বাংলার বাইবেল : পর্ব ১

সোসাইটি বনাম সোসাইটি

১৮১২। চৈত্রের মধ্যগগনে তীব্র তেজোদ্দীপ্ত রবি। আর খ্যাতির মধ্যগগনে শ্রীরামপুর প্রেস। ষোলোটির ওপর ভারতীয় ভাষায় ধর্মগ্রন্থ— যার মধ্যে আছে বাইবেল, পুরাণ, কোরান, রামায়ণ-মহাভারত, বেদ-উপনিষদ, ব্যাকরণ, অভিধান থেকে কোর্টের ফর্ম ও কলেজের প্রশ্নপত্র। সবই ছাপছেন তাঁরা। কাগজ, কালি, ফন্ট— সব নিজেদের। আর সব দেশি হওয়ায় খরচও কম। তাই সব কাজই এসে পৌঁছয় শ্রীরামপুর। রীতিমতো ‘ইন্ডাস্ট্রি’। আর তাতেই লাগল আগুন। লাগল, নাকি লাগান হল কে জানে! তবে সে আগুন ভয়ানক! কাগজ-কালি, আঠা, বোর্ড— সমস্তটা মিলিয়ে গুদামঘরে এক জতুগৃহ তৈরিই ছিল। স্ফুলিঙ্গ পড়তেই প্রায় সব ছাই। তবে ফন্ট নষ্ট হলেও, ফন্টের ছাঁচ বেঁচে গিয়েছিল। আলাদা বাড়িতে থাকায়, বেঁচে গিয়েছিল ঐতিহাসিক মুদ্রণ যন্ত্রটিও। প্রাণহানিও সেরকম হয়নি। আর বেঁচে গিয়েছিল বাংলা গদ্য।

আরও পড়ুন: কীভাবে কলকাতা হয়ে উঠল ‘গির্জানগর’? লিখছেন রামিজ আহমেদ…

শ্রীরামপুর ও ফোর্ট উইলিয়ামের জোড়কলমী শৈলীর চোরাস্রোতে আটকে পড়ে সে খাবি খাচ্ছিল। ফলে বাঙালিরা অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। তবে সে খুশি কিছুই নয়, যতটা খুশি ব্যাপ্টিস্ট সোসাইটির কেষ্টবিষ্টুরা হয়েছিলেন তাঁর তুলনায়। মানে ইংল্যান্ডে ব্যাপ্টিস্ট মিশনের মাথারা, যাঁরা শ্রীরামপুর-ত্রয়ীর স্বাধীন কার্যকলাপে ক্রমেই তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছিলেন।কিন্তু তাঁদের স্থানীয় প্রভাবের সামনে, চুপচাপ থাকা ছাড়া কোনও রাস্তা পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে কোম্পানির সঙ্গে কেরি সাহেব নিজগুণে এমন এক সুসম্পর্ক বানিয়ে নিয়েছিলেন, যা অবিশ্বাস্য। এমনিতে কোম্পানির লোকজনদের সঙ্গে এই সব ডিসেন্টর মিশনারিদের সম্পর্ক ছিল আদায়-কাঁচকলায়। ইংল্যান্ডে শ্রেণিবিভাজন ছিল ভয়ানক। এখানকার বর্ণব্যবস্থার থেকে কম কিছু নয়। তাই বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে আসা কোম্পানির বড়সাহেবদের কাছে সমাজের নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা এই সব প্রচারকরা ছিলেন এক উটকো অশান্তি। এঁদের ধর্মবোধ, বাইবেল শিক্ষা, ভাষা ক্ষমতা সর্বোপরি সেই সব নবলব্ধ বিদ্যে চটজলদি নেটিভদের ওপর ‘প্রয়োগ’ করার ব্যাগ্রতা দেখে তাঁরা প্রমাদ গুনতেন। তবে, কেরিকে তাঁরা শ্রদ্ধা করতেন। তাই অগ্নিকাণ্ড অনেকের কাছেই খুশির কারণ হয়েছিল। অবশ্যই কেরি ছাড়া। তিনি সে-সময়ে শ্রীরামপুরে ছিলেন না। ছিলেন কলকাতায়। খবর নিয়ে যান মার্শম্যান। শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন কেরি। তারপর ধীরেসুস্থে পরের কার্যপ্রণালী ঠিক করে নেন।

উইলিয়াম কেরি

উদবিগ্ন কেরি চিঠি লিখলেন তাঁর পেরেন্টবডিকে, আর জানিয়ে দিলেন এই বিদ্ধংসী আগুনের কথা। জানান তাঁদের এতদিনের সাজানো সাম্রাজ্য প্রায় ছাই হয়ে গেছে। একে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা অসাধ্যকর। কারণ, একে প্রবল অর্থের প্রয়োজন, পাশাপাশি তাঁদের আগের বয়স-উদ্যমও আর নেই। এমতাবস্থায় কী করণীয়, তা যেন সম্পাদকমণ্ডলী তাঁদের জানায়।

তবে কেরি শুধুমাত্র ব্যাপ্টিস্টদের জানিয়েই থেমে থাকেননি। তিনি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড নানা জায়গায় এই বিষয়টি জানিয়ে লেখালেখি করেন। যা টাকা ওঠে, তা আশাতীত। কিছু বছরের মধ্যেই শ্রীরামপুর তাঁর আগের চেয়েও পোক্ত পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলে এবং প্রচুর বই, গ্যাজেট ইত্যাদি ছাপায়। শেষাবধি প্রায় চুয়াল্লিশটি ভাষায় বাইবেল প্রকাশ করে শ্রীরামপুর মিশন। পুড়ে যাওয়া প্রেসটি অনেক বড় করে পুনরায় নির্মিত হয়। কিন্তু যা তাঁরা হয়তো আন্দাজ করেননি, তা হল এই বিশাল প্রকাশনা সাম্রাজ্য তাঁদের আরেক বিশাল আন্তর্জাতিক পুঁজিপুষ্ট প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল। ফলে বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই প্রতিষ্ঠান— আন্তর্জাতিক বাইবেল সোসাইটি ও তার স্থানীয় শাখা, যাকে ক্যালকাটা অক্সিলিয়ারি বলা হত। শুরুতে অবশ্য বিরোধ ছিল না। ছিল সহযোগিতা ও সহাবস্থান। ফান্ডিং সম্পর্কে কেরির গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ফান্ডের প্রয়োজনও ছিল একটানা। তার উপায়ও ছিল কিন্তু সময়-সুযোগ মতো আবেদন করে সেগুলোকে আনা এবং তার সদ্ব্যবহার করে সেই নথি প্রস্তুত রাখা— এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে কেরি ছিলেন দর।

ইংল্যান্ডের ব্যাপটিস্ট সোসাইটিকে পাঠানো চিঠি, উইলিয়াম কেরি-র সই করা

সারা পৃথিবীতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে খ্রিস্টিয় ধর্মগ্রন্থ ও অনুদিত বাইবেল তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিন বাইবেল সোসাইটি স্থাপিত হয় ১৮০৪ সালে। তাঁরা নিজেরা অনুবাদ করবেন, আর যেখানে আগের থেকেই অনুবাদের কাজ চালু হয়ে গেছে, সেখানে তাঁরা আর্থিক সহযোগিতা করবেন। এ-বিষয়ে তাঁরা একটি বিজ্ঞাপন দেন, এবং থিতু হয়ে বসতে না বসতেই, সেখানে একটি চিঠি পৌঁছয় বাংলায় বাইবেল ছাপার জন্য ১০০০ পাউন্ড প্রার্থনা করে। তাদের প্রথম রিপোর্টের সূচিতেই তাদের বিস্ময় স্পষ্টঃ A correspondence has been opened by your Committee, with some gentleman at Fort William in Bengal, and that the plan and regulation of the Society have been communicated to him. ইনি আর কেউ নন, উইলিয়াম কেরি। যিনি জানতেন এসব ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে টাকা পাওয়া শুধু কঠিন নয়, কখনও-কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সোসাইটির ১৮০৭ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে— কেরির চটজলদি রেসপন্সে খুশি হয়ে তাঁরা পাঁচটি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ বাবদ কেরীকে ১০০০ পাউন্ড অগ্রিম দেন এবং একটি লাইব্রেরী গড়ে তোলার, স্থানীয় সহকারীদের মাইনে দেওয়ার আর ছাপানোর বিবিধ খরচ বাবদ আরও বোনাস ১০০০ পাউন্ড মঞ্জুর করেন। স্পষ্টত, ফোর্ট উইলিয়মের মতো একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদনটি যাওয়ায়, তাঁরা আরও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনুদানটি দেয়। শীঘ্রই ফোর্ট উইলিয়মে কেরীকে সদস্য রেখে একটি কমিটি তৈরি হয়, টাকাটির ব্যবহার তদারকি করার জন্য। এতে ফোর্ট উইলিয়মে একরকম সমস্যা হয় যদিও। আগে সেই গল্পটা করে নেওয়া যাক।

১৮০০ সালে বড়লাট ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ পত্তন করেন এদেশে আসা সাহেব অফিসারদের দেশি ভাষায় পটু করে তোলার জন্য। সেটি ভাষা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে একইসঙ্গে বিতর্কেরও। যখন বাইবেল অনুবাদের খানিকটা উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন ভারতীয় শিক্ষকদের একাংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। কেন সরকারী টাকায় সরকারী পরিসরে ধর্ম-প্রচারমূলক কাজ হবে এই নিয়ে। কর্তৃপক্ষ শঙ্কিত হন এই ঝামেলায় আসল কাজ, অর্থাৎ প্রশাসকদের ভাষা শিক্ষার কাজ না ডকে ওঠে। অতএব উদ্যোগটি ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ব্যবস্থাটি এরকম দাঁড়ায় যে— বাইবেল অনুবাদ করবে শ্রীরামপুর প্রেস, আর বাইবেল সোসাইটির অনুদান পর্যবেক্ষণ করবে ফোর্ট উইলিয়মস্থিত একটি কমিটি। আর কেরি এই দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ-সূত্র হিসাবে থাকবেন। স্পষ্টতই, প্রথম দিকে বাইবেল সোসাইটির কাজ ছিল সাহায্য ও সমর্থনের। সরাসরি অনুবাদের কাজে তাঁরা শ্রীরামপুরত্রয়ীর ওপরেই নির্ভরশীল ছিল। তবে এই অবস্থা পালটাতে সময় লাগেনি বেশি। বাইবেল সোসাইটির প্রাথমিক কেরি নির্ভরতার একটা কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, ১৮১৩ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মিশনারি ক্রিয়াকলাপ শুধু যে অনভিপ্রেত ছিল তা নয়, রীতিমতো বেআইনি ছিল।

উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাইবেল

১৮১৩ সালের চার্টার কোম্পানির শাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নীতিগত পরিবর্তন আনে — ব্যবসায়, শিক্ষায় এবং মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের অধিকারের ক্ষেত্রে। এরপর বিভিন্ন মিশনারি গোষ্ঠী তুলনায় স্বাধীন ভাবে ভারতে ধর্মপ্রচার করতে সক্ষম হয়। ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ ও ছাপানোর বা বিতরণের কাজও নিঃসঙ্কোচ হয়। যদিও সবসময়ে যে কোম্পানির উপরমহল, ব্যাপ্টিস্ট এবং অন্যান্য ডিসেন্টারদের প্রতি খুব সদয় হয়ে পড়েন তা নয়। তবে মিশনারি গোষ্ঠীগুলোর আর তত মন যুগিয়ে চলার প্রয়োজন থাকে না। ১৮১১ সালে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজেই বাইবেল সোসাইটির একটি কলকাতাস্থিত শাখা বা অক্সিলিয়ারি খোলার প্রস্তাবনা আনা হয়। এটি শুধু কলকাতা নয়, সমগ্র পূর্বাঞ্চলে সোসাইটির কর্মকাণ্ডের প্রধান কার্যালয় হবে। কেরি এবং শ্রীরামপুরের মিশনারিরা সিঁদুরে মেঘ দেখেন এবং এটিকে শুধু অপ্রাসঙ্গিক নয়, তাঁদের প্রস্তুত করা ক্ষেত্রে অনর্থক হস্তক্ষেপ মনে করেন। এ-বিষয়ে চিঠিও লেখেন। কিন্তু কোম্পানি এতে ভাল সুযোগ পায় ব্যাপ্টিস্টদের মতো ডিসেন্টর সংগঠনগুলির ক্রিয়াকলাপ খর্ব করার। সেটি এবং অবশ্যই পুঁজির জোরে শেষ অবধি অক্সিলিয়ারিটি খুলেই ফেলা হয়। কিন্তু হঠাৎ এর প্রয়োজন হয় কেন? এর বছর খানেক আগে, নামকরা মিশনারি হেনরি মার্টিন কলকাতায় আসেন আর কলকাতার ব্যপ্টিস্টদের সভায় একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন ভারতে বাইবেলের আকাল, এবং শীঘ্রই ৯০,০০০ বাইবেলের প্রয়োজন। এক লাখ হলে আরও ভাল। মার্শম্যান অবশ্য বুঝে পান না, এত পাঠক মার্টিন পেলেন কোথায়! তাঁর হিসেবে ৫০,০০০-এর কিছু বেশি হলেই যথেষ্ট, তাও ক্যাথলিকদের ধরে যাঁদের অনুদিত বাইবেলে আগ্রহ কম। আর সেটুকু প্রয়োজন শ্রীরামপুরই মিটিয়ে দিতে সক্ষম। কিন্তু ততক্ষণে ডেভিড ব্রাউন, যিনি পাদ্রী, নীলকর সাহেব আর কোম্পানির ‘পেয়ারের লোক’, তিনি পেয়ে গেছেন সুযোগ। ইনিই সেই লোক, যার ওপরে বিশ্বাস করে জন টমাস প্রায় ঘটিবাটি বেচতে বসেছিলেন। তিনি কালক্ষেপ না করে বক্তৃতাটি ছাপিয়ে বিলি করে দেন এবং ফোর্ট উইলিয়ামে মিটিংও ডেকে ফেলেন। সেই মিটিংয়ে তিনি বলেন, এই বিপুল পরিমাণ চাহিদা মেটাতে, বাইবেল সোসাইটির একটি কলকাতা অক্সিলিয়ারি খোলা হোক; আর আগের ওই সমন্বয়কারী কমিটিকে ডিজল্ভ করা হোক, কারণ এখন বাইবেল সোসাইটি নিজেরাই তাদের অনুদান মনিটর করুক। আগের কমিটির আর কোনও দরকার না থাকায়, সেটিকে ভেঙে দেওয়া হোক এবং কেরি ও তাঁর সহকর্মীরা যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ওই পদ ধরে রেখেছেন তাঁরা স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিন। ক্ষুব্ধ কেরি বলেন, এই সব কমিটি ভাঙাচোরার ব্যাপারটা বাইবেল সোসাইটির পেরেন্টবডির ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। একজন মিশনারির একটি সভায় রাখা কিছু বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয়ভাবে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। ব্রাউন বলেন যে, কেরি যেন শঙ্কিত না হন কারণ দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রাচ্যে বাইবেল অনুবাদের মুখ। তাঁর মতো ব্যাপারটা কেউ বোঝে না। ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে এই নতুন অক্সিলিয়ারি কাজ করতে পারবে না। তিনি যেন ওই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া কমিটিকে গুটিয়ে দিয়ে বাইবেল সোসাইটির অংশ হয়ে কাজ করেন। তাতে সব পক্ষই লাভবান হবে। বাইবেল সোসাইটি তাঁকে কতটা শ্রদ্ধা করে, তাদের আগের সহযোগিতাই তার প্রমাণ। কিন্তু কেরি মানতে চান না। তিনি ব্যাপ্টিস্ট হয়ে এসেছেন, তাঁদের হয়েই কাজ করতে চান। বাদানুবাদ চলতে থাকে। ক্রমে এরকম একটা সিদ্ধান্তে সবাই পৌঁছন যে— অনুবাদের কাজ শ্রীরামপুর যেমন করছে করুক, কিন্তু তার ফান্ডিং, মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ বাইবেল সোসাইটি করবে। তারা অনুবাদে দখলদারী করবে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইবেল সোসাইটিকে বৃহৎ মার্কিন পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হয়। মুদ্রণের খরচও ছিল প্রচুর। তবু শ্রীরামপুরের একটা জোরের জায়গা ছিল। তাদের বিস্তৃত মুদ্রণ-পরিকাঠামো। এক বছরের মধ্যে সেখানে আগুন লাগে।

ব্রাউন বলেন যে, কেরি যেন শঙ্কিত না হন কারণ দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রাচ্যে বাইবেল অনুবাদের মুখ। তাঁর মতো ব্যাপারটা কেউ বোঝে না। ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে এই নতুন অক্সিলিয়ারি কাজ করতে পারবে না। তিনি যেন ওই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া কমিটিকে গুটিয়ে দিয়ে বাইবেল সোসাইটির অংশ হয়ে কাজ করেন। তাতে সব পক্ষই লাভবান হবে।

১৮১৫ সালের বাইবেল সোসাইটির রিপোর্টে পাই, তাদের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে সিংহল থেকে চিন অবধি এক বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে। প্রায় সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়া তাদের বিস্তীর্ণ কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে ১৮১৪ সালে বম্বে অক্সিলিয়ারি খুলে ফেলা হয়েছে। ব্যপ্টিস্টদের সঙ্গে সম্পর্কের চিড় জোড়েনি, তবে তাতে খানিক প্রলেপ পড়েছিল। কিন্তু শ্রীরামপুরের যেটা সবচেয়ে শ্লাঘার জায়গা, অর্থাৎ পূর্বএশিয়ার বৃহত্তম মিশনারি প্রেস ও বাইবেল অনুবাদক প্রচারক গোষ্ঠী, তাতে আঘাত লেগেছে অনেকটাই। যার জোরে এতদিন পেরেন্টবডিকে খানিকটা অবজ্ঞা করেই স্বাধীন ভাবে কাজ করছিলেন তাঁরা, তা কমে এসেছে। নিজেদের মধ্যে দলাদলির জেরে ১৮২৭ সালে ভেঙে যায় সোসাইটি। শ্রীরামপুর মিশন আলাদা হয়ে যায়। ব্যাপ্টিস্ট মিশন কলকাতায় হেড কোয়ার্টার তৈরি করে। এটি ভেঙে পরে একটি ক্যালকাটা ব্যাপ্টিস্ট মিশনও স্থাপিত হয়। বাইবেল সোসাইটি নতুন মিশনের হাত ধরে। কিন্তু বাইবেল কোথায়? তাঁরা কি সেই পুরনো কেরির বাইবেলই ছাপাবে, যা শত কাজের মধ্যেও তিনি মাঝে-মাঝে পরিমার্জন করতে থাকেন। এখানেই বাইবেল সোসাইটি একটি ট্রাম্প কার্ড খেলে। তাঁরা কেরির প্রতিস্পর্ধী হিসেবে তুলে আনেন ব্যাপ্টিস্ট মিশনের এক তরুণ মিশনারিকে। উইলিয়ম ইয়েটস। তাঁর হাতেই রচিত হবে কেরি পরবর্তী বাংলা বাইবেলের এক গতিময় অধ্যায়। তবে এই হাতবদল খুব সহজে হবে না। কেরি ছিলেন সর্বতোভাবে অমায়িক। এদেশে আসা ইস্তক তাঁর পরিবার ছারখার হয়ে গিয়েছিল। পুত্র পিটারকে হারিয়েছিলেন শিশু অবস্থায়। মদনাবাটির শীতল মাটির নীচে সেই শিশু আজও শুয়ে আছে। ইয়েটসকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন কেরি। কেরি জানতেন, তাঁর চেয়ে শ্রেয় অনুবাদক আসবেন, তিনি শুধু শুরু করেছেন কাজটি। কিন্তু বাইবেল সোসাইটি জানত যে, কেরির জায়গায় ইয়েটসকে আনতে গেলে একটা জোরালো ইস্যু দরকার। সেটি তারা পেয়েও যায়। বাংলা বাইবেল অনুবাদে এক আশ্চর্য বিতর্কের জন্ম হয়, যার ঢেউ গিয়ে পড়ে এদেশ ছেড়ে আমেরিকার মাটিতে। একটিমাত্র শব্দকে কেন্দ্র করে বাইবেল সোসাইটির উত্থান প্রশ্নাতীত হয়ে যায়।

উইলিয়ম ইয়েটস

শব্দ ডোবায়, শব্দ ভাসায়! পটে আঁকা ছবির মতো শ্রীরামপুর গ্রাম। গোস্বামীদের প্রাসাদোপম ইমারত, ইতস্তত ছড়ানো ইটের গাথা মন্দির, দিনেমার বণিকদের কাছারি ও উপান্তে মিশনারিদের কুঠি। তাঁর পাশে কুলুকুলু বয়ে চলেছে পুণ্যতোয়া গঙ্গা। এমনিতে শান্ত, গাছগাছালি ঘেরা বাঁধানো ঘাটে স্নান করতে আসা-যাওয়া মানুষের অল্প যাতায়াত ও মৃদু কথোপকথন। তরঙ্গময়ী জাহ্নবীতীরে এক নিস্তরঙ্গ জীবন। যদিও আজ সেখানে উত্তেজনা যথেষ্ট। কৃষ্ণ পাল আজ খ্রিস্টান হবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মিশনারীরা অবশেষে আজ একজনকে ধর্মান্তরিত করবে। তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীর স্রোত তার দু’পারের ভাঙাগড়ার পটে অনেক ছবিই দেখেছে। সপ্তগ্রামের উত্থান-পতন, রোমীয় বাণিজ্যপোতের আনাগোনা, ধনপতির সিংহল যাত্রা, পোর্তুগীজদের আগমন ও মহাপ্রভুর নির্গমন। আজ এও দেখবে। দেখলোও। শেষ ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে-কাঁপতে খ্রিস্টান হলেন কৃষ্ণ পাল। গঙ্গায় ডুব দিলেন। তারপর কেরি তাঁকে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে… কী করলেন? সেটাই হল কথা, আর সেই কথা নিয়েই যত বিপত্তি।

কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশনের জন্য উইলিয়াম ইয়েটসের অনুবাদ করা ওল্ড টেস্টামেন্ট

ওয়ার্ড প্রবল উৎসাহে লিখলেন – ‘Thus, the door of faith is open to the Hindoos, and who shall shut it?’ব্যাপ্টিস্টদের কাছে ব্যাপ্টিজম যে খুব ‘সিরিয়াস’ ব্যাপার, সে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু যা আশ্চর্য, তা হল, এই ঘটনার দেড়-দু’মাসের মাথায় যখন নিউ টেস্টামেন্টে ছেপে এল, আর বাইবেল অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ মোটের উপরে সম্পন্ন হল, তখন দেখা গেল এই কেন্দ্রীয় খ্রিস্টিয় আচারটি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে — ‘আমি দেখিলাম আত্মা নামিতেছে ঘুঘুর মতো তাহাও বসিল তাহার ওপরে এবং আমি তাঁহাকে চিনিলাম না কিন্তু তিনি পাঠাইলেন আমাকে ডুবাইতে জলে। তিনি বলিলেন আমাকে যাহার ওপর দেখিবা আত্মা নাকিয়া বসিল তিনি সে জল যাহা ডুবাইবেন পরমাত্মাতে। এবং আমি সাক্ষী দিলাম এই ঈশ্বরের পুত্র।’ (জোহান ১:৩২)এখন হতদরিদ্র অসহায় কৃষ্ণ পালকে হুগলীর জলে নিমজ্জন করা এক জিনিস, কিন্তু পরমাত্মাকে যেভাবে কেরি ডোবালেন, তাতে অনেকেই আঁতকে উঠেছিল। মনে রাখতে হবে যে, এই নিমজ্জনের মধ্যে দিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষার ব্যাপারটা ব্যাপ্টিস্টদের একটি জরুরি সাম্প্রদায়িক আচার হলেও, সবার কাছে নয়। অনেকেই জল ছিটিয়ে, অর্ধেক ডুবিয়ে বা আরও নানা উপায়ে এই আচারটি পালন করেন। তাঁরা অনেকেই এই অনুবাদে বিব্রত হয়ে পড়লেন। কিন্তু এটা যে একটা বিশাল আকার নেবে এবং শেষে শ্রীরামপুরের বাইবেল অনুবাদের বিপুল কাজটিকেই মোটামুটি তামাদি করে দেবে, এতটা আঁচ বোধহয় কেরি-মার্শম্যানের মতন অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ মিশনারিরাও করেননি। বাইবেল অনুবাদের ইতিহাসে এটাকে ‘ব্যাপ্টিজো কন্ট্রোভার্সি’ বলা হয়। আর এই কন্ট্রোভার্সির দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন গুরু ও শিষ্য— দুই উলিয়ম, কেরি এবং ইয়েটস।

১৮০৫-এর প্রথম বাইবেল সোসাইটির নথিতে অন্তর্ভুক্ত উইলিয়াম কেরি-র চিঠি

উইলিয়াম ইয়েটসের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা অনেকটা অন্যান্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদেরই মতো। সাধারণ শ্রমজীবী পরিবারে, শিশুকাল থেকে শিক্ষানুরাগী, ভক্তিবান প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ভাষাজ্ঞানে উৎসাহী। তরুণ বয়স থেকেই ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইংল্যান্ডে তাঁর পড়াশোনার ভার নেয়, এবং প্রচারক হিসেবে তাঁকে লালন করে। প্রাথমিকভাবে তিনি ইথিওপিয়া যেতে চেয়েছিলেন, আমহারিক শিখেছিলেন, কিন্তু কেরি তাঁকে ভারতে, এবং বিশেষ ভাবে শ্রীরামপুরে নিয়ে যান। তিনি উইলিয়াম কেরির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। প্রথমে ইয়েটস খুব যে অনুবাদে আগ্রহী ছিলেন তা নয়, তাঁর ভাষা শিক্ষার মূল প্রেরণা ছিল— ধর্মপ্রচারের কারণে বক্তৃতা ও কথোপকথন। কিন্তু কেরির সঙ্গে থেকে তাঁর অনুবাদের আগ্রহ জন্মায়। ১৮১৮ সালে তিনি একটি চিঠিতে প্রথমবার পরিস্কার ভাবে তাঁর অনুবাদক হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ইতোমধ্যে তিনি সংস্কৃতশিক্ষা করেন এবং কমবেশি চারশো পাতার একটি সংস্কৃত ব্যকরণ গ্রন্থও প্রণয়ন করেন। অনুবাদ বিষয়ে কেরির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হত। কেরির পদ্ধতির সঙ্গে তিনি সম্যক ভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে আমরা কেরির অনুবাদদর্শন সম্পর্কে জানতে পারি যে— তিনি ‘translation’-এ বিশ্বাসী ছিলেন, ‘transference’-এ নয়। কেরি পারতপক্ষে কোনও বিদেশি শব্দ রাখতেই অরাজি ছিলেন। নামের ক্ষেত্রে, এবং কিছু নামবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রে যেমন ফুল, খাদ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে তিনি অনেক সময়ে হিব্রু, পারসিক থেকে নিকটবর্তী শব্দ নিতেন। কিন্তু ইওরোপীয় ও বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ একেবারেই ব্যবহার করতে চাইতেন না। ভাষায় আড়ষ্টতা ছিল। সেটার কারণ সে-সময়ে তেমন কোনও মডেল ছিল না। তবে আমার মনে হয়, তিনি এটাও চাইতেন যে, বাইবেলের বা খ্রিস্টিয় সাহিত্যের একটা ভাষা-ঘরানা তৈরি হোক, যাতে দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল ধর্মসাহিত্যের ভিড়ে বাইবেল ‘আরেকটি’ হয়ে থেকে না যায়। প্রথম দিকে একটু তাড়াও ছিল। যদিও ইয়েটসের সঙ্গে আলোচনায় তিনি— পরিমাণের ওপর গুণমানকে রাখার কথা বলতেন বলে ইয়েটসের জীবনীকাররা বলেন। কিন্তু এসবের মধ্যেই ব্যাপ্টিস্ট সোসাইটি ভাগ হয়ে যায়, এবং ইয়েটসও শারীরিক ও মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা চলে যান। সেখান থেকে আমেরিকা যাত্রা করে বিশ্বের তাবড় ব্যাপ্টিস্ট নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, আলোচনা করে ১৯২৯-এ ভারতে ফেরেন— অনুবাদক হওয়ার উগ্র বাসনা নিয়ে। আর তখনই সমস্যাটি সামনে আসে। ডব্লিউ এস পিয়ার্সকে নিয়ে তিনি নতুন অনুবাদে হাত দেন। রাজা রামমোহন রায় তাঁকে প্রাথমিকভাবে সাহায্য করেছিলেন নিশ্চিতভাবে। দু’জনে একটা সময়ে কাছাকাছি এসেছিলেন। ইয়েটসের আগ্রহ ছিল বেশি। কারণ তিনি শুধু যে রাজার প্রজ্ঞা ও বহুভাষিক জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন তা নয়, তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, রাজা অচিরেই ধর্ম পরিবর্তন করবেন। তিনি তাঁর সহায়ক হতে চেয়েছিলেন। যখন দেখা গেল যে— রামমোহনই উলটে তাঁর মধ্যে ‘ডেইস্ট’ ধারণার প্রভাব বাড়াচ্ছেন, তখন তিনি নিজের থেকেই খানিকটা তফাতে সরে আসেন। তবে এই সম্পর্ক যে বাইবেলের ভাষাটিকে স্বাদু করেছিল এ-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

বাইবেল তো লেখা শেষ হল, দেখা গেল এর খরচ বিপুল। বাইবেল সোসাইটি ছাড়া উপায় নেই। তারাও অনাগ্রহী নয়। তবে অনুবাদ তাদের মনমতো হতে হবে। আর এখানেই বাধল গোল। ইয়েটস একটি কথোপকথনে পরে ঘটনাক্রমটি নিপুণভাবে বলেছেন। ১৮৩০-এর সময় থেকে কলকাতার ব্যাপ্টিস্ট মিশনের প্রেস ব্যস্ত ও বিরাট আকার ধারণ করে। টাকার বেশিরভাগটাই দেয় বাইবেল সোসাইটি। ১৯২৯ ওয়েঙ্গার ইংল্যান্ড গিয়ে ব্যাপ্টিস্টদের থেকে ভালই অনুদান আনতে সক্ষম হয়। ব্যাপ্টিস্টদের ইতিহাসের শুধু কলকাতা ও তার প্রেসের আখ্যান। নানান ভাষার ফন্ট তৈরি করা, বেশ কিছু ভাষায় অনুবাদ ও বিপুল পরিমাণে বাইবেল প্রকাশ সেই প্রেসের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। প্রায় শ্রীরামপুর প্রেসের মাত্রায় ক্যালকাটা ব্যাপ্টিস্টদের প্রেস তৈরি হয়। যদিও কেরির একটি চিঠিতে দেখি, শ্রীরামপুরও সক্রিয়, কিন্তু স্পষ্টতই ইতিহাসের ঢল এখন ক্যালকাটা ব্যাপ্টিস্টদের দিকে হেলে। কলকাতার পরিস্থিতিও এমন যে— তাকে কেন্দ্র করেই সবাই কাজ করতে আগ্রহী। তাই বাইবেল সোসাইটিকে ক্যালকাটা মিশন থেকে অনুদিত বাইবেলের বারোটা কপি পাঠানো হয়। তখনই প্রথম ওই ‘ডোবানো’ শব্দটিকে নিয়ে আপত্তি ওঠে। বাইবেল সোসাইটি নানান মতের খ্রিস্টানদের নিয়ে তৈরি সংগঠন, যাকে বলে একুনেমিকাল। তাঁরা একেকজন একেক রকম ব্যাপ্টিজমে বিশ্বাসী। তাই কোনও একটি মত চাপিয়ে দিলে, তা অন্যদের জন্য আপত্তির কারণ হতে পারে। এখানে ‘ব্যাপ্টিজম’ শব্দটিকেই রাখা হোক। এছাড়া তাদের এই অনুবাদ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। তাঁরা খুশি। কিন্তু বাধ সাধে ব্যাপ্টিস্টরা। আর হাজার হোক, ইয়েটসও ব্যাপ্টিস্ট। তিনি বিষয়টা তাঁর ভাষাচর্চা ও অনুবাদের গুরু কেরির কাছে নিয়ে যান। কিন্তু ব্যাপ্টিস্টরা অনড়। তাঁরা ন’পয়েন্টের একটি চিঠি দেন এটা জানিয়ে, কেন এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। তারপর প্রায় পাঁচ বছর ধরে দড়ি টানাটানি চলে। এদিকে অনুবাদ প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে। ইয়েটসের জবানিতে পাই, কেরিও কোনও শব্দঋণের বিপক্ষে ছিলেন। এই শব্দটি তাঁর পাঠকদের কাছে কোনওভাবেই অর্থবহ হবে না। তাঁরা এই শব্দটিকে চেনেনই না। বরং নদীতে নিমজ্জন একটি ধর্মীয় শুদ্ধিকরণের কাজ করে, এমন ধারণা হিন্দুদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান। ফলে এর আচারিক গুরুত্বটি তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছবে। ইয়েটস এও বলেন যে, বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষায় যাঁরা অনুবাদের কাজ করছিলেন, যেমন হেনরি মার্টিন, তাঁরা সকলেই পার্সি বা হিন্দুস্তানীতে শব্দটি ভাষান্তর করেছেন, সরাসরি ব্যবহার করেননি, একজন ছাড়া, যিনি ইয়েটসের ভাষায় – ‘হিব্রু বা গ্রীক কোনওটাই জানতেন না।’ এই একজন অবশ্য জন এলার্টন। তাঁর করা ১৯১১ সালের সুসমাচারের অনুবাদে আমরা শব্দটিকে পাই এভাবে— ‘আমি তোমারদিগের মন ফিরাণের প্রতি জলেতে বাপটাইজ করিতেছি বটে কিন্তু যিনি আমার পশ্চাতে আসিতেছেন তিনি আমা হইতে মহৎ আছেন তাঁহার জুতা ভিতে আমি যোগ্য নহি তিনি তোমারদিগের ধর্ম্মাত্মাতে ও অগ্নিতে বাপটাইজ করিবেন।’

ইয়েটস বলেছেন, কেরি কোনওদিন তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরননি। কোনওদিনও নয়। প্রথম থেক শেষ সংস্করণ অবধি তিনি একই শব্দ ব্যবহার করেন। এদিকে বাইবেল সোসাইটি অনড়। তাঁরা বলেন বৃহত্তর কমিটির কথা ভেবে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হলেন যে, যদি শব্দটির পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে আর্থিক সহায়তায় তাঁরা অপারগ। ইয়েটস ও ওয়েঙ্গার নিজেদের এই বিতর্ক থেকে সরিয়ে নেন। তাঁরা এটা একেবারেই সোসাইটির পরিচালন সমিতির হাতে ছেড়ে দেন। এবং সমিতি সেটা মেনেও নেন। তাঁরা বলেন, যদিও তাঁরা এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নয়, তবে শান্তি ও অনুবাদের বৃহত্তর প্রয়োজনের কথা ভেবে তাঁরা এটা মেনে নিলেন। লক্ষণীয় ব্যপ্টিস্টরা এর মধ্যে দিয়ে শ্রীরামপুরের সঙ্গে সংস্রব একরকম চুকিয়ে ফেললেন। এর পর ১৯৪০ থেকে ক্যালকাটা ব্যপ্টিস্ট সোসাইটি, বাইবেল-অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে, আর তার অনেকটাই বাইবেল সোসাইটির আর্থিক সহায়তায় এবং তাদের ক্রমবর্ধমান বিপণন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে। এখন বাইবেল সোসাইটি দু’টি সম্পূর্ণ বাংলা বাইবেল প্রকাশ করে। পুরাতন বাইবেল আর ১৯৮০ তে প্রকাশিত চলিত ভাষায় বাইবেল। নানা কারণে পুরাতনটাই জনপ্রিয় বেশি। যদিও কেউ-কেউ এটিকে কেরীর অনুবাদ মনে করেন (এবং বলেনও) এটি আসলে উইলিয়ম ইয়েটসেরই অনুবাদ, তবে বানান ও ব্যকরণের আধুনিকিকরণ সময়ে-সময়ে চলতে থাকে। কেরীর সঙ্গে এর পার্থক্য স্পষ্ট— ‘আমি আত্মাকে কপোতের ন্যায় স্বর্গ হইতে নামিয়া উহার উপরে অবস্থিত করিতে দেখিলাম। আর আমি উহাকে চিনিতাম না, কিন্তু যিনি জলে বাপ্তাইজ করিতে আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, তিনিই আমাকে কহিয়াছিলেন, যাহার উপরে আত্মাকে নামিয়া অবস্থিতি করিতে দেখিবা, তিনিই পবিত্র আত্মাতে বাপ্তাইজ করিবেন। আর আমি তাহা দেখিয়াছি, এবং উনি যে ঈশ্বরের পুত্র, ইহার সাক্ষ্য দিয়াছি।’

ভারতের স্বাধীনতার পরে উপনিবেশের বজ্রআটুনি সরে গেলে, ভারতীয়রা ততাঁদের মতন করে বাইবেলকে সাজিয়েছেন। নানান সোসাইটি, সংঘ, মণ্ডলীর এবং কখনও-কখনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাইবেল অনুবাদ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে অথবা ছোট-ছোট অংশে। ছোটদের জন্য, রোজকার প্রার্থনার জন্য, বাংলার মধ্যে নানা উপভাষায়, আঞ্চলদিক ভাষায় বাইবেল এখন লভ্য। কিন্তু ব্যাপ্টিজম নিয়ে অনিশ্চয়তা যায়নি। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এখনও ‘বাপ্তিসম’ শব্দটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে। তবে ভারতীয় অনুবাদকরা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যেমন অরবিন্দ দে বাংলা বাইবেলে একবারে দ্বিধাহীন ভাবে দীক্ষা শব্দটিকে নিয়ে এসেছেন তাইই নয়, এর পাদটীকায় রূপ-প্রত্যয়-সহ শব্দটির সংস্কৃত উৎস উদ্ধৃত করে, সেটিকে একেবারে ভারতীয় আধ্যাত্মচর্চার মূলস্রোতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখনও বাইবেল সোসাইটির অনুবাদটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। গিডিয়নরাও এই অনুবাদটিই ব্যবহার করেন। ‘ব্যাপ্টিজম’ শব্দটিও বাংলা ভাষায় মিশে গেছে একেবারে। যদিও এর আড়ালে রয়ে গেছে সম্প্রদায়, সম্পর্ক, আন্তর্জাতিকপুঁজির পারস্পরিক সম্পর্কের এক প্রায় অজানা অধ্যায়। বাংলা বাইবেল আর পুঁজির সম্পর্ক অতি চমকপ্রদ। আমরা এর আরেকটি দিক নিয়ে পরের অংশে আলোচনা করব।