ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আমার প্রথম ফিচার ছবি, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। ঋতুদার সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম বড় কাজ। তার আগে ঋতুদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার, ‘খেলা’-র সূত্রে। ‘খেলা’-তে আমি কিছু স্টক শট নিয়েছিলাম কলকাতার বৃষ্টির। অভীক মুখোপাধ্যায় তখন কোনও কারণে ব্যস্ত ছিলেন। সেসময়ে খুব বৃষ্টি হয়েছিল, কলকাতা জলে ডুবে গিয়েছিল। সেই সুযোগটাই ছিল প্রথম। তারপর একটি প্রাইভেট চ্যানেলের জন্য ঋতুদা দুটো টেলিছবি বানায়। তার মধ্যে একটি আমি শুট করি, সম্ভবত ‘পিছুটান’ নাম ছিল ছবিটার, যদি খুব ভুল না হয়, যতদূর মনে পড়ে, রনিদা. রজতাভ দত্ত ছিল। সেই থেকে ঋতুদার সঙ্গে আমার জার্নি শুরু, আমার চোখে ঋতুদাকে দেখাও সেই শুরু। সেই যাত্রাপথটা চলেছিল ২০১৩ সালে, ওঁর মৃত্যু পর্যন্ত। আমি এরপর অনেকগুলো কাজ করেছিলাম, এবং সুযোগ পেয়েছিলাম ঋতুদাকে দেখার, অ্যাজ আ ডিরেক্টর, অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর।
অভিনেতা হিসেবে ঋতুদাকে আমি পেয়েছি সরাসরি পরিচালক ঋতুদারও আগে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে আমি অভিনেতা হিসেবে কাছ থেকে দেখেছিলাম ঋতুদাকে। পরিচালক হোক, অভিনেতা হোক, বা প্রোডাকশন ডিজাইনার হোক— যে ভূমিকাতেই ঋতুদা থাকুন না কেন, ওঁর সঙ্গে কাজ করা ছিল একটা মাস্টারক্লাস। ক্যামেরার পিছনে পরিচালক হিসেবে, ক্যামেরার সামনে অভিনেতা হিসেবে— চিত্রগ্রাহক হিসেবে দুটোই ছিল আমার কাছে খুব জরুরি শিক্ষা। যেভাবে অভিনয় করে দেখাতেন ঋতুদা, প্রোডাকশন ডিজাইনের যে চোখ ছিল ঋতুদার, তা ছিল অতুলনীয়।
অভিনেতা ঋতুদার থেকে যে জরুরি শিক্ষাটা পেয়েছিলাম, তা অভিনয় এবং ক্যামেরা মুভমেন্ট সংক্রান্ত। অভিনেতার কাজের মধ্যে ক্যামেরা কখনও ইনট্রুড করবে না, বরং ক্যামেরা অভিনেতাকে অনুসরণ করবে। অভিনেতা ঋতুদার দর্শন ছিল এটাই। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ছাড়াও ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-এও অভিনেতা হিসেবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ওঁকে। পরিচালক ঋতুদা যখন শট বোঝাতেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কথা বলার ঢংয়ে অভিনয় করে দেখাতেন। সেটাই জ্যান্ত হয়ে উঠত শটে। তাই সেটাই ধরা পড়ত ক্যামেরায়।

অভিনেতা ঋতুদার থেকে যে জরুরি শিক্ষাটা পেয়েছিলাম, তা অভিনয় এবং ক্যামেরা মুভমেন্ট সংক্রান্ত। অভিনেতার কাজের মধ্যে ক্যামেরা কখনও ইনট্রুড করবে না, বরং ক্যামেরা অভিনেতাকে অনুসরণ করবে। অভিনেতা ঋতুদার দর্শন ছিল এটাই। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ছাড়াও ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-এও অভিনেতা হিসেবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ওঁকে। পরিচালক ঋতুদা যখন শট বোঝাতেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কথা বলার ঢংয়ে অভিনয় করে দেখাতেন। সেটাই জ্যান্ত হয়ে উঠত শটে। তাই সেটাই ধরা পড়ত ক্যামেরায়।
পরিচালক হিসেবে ঋতুদাকে পেয়েছিলাম ওঁর তিনটি কাজে, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’, ‘নৌকাডুবি’ আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওঁর ডকু ফিকশন ‘জীবনস্মৃতি’-তে। এই তিনটি কাজেই আমি ছিলাম চিত্রগ্রাহক। এছাড়া ‘মুম্বই কাটিং’ অ্যান্থোলজিতে ঋতুদার সঙ্গে কাজ করেছিলাম। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এ রঙের ব্যবহার থেকে শুরু করে আরও নানা কিছুতে নিরীক্ষামূলক কিছু কাজ হয়েছিল। আমার কেরিয়ারেও তাই ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকে যাবে। এক্সপেরিমেন্ট করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন ঋতুদা। বলতেন, ‘তোর যদি আনরিয়েল লাগে, তাও তুই তোর মতো করেই কাজটা কর।’ আলোর ব্যবহার নিয়েও নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হত ঋতুদার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। ‘জীবনস্মৃতি’-তে যেমন ঘটেছিল জালিওয়ানওয়ালাবাগের দৃশ্য তৈরি করতে গিয়ে, মনে পড়ে। ‘জীবনস্মৃতি’ ছিল ডিজিটাল কাজ। ‘নৌকাডুবি’ ছিল আবার অ্যানালগ। রঙের ব্যবহারে পিরিয়ডকে কীভাবে ধরা যায়, সেটা ঋতুদার কাছ থেকে শিখেছিলাম। শিখেছিলাম, চিত্রগ্রহণে কীভাবে পোশাক থেকে সেট— সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ঋতুদার থেকে স্ক্রিপ্ট শোনা ছিল একটা অভিজ্ঞতা! চিত্রনাট্য শুনতে শুনতে যেন ছবিটা দেখতে পাওয়া যেত। শুটের সময়টা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, শুটের আগের সময়টাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সকলের মনে মনে ছবিটা আসলে তখনই তৈরি হয়। সেই সময়টায় ঋতুদার নির্মাণচিন্তার হদিশ পাওয়া যেত যেন!
ঋতুদা চলে গিয়েছেন ১২ বছর হয়ে গেল আজ। একটা যুগ হয়ে গেল, ঋতুদা নেই। ভাবতেই অবাক লাগে। দাদা, বন্ধু, শিক্ষক হিসেবে ঋতুদা চিরকাল মনে থেকে যাবেন!
ছবি ঋণ : সঞ্জীব ঘোষ