ভক্তপুর ভয়ংকর
টক করে চক্কর লেগে গেল মাথায়!
এ আবার কেমন ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক?
খেতে এসেছি কাঠমান্ডুর জমজমাট এলাকা থামেলে। খেতে এসেছি না বলে, বলা ভাল, খাবারের ছবি তুলতে এসেছি। অথেন্টিক নেপালি থালি। শুনেছি, ঝালমশলা বেশি খায় এরা। সেই ভয়ে আমি গত দু’দিন নুডলস আর মোমোর ওপরই ছিলাম। ক্যামেরাম্যান হাল্কা বিদ্রোহ করলেও বেশি পাত্তা দিইনি, বলেছি, কাজ করতে এসে অসুস্থ হলে মুশকিল! কিন্তু আজ আর উপায় নেই, ট্রাভেল শোয়ে সেই জায়গার খাবারদাবারও দেখতে চান দর্শক।
থামেলে প্রচুর দোকানপাট, হোটেল, রেস্তরাঁ, নাইট ক্লাব, আর আছে ক্যাসিনো। আমরা ট্যাক্সিওয়ালাকে বলেছিলাম, একটা ভাল নেপালি খাবারের রেস্তরাঁয় নিয়ে যেতে। দোতলার ওপর এই রেস্তরাঁটার দরজা ঠেলে ঢুকেই বুঝেছি, মেনু কার্ডের ডানদিকটা বেশ ভারী। চমৎকার সাজানো, বিদেশিরা যাতে স্বাদ পায় খাঁটি নেপালের। সিলিং থেকে ঝুলছে লম্বা লম্বা সিল্কের থাঙ্কা। অনেকটা বাংলার পটচিত্রের মতো। বৌদ্ধধর্মের নানা মোটিফ আঁকা তিব্বতি শিল্পকর্ম, নেপাল-ভুটানে দেখা যায়। পাহাড়ি সুরে হালকা বাঁশি বাজছে। খেতে বসার ব্যবস্থা মাটিতে জমকালো আসনে, সামনে কারুকাজ করা নিচু চৌকিটাই টেবিল। ভারতীয় অতিথি দেখে এবং টিভি ক্যামেরা চলবে জেনে খুবই আপ্লুত হয়ে পড়লেন ম্যানেজার। বসামাত্র ওয়েটার টেবিলে রাখল দুটো গ্লাস। কম্পলিমেন্টারি ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক। ক্যামেরাম্যান নির্দেশ দিল, ‘একটা চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াবে, তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করবে কোথায় এসেছ।’
বড় করেই চুমুক দিলাম, গলায় বেশ ঝাঁঝ লাগল স্পিরিটের, গন্ধটাও বেশ কড়া। কিন্তু ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক তো সাধারণত নন-অ্যালকোহলিক হয়! অতশত না ভেবেই উঠে দাঁড়াতে গেলাম। ঝামেলাটা হল এখানেই। মাথাটা ঘুরে গেল। আবার বসে পড়লাম। আগে জানতে হবে, এটা কী? ওয়েটার জানাল, এটা নেপালের বিখ্যাত পানীয়— রকসি। ভাত বা বাজরা থেকে তৈরি হয়, অনেকে বাড়িতেও তৈরি করে। উৎসবে এই সুরা মাস্ট। যত দূর বুঝলাম, সাঁওতালদের ভাত পচানো হাঁড়িয়ার একটা সফিস্টিকেটেড সংস্করণ পরিবেশন করা হয়েছে। অভ্যেস না থাকলে যা হয়, মাথা ঘুরে গেছে। সামান্য খেয়েছিলাম, তাই একটু পরেই ঠিক হয়ে গেল। গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ভান করে খুব প্রশংসা করলাম ওয়েলকাম ড্রিঙ্কের, অবশ্যই সুরার অংশটা বাদ দিয়ে। কোনও নেশার বস্তুকে প্রোমোট করার প্রশ্নই আসে না।

খাবারটা কিন্তু আহামরি কিছু নয়। উত্তর ভারতে যাকে কালি ডাল বলে, বাংলায় মাসকলাই, সেটাই খুব মশলা দিয়ে রাঁধা। সঙ্গে ভাত, সবজি আর টমেটোর চাটনি। এটাই নেপালের ‘থাকালি’ খানা। ‘থাকালি’ নামে উপজাতি আছে নেপালে, সম্ভবত তাদের থেকেই এসেছে এই খাবারটা। এমনিতে ডাল-ভাত নেপালিদের ঘরোয়া খাবার। আমিষ অবশ্যই খায় এরা, তবে বাঙালিদের মতো বিশেষ কায়দার রান্নায় বোধহয় তেমন খ্যাতি নেই এদের। পথের খাবার হিসেবে মোমো আর থুকপার ছড়াছড়ি। আর খেলাম সেকুয়া বলে একটা খাবার। চিকেন আর মাটন— দু’রকমই পাওয়া যায়। নানারকম মশলা আর হার্ব দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা মাংস কাঠের আগুনে গ্রিল করে দেয়। শিককাবাবের মতো। দু-একটা দোকানে জিলিপি সাজানো দেখে লোভ হল। হাজার হোক বাঙালি তো, মিষ্টির প্রতি একটা টান থেকেই যায়। দেখলাম, এরা জিলিপিকে ‘জেরি’ বলে। অবশ্যই অবাঙালি স্টাইলের কেসর দেওয়া কড়া মিষ্টি জিলিপি সেটা। বরং অন্যরকম লাগল দুধ, গুড়, ঘি দিয়ে তৈরি মিষ্টি পোস্টিকান, ওপরে নারকেল কোরা, খেজুর, পেস্তাবাদাম ছড়ানো।
থাকালি খালি খাওয়ার পর আমাদের গন্তব্য ক্যাসিনো। নিজেদের দেশে কখনও ক্যাসিনো দেখিনি, তাই বেশ উত্তেজিত ছিলাম ক্যাসিনোয় ঢুকব বলে। কাঠমান্ডুতে আমার পরিচিত এক বাঙালি সাংবাদিক সাবধান করে দিয়েছিল, ‘বড় হোটেলের ক্যাসিনো ছাড়া যেও না। গেম পার্লারের আড়ালে ছোটখাটো কিছু ক্যাসিনো চলে, কিন্তু সেসব জায়গায় জুয়ার বখরা নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে। মারামারি, খুনোখুনি হয় হামেশা।’ সেই মেয়েটিই এক পাঁচতারা হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের শ্যুটিং-এর পারমিশন করিয়ে দিয়েছিল। সেই মধ্যরাতে বেশ রোমহর্ষক লেগেছিল ক্যাসিনোর টেবিলে টেবিলে টাকার খেলা দেখে, কিন্তু অনেক বছর পর ক্যাসিনোর বিশ্ব-রাজধানী বলে বিখ্যাত সিন সিটি লাস ভেগাসে গিয়ে বুঝেছিলাম, কাঠমান্ডু নেহাত নিরামিষ। কার্ড, পোকার আর রুলেট খেলার চেয়ে বেশি কিছু নেই।

খেলা যাই হোক, উত্তেজনা তো কম নয়! কিন্তু যাঁরা খেলছেন, আর যাঁরা চারপাশে ভিড় করে দেখছেন, সবাই বিদেশি। নেপালিদের ক্যাসিনোতে ঢোকা নিষিদ্ধ। এন্ট্রি ফি নেই যখন, পাসপোর্ট দেখিয়ে অনেক বিদেশি অতিথিই (পড়ুন, ভারতীয় আর বাংলাদেশি) ক্যাসিনোয় আসেন খেলা দেখার জন্য আর আলো-চমকানো মেশিনের সামনে গ্লাস হাতে পোজ মেরে বসে ছবি তোলার জন্য। আর-একটা জিনিস দেখে বেশ অবাক হলাম। অনেকেরই হাতে-গলায় মোটা মোটা সোনার গয়না। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, নেপালে সোনা মোটেই সস্তা নয়। আসলে নেপাল হল ভারতে সোনা চালানের বড় ট্রানজিট পয়েন্ট।
আন্তর্জাতিক স্তরে পশুপ্রেমীরা বছরের পর বছর প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন সব করছেন, কিন্তু কিছুই বদলাচ্ছে না। নেপাল জুড়ে মন্দিরে-মন্দিরে পশুবলি চলছেই। একটা-দুটো নয়, একবারে কয়েক হাজার। কাঠমান্ডু থেকে অল্প দূরত্বে দুই প্রাচীন নগরী আছে— পাটান আর ভক্তপুর। মন্দিরনগরী বলা যায়। কী অসামান্য স্থাপত্য, কী সূক্ষ্ম কারুকাজ! কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে বা বাসে মাত্র মিনিট কুড়ি লাগে পাটান যেতে। একসময় নাম ছিল ললিতপুর। মল্ল রাজাদের আমলের নেওয়ারি স্থাপত্যের রমরমা টের পাওয়া যায় আজও। পাটানের গলিঘুঁজিতে সারাক্ষণ ঠং ঠং শব্দ, পাথরে ছেনি-হাতুড়ি মারার। মূর্তি তৈরি করতে ব্যস্ত শিল্পীরা।
এখানেও আছে বিশাল দরবার স্কোয়্যার। তার পাশেই দেবদেবী, আর হাতির মূর্তি বিক্রি হচ্ছে। আমিও দরাদরি করে কিনলাম পাঁচটা হাতির দল। ছোট-বড় মিলিয়ে এই হাতিযূথের আকার ইঞ্চি ছয়েকের মধ্যে হলেও রীতিমতো ভারি। এখন একে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে সারা নেপাল, ভেবে আতঙ্ক হল।
পাটানের মন্দিরে অকাতরে পশুবলি হয় শুনলাম, কিন্তু আর এক কাছের শহর ভক্তপুরে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে গা গুলিয়ে উঠল। কাঠমান্ডু থেকে ১৩ কিলোমিটার মাত্র, কিন্তু পা দিলেই মনে হবে, পিছিয়ে গেছেন হাজার বছর। এই প্রাচীনত্ব ঠিক ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ টাইপ রোম্যান্টিসিজম নয়, বরং গা-ছমছমে অতিলৌকিক গন্ধ জড়িয়ে আছে ভক্তপুরের গায়ে। নেপালের সবচেয়ে ছোট অথচ ঘিঞ্জি এই শহরকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দিয়েছে ইউনেসকো, এই মধ্যযুগীয় আবহের জন্য। ভাবছিলাম, এই প্রাচীনত্ব কি চেষ্টা করে ধরে রাখা, না কি এই জনপদ অন্য কোনও কারণে এগোতে পারেনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে? রাজধানীর আধঘণ্টা দূরত্বে বাস করেও এখানকার মানুষজন যেন কাঠমান্ডুর থেকে সহস্র মাইল দূরের অন্য গ্রহের বাসিন্দা। এরকম মনে হয়েছিল, আমার দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরমে গিয়ে। এপিজে আব্দুল কালামের মতো বিজ্ঞানীর জন্মস্থান, আর সেখানকার কত মানুষ খালি পায়ে ঘোরেন এই বিশ্বাসে যে, জুতো পরলে হার্ট অ্যাটাক হয়। রামেশ্বরমে হোটেলের মালিককে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রচুর লোককে এই গরমে দেখছি খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে, কেন? প্রথমে বললেন, ‘আমরা তো শুধু মন্দিরে যাই, তাই আর জুতো পরা-খোলা করে সময় নষ্ট করি কেন?’ তারপর ওই হার্ট অ্যাটাকের তত্ত্ব!

ভক্তপুরে অবশ্য এরকম কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি। তার আগেই এক মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে দেখি সিংদরোজায় শুকনো দড়ির মত একগোছা কী ঝুলছে। ক্যামেরাম্যান তো আশ্চর্য কিছু দেখলেই তার যন্ত্রটি তাক করে ছবি তুলে রাখে। কিন্তু জানতে তো হবে, এই দড়ির পিছনে রয়েছে কোন আচার? এক ভক্তকে পাকড়াও করে প্রশ্ন করতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘প্রতি বছর দশেরায় এই মন্দিরের সামনে কত মোষ আর ছাগবলি হয় জানেন? দশ হাজার। হাঁটু পর্যন্ত রক্ত জমে যায়। পুরোহিত সেখান থেকে নাড়িভুঁড়ি এনে মন্ত্র পড়ে টাঙিয়ে দেন দরজায়। একবছর পর এই শুকনোগুলোকে নামিয়ে আবার তাজা নাড়িভুঁড়ি ঝোলানো হবে।’ বলেই আমার হাঁ-মুখের সামনে সে ওই গোছায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। পরে জানলাম, শুধু এই মন্দিরে নয়, নেপাল জুড়ে দশেরা, দীপাবলি আর শক্তির দেবী গাধিমাই-র পুজোয় কয়েক লক্ষ পশুবলি হয়। পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো তো নয়ই, এমনকী, নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আদেশও পারেনি এই রক্তগঙ্গা বন্ধ করতে।
ভক্তপুর বিখ্যাত টেরাকোটা শিল্পকর্মের জন্য। আলাদা পটুয়াপাড়াও রয়েছে। বংশপরম্পরায় তারা পোড়ামাটিতে ফুটিয়ে তুলছে অসামান্য নকশা। এমনই এক শিল্পীর ঘরে শুটিং-শেষে তাঁর স্ত্রী আপ্যায়ন করলেন একবাটি দই দিয়ে। জমাট ওই দই দেখে, সত্যি বলছি, খুব লোভ হল। কিন্তু রেস্তরাঁয় পানীয় কাণ্ডের পর আমি সাবধান হয়ে গিয়েছি। জিগ্যেস করেই ফেললাম, ‘এটা কী?’ উত্তরে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জুজু ধাউ।’ আমার তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ক্যামেরাম্যান খুব চালাক, আগে দেখে নেয়, আমি খাচ্ছি কি না আর খেয়ে আমার কী প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কৌতূহল তো মেটাতে হবে। তাই আবারও প্রশ্ন করলাম, ‘কী দিয়ে তৈরি?’ শুনে হাঁফ ছেড়ে বাটিটা হাতে তুলে নিলাম। মোষের দুধ ঘন করে তৈরি ভক্তপুরের বিখ্যাত দইকে এরকম ভয় পাওয়ানো ‘জুজু’ নামে ডাকেন এঁরা। যেমন নিজেদের শহরকে আদর করে বলেন ‘খোপা’।

ভক্তপুর বলতেই একদিকে যেমন মন্দির আর তাকে ঘিরে কুসংস্কারের অন্ধকূপ মনে পড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে, অন্যদিকে ঠিক উল্টো হিমালয়ের উদাত্ত ডাক— নাগরকোট। কাঠমান্ডু উপত্যকার বারান্দা বলে যদি কিছু থাকে, সেটাই এই ছোট্ট গ্রাম। ভক্তপুর শহর থেকে মাত্র আধঘণ্টা দূরে স্বর্গের আগের স্টেশন নাগরকোট। আমার-আপনার মতো যারা দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে ভোররাতে উঠে মাঙ্কিক্যাপ পরে টাইগার হিলে যাই, সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশায়, তাদের কাছে জন্মজন্মান্তরের সম্পদ— নাগরকোট থেকে এভারেস্ট দর্শন। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত, কোনটা বেশি মোহময়, তালগোল পাকিয়ে যাবে ওই অপার্থিব দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে। আপনি ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে আছেন দিগন্ত জুড়ে অলৌকিক আগুনখেলার দিকে, আর আপনাকে ঘিরে নাচছে প্রজাপতির দল! এই উপত্যকার আর-এক সৌন্দর্য সবুজের মাঝে আলপনা এঁকে যাওয়া রংবেরঙের প্রজাপতি। ‘আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি’। ভাবা যায়, মাত্র আধঘণ্টার ফারাকে এমন ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর সহাবস্থান?
আর-একটা কথা বলি। এটা অবশ্য একেবারেই আমার ব্যক্তিগত মত। আমি মনে করি, শৃঙ্গজয়ী পর্বতারোহীরা ছাড়া আর কারও হক নেই ‘পায়ের নিচে এভারেস্ট’ অনুভব করার। কাঠমান্ডু থেকে পর্যটকদের জন্য হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত, টিকিটের দাম লাখ টাকার কাছাকাছি। মাউন্ট এভারেস্টের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই শিহরণ জাগে, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, অনধিকার চর্চা!