ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, আমি তখন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র; হোস্টেলে থেকেই লেখাপড়া করি, একটা গিটার ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি, সেই চর্চাও চলত সমান্তরাল ভাবে।
সে-সময়ে বাংলা ভাষায়, যে-সমস্ত গান রচনা হত এবং যা ঔপনিবেশিক পর্বে ফেলে আসা, বাঙালির ক্ষয়িষ্ণু বাবু কালচারকেই প্রতিফলিত করত, (সেই— চাঁদ-তারা-ফুল-পাখি, বাবু-বিবি, বেলোয়াড়ি ঝাড় হয়ে সিংহদুয়ার)— এ-সব থেকে বাঙালিদের একটা বড় অংশ কোনওভাবেই বেরোতে পারছিল না। সর্বোপরি তরুণ বয়সে, আমরাও সেই গানগুলোর সঙ্গে নিজেদের জীবনবোধ, বিশ্বাস মেলাতে পারছিলাম না।
কিন্তু, আমাদের চারপাশের যে-সময়, সেটা তখন বড়ই অস্থির, সত্তরের দশকে সদ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমরা দেখেছি, গিটার, ব্যাঞ্জ, তুলি, কলম কীভাবে একটা যুদ্ধ থামাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে; তার আগে আমরা দেখে এসেছি নকশাল আন্দোলন, কিন্তু এ-সবের কোনও প্রভাবই আমরা, এখানে তৈরি হওয়া বাংলা গানে পাচ্ছিলাম না। যেটুকু আমাদের গুরুস্থানীয়রা করছিলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংখ্যায় সীমিত।
বাংলা গানের জগতে তৈরি হওয়া এই শূন্যতাই কোথাও গিয়ে ষাট ও সত্তরের একদল তরুণ ছাত্রছাত্রীকে প্রাণিত করল, নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে, গান লেখা ও গাওয়ার জন্য— তাদের দর্শনের অন্যতম ভিত্তিই জন লেলনের সেই অমোঘ উক্তি, ‘Give Peace a Chance’— এটুকু সম্বল করেই আমি, আমাদের প্রজন্ম নতুন গানের সন্ধানে পদাতিক হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এবং কী আশ্চর্য! এই সময়েই প্রেসিডেন্সি কলেজে, আমারই বয়সী এক ছাত্র, সেও সন্ধানে নেমেছিল, নতুন ধারার বাংলা গানের। আমাদের একদিন দেখা হল; কবি বলেছেন, ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’— কে মেলাল? বি.ই কলেজেই আমার থেকে দু’ব্যাচ জুনিয়র বুলা, যে পরবর্তীকালে প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় নামে মহীনের ঘোড়াগুলির অন্যতম কুশীলব হবে, সে আমাকে ডেকে বলল, ‘আমার একজন মেজদাদা আছে, সেও এরকম নতুন বাংলা গানের সন্ধানে গিটার বাজিয়ে গাইছে’

আমি বললাম, ‘তাই নাকি? চল দেখা করে আসি’— সেই প্রথম আমাদের আলাপ হল। সেখান থেকেই গভীর বন্ধুতা; কী আশ্চর্য, শিবপুর আর প্রেসিডেন্সির দুই তরুণ, হুগলী নদীর উপর সেকেন্ড ব্রিজ হওয়ার আগেই মিলে গেল। তাদের মেলাল নতুন বাংলা গান বানানোর স্বপ্ন!
তারপর দীর্ঘসময়, দিনের পর দিন— আমাদের পুরনো বাড়িতে আড্ডা হয়েছে, মণিরা(গৌতম চট্টোপাধ্যায়) আগে থাকত বেহালায়, পরে উঠে গেল নাকতলায়। কী গান আমরা করতে চলেছি, কেন করতে চলেছি এ-সব নিয়ে আমাদের তর্ক, আলোচনা চলত; কিন্তু, যা খুশি নয়! যে কোনও শব্দ বিন্যাসে গান তৈরি করে, যার সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনও সাযুজ্য নেই, এমন গান নির্মাণ আমরা পরিহার করেছিলাম সচেতন ভাবে। উই ওয়ান্টেড টু নো আওয়ার সং বিফোর উই সিং ইট। সেই শুরু…
সে-সময়ে, বিটলস যুগ, এঁরাই কিন্তু ব্যান্ড সংগীতের ভাবনায় বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন। প্রথাগত গিটারের ভাবনা ভেঙে তিন-টুকরো হল, লিড, রিদম এবং বেস। সারা বিশ্বকে চমক দিয়ে তরুণ দিশাহীন প্রজন্মের প্রতি তাঁরা গেয়ে উঠলেন, ‘আই ওয়ানা হোল্ড ইওর হ্যান্ড’। এই আদলেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে উঠল, নানা ব্যান্ড— আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ল, কিন্তু তার পুরোটাই শহর কেন্দ্রিক; এদিকে আমাদের দেশ যেহেতু শিরায়-উপশিরায় বাউল দর্শন বয়ে বেড়াচ্ছে, তাই বেশকিছু ব্যান্ড বা রক গানেও আমরা পাব গ্রাম্য, লোকজ সংগীতের উপাদান— যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মণির— ‘কখন তোমার আসবে টেলিফোন’ গানটির মূল ভাব। বাউল দর্শন বয়ে না বেড়ালে এমন গান লেখা, সুর করা— গাওয়া সম্ভব নয়।


কলকাতায় যে-সমস্ত ব্যান্ড তৈরি হল, তাদের মধ্যে অন্যতম, ‘গ্রেট বেয়ার’, ‘হেলফায়ার’, ‘দ্য কিউ’, ‘মহামায়া’, ‘সুগারফুট’ ইত্যাদি; ‘দ্য আর্জ’ বলে কলকাতাতে একটি ব্যান্ড ছিল সে-সময়ে, তাঁরা পার্কস্ট্রিটের একটি বারে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন, সেই দলেরই লিড গিটারিস্ট ছিল মণি।
তারপর, দীর্ঘদিন গিটার নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে গান গেয়েছি, তখন বাঙালিদের একটা বড় অংশের ধারণা ছিল, যারা মঞ্চে এসে গান গাইবে, তারাই শিল্পী, আর রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে যারা গান গায় তারা আউল-বাউল, ফকির, দরবেশ ভিখিরি; অথচ, আমরা রাস্তায় ঘুরে, কখনও পার্কের বেঞ্চিতে, কখনও রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গান গেয়েছি, নিজের মতো করে নিজের গান। লোকে অবাক চোখে দেখছে, ‘এ কীরকম গান?’, ‘ভিখিরির মতো গাইছে, কিন্তু ভিক্ষেও তো চাইছে না, এদিকে দেখেও খুব শিক্ষিত মনে হয়’ বা ‘যাদের দেখে আমরা অভ্যস্ত এঁরা তো তেমন নয়।’ সমাজে, মানুষের মননে ওই সজোর ধাক্কাটা আমরা দিতে পেরেছিলাম। এই প্রশ্নগুলো ভাবাতে পেরেছিলাম মানুষকে। চৌকো মঞ্চের বাইরেও যে একটা বড় ক্ষেত্র আছে সেটা অনেকে ভাবতে শিখল।
কী গান আমরা করতে চলেছি, কেন করতে চলেছি এ-সব নিয়ে আমাদের তর্ক আলোচনা চলত; কিন্তু, যা খুশি নয়! যে কোনও শব্দ বিন্যাসে গান তৈরি করে, যার সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনও সাযুজ্য নেই, এমন গান নির্মাণ আমরা পরিহার করেছিলাম সচেতন ভাবে। উই ওয়ান্টেড টু নো আওয়ার সং বিফোর উই সিং ইট। সেই শুরু…
পরে মানুষ আরও ঘাবড়ে গেল, যখন জানতে পারল, দুই বন্ধুর একজন প্রেসিডেন্সিতে পড়ে, আরেকজন হবু ইঞ্জিনিয়ার— সর্বোপরি আপোষের কোনও জায়গা নেই। সমাজকে ঘাবড়ে দেওয়ার কাজটা আমরা সফলতার সঙ্গেই করলাম;
একইসঙ্গে, একটা নতুন ধারার পথপ্রদর্শক হওয়ার সুবাদে আমাদের যে-সমস্ত লাঞ্ছনা, অবহেলা জোটার কথা ছিল, সবই জুটল, কিন্তু আমরা ভ্রুক্ষেপও করিনি। আজকে যে শত-শত ছেলেমেয়েরা গিটার হাতে নিজেদের গান খোঁজার চেষ্টা করে, তারা বলে, ভাগ্যিস আপনারা গান লিখেছিলেন, গেয়েছিলেন— সমাজ বদলানোর হাতিয়ার স্বরূপ ভাগ্যিস অস্ত্রের বদলে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জনপ্রসাদ হাতে তুলে নিয়েছিল গিটার।
আমার আর মণির মধ্যে গান নিয়ে তর্কও হত প্রচুর। শুধু যে তুই কত ভাল, আমি কত ভাল তা নয়, দু’জন কলেজ পড়ুয়া তরুণের যেমন তর্ক হওয়া উচিত, তেমনই ছিল তার চেহারা। সেই তর্কে মতান্তর প্রচুর হত, কিন্তু মনান্তর কখনও হয়নি। কারণ আমরা জানতাম, খোলস আলাদা হলেও, আমরা একই জিনিস করছি, মানুষের গান গাইছি।
একটা মত পার্থক্যের উদাহরণ দিই, মণির ছিল যথেষ্ট ইগো, ওর বক্তব্য, কেউ ওর গান বুঝলে ভাল, না বুঝলে সরে যাও, তুমি বুঝতে পারছ না, সেটা তোমারই অক্ষমতা; ওর গানের কথাতেও এই কথা একাধিকবার এসেছে, এই গানটিই ধরা যাক,
‘চুলোয় যাক সব ভদ্দরলোকের কৃষ্টি
আসুক তেড়ে বৃষ্টি
ফস্টি নস্টি রসাতলে দাও—
আমরা গাইবো শুধু গান
আমরা চাই না ভুয়ো মান…
থাকো ইচ্ছে হলে, কিংবা কেটে যাও…
‘থাকো ইচ্ছে হলে, কিংবা কেটে যাও…’— এইটা ও বলতে পারত, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত বলেই বলত। উলটোদিকে, আমি বিষয়টাকে এ-ভাবে দেখতাম না, আমার গানের বক্তব্য নতুন হলেও ছিল আলাদা, সেখানে প্রকৃতিই এসেছে বেশি। আমার ভাবনা, আমি পারছি না, তাহলে নিশ্চয় আমারই অক্ষমতা; তবে ওই যে, আমাদের মনান্তর কখনও হয়নি, সর্বোপরি দু’জনেরই তো আসল উদ্দেশ্য সময়ের কথা বলা, সেটাই আজীবন বলে এসেছি। তবে মত পার্থক্যের পর, যদি কোনওভাবে আমার মত প্রতিষ্ঠা করে ফেলতাম, তখন মণি যে হাসিটা দিত, অমন দরাজ, অনাবিল হাসি ভোলার নয়! পরবর্তীকালে, অনেক শিল্পীকে দেখলাম, নিজেদের বিশ্বাস থেকে স্খলন হল তাদের, তারা শুধুই কণ্ঠ শিল্পী; গানওয়ালা হয় অনেকে, বাতিওয়ালা তথা পথপ্রদর্শক তো একজন কিংবা দু’জনই…

মণি চলে গেছে কতবছর হয়ে গেল, বড় একা লাগে এখন। মনে পড়ে, একদিন রাত দেড়টার সময় হঠাৎ মণির টেলিফোন, ‘এই, জেগে আছ’, খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমোচ্ছিলাম, সে-কথাই বললাম, মণি বলল, ‘এই প্লিজ ফোনটা রেখো না, এক্ষুনি একটা গান লিখেছি, তোমায় শোনাব।’
আমি রিসিভারটা কানে ধরে রইলাম, মণি ওপ্রান্ত থেকে গিটার বাজিয়ে গেয়ে শোনাল, ‘রাবেয়া কী রুকসানা ঠিক তো মনে পড়ে না’ — এরকম বেশকিছু গানের প্রথম শ্রোতা আমি। কতবার এমন করে, মাঝরাতে মণি টেলিফোন করে বলেছে, ‘একটা গান বানিয়েছি, শুনবে?’ এ-রকম আমারও অনেক গান মণিই প্রথম শুনেছে।
‘রাবেয়া কী রুকসানা’ গানটার কথাই যদি ধরি—চাইল্ড ট্রাফিকিংয়ের উপর এত ভাল গান আজ পর্যন্ত কে লিখতে পেরেছে! আসল কথাটা হচ্ছে মানুষকে বোঝা, মানুষকে জানা; সেই যে রামপ্রসাদের গানটা? ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা’— এই মানবজমিন থেকেই জীবনের গান উঠে আসে; মানুষের গান উঠে আসে। মণি আমৃত্যু সেই মানবজমিনই আবাদ করে গেছে এবং আমরা আজও তাই করে চলেছি… এই লেখাটি শেষ করেই, উঠে যাব আরেক শিল্পীর গান শুনতে, সেও মানবজমিন আবাদ করেই গান লেখে, সুর করে, গায়— রূপম ইসলাম! — ওর অন্যতম আদর্শও তো মণি-ই! একমঞ্চে আমরা গান গেয়ছিলাম একসময়, সে-স্মৃতি আজও অমলিন! মণি, আমরা উত্তর প্রজন্মের হাতে মানুষের গান গাওয়ার এই মশালটা তুলে দিতে পেরেছিলাম, তাই ওরাও আজ সমাজের অসুখ নিরাময় করবে বলে, অস্ত্রের বদলে গান তুলে নেয়! চিৎকার করে বলার সাহস রাখে, ‘Give Peace a Chance’; মণির জন্ম— গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এখানেই, মানুষের মঞ্চে! একবার নয়, বারবার! হাজারবার!