২০১৪ থেকে ২০২৫— এই এক দশকের বেশি সময়টিকে ভারতের প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বাঁকবদল ঘটানো পর্বগুলোর একটি বলা যায়। দক্ষিণপন্থী, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার এক ব্যাপক প্রকল্প কাঁধে নিয়েছে, রীতিমতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পই বলা চলে তাকে। প্রকল্পটা কী? ভারত নামক দেশটার পরিচিতি, সত্তা ও এত বছর ধরে রাষ্ট্রের যে গঠনতন্ত্র গড়ে উঠেছে— তা আমূল বদলে ফেলার প্রকল্প। দিল্লির সরকার যে সময়কে ‘নতুন ভারত’ বা নয়া ভারত-এর সময়কাল বলে আখ্যা দেয়, সেই সময়কালেই এদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়, নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচন এবং নাগরিকত্বের ধারণার সংজ্ঞা বদলে যাওয়া— এই তিনটি প্রবণতা দেশ-বিদেশের মানবাধিকার-সচেতন মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এই প্রতিবেদনে গত এক দশকে ভারতের মানবাধিকারের মানচিত্রের একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। মোদ্দায়, এই সময়ে যে পরিবর্তনগুলি দেখা গেছে, তা যে-কোনও উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের ভেতর ঘটে চলা কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম নয়; বরং তা এমনই এক কাঠামোগত পরিবর্তন—যাকে এখন বহু গবেষক ও বৈশ্বিক সূচক নির্ধারকরা ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ (electoral autocracy) হিসেবে চিহ্নিত করছে। এই পরিবর্তনের লক্ষণ—বিরোধিতা দমন করতে আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, সন্ত্রাসদমন আইনগুলির অপব্যবহার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষয়, বিচারব্যবস্থার ওপর বিভিন্ন নির্বাহী ক্ষমতার আধিপত্য এবং অবশ্যই, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির উত্থান, যা বিশেষ করে দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাপী নানা ডেটাসেট, আইনসংগত নথি, আদালতের রায় এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলা থেকে শুরু করে ‘বুলডোজার জাস্টিস’ ও মণিপুর সংকট— এরকম একাধিক কেস স্টাডির আলোকে এই প্রতিবেদন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতের মানবাধিকারের পরিসরের একটি নথিবদ্ধ ছবি তুলে ধরতে চাইছে।
আরও পড়ুন: এসআইআর নিয়ে শাসক যা চেয়েছিল, এবং যা ঘটছে! লিখছেন শুভাশিস মৈত্র…
অবক্ষয়ের সংখ্যাতত্ত্ব: বৈশ্বিক সূচক (২০২৪–২০২৫)
স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরিমাপ বলছে, ভারতের গণতান্ত্রিক অবস্থান ধারাবাহিকভাবে নেমে এসেছে— এমনকী, ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর বহু দেশের নিচে তার অবস্থান।
ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক ভিত্তি ছিল ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সূচকগুলো ধারাবাহিকভাবে আমাদের দেশকে নিচের দিকে নামিয়ে এনেছে। ২০২৪ সালে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ভারত ছিল ১৫৯তম— নেপাল (৭৪তম) ও শ্রীলঙ্কা (১৫০তম)-র নিচে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখেও, নেপালের সঙ্গে ভারতের দমবন্ধ পরিবেশের সঙ্গে প্রবল বৈপরীত্য তৈরি হয়ে রয়েছে। ‘V-Dem’ শ্রীলঙ্কা ও নেপালকে ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে ভারতকে রাখা হয়েছে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ শ্রেণিতে। অর্থাৎ, শত নৈরাজ্য সত্ত্বেও, এই সমস্ত দেশের মৌলিক গণতান্ত্রিক পরিসরটুকু অন্তত ভারতের চেয়ে বেশি অক্ষুণ্ণ। এই সমীক্ষাগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক।
ফ্রিডম হাউস
‘ফ্রিডম হাউস’ তাদের ২০২৪ সালের রিপোর্টে ভারতকে ‘আংশিক স্বাধীন’ (Partly Free) শ্রেণিতে রেখেছে— স্কোর, ৬৩/১০০। ২০১৪ সালে এই স্কোর ছিল ৭৭, এবং ভারত ছিল ‘স্বাধীন’ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক অধিকারকে রাখা হয়েছে ৪০-এর মধ্যে ৩১-এ। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এদেশে ক্রমশ যেভাবে অপরাধ হয়ে উঠেছে, যেভাবে বিরোধী নেতাদের হেনস্থা বাড়ছে, তার সরাসরি প্রতিফলন এই সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। আবার, নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে ৬০-এর মধ্যে ৩২-এ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার অধিকার ও সারস্বত চর্চার স্বাধীনতা যেভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এদেশে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই প্রতিবেদনে।
স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভারতে গণতন্ত্রের আপাত কাঠামো থাকলেও তার ভিত অনেকটাই ফাঁপা হয়ে গেছে— মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি, সাংবাদিক ও এনজিও-দের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ, বিরোধী নেতা ও সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা ইত্যাদিই এর প্রধান কারণ।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স
২০২৫ সালে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (RSF) ভারতে সংবাদমাধ্যমের পরিস্থিতিকে ‘কঠিন’ থেকে ‘অত্যন্ত সংকটপূর্ণ’— এই পর্যায়ে রেখেছে। র্যাঙ্ক ১৫১। সংখ্যার দিক থেকে একটু উন্নতি হলেও (২০২৪-এ ছিল ১৫৯), এই উন্নতি বিভ্রান্তিকর বলে RSF জানিয়েছে, তারা একথাও বলতে ভোলেনি, ভারতের পরিস্থিতি এখন গুরুতর। উল্লেখযোগ্য, ২০১৪ সালে ভারত ছিল ১৪০তম— দীর্ঘমেয়াদি অবনমন এখান থেকেই স্পষ্ট।
V-Dem (ভ্যারাইটিজ অফ ডেমোক্রেসি)
গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান V-Dem ২০২৪ ও ২০২৫— দুই বছরেই ভারতকে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে— ২০১৮ থেকে এই অবস্থান অপরিবর্তিত। সবচেয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন বোধহয় এটিই। ভারত এখন সেইসব দেশের সমান্তরালে, যেখানে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার দরুন, নির্বাচন কেবলই প্রহসনমাত্র। ভারতকে বিশ্বের গণতন্ত্রের নিরিখে সর্বোচ্চ স্বৈরাচারীদের তালিকায় রাখা হয়েছে এই মুহূর্তে।
২০২৫ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে: দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক স্বৈরতান্ত্রিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের ৯৩% মানুষ এখন নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে বাস করছে— মূলত ভারতের কারণেই। ভারতের ‘Liberal Democracy Index’ গত দশকে পরিসংখ্যানের নিক্তিতে উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে গেছে— বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে।
হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্স
ক্যাটো ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের মানব-স্বাধীনতা সূচকে ভারত ১১০তম— ২০১৪ সালে যা ছিল ৮৭তম।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স
২০২৪ সালে ভারত ১২৭ দেশের মধ্যে ১০৫তম— ‘গুরুতর’ শ্রেণিতে। সরকার যদিও এই সূচককে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সরকারের পাল্টা-বয়ান
ভারত সরকার কিন্তু কূটনৈতিকভাবে এবং বৌদ্ধিকভাবে এসব সূচককে প্রবলভাবে চ্যালেঞ্জ করে আসছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর যেমন এগুলোকে ‘ভণ্ডামি’, ‘ঔপনিবেশিক মনোভাব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ২০২৪-২৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রক বারবার যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট ও US Commission on International Religious Freedom (USCIRF)-এর ভারতের বিরুদ্ধে করা সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের প্রতিবয়ান— ভারত পশ্চিমা মানদণ্ডে গণতন্ত্রকে মাপে না, বরং ‘বিশ্বগুরু’ বা ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’-র ধারণাকে সামনে রাখে। ২০২৪ সালে সরকার দেশীয় থিংক-ট্যাঙ্ককে দিয়ে একটি ভারত-কেন্দ্রিক গণতন্ত্র সূচক তৈরির উদ্যোগ পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে— যেখানে কিনা অধিকার নয়, পরিষেবা ও উন্নয়নই হবে প্রধান মানদণ্ড।
প্রতিষ্ঠানের সংকট
‘এনএইচআরসি’-র বিশ্বাসযোগ্যতায় ধাক্কা
ভারতের আইনি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব কমে যাচ্ছে যে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) ‘A’ মানের স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া। জাতিসংঘ ও ‘GANHRI’ (Global Alliance of National Human Rights Institutions) এই পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বহুমতের অভাব এবং পুলিশের ওপর অতিনির্ভরতা এর প্রধান কারণ। ‘B’ মানে নেমে গেলে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিষদে ভোটাধিকারের অধিকারও হারাতে হতে পারে।
বিচারব্যবস্থা: সংশোধন ও সীমাবদ্ধতার দ্বন্দ্ব
বিলকিস বানো রায় (২০২৪): গুজরাত সরকার যে ১১ জন দণ্ডিতের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করে তা বাতিল করতে হয় অবশেষে। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় জানায়, সরকার তাদের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে বিচারব্যবস্থাকে বিকৃত করেছে এক্ষেত্রে।
জি.এন. সাইবাবা মামলা: দশ বছরের কারাবাসের পর ২০২৪ সালে মুক্তি পেলেও, বিচারব্যবস্থার বিলম্বই শেষ পর্যন্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল। Unlawful Activities (Prevention) Act বা (UAPA)-র সঙ্গে লড়াই করে শেষমেশ জয় তিনি পেলেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেল। এই প্রক্রিয়াই যেন শাস্তিস্বরূপ হয়ে রইল ওঁর জন্য।
ফাদার স্ট্যান স্বামী: বিচারের আগেই UAPA-র অধীনে দীর্ঘ কারাবাসে ২০২১ সালে মৃত্যু— ভারতের মানবাধিকার সংকটের আরেক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।


দেশের সীমার বাইরেও নিপীড়ন
কানাডায় হরদীপ সিং নিয্জারের হত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রে গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুনকে হত্যা-চক্রান্তে ভারতীয় এজেন্টরা অভিযুক্ত হওয়ার পর, ভারতের মানবাধিকারের রেকর্ডে নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক নজরদারি শুরু হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২৪ সালের রিপোর্টে এ-বিষয়ে পৃথক অধ্যায় রেখেছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকারের সংকোচন
সংবাদমাধ্যমের দমন
২০১৪–২৪ সালে ২৮ সাংবাদিক নিহত। গোদি মিডিয়া— অর্থাৎ সরকারপন্থী সম্প্রচারের উত্থান স্বাধীন সাংবাদিকতার জায়গা সংকুচিত করেছে।
পেগাসাস নজরদারি
২০২৩ সালের শেষ দিকে ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি নিশ্চিত করে— পেগাসাস এখনও সাংবাদিকদের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে। এই রিপোর্টের সহ-লেখক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার ডিভাইসেও নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ে।
ইন্টারনেট শাটডাউন
ভারত পাঁচ বছর ধরে বিশ্বের সর্বাধিক ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার দেশ।
২০২৪ সালে প্রায় ৬০টি শাটডাউন
মণিপুরে ৫,০০০ ঘণ্টারও বেশি সময় নেটবন্দি— যা ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম। ‘টেলিযোগাযোগ আইন ২০২৩’ সরকারকে ‘জননিরাপত্তা’-র নামে টেলিকম-কাঠামো দখলের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে— যা কার্যত এখন ভিন্নমতকে দমন করতে ব্যবহার হচ্ছে।
ডিজিটাল ও সম্প্রচার আইন
Broadcasting Services (Regulation) Bill 2024: ইউটিউবার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ওপর সম্প্রচারমাধ্যমের মতো নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। DPDP Act 2023-এর জন্য আরটিআই আইন ক্রমশ দুর্বল হয়েছে— সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আইনের অস্ত্রায়ণ: শাস্তি হিসেবে প্রক্রিয়া
২০২৪–২৫ সালে সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় দমন বিশেষভাবে বেড়েছে। UAPA এখন কার্যত অপরাধ প্রমাণের আগেই অপরাধীর মতো আচরণ চাপিয়ে দেয়। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ১৬ জন এখনও বছরের পর বছর কারাবন্দি। উমর খালিদের জামিন বারবার খারিজ হয়েছে। প্রবীর পুরকায়স্থ— নিউজক্লিকের সম্পাদক— সাত মাসের বেশি আটক; নানা মামলা তাঁর বিরুদ্ধে, বিশেষত UAPA ও PMLA-র যত্রতত্র ব্যবহার তো আছেই।
এনজিও দমন
২০১৫ সাল থেকে ১৬,০০০-এর বেশি এনজিও-র লাইসেন্স বাতিল। CPR-কে কার্যত অচল করে দেওয়া হয়েছে।
নতুন ফৌজদারি বিধি (BNS)
‘সেডিশন’ শব্দটি বাদ দেওয়া হলেও ১৫২ ধারায় ‘সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা’-র নামে একই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা ফিরেছে।
রাজ্যস্তরের দমন
উত্তরাখণ্ডে ইউনিফর্ম সিভিল কোড: লিভ-ইন সম্পর্ক নথিভুক্ত না করলে জেল—ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ।
‘বুলডোজার জাস্টিস’: মুসলিমদের বিরুদ্ধে বেছে বেছে বাড়ি ধ্বংস— অ্যামনেস্টি ১২৮টির নথি করেছে। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রথাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে।
নয়া ভারত’ শক্তি ও ঐক্যের যে বয়ান তুলে ধরে, তার উল্টো ছবিটাই মিলছে বাস্তবে। সংবাদমাধ্যমের স্তব্ধতা, নাগরিক সমাজের ক্ষয় এবং পরিচয়-ভিত্তিক বিভাজন— এসব মিলিয়ে রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্কের মৌলিক ভিত্তিই বদলে যেতে শুরু করেছে।
শ্রম ও পরিবেশ সংকট
ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এখন আরও ঘোরতর বাস্তব; ২০১৯–২৪ সময়ে প্রায় ৩০০ মৃত্যু ঘটেছে এর দরুন। ছত্তিসগড়ের হাসদেও অরণ্যে আদিবাসীদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে খনির সম্প্রসারণ ঘটেছে। সহস্রাধিক গাছ কাটা হয়েছে। আর সংঘাতের নতুন চিহ্ন এখন সোনম ওয়াংচুক। ২০২৫ সালে লাদাখের সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে ‘দিল্লি চলো’ পদযাত্রার সময় দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হন ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী সোনম ওয়াংচুক। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকেও রাজধানীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া— রাষ্ট্রীয় দমনের নতুন দৃষ্টান্ত।
উপসংহার: ব্যতিক্রমের স্বাভাবিকীকরণ
২০১৫–২০২৫ দশক ভারতকে এমন এক সংকটময় মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে ‘ব্যতিক্রমী অবস্থা’-ই ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আইন, ডিজিটাল পরিসর ও প্রশাসনিক বিস্তার মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কেবল ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষয়ের নয়— বরং দেশের সরকার ও তার ক্ষমতাকে সাংবিধানিক জবাবদিহির হাত থেকে কাঠামোগতভাবেই মুক্ত করে দিচ্ছে।
‘নয়া ভারত’ শক্তি ও ঐক্যের যে বয়ান তুলে ধরে, তার উল্টো ছবিটাই মিলছে বাস্তবে। সংবাদমাধ্যমের স্তব্ধতা, নাগরিক সমাজের ক্ষয় এবং পরিচয়-ভিত্তিক বিভাজন— এসব মিলিয়ে রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্কের মৌলিক ভিত্তিই বদলে যেতে শুরু করেছে।
আজ ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনার টিকে থাকা আর কেবল প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর নির্ভরশীল নয়— কারণ সেগুলির অনেকটাই আপসকামী হয়ে পড়েছে। এখন আশা টিকে আছে নাগরিকদের জেদি মানবিক প্রতিরোধেই, যাঁরা এখনও সাংবিধানিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিকে জীবিত রাখার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।



