ধরা যাক আজ রোববার

Sunday

‘যারা রবিবার বলে তাদের আমি বিশ্বাস করি না, ওটা রোব্বার’

এখন রোববারে চিল হয়, কিন্তু আগে শক্তিমান হত। হ্যাঁ, আগে শুরু হয়েছিল শনিবারে, কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তায় সে-সময়টা, রোববার দুপুর বারোটা করা হল। শক্তিমানের আগে ক্যাপ্টেন ভিওম হত। কিছুটা পিছিয়ে গেলে, ‘চন্দ্রকান্তা কী কাহানি ইয়ে মানা হ্যা পুরানি’ হত (এটা পুরোটাই বলতে হয়)। বাবাদের আমলে শুনেছি, রোববারে ‘মহাভারত’ হত। রাস্তাফাস্তা নাকি খাঁখাঁ করত ওই সময়ে। পাড়ার মোড়ে দাঁড়ালে, প্রতিটা বাড়ির টিভি থেকে ভেসে আসা— ‘ম্যায় সময় হুঁ’ ব্যারিটোনের সম্মিলিত স্ত্রোত্রে, পাড়া হয়ে উঠত— পবিত্রথরথর পূন্যভূমি!

দাদু অবশ্য, তারও আগের রোববার দেখেছে। কিন্তু দাদুর স্মৃতিচারণা বড় বেদনাদায়ক! ওদের গ্রামে নাকি রোববার হলেই, উঠতি কিশোর ধরে-ধরে, বাটিছাঁট চুল করে দেওয়া হত। আমাদের ক্ষেত্রেও, দাদু সে চেষ্টা কয়েকবার করেছে এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে সফলও হয়েছে! আমরাও কষ্ট পেয়েছি দস্তুরমতো। কারণ, তখনও বাঙালি, কোরিয়ান সভ্যতার এহেন সংস্পর্শে এসে পড়েনি।

আরও পড়ুন: আইপিএলে গণউন্মাদনার পাশে চাপা পড়ে গেল যে দুর্ঘটনা। লিখছেন শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

যাকগে, দাদুরও আগে রোববার দেখেছে এমন কারও সঙ্গে আমার কখনও ব্যক্তিগত হোক বা দুরপাল্লার, কোনও ধরনের আলাপই ছিল না। তাছাড়া ইতিহাস বইতে, মানবসভ্যতায় রোববারের ভূমিকা জাতীয় কোনও অধ্যায়— থেকে থাকলেও, তা আমার অন্তত পড়া হয়নি। জানি না। কিন্তু এটা জানি যে, তারও আগে রোববার ছিল না! না মানে, রোববার ছিল অবশ্যই, কিন্তু সেটার সঙ্গে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর বিশেষ ফারাক ছিল না। নারায়ণ মেঘাজি লোখান্ডে না থাকলে, এখনও সে ফারাক থাকত না।

কারণ, ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের জনক নারায়ণ মেঘাজি লোখান্ডে ও তার সংগঠের অবিরাম লড়াইয়ের ফলেই মহামহিম ব্রিটিশ সরকার রোববারকে ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

নায়ায়ণ লোখান্ডে ১৮৪৮ সালে, থানেতে জন্মগ্রহণ করেন। রেলওয়ে ও ডাকবিভাগে কর্মজীবন শুরু করে, ১৮৭০ সালে স্টোর কিপার হিসেবে মাভান্ডি টেক্সটাইল মিলে যোগদান করেন। মূল গল্পটা শুরু হয় এখান থেকেই। কারণ এখানে এসেই তিনি বুঝতে পারেন, স্বদেশে শ্রমিকদের জীবন কতটা ‘রূপকথাময়’/ রূপকথার গল্পে, দুষ্টু রাজার দেশে— যে রাক্ষুসে অত্যাচার ও নিপীড়নেরে সাদাকালো ছবি আঁকা থাকে, কারাখানার বাস্তবে, সে-ছবিটা তার চাইতেও বেশ এগিয়ে। রঙিন কিনা! রক্ত, ঘাম সব একেবারে সুস্পষ্ট!

সন্তুমনা মালিকরাই বা কী করবে! কারখানা আইন তো প্রণয়ন হল এই সেদিন, ১৮৮১ সালে! যেখানে আইন থাকতেও, পরিযায়ী শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল ‘ডেটাহীন’ হাঁটা ‘সার্থক’ হল, সেখানে আইন এবং স্বাধীনতা দুটোই না থাকলে যা হয়! ১৮৮১-র আদমশুমারী অনুযায়ী বম্বে টেক্সটাইল মিলগুলোর সমস্ত শ্রমিকের ২৩% ছিল ১৫ বছরের কমবয়সী মহিলা ও শিশুর দল!

কারখানা খুলত ভোরবেলা, চলত দশ থেকে চোদ্দঘণ্টা, তারপর আবার পরদিন, ভোরবেলা। হাজিরায় সামান্য দেরি হলে তো কথাই নেই। তাই অনেক শ্রমিক কারখানার বাইরে ঘুমোতেন। গোটা দিনে ‘আরাম’ বলতে ওই খাতায় কলমে আধঘন্টার জন্যে ‘টিফিনব্রেক’, যেটা বাস্তবে পনেরো-কুড়ি মিনিটে এসে ঠেকত। এই পরিস্থিতিতে, কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল কী হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।

ছুটি বলতে, ওই হাতেগোনা সামান্য কয়েকটা হিন্দু উৎসব। কারণ সাপ্তাহিক ছুটির কথা ভাবলেই সাহেব পাপ দিয়ে দেবে! সাদা চামড়ার দেওয়া পাপ, সাংঘাতিক একেবারে! এমতাবস্থায় ১৮৮৪ সালে, নায়ায়ণ লোখান্ডের নেতৃত্বে তৈরি হয়, দেশের প্রথম শ্রমিক সংগঠন— ‘বম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন’।

সেই সংগঠন পরবর্তীতে, যাদের উদ্যোগে, ১৮৯০ সালের ২৪ এপ্রিল, বম্বের রেসকোর্স গ্রাউন্ডে ১০,০০০ শ্রমিক একত্রিত হয়ে, ইতিহাস রচনা করবেন এবং সে-সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক মহিলা শ্রমিক সেই সভায় বক্তব্য রাখবেন।

১৮৯১-তে পাশ ও ’৯২-তে কার্যকর হওয়া কারখানা আইনের ক্ষেত্রেও, লোখান্ডের অবদান অনস্বীকার্য। ১০ জনের বেশি শ্রমিক আছে, এমন সমস্ত কারখানাকে এই আইন মেনে চলতে হত। নয় বছর বয়সের কম, এমন কাউকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যেত না! নির্দিষ্ট কর্মসময়ের বেশি কাজ করানো যেত না! আর রবিবার ছুটি দিতে হত।

কারণ নায়ায়ণ লোখান্ডের ক্রমাগত লড়াইয়ের প্রথম জয় হিসেবে, ১৮৯০-এর ১০ জুন সাপ্তাহিক ছুটির অধিকার আদায় করে নিয়েছিল শ্রমিকরা। যে-অধিকারে, বর্তমানে আমরা উদ্বাহু ‘স্যাটার্ডে নাইট’, ‘উইকেন্ড সর্টেড’ ইত্যাদি পালন করি। কয়েক কাপ বেশি চা, পাঁঠার মাংস, ভাতঘুমের অধিকার। চোদ্দবার করে ঘড়ি না দেখার অধিকার। হুট করে একটা সিনেমা দেখতে বা বাইরে খেতে চলে যাওয়ার অধিকার। সারদিন কিচ্ছুটি না করে, শুধুই গা এলিয়ে পড়ে থাকবার অধিকার। ভর দুপুরবেলায় পাড়ার বন্ধু আড্ডা মারতে না এলে, তাকে গালাগাল দেওয়া অধিকার।

তাদের তো যাহা সোম, তাহাই শনি আর— রবি মানে ঠাকুর। তাছাড়া কর্পোরেট শ্রমিক অথবা আমাদের মতো বিনোদন জগতের মজদুরদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আমাদের মাথার মধ্যে কে যেন গোটা-গোটা করে লিখে দিয়েছে, ‘নাহি দিন, নাহি রাত— খাটিলেই বাজিমাত’। আমাদের মতো একটা বেশ বড় অংশ আছে, যারা ছুটি চায় না। কারণ একদিনের ছুটি মানে একদিনের টাকা নষ্ট।

‘যারা রবিবার বলে তাদের আমি বিশ্বাস করি না, ওটা রোব্বার’ বলার অধিকার। অবশ্য এই কথাটা আমি শুনেছিলাম, আমাদের কলেজ লাগোয়া এক বিখ্যাত চায়ের দোকানে, কোনও এক বুধবার। ওই দুপুর সাড়েবারোটা-একটা নাগাদ। আমার তখন সেকেন্ড ইয়ার। প্রতিদিনই রোববার আর রোববার! একটা বিরক্তিকর দিন! কলেজ…ইয়ে মানে ক্যান্টিন বন্ধ থাকে যে!

যাকগে, দিনটা যে বুধবার ছিল সে-কথা স্পষ্ট মনে আছে, কারণ সে-সময়ে নানাবিধ যত্নশীল বোকামোর মধ্যে, ‘বুধের উদ’বলে এক বিশেষ বোকামোর প্রচলন করেছিলাম আমরা। বুধবার কলেজে এসেও, কলেজে ঢুকতাম না! পাশের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম অথবা কোথাও একটা চড়তে বেরোতাম। সে-দিনও আড্ডা দিচ্ছিলাম, যার মূল বিষয় ছিল, সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর মতো রোববার দিনটাকেও কীভাবে সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা যায়। তখনই চা-দোকানের পার্মানেন্ট নিবাসী, আমাদের থেকে প্রায় বছর আটেক বড় এক দাদা এই বাণী প্রদান করেছিল। সেই দাদা কিছুর একটা ব্যবসা করত বলে শুনেছি, দেখিনি। দেখেছি শুধু অপেক্ষা করতে, রোববারের অপেক্ষা। যেদিন আমাদের মতো অসমবয়সীদের ছেড়ে নিজের চাকরি বা সত্যিকারের ব্যবসারত বন্ধুদের সঙ্গে অন্তত একবেলা আড্ডা দিতে পারবে। কারণ সেই চায়ের দোকানও রোববার সন্ধ্যায় বন্ধ থাকত, আর সমবয়সীদের ব্যক্তিগত জীবন ছিল। ওই দাদার ছিল না সেটুকুও, আরও অনেক মানুষের মতো যাদের রোববার নেই।

রেঁস্তোরা, শপিংমল, সিনেমাহল, পানশালায় কাজ করা মানুষগুলো যাদের মূল পরিশ্রম ও লাভ ওই শুক্র থেকে রবির মধ্যেই। ফ্রিল্যান্সার যাঁরা, যাঁরা রিক্সা, অটো, বাস চালান, পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, ডাক্তার, নার্স, যে মানুষগুলো রোজ আপনার এলাকা থেকে ময়লা তুলে নিয়ে যায়, যে মানুষটা শ্মশানের কাউন্টারে বসে, সে-লোকটার দোকানে সপ্তাহান্তে ‘সেল’ হয় সবচেয়ে বেশি! প্রমুখরা।

তাদের তো যাহা সোম, তাহাই শনি আর— রবি মানে ঠাকুর। তাছাড়া কর্পোরেট শ্রমিক অথবা আমাদের মতো বিনোদন জগতের মজদুরদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আমাদের মাথার মধ্যে কে যেন গোটা-গোটা করে লিখে দিয়েছে, ‘নাহি দিন, নাহি রাত— খাটিলেই বাজিমাত’। আমাদের মতো একটা বেশ বড় অংশ আছে, যারা ছুটি চায় না। কারণ একদিনের ছুটি মানে একদিনের টাকা নষ্ট। আর এভাবেই, সামহোয়্যার বিটুইন নারায়ণ মেঘাজি অ্যান্ড নারায়ণ মূর্তি— আমরা এতটা বাস্তববোধ-সম্পন্ন যন্ত্রমানব হয়ে উঠলাম যে, স্ট্রেস আমাদের ভিত্তি, অ্যাংজাইটি আমাদের ভবিষ্যৎ! অথচ এরকম হওয়ার কথা ছিল না…সত্যিই ছিল না!

কিন্তু হয়েছে যখন, চেষ্টা ছাড়া তো আর তেমন কিছুই করার নেই… এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটু ভাল থাকার চেষ্টা। একটু আলসেমির চেষ্টা। একটু শান্তির চেষ্টা। স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না বন্ধু! যে স্বপ্নে, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে বারংবার নেমে আসতে পারে, এমন একটা দারুণ দিন, যেদিন সে স্বেচ্ছায়— বাঁচতে ও বলতে পারবে,

 ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনো কাজ নেই
বেশ করব শুয়ে থাকব, আজ রোববার