গান ঈশ্বরের আশীর্বাদ। যেমন ফুল, যেমন শিশু। কিন্তু সবকিছুরই তো জায়গা, বেজায়গা আছে। আপনি হদ্দ ব্যাচেলর, হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখলেন, একটি শিশু আপনার ঘরে বসে, আপনার দিকে তাকিয়ে— খিলখিলিয়ে হাসছে, আপনি নিশ্চয়ই পুলকিত হয়ে, দালের মেহেন্দির মতো, ‘তুনাক তুনাক তুন’ নাচবেন না। বা আপনার ফুল ভাল লাগে— এই যুক্তিতে যদি আমি, গাঁদাফুলের বিরিয়ানি আর রজনীগন্ধার রেজালা আপনাকে খাওয়াতে চাই, আপনি কি মেনে নেবেন?
ঠিক তেমনই, গান কখন যে এসে গুঁতিয়ে দেবে, তার ঠিক নেই। আমাদের স্কুলের বন্ধু রতন যেমন, সে এখন আমাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন। ওর কানে কে গুজব রটিয়েছে, ও ভাল গায়ক। এবং আমরা সবাই একমত। দেখুন, গানের সুরই তো একমাত্র জিনিস নয়। রতনের প্রত্যেকটা গানের কথা মুখস্থ। ও যখন গাইবে তখন আপনি চমকে- চমকে উঠবেন। কথা আপনি ঠাওর করতে পারছেন, কিন্তু সুর শুনে বোঝার জো নেই, এটা সেই গান। রতনের গানের সুর, সম্পূর্ণ রতনের। আহা, ও যখন, ‘ম্যায় নেহি মাখন খাইয়ো’ বলে গিটকিরি লাগায়, ভয় করে, কৃষ্ণর না কোলস্টোরল বেড়ে যায়। ‘সন্দেশ আতে হ্যায়’ বলে যখন গলা ছাড়ে, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, ‘বর্ডার’ ছবির পর, সানি দেওল এত রেগে থাকে কেন।
এখন বিষয়টা অনেক কমেছে, আমাদের ছোটবেলায় অনেক বেশি ছিল। বাড়িতে কেউ এলে, অতিথিদের সামনে শিশুর প্রতিভা প্রদর্শন। সেখানে বাচ্চা বা অতিথিদের ইচ্ছে গৌণ, বাবা মার ইচ্ছেটাই সব। সেরকমই একটি বাড়িতে শিব্রাম গেছেন সিঙারা, মিষ্টি খেতে। জোর করে একটি বাচ্চাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, শিব্রামের সামনে গান গাইবার জন্য, এদিকে শিব্রামের তখন, গান শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, অতগুলো মিষ্টির মায়া ত্যাগ করেও, উঠতে পারছেন না। শিব্রাম কিছু না বলে, শুধু শিশুটির দিকে তাকিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলেন। কেউ বুঝতেও পারল না, বাচ্চাটা কেন হঠাৎ হারমোনিয়াম ফেলে দৌড় দিল, শিব্রাম মিষ্টিতে মন দিলেন।
আসলে কিছু লোকের গান পায়, আর তারা তখন আউলা হয়ে যায়। তাদের তখন ধরে রাখা যায় না। তারা গান শোনাবে। শোনাবেই গান তখন। হোক না আপনি মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছেন অথবা, ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে বেরিয়েছেন, সে যদি আপনাকে বাগে পায়, গান আপনাকে শুনতে হবে। ধরুন কোনও চূড়ান্ত ক্ষমতাবানের শিল্পী মন, কিন্তু মন শিল্পীর হলেই গলায় তা থাকতে হবে, তার মানে নেই। যেমন আমার মন ক্রিকেটারের, আমি টিভিতে দেখে স্পষ্ট বলে দেব, বিরাটের টেকনিক্যাল ত্রুটি, শুনলে মনে হবে, রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে রোজ আধঘণ্টা আলোচনা হয় এসব নিয়ে। কিন্তু ব্যাট হাতে দিন, তখন আমি প্রভুদেবা, নাচে ভুবন ভরিয়ে দেবে, ভেবেছিল একটি পাখি। তা, তেমন-তেমন ক্ষমতাধর কোনও নেতা বা মন্ত্রী যে সম্পূর্ণ বেসুরো, তা কি কেউ তাঁদের বলতে পারে না? এত ভয় কীসের? কী হারানোর? এঁদের সঙ্গে মঞ্চে হয়তো দিব্য তাল মেলাবেন অনেক প্রথিতযশাও। ওই সুর শুনে অটোটিউন জিয়াগঞ্জে পালিয়ে যাবে, এতজন শিল্পীর শিল্পবোধে তা ধরা পড়বে না? এছাড়াও নিত্যনতুন উৎপাত লেগেই আছে, ধরা যাক কোনও বিশাল এক সংস্থার কর্ণধার, তাকে মঞ্চে উঠে ছাগলদাড়ি নাচিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের শ্রাদ্ধ করতে কে বলেছে, কে জানে? অ্যাপ্রেইজালের চক্করে কেউ হয়তো ভুলভাল বুঝিয়েছে, উনি তা খেয়ে গিয়েছেন।

আর ওই যে বললাম, গান যার ভেতরে আছে, সে একবার প্রশ্রয় পেলে, নদীর মতো অবারিত, তাকে আটকায়, সাধ্য কার?
এইবার আসি নিজের গল্পে, শীতকালে পেটের দায়ে আমাদের ফাংশন করতে যেতে হয়। সেখানকার দর্শক ক্ষমাসুন্দর হয়, ওরা ভাবেই না, একজন অভিনেতা মঞ্চে উঠে, অরিজিত সিং হয়ে যাবে। তো একটু-আধটু ভুল ক্ষমা করে দেয়। আর আমি ঠিকঠাক গেয়ে দিই, কিন্তু অবশ্যই সেইসব গান, যেগুলো প্র্যাক্টিস করা।
বছর দু’য়েক আগের ঘটনা, একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছি শো করতে। বোধহয় সেখানে বেশি কেউ যায়নি আগে বুঝলেন, না হলে, আমাকে নিয়ে সে কী আকুলি-বিকুলি! যেন আমি অর্ধেক দেব, অর্ধেক শাহরুখ খান। হাজার-হাজার মাথা, আমার নাম নিয়ে চিৎকার করছে। গান শুরু করলাম, পরপর দারুণ হতে থাকল গানগুলো, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল, চিৎকার আর উৎসাহ। এই করে আমার স্টকের গান শেষ, ওদিকে উৎসাহের কোনও কমতি নেই। ‘আরও চাই আরও চাই’ বলে দাবি আসতে লাগল। হাজার হোক মানুষ তো, দেব আর শাহরুখ খানের সঙ্গে ভিতরে অরিজিতের আত্মবিশ্বাস চলে এল, অখিলবন্ধু ঘোষের, ‘ও দয়াল বিচার করো’ আমার অত্যন্ত প্রিয় গান, তার উপর তালপাতার সেপাইয়ের কাভারটাও সে-সময়ে বারবার শুনছি। মনে হল, গাইলে আজ এইটাই গাইব। ধরলাম। সে যে কী ধরলাম, সাতটা সুর পাগলা ষাঁড়ের মতো সাত দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই দয়াল আর বিচার করতে পারবে না, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই শীতেও, মিউজিশিয়ান দাদার কপালে ঘাম, অনেক হাতড়েও, সে সুর খুঁজে পাচ্ছে না, ড্রামের দাদা কাঠি দিয়ে কান খোচাচ্ছে, কারণ তালের কোনও প্রশ্নই নেই। উদ্যোক্তার মুখ শুকিয়ে আমসি, আমার সহকর্মী এমন ভাব করছে— যেন আমায় চেনেই না। সেবার খুব জোর রক্ষা পেয়েছিলাম। তারপর দিব্যি কেটে বলেছি, জীবনে আর যাই-ই খাই, মঞ্চে উঠে, বার খাব না।