সমাজ, নীতি, বিচার

Frank Caprio

পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষদ নবম শ্রেণির দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজির সিলেবাসে এজি গার্ডিনারের একটি ছোটগল্প রেখেছে। গল্পটির নাম: ‘অল অ্যাবাউট আ ডগ’। এ-গল্পে একটি ছোট্ট কুকুর প্রবল শীতের রাতে, বাসে তার মালকিনের সঙ্গে বসবে না কি নিয়মানুযায়ী দোতলা বাসের ছাদে যাবে তা নিয়ে আইন, রাষ্ট্র, আইনের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা এবং শিথিলতার পরীক্ষা— এমন নানাবিধ বিষয়ে পাঠককে ভাবায়।

যে-কোনও রাষ্ট্র এবং সমাজের আইন আদর্শগতভাবে একটি নিরপেক্ষ নিয়মাবলী। কোনও অবস্থাতেই তার পরিবর্তন চলে না। কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল মানব সমাজ ও জীবনে কীভাবে তা খাপ খায় তাও ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক কালে সমাজ মাধ্যমের নানা ভিডিওতে এমন অনেক ঘটনা উঠে আসে। যেমন— একজন ছিয়ানব্বই বছর বয়সের পিতা জোরে গাড়ি চালিয়েছেন কোনও একটি স্কুলের সামনে দিয়ে। তাতে তাঁর বিরূদ্ধে মামলা হয়েছে। অপরাধ যদি কেউ করে, খুব স্বাভাবিক ভাবে সে কোন অর্থনৈতিক শ্রেণির, কোন জাতের, কী তার লিঙ্গপরিচয় এবং তার বয়স কত— আইনের সে-সব দেখার কথা নয়।

আরও পড়ুন: ডগ শো-তে গিয়ে মেডেল না পাক, ট্রেনিং দিলে যে-সব আশ্চর্য কাণ্ড করতে পারে নেড়ি কুকুরও! লিখছেন পিনাকী ভট্টাচার্য…

পর্যায়ক্রমে, সেই অতি বৃদ্ধ মানুষটি পুরসভার আদালতে এসেছেন এবং তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিচারক যিনি, তিনি জিজ্ঞেস করছেন কেন সেই ব্যক্তি এত জোরে গাড়ি চালিয়ে আইন হাতে তুলে নিলেন? এর উত্তরে বৃদ্ধ পিতা যা বললেন তাতে আইন-কানুন নিয়ে, আইন-কানুনের তথাকথিত নিরপেক্ষতার মডেল নিয়েও দু’বার ভাবতে হয়। ঘটনা হল ছিয়ানব্বই বছরের সেই পিতার ঘরে আছে ছেষট্টি বছরের এক পুত্র সন্তান যে প্রতিবন্ধী! শুধু তাই নয়, পিতার সন্তানটি এখন ক্যান্সার আক্রান্ত। নিয়মিত রক্ত দিতে হয় তাকে। সেই রক্ত যোগাড় করতে এই বয়সেও গাড়ি চালিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করেন অসহায় পিতা। তীব্র গতিতে গাড়ি চালানো তাঁর স্বভাববিরূদ্ধ। কিন্তু সেদিন কিছু করার ছিল না। বহু জায়গায় রক্ত অমিল থাকায় তিনি খুব দ্রুত শহরের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত গাড়ি নিয়ে ছুটছিলেন। এত সব শুনে বিচারক অশ্রুসজল নয়নে বৃদ্ধ পিতার বিরূদ্ধে থাকা সব মামলা খারিজ করে দেন।

সমগ্র ঘটনাটি ঘটছিল ‘কট ইন প্রভিডেন্স’ (প্রভিডেন্সে ধৃত) নামক একটি অনুষ্ঠানে। আমেরিকার রডআইল্যান্ডের প্রভিডেন্স এলাকার প্রখ্যাত পুরসভার বিচারক ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিওর প্রাত্যহিক বিচার সভা সেখানকার টিভি চ্যানেলে দেখানো হত। সেইটিই ‘কট ইন প্রভিডেন্স’। পরে সেই অনুষ্ঠানের বহু অংশ টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক এবং ইন্সটাগ্রামে ছেয়ে যায়। শুধু উপরোক্ত ঘটনা নয়, আরও অনেক আবেগঘন ঘটনা, সহায়হীন মানুষের ইতিবৃত্ত, দয়াপরবশ বিচারের দৃশ্য ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিওর অনুষ্ঠান থেকে উঠে আসে এবং তাতে তিনি আবিশ্ব মানুষের কাছে খুবই প্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘ওয়ার্লডস নাইসেস্ট জাজ’ (বিশ্বের সব থেকে ভাল বিচারক)-এর আখ্যা দেওয়া হয় তাঁকে। বলা হয়, তাঁর অনুষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ বিচার ছিল সেগুলি, যেখানে শিশুরা তাদের মা-বাবার বিচার করত। ‘কট ইন প্রভিডেন্স’- টিভি হোক কিংবা সমাজ মাধ্যম— জনপ্রিয়তার নিরিখে এখনও একটি দুর্দান্ত অনুষ্ঠান। আর বিচারক ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিও আইনের একজন আদর্শ রক্ষক হিসেবে প্রতিভাত। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত ২০ আগস্ট এই জনপ্রিয় বিচারক অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত তিনি সমাজ মাধ্যমে একটি প্রেরণামূলক ভিডিও ছাড়েন। এতে তাঁর মৃত্যু পরবর্তী অনুপস্থিতি আজ আরও প্রকট। তাঁর একেকটি বিচার যেমন আনন্দে মানুষকে কাঁদিয়েছিল ঠিক তেমনই তাঁর চলে যাওয়া তাঁর ভক্তদের চোখে অশ্রু সঞ্চার করেছে।

বিচারক ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিও

এবার কথা হল, আইন কি আবেগতাড়িত হতে পারে কখনও? একজন বিচারক যদি প্রথম থেকেই দয়াপরবশ হবেন বলে ভেবে নেন তবে কি তাঁর বিচার নিয়ে সন্দেহ থেকে যায় না? বিচারক ভগবান নন। তিনি আইনের রক্ষক। কোনও বিচার সংশ্লিষ্ট আইন মেনে হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করাই বিচারকের কাজ। ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিওর প্রত্যেকটি বিচার কোথাও যেন মনে হয় দোষীকে চোখে আঙুল দিয়ে তার দোষ দেখানোর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যে সে একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে, আর করবে না গোছের বাচ্চা ভোলানো খেলাকে। সব থেকে বড় কথা, একটা বিচারকক্ষ তা সে যতই পুরসভার হোক সেখানে যদি ক্রমাগত টিভিতে প্রচারিত হবার জন্য ক্যামেরা চলতে থাকে, তবে বিচারক কি প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারেন? তাঁর কোনও বিচার যদি বহু লাখ ‘ভিউ’ পায় সমাজ মাধ্যমে, বিচারকের ইউটিউব চ্যানেল যদি তথাকথিত সাবস্ক্রাইবারে সাংঘাতিক ভরে যায়, সেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বিচারক জনপ্রিয় বিচারই দেবেন না, তা কে বলতে পারে? আমরা তো দেখছি বিচারের আবেগমথিত জায়গাটি এবং ভাবছি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একজন বিচারক নিশ্চয়ই আছেন যিনি মাফ করে দেন। কিন্তু আমরা যদি ধরেনি আইন-কানুন আবেগপ্রবণ ও দয়াপরবশ হবে তবে পরোক্ষে যে দোষী প্রশ্রয় পেয়ে যাবে না, তা কে বলতে পারে? স্কুলের যে শিক্ষক গম্ভীর, তিনি ভাল পড়ালেও জনপ্রিয় হন না। অন্যদিকে, হাসিখুশি ব্যক্তিত্বের আরেকজন শিক্ষক যিনি বকেন না, তিনি ফাঁকিবাজ হলেও ছাত্রদের মধ্যে তাঁর সুখ্যাতি হয়। সব চেয়ে বড় কথা ‘কট ইন প্রভিডেন্স’ সব সময়ে এমন ঘটনাই দেখিয়েছে যেগুলি দর্শককে আবেগের দিক থেকে দুর্বল করে। বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ কি না তা বোঝার জন্য প্রশাসনিক দিক থেকে বিচারকক্ষে ক্যামেরা চলতেই পারে। কিন্তু ছিয়ানব্বই বছর বয়সি পিতা বছর ছেষট্টির ক্যান্সার আক্রান্ত প্রতিবন্ধী পুত্র সন্তানটির জন্য আইন ভেঙেছেন এবং বিচারক সেই পিতার বিরূদ্ধে থাকা মামলা খারিজ করছেন, এমন সব দৃশ্য বার বার উঠে এলে এবং সমগ্র বিচারপ্রক্রিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হলে অবশ্যই তা দর্শক মনে প্রভাব ফেলে। তারা মনে করতে পারে আইন-কানুন এমন শিথিলই হওয়া উচিত। তাতে সমাজ মাধ্যমের ব্যবসা সফল হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজে আইন-কানুনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। বিচারক ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রিও আমাদের মধ্যে আর নেই। জীবৎকালে তাঁর বহু বিচার মানুষকে ভাবিত করেছে আবার বিনোদনও দিয়েছে। কিন্তু বিচার ও বিচারক যদি জনপ্রিয় হন তবে সন্দেহ হয় কোথাও বুঝি একটা ভুল রয়ে গিয়েছে।