বাঘ ও বাল্মীকি

Valmik Thapar in an expidition

যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, বংশের ব্যাপার একটা থাকেই। কোন পরিবারে, কাদের সঙ্গে, কেমন আবহে— মানুষ হচ্ছেন, সেটা জরুরি হয়ে ওঠে। এই মানুষটির ক্ষেত্রেও, তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাবা রমেশ থাপার, বিখ্যাত সাংবাদিক। ওপরে উঠলে, দয়ারাম থাপার, প্রাণনাথ থাপার— যুদ্ধের লোক। রোমিলা থাপার, তাঁর পনেরো বছর বয়সে, দেশের স্বাধীনতা দেখেছেন। ৭৫ বছরের উদযাপনও দেখেছেন। বেঁচে আছেন, জমিয়ে। অন্যতম শ্রেষ্ঠ, বন্দিত ইতিহাসবিদ। করণ থাপার, জাঁদরেল টিভি সঞ্চালক, যিনি চেপে ধরলে যুক্তির সাঁড়াশি আক্রমণ থেকে বেরোনো শক্ত, এখন ‘দ্য ওয়্যার’-এ। একই পরিবারের সদস্য, লতায়-পাতায়। 

অতএব আমাদের আজকের ফিরে দেখা, সদ্য প্রয়াত চরিত্র, ভাল্মিক থাপারকে। যিনি সর্বার্থে— যথেষ্ট অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসরে নামবেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কে তিনি? জঙ্গুলে খাকি পোশাক, সব কথাই গর্জনসম, চোখের দৃষ্টি যেন বাঘের ক্লোজ-আপ, নামে, বিতর্কে— নেতারাও চেনে, বাঘেরাও। চেনে, সাতে-পাঁচে না থাকা হরিণরা। এক লাইনে— ভারতীয় প্রকৃতিবিদ, বন্যপ্রাণ সংরক্ষক, লেখক, ওয়াইল্ডলাইফ সংক্রান্ত ফিল্ম প্রযোজক। সম্মানিত, বিতর্কিত মানুষ। পেডিগ্রি দেখে আন্দাজ করা যায়— আর যাই হোক, জংলী নন। 

আরও পড়ুন: দুমদাম সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ থেকে উদ্ভিন্নযৌবনা বাঘিনীদের নিয়ে এসে, পরিকল্পনারহিতভাবে ছেড়ে দিলে— তাদের মন যে ঘরে টিকবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক। লিখছেন তিষ্য দাশগুপ্ত

ভাল্মিক থাপারের ছবি দেখলে বা লেখা পড়লে, ‘নিজের দেশের মানুষ’— গন্ডির বাইরেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঠ্যপুস্তকের খামতিগুলো কিছুটা মেটে। জঙ্গলরাজ কথাটার অর্থ ঘুরে গেছে এখন। গত দেড়শ বছরে, বা তার চেয়েও বেশি হবে হয়তো। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে, মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পৃথিবীতে বহু জঙ্গল মুছে দেওয়া হয়েছে। সভ্যতার প্রকান্ড হাঁ-কে শান্ত করতে, সেখানে দখল নিয়েছে কলকারখানা, মাইনিং, নদী বাঁধ, পাওয়ার প্লান্ট।

বন-চেরা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে, উন্নয়নের প্রকান্ড সব তোরণ তৈরির ব্যাপারটা— এককালে ভালই এগোচ্ছিল। অতি প্রাচুর্যের পাশাপাশি, ‘জঙ্গল-জঞ্জাল’ সাফের একটা মজা পেত, স্বাধীন দেশের অশিক্ষিত লিডাররা। সেই উচ্ছেদ-প্রকল্পে, কথা বলতে না পারা গাছগুলো— বেঘোরে প্রাণ হারাল। লাখে-লাখে।

জীব-জন্তুদের কী হল, সেসব বইতে লেখা নেই। তবে আজকের শিশুরা, তার খবর রাখে। জঙ্গলের অধিবাসীদের ভাষা আমরা শিখতে রাজি হইনি। ক্রমাগত উৎখাত হতে-হতে— লতা, পাতা, বিইটার, ম্যানইটার, কে কার সঙ্গে, কী কথা বলেছিল, তার রেকর্ড নেই। অথচ সেসব জানি আমরা। একটু কিপলিং পড়লে, বিভূতিভূষণ বা বুদ্ধদেবে চোখ বোলালে, মায় বিলিতি ছাপের ডিজনি দেখলেই— ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।

এখানে একটা দ্বিচারিতার ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। ‘জঙ্গল বাঁচাও’ বলে চেঁচাব। জীবনটা উত্তরোত্তর আরও সুখকর হোক, সেটাও চাইব। অনেক কিছুর সঙ্গে জঙ্গলকেও বলি দেব। আকাশ, বাতাস, নদী, সমুদ্র… আচ্ছা, ফিরিয়ে নাও এ-অরণ্যের মতো— সবকিছু ওয়াপাস হলে কি সমস্যা মিটে  যাবে? শোভা তো কম পড়ে নাই। শাখে-শাখে পাখি না ডাকলে কী এমন বিপদ? বিপদটা ভয়ঙ্কর, যবে থেকে মানুষ বুঝেছে, কমবেশি পদক্ষেপও নিয়েছে।

স্বাধীনতার আগে, কিছু ন্যাশনাল পার্ক ছিল। কিন্তু তাদের রক্ষা করার জন্য আইন, নিয়ম চালু হল ১৯৭২ সালে। তারপরে, প্রজেক্ট টাইগার। কাল ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে, নয়া গোলমাল শুরু হয়ে গেল। রাজনীতির ব্যাটন উঁচিয়ে, বহু প্রান্তিক মানুষকে, ঠেলে দেওয়া হল জঙ্গলের দিকে। ইচ্ছে না থাকলেও, মানুষ ও জানোয়ার রুম শেয়ার করতে বাধ্য হল। এই প্রসঙ্গগুলো ভাল্মিক থাপার বার-বার তুলে আনছিলেন, একদিন লোকের মাথায় ঢুকবে— সেই আশায়।

পশুরাজ্যে মানুষ হানা দিল— মধু, কাঠের লোভে। ওদিকে জঙ্গল উধাও হতে শুরু করায়, সেখানে শুরু হল খাদ্যাভাব। চিরকালই মানুষের বড় শত্রু মানুষ নিজে। এবারে যোগ হল, অন্য প্রাণীরাও। ডেঞ্জার্ড ও এনডেঞ্জার্ডের সমস্যা বড় চেহারা নিল। পালে বাঘ পড়তে শুরু করল। এই বিপদ থেকে মানুষ ও বাঘকে বাঁচানোর জন্য, যা করণীয় ছিল, সে-ব্যাপারে ভারতীয় রাজনীতির প্রভুদের তেমন মাথাব্যথা ছিল না। মাত্রা ছাড়ানো জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বন্যপ্রাণের হ্রাস, সেটা মানুষের জন্য কতখানি ভয়ানক হতে চলেছে— বোঝার জন্য, শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কমই ছিল। আমাদের কপাল ভাল, ভাল্মিক থাপারের মতো কয়েকজন ভারতীয়, ব্যাপারটা বুঝে, বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন— সমস্যার মোকাবিলায়।

যুদ্ধটা ছিল মানুষের গাধামোর বিরুদ্ধে। ভাল্মিক থাপারকে বাঘের লোক হিসেবেই লোকে জানে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, বিবিসির জন্য করা ওঁর বিখ্যাত টিভি সিরিজ এবং বই, ‘ল্যান্ড অফ দ্য টাইগার’-এর পরিচয়ে বলা আছে, ‘আ ন্যাচারাল হিস্ট্রি অফ দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট।’ কোথায় যেন বলেছিলেন, ‘বাঘ বাঁচলে, প্রজাপতিও বাঁচবে।’ 

জমি, বনসম্পদ লুঠ শুধু নয়, বন-জঙ্গল নিয়ে মানুষের হরেক কিসিমের ধান্দা আছে। প্রচুর পয়সাওয়ালা ছোটলোক, রাজা, নবাব, সাহেব, ফুটো মস্তানরা— একদা শিকারে যেত, পাড়ায় ফিরে হিরো হবে এই আশায়। অনেক বিত্তবানের বাড়িতে যে ‘ট্রফি’টি এখনও ঝোলানো আছে, সেটি যে তাদের বংশের অমর্যাদার কারণ, আজও তারা বুঝতে পারে না। এদের সবার বড় টার্গেট ছিল, বাঘ। গ্রেসফুল, হ্যান্ডসাম, ডায়নামিক চামড়ার বিউটি।

আবার, অমানবিকতা, সংকীর্ণতার— লোয়েস্ট ডিনোমিনেটর, চীনাদের ব্যাপারটা অন্য। মৃত বাঘের যৌনাঙ্গের ব্যবহারে, এই প্রজাতি তাদের বীর্যবত্তার জয়গান করবে, এটাই ছিল অন্ধবিশ্বাস। শুনেছি, আজও আছে। হাতিও মার খেয়েছে দেদার। সব ছেড়ে, ওই দাঁত দিয়েই হবে, মহান শিল্পকর্ম। গন্ডারের শিংয়ের গুঁড়ো, ধ্বজভঙ্গ মানুষের একমাত্র সাপোর্ট, ধামা-ধামা মানুষের লজ্জাজনক ইতিহাস। বনের প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যার ইতিহাসটা ভারতবর্ষে খুব একটা দীর্ঘায়িত হয়নি— ভাল্মিক থাপার ও তাঁর মতো মানুষদের প্রতিরোধে।

১৯৭০ সালে, দেশে বাঘের সম্ভাব্য সংখ্যা ছিল, ১৮০০। অথচ বলা হয়ে থাকে, ১৯৫০ সালে ছিল তার দ্বিগুণ। ১৯৮০-তে ৪০০০, এটাও আন্দাজ। এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, বনসম্পদ নিয়ে চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন আধিকারিকরা— সরকারি কোপ দৃষ্টি থেকে, অনেক দূরে থাকাই নিরাপদ মনে করত। বন থেকে কেউ প্রতিবাদ করেনি যে!

কিছু শহুরে শিক্ষিত, ও বেয়াড়া লোক করলেন। ২০০৬ সালে, ঠিকঠাক গণনায় হাতে রইল ১৪১১-টি বাঘ। এইবারে নড়েচড়ে বসল অনেকে। চাপের মুখে, কিছু বিজ্ঞানসম্মত কাজকর্ম শুরু হল। লোকালয় থেকে বনকে আলাদা রাখা, বন্যপ্রাণীদের আহার, তাদের নিরুপদ্রব বাসস্থান নিশ্চিত করা, পাহারা দেওয়ার সুফল পাওয়া গেল দ্রুত। ২০১০-এ ১৭০৬, ২০১৪-তে ২২২৬, ২০১৯ সালের সেন্সাসে ২৯৬৭। নট ব্যাড।

মানুষের ওয়েলফেয়ারের মতোই, বাঘেদের জন্যও কোর কমিটি, সরকারি টাকা মঞ্জুর করা, তার যথার্থ ব্যবহার, সর্বোপরি মানুষের মধ্যে চেতনা জাগ্রত করার ব্যাপক অভিযান শুরু হয়ে গেল। স্কুলের বাচ্চাদের কাছে, বাঘ হয়ে উঠল অতিপ্রিয়। মনে রাখা যেতে পারে, টাইগার কমিটির সূচনা হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে। রাজীবও, এর বড় সমর্থক ছিলেন। দু’জনের অকালমৃত্যুতে ওই মুভমেন্টের বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

এইখানে আবার ভাল্মিক থাপারকে স্মরণ করব। দাঁতে-দাঁত চেপে আন্দোলনটা জিইয়ে রেখেছিলেন নানাভাবে, প্রায় একক জোশে। ‘প্রজেক্ট টাইগার’ কোথাও-কোথাও ব্যর্থ হয়েছিল সরকারি আলস্য ও অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য। পান্না ও সারিস্কায় একবার দেখা গেল, আর একটিও বাঘ নেই।

ভাল্মিক থাপার তাঁর বিভিন্ন বইতে, ধরিয়ে দিয়েছেন কয়েকটি সূত্র। ভারতীয় উপমহাদেশে জীবজন্তুরা বরাবরই বেজায় সম্মানিত, পূজিত। বাঘের কথা যদি ধরি, সে মানুষের শত্রু হলে, দেবতার আসন পেল কীকরে? পুরাণ বা প্রাচীন কথাসাহিত্যে সত্যমিথ্যার ওপরে, বিচরণ করে কিছু জবরদস্ত ফিলোজফি। বর্ণিত রূপকগুলি থেকে, নিজেদের ভাল থাকার রসদ মেলে প্রচুর। বাঘ আমাদের রক্ষা করবে। অতএব, আমাদেরও উচিত তাকে রক্ষা করা। একে উদ্ভট, গাঁইয়া কনসেপ্ট না ভেবে, এসব রীতিমতো বাস্তবসম্মত নীতি বলে ভাবতে পারলে— পরিবেশ ও নিজেদের লাভ আছে।

আক্রমণটা ছিল, অপদার্থ, আয়েশি, সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে। যারা বনের কিছুই বোঝে না। সাফ বলেছিলেন, কোর  কমিটিতে  দরকার স্রেফ ফরেস্ট রেঞ্জার নয়, চাই স্থানীয় অধিবাসীও, যারা জঙ্গলের কথা শুনতে পায়।

এককথায়, সহাবস্থান, ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স না থাকলে, যুক্তির ভারে ভারাক্রান্ত— কোনও প্রযুক্তিই শান্তিতে বাঁচতে দেবে না।  শুধু কথায়, চিড়ে ভেজে না। তাই আওয়াজ তুলতে হয়েছে ক্রমাগত। রণথম্বরে, জঙ্গলগুরু ফতেহ সিং রাঠোরের শ্রেষ্ঠ শিষ্য অনুভব করেছিলেন, আপাত বধির— গাছপালা, নদী, জল,পাখি, সরীসৃপ থেকে শুরু করে, বিগ বসদের মনের কথা। 

প্রথাগত নিদানের ভ্যারান্ডা না ভেজে, দেগে দিয়েছিলেন— একাধিক নতুন কনসেপ্ট। আক্রমণটা ছিল, অপদার্থ, আয়েশি, সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে। যারা বনের কিছুই বোঝে না। সাফ বলেছিলেন, কোর  কমিটিতে  দরকার স্রেফ ফরেস্ট রেঞ্জার নয়, চাই স্থানীয় অধিবাসীও, যারা জঙ্গলের কথা শুনতে পায়। চাই একদম ফ্রেশ, লেখাপড়া করা তরুণদের। এত বড় দেশ, এমন বায়োডাইভার্সিটি, সব জায়গা আলাদা। সেখানে করণীয় কাজের চরিত্রও আলাদা। সেন্ট্রাল নয়, রাজ্যভিত্তিক অ্যাকশন কমিটি, স্থানীয় মানুষদের নিয়ে তৈরি ওয়ার্কফোর্স দরকার।

ধরা যাক, তামিলনাড়ুর এক অফিসারকে এনে বসানো হল তাড়োবায়। কাজটা সে শুরু করবে কখন?  নিজের কর্মক্ষেত্র চিনতেই তো যুগ পেরিয়ে যাবে! মাথায় জং ধরে যাওয়া, সুবিধাভোগী— অনেকেই বেজায় চটে গিয়েছিলেন। এরপরের দাবি শুনে, থমকে গেছিল, জঙ্গলের ‘সেলফ-প্রোক্লেমড’ জায়গিরদাররা।

জানোয়ার নিশ্চয়ই প্রোটেকটেড জায়গায় থাকবে, কিন্তু বেষ্টনীর বাইরে, নিরাপদ দূরত্বে, দরকার আরও কিছু মানুষ। জঙ্গলের সঙ্গে তাদের স্বার্থ মিলিয়ে দিতে হবে। জঙ্গলে চাই টাকার আমদানি। রেস্পন্সিবল ট্যুরিজম। সেরেঙ্গেটি থেকে শুরু করে, আফ্রিকার যাবতীয় বিগ গেমের আড়তগুলোয় চমৎকার কাজ করেছে এই মডেল। শুধু সরকারি অনুদান নয়, চাই ফরেস্টের নিজস্ব রোজগার। বর্ধিত হবে স্থানীয় ইকোনোমি। অবশ্যই সরকারি নজরদারিতে।

এই ইনসেনটিভ পেলে, এদের কাজের আগ্রহ বাড়বে। অনেক ঝামেলা গোড়াতেই বিলুপ্ত হবে। দক্ষিণের জঙ্গলে পোচিং, চন্দনকাঠ ডাকাতি— অনেকটাই সামলানো গেছিল, বুদ্ধিপ্রযুক্ত কিছু সিদ্ধান্তে। সরকার নিশ্চিত করেছিল, একদা অপরাধীদের উপার্জন। এই কাজের অন্যতম নায়ক ছিলেন, অমিতাভ কান্ত। ভাল্মিক থাপারের বন্ধুলোক। কেরালার সার্থক ক্যাম্পেন, ‘গডস ওন কান্ট্রি’ ও আরও অনেক ভারতীয় উন্নয়নের দিশারী, অতি বিখ্যাত পলিসি-মেকার। জঙ্গলের বৃহত্তর স্বার্থে, অনেকেই এগিয়ে এসেছেন।

ভাল্মিক থাপারের নিজের জবানিতে, ‘১৯৯৫ সালের পর বিশেষ করে, সুপ্রিম কোর্ট একের পর এক রুখেছে— বে-আইনি কাঠের ব্যবসা। অন্তত ২০০-টি আদেশ, মধ্যবর্তী রায়দান না হলে আজ আমরা শূন্য হয়ে যেতাম।’

বাঘ সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত মুভমেন্টের পুরোভাগে থাকা, অভিজ্ঞ মানুষটি চুপ করে থাকার অভ্যেস হারিয়ে ফেলেছিলেন। কয়েক বছর আগে, আফ্রিকান চিতা এনে ছাড়া হয়েছিল কুনো-য়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস্টিজ প্রজেক্ট। বিরূপ মন্তব্য করে বসলেন, ভাল্মিক। বললেন, ভুল সিদ্ধান্ত। এই জায়গা, এদের বাঁচার পরিবেশের পরিপন্থী। আফ্রিকায় নেই, কিন্তু এখানে এদের স্থানীয় শত্রু আছে। এদের পক্ষে, যাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা কঠিন। একমাত্র নির্ধারিত বড় খোলা জায়গায়, খাঁচার নিরাপত্তায় রাখতে হবে। যেভাবে নার্সারিতে থাকে ছোট গাছ। সৌন্দর্য, গতির চূড়ান্ত নিদর্শন, কিন্তু ভীষণই ভালনারেবল এরা।

কুনো-র চিতাদের কয়েকটির হঠাৎ মৃত্যুতে, এই বিতর্ক আবার সামনে এসেছে। সুদূর অতীতে, দেশে, বিদেশি জানোয়ার আনা হয়েছে সাগর পেরিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল, শিকার নামক স্পোর্ট। সিংহ নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে, সংখ্যা বৃদ্ধিও হয়েছে। তাই এশিয়াটিক লায়ন আছে একমাত্র ভারতের ‘গির’-এ। ওঁর লেখায় প্রশ্ন রয়েছে, আদতে স্বদেশি না হলেও, সিংহ ভারতের টপ সিম্বল, কিন্তু বাঘ নয় কেন?  

জেদি, প্রতিবাদী মানুষটার অন্যদিকটাও চোখে পড়েছে। বাঘের প্রতি প্রেমটা একটু বেশিই ছিল। স্বীকার করেছেন একাধিকবার। নিজের প্রধান কর্মক্ষেত্র, মধ্যভারতের সব টাইগার রিজার্ভ। সেখানকার বাসিন্দা, তাদের সন্তান সন্ততিদের সঙ্গে ‘ব্যক্তিগত’ সখ্যতার কথা জঙ্গলমহলে সর্বজনবিদিত। পদ্মিনী, মছলি, কৃষ্ণা, অ্যারোহেড… এদের  অন্দরমহলে অবাধ যাতায়াত থাকায়, বাঘের সংসারের খবরগুলো ওঁর জানা ছিল। যাবতীয় গবেষণা, লেখালেখি, বক্তৃতা, ফিল্ম— সবের মূল চরিত্র এরাই। এইসব বাল্মিকী বাঘেরা-ই ওঁকে চিনিয়েছিল, বনজগতের অন্যান্য পড়শিদের।

ভারতীয় উপমহাদেশের যাবতীয় উইল্ডারনেসকে, কী চোখে দেখতে আগ্রহী ছিলেন, সেটি ওঁরই একটি ফিল্মের, শুরুর অংশের সামান্য বর্ননা দিলে, বুঝতে সুবিধে হবে। মরা, সবুজ, খয়েরি, ধূসর, শুকনো গাছপালা, কিছুটা খোলা জায়গায়— মায়ের সদ্য সাজিয়ে দেওয়া খাবার নিয়ে, খেলা করছে সিংহের বাচ্চারা। মায়ের বুকের ওপর লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে… ক্যামেরা জুম আউট করল। বেশি দূরে নয়। সামনেই দেখা যাচ্ছে, সবুজ জামা পরা, দূরবীন হাতে, দাড়িওয়ালা আমাদের চেনা লোকটাকে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে, তিনিও দেখছিলেন ওই স্বর্গীয় দৃশ্য। এবারে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের (ক্যামেরার) দিকে তাকিয়ে ওঁকে ফিসফিস করে বলতে শোনা যায়, ‘… শোনো, এই অপূর্ব ঘটনা ঘটছে গির-এ, ইন্ডিয়াতে। এটা আফ্রিকা নয় কিন্তু…’