্কৃতির প্রতি অবগত থাকা প্রধান গুণ বলে বিবেচিত হবে। বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে, ‘We seek those fluent in Arabic, Chinese, Farsi, Korean, Russian, Spanish, Urdu or Vietnamese among other.’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই নাৎসি জার্মানি তার স্পাই-এজেন্সি ‘Abwehr’-এর মাধ্যমে আমেরিকা আর ব্রিটেন-সহ নানা দেশে গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। কিন্তু যুদ্ধের আবহাওয়ায় ব্রিটেন পড়ল মুশকিলে, এত ভাষা জানা লোক পাওয়া তো সম্ভব নয়, আর এত অল্প সময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়াও অসম্ভব। ব্রিটেন অন্য কৌশল নিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা এতদিন ব্রিটেনে এসে ছিল, সেইসব পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের স্পাই হিসেবে পাঠানো হল তাদের আগের দেশে। সেই দেশে গিয়ে তারা মিশে গেল সাধারণ জনগণের মধ্যে। 

এই সময় জাপান এক অদ্ভুত ভাষাগত কৌশল নেয়। আমেরিকার সৈন্যরা প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান-নিয়ন্ত্রিত দ্বীপগুলিতে এসে হাজির হয়। যুদ্ধ করা ছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে অপেক্ষাও করতে হত, এবং বিনোদনের জন্য শুনত রেডিও। জাপান থেকে রেডিওয় সেই সময় আমেরিকার গান বাজাতে থাকে, যাতে নিজের বাড়ি আর পরিবারের প্রতি প্রবল টান অনুভব করে আমেরিকার সৈন্যরা। এছাড়াও মহিলা ঘোষকরা ইংরেজি ভাষায় নানা গল্প আর প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে, যাতে মনোবল ভেঙে যায় তাদের। এই মহিলাদের বলা হত— ‘টোকিও রোজ’।

গুপ্তচরের দুনিয়ায় অদ্ভুত সব শব্দ চলে। ধরুন, গোপন কোনও জায়গা দিয়ে তথ্য পাচার করাকে বলা হয় ‘ডেড ড্রপ’, আবার কোনও পাবলিক প্লেসে কোনও কিছু দ্রুত হস্তান্তর হল ‘ব্রাশ পাস’, বা শত্রুপক্ষের মধ্যে পরিচয় পালটে থাকা চর হল ‘মোল’। বাংলাতে এই নিয়ে চমৎকার কাজ করেছেন ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক, তাঁর ‘অপরাধ জগতের ভাষা’ বইয়ে। এইরকম প্রচুর শব্দ ও অপশব্দকে রপ্ত করা, টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজের প্যাটার্নকে গভীরভাবে শেখার জন্য সেই ভাষার বাক্য গঠন, শব্দ ব্যবহার, ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, উচ্চারণের রকমফের আর সংস্কৃতির ছাপগুলিকে যত্ন করে বুঝে নিতে হয়।

১৯৪১ সালে কানাডা আর আমেরিকার বর্ডার অঞ্চলে, একেবারে নির্জন জায়গায় অত্যন্ত গোপনে প্রথম খোলা হয় স্পাই ট্রেনিং স্কুল। তারপর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে একের পর এক এই ধরনের ট্রেনিং স্কুল খোলা হতে থাকে। এই সব জায়গায় নানা কৌশলে শেখানো হয় স্পাই-ভাষা। এই কৌশলগুলির কয়েকটা এখানে উল্লেখ করি।

শুধু কোড নয়, এই পেশার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকই হল ভাষাগত দক্ষতা। যথাযথ ভাষার ট্রেনিং না থাকলে কোনওভাবেই সম্ভব নয় এই কাজ করা। আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অফ জাসটিস’-এর অধীনে ‘ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ (FBI) লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে রীতিমতো ঘোষণা করে বলে যে, বিদেশি ভাষায় দক্ষতা এবং নানা দেশের সংস্কৃতির প্রতি অবগত থাকা প্রধান গুণ বলে বিবেচিত হবে।

প্রথম পদ্ধতির নাম ‘Immersion: The ultimate language boot camp’— বিদেশি ভাষার মধ্যে একেবারে চুবিয়ে রাখা হয়। মনে করা হয়, শিক্ষার্থীকে যেন অন্য কোনও দেশে নামিয়ে আসা হয়, যেখানে সেই দেশের ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা বলার একটুও সুযোগ নেই। খাওয়া, ঘুম, নিশ্বাস নেওয়া— সবই চলতে থাকবে সেই বিদেশি ভাষায়। এই পরিবেশ তৈরি করে নেওয়া হয় তার বাড়িতে। ফোনের সেটিং বদলে দেওয়া হয়, বিদেশি ভাষার সিনেমা, খবর ইত্যাদি চলতে থাকে, এমনকী, ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্রের ওপর বিদেশি ভাষার লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়। আবার এর সঙ্গে আছে ‘Perfection Paradox’। স্পাই স্কুলে খেয়াল রাখা হয়, যাতে ভাষা শেখা একেবারে নিখুঁত না হয়। ব্যাকরণ মেনে ত্রুটিহীন ভাষায় কথা বলা বা উচ্চারণ সাধারণ লোকের কথাবার্তার সঙ্গে অনেক সময়েই মেলে না, সহজেই সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। একই কারণে দরকার হয় ‘Adapting your accent’, যেখানে উচ্চারণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে জোর পড়ে। কোনও একটা শব্দের ভুল উচ্চারণ সাংঘাতিক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এছাড়াও ‘High-Frequency Words’, ‘Listening Skill’, ‘Code-Switching’ এবং ‘Non-Verbal Body Language’ বিষয়েও চলে কঠিন প্রশিক্ষণ। 

তথ্য পাচারের অন্যতম উপায় ‘স্টেগানোগ্রাফি’

তবে একটি বিশেষ পদ্ধতির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন: The Anti-Routine Approach। এ হল, সাধারণভাবে যেভাবে ভাষা শেখানো হয়, সেই পথকে মাঝেমধ্যেই ভেঙে দিয়ে একেবারে অন্য পরিবেশে ভাষা শেখার কৌশল। এতে করে মস্তিষ্ক অনেক বেশি সজাগ আর সক্রিয় থাকে। হঠাৎ করে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাওয়া হয় এমন কোনো পার্কে, যেখানে টার্গেট ভাষায় কথা বলা লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা কথা শুরু করে শিক্ষার্থীর সঙ্গে, বা হয়তো নিয়ে যাওয়া হল কোনও খাবার জায়গায়, যেখানে সে অর্ডার করবে সেই বিদেশি ভাষায়। নিয়মের বাঁধা পথের বাইরে বিভিন্ন পরিস্থিতে ফেলে সড়গড় করা হয় ভাষাকে। রাষ্ট্রের মদতে যত স্পাই-স্কুল চলে, এ সবই সেখানে সিলেবাসের বিষয়।

স্পাই-লিঙ্গুইস্টিকসের কয়েকটি বিশেষ শাখার কথা বলে আপাতত এই লেখা শেষ করি। কয়েকটি ক্ষেত্রে অন্য মাধ্যমের সাহায্য নিতে হয় তথ্য গোপন করে পাচারের জন্য। যেমন, অদৃশ্য কালির ব্যবহার, খুব বড় কোনও টেক্সটের মধ্যে খুব ছোটো কোনও ফুটকি বা ছবি (Microdots) বা কখনও কোনও নিরীহ লেখার মধ্যে বিশেষ প্যাটার্নে তথ্য গুঁজে দেওয়া— এই সবের পোশাকি নাম ‘স্টেগানোগ্রাফি’। এছাড়া এই এতরকমের কোড বা সংকেতের কথা বলা হল, তাকে ডিসাইফার করার জন্য দরকার হয় ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এর রমরমা। আজ তো সিগনাল প্রসেসিং থেকে ডেটা অথেনটিকেশন, ডিজিটাল মাধ্যমে এর ব্যবহার অন্তহীন। আর আছে ভাষাবিজ্ঞানের এক নতুন শাখা, Contract Linguistics— যে-কোনও গুপ্ত তদন্তকারী সংস্থায় এই বিষয়ে দক্ষ সব লোক কাজ করে যাচ্ছে। যে-কোনও আইনি ভাষার বিশ্লেষণ করাই এদের কাজ। চুক্তিপত্রের ভাষা থেকে বিভিন্ন শর্ত, নানা ডিসপিউট, বিতর্ক, ব্যক্তি বা পার্টি শনাক্তকরণ ইত্যাদি নিয়ে এরা মাথা ঘামান। FBI-এর ওয়েবসাইটে লেখা আছে: ‘Generally, FBI Linguists begin their careers as Contract Linguists;… FBI has jurisdiction Linguists also may testify at trials, help interview suspects, victims and witnesses and occasionally accompany Special Agents on searches or arrests.’

শেষে একটা হাতে-গরম উদাহরণ দেওয়া যাক। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘একেনবাবু’ সিরিজের সিনেমা ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’, এই সিনেমার গল্প বা গুণমান নিয়ে এখানে কিছু বলছি না, শুধু বলছি এই সিনেমায় ব্যবহৃত মর্স কোডের কথা। শুধু ডট আর ড্যাশ দিয়ে কত ভাবে তথ্য পাচার করা যায়, বেশ পুরনো এই পদ্ধতির চমৎকার ব্যবহার বাহবা পাওয়ার মতো। এর বেশি এখানে বলা বোধহয় খুব সমীচীন হবে না।