চোখ-কান খোলা : পর্ব ১৫

Fire Crackers

শব্দকল্পদ্রুম

কেউ বলছেন, অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কেউ বলছেন, কান পাতা দায়। কারও শ্বাসকষ্টর সমস্যা, কারও হৃদরোগ। কলকাতা মেট্রোয় উঠে পড়ছে বিপন্ন পথকুকুর। কলকাতায় বায়ুদূষণের যে পরিমাপ, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স সচরাচর যেমন থাকে, তার চেয়ে খানিক অবনতিই লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও দেশব্যাপী অন্যান্য শহরের তুলনায় তা অনেকটাই যথাযথ বলে দাবি করেছে কলকাতা পুলিশ। এইসবের মূলে কী? বাজি, মূলত শব্দবাজি। যত রাত বাড়ছে, তত বাড়ছে তার প্রকোপ।

চিনের হান সাম্রাজ্যের আমলে নাকি বাঁশে আগুন দিয়ে তা শূন্যে ছুড়ে অশুভ শক্তিকে দূর করা হত। কালীপুজোর সঙ্গে, শাস্ত্রমতে, অশুভ শক্তি দূরীকরণের যোগাযোগ আছে। অনেক বাড়িতে এদিন লক্ষ্মীপুজো হয়, যেখানে ‘অলক্ষ্মী বিদায়’ হয়, এবং তা বেশ শব্দ সহযোগেই ঘটে। কিন্তু এই প্রসঙ্গ আপাতত থাক। একথা ঠিক, বাংলায় দীর্ঘদিন ধরেই শব্দবাজি ফাটানো হয়, এবং তা বেশ সাড়ম্বরেই। অনেকেরই মনে পড়ে যেতে পারে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদিম রিপু’ উপন্যাসের কথা। সেখানে কালীপুজোর শব্দবাজির প্রকোপে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল একটি বন্দুকের গুলির শব্দ, যার জেরে একটি হত্যা, প্রায় নিশ্চুপেই সংঘটিত হয়েছিল। সেই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ১৯৪৬ সাল। অর্থাৎ, তখন থেকেই শব্দবাজি আরও অনেক শব্দকেই ঢেকে দিতে সক্ষম। বুড়িমার যে চকলেট বোমা বাঙালির লব্জ হয়ে উঠেছে প্রায়, সেই ব্যবসার উৎপত্তির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে দেশভাগের অনুষঙ্গ। অতএব, শব্দবাজি হয়তো বঙ্গজীবনে দীর্ঘদিন যাবৎই উপস্থিত।

কিন্তু সময় বদলেছে ক্রমে। শব্দবাজি রোগবিরোগের কারণ হয়ে উঠছে, দূষণ বাড়াচ্ছে ইত্যাদি অভিযোগের ভিত্তিতে ক্রমশ তা নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একুশ শতকে পৌঁছে, যবে শব্দবাজি নিষিদ্ধ হল, ততদিনে আর কালীপুজোয় সীমাবদ্ধ নেই তার উপদ্রব। ক্রিকেট ম্যাচে ইন্ডিয়ার জেতা থেকে অন্যান্য নানা পুজো ও তার ভাসান, ভোটের ফলাফল থেকে বিয়েবাড়ি ও বর্ষবরণ— বিবিধ উপলক্ষেই তখন চকলেট বোমা থেকে কালীপটকা, হাউই বা রকেট থেকে দোদোমা হয়ে অত্যাধুনিক শেলের বাড়বাড়ন্ত। কয়েক বছর আগে থেকে ফানুস জনপ্রিয় হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে ‘শব্দসন্ত্রাস’ একচুলও কমেনি। বাঙালি এইসবেই একটু একটু করে অভ্যস্তও হয়েছে। কিন্তু তলে তলে বাঙালির মননে যে শব্দবাজির দূষণের চেয়েও ভয়ংকর কোনও বিষের উৎপাত শুরু হয়েছে, তা বোঝা যায়নি প্রথমে। যা এই কালীপুজোয় খানিক খোলসা হল, ফেসবুকে বহু বাঙালির কমেন্টে ও পোস্টে।

জেন-জি বিপ্লবের আড়ালে কোন সত্য লুকিয়ে?
পড়ুন ‘চোখ-কান খোলা’ পর্ব ১৫…

এবারের কালীপুজোয় যখনই শব্দবাজির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠে এসেছে, তার বিপ্রতীপে উঠে এসেছে আশ্চর্য সব যুক্তিক্রম। একটি তো সহজ যুক্তি, অন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা যদি এমনটা করতে পারেন, আমরাই বা কেন পারব না? এই যুক্তি অবশ্য শব্দবাজির মতো নিরীহ ঘটনাতেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকে না। ধর্মীয় সন্ত্রাস থেকে রাস্তা আটকে আচারবিধি পালন, সবেতেই এই সমান যুক্তি বুক চিতিয়ে সাইনবোর্ডের মতো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঘটনাটা এখানেই শেষ নয়। কেউ হয়তো বলছেন, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন তুমুল শব্দদাপটে, তাঁকে বলা হচ্ছে, সারাবছর তাঁর অসুবিধে হয় না কেন? প্রথমত, সারাবছর এমন পাইকারি হারে বাজি আদৌ ফাটে কি না, তাই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই যুক্তির কান্ডারীরা কী বলবেন, কে জানে। দ্বিতীয়ত, যিনি অসুস্থ বোধ করছেন, তার প্রতি বিন্দুমাত্র সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি সহনাগরিকরা কবে থেকে দেখাতে ভুলে গেল? কেউ হয়তো ‘বেশ হয়েছে’ বলে কলারও তুলছেন। অর্থাৎ, চুলোদ্দোরে যাক তোমার অসুস্থতা বা বিড়ম্বনা, আমি আমার ধর্মপালন, অথবা ফুর্তির জন্য যা ইচ্ছে তাই করব, আমাকে বাধা দেওয়া যাবে না। পোষ্য বা পথকুকুরদের অস্বস্তি, বা বহু পাখির মৃত্যু নিয়ে কথা বললে তার যে পাল্টা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা অতুলন। বলা হয়েছে, নিরামিষাশী ছাড়া আর কারও পশুপাখিদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর অধিকার নেই। আমার খাদ্যাভ্যাসের জন্য কি আমি আমার প্রতিবেশী, সে মানুষই হোক মনুষ্যেতর জীব, তার সরাসরি কোনও ক্ষয়ক্ষতি করি? তাহলে এই অগ্রপশ্চাৎহীন যুক্তির মানে কী!

মানে আসলে একটিই। কেবল শব্দবাজি নয়, ডিজে বাজানো থেকে সাইলেন্সার খুলে রাস্তায় বাইক হাঁকানো, অন্যের অসুবিধে হবে জেনেও আরও যা যা করা সম্ভব, কোনওকিছুতেই বাঙালি আর ক্ষমাপ্রার্থী নয়। অন্যায়ের পক্ষে অপযুক্তি আছে, তাও না থাকলে রয়েছে সরাসরি কাঁধ ঝাঁকিয়ে উপেক্ষা বা ‘বেশ করেছি’-র অহং। এই সংবেদনহীন মন বাঙালির কীভাবে তৈরি হল? আমার আনন্দ অন্যের চরম সর্বনাশের কারণ হতে পারে জেনেও, কেবল ধর্মোন্মাদনা থেকে, সামাজিক অসভ্যতার লাইসেন্সকে কীভাবে উদযাপন করতে শিখল বাঙালি! ভূরাজনীতি নিয়ে, দেশকাল বা রাজ্যের বেহাল দশা নিয়ে কথা বলার আগেও, জাতিগতভাবে বাঙালির এই চরিত্র নিয়ে একটু ভাবা বোধহয় প্রয়োজন। আমি চাইব, সরকার আমাকে স্বর্গরাজ্য দেবে, আমার চারপাশ হবে ফুলেল, নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, রাজনৈতিক দল হবে শ্বেতশুভ্র, বুদ্ধিজীবীরা হোক মনীষার প্রতিরূপ আর জাতির যথার্থ বিবেক— আর আমি নির্বিচারে অভদ্রতাকে বৈধ বলে চালিয়ে যাব দিনের পর দিন? আমি আমার পড়শিকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত হব না, আর চাইব সমাজ সঠিক পথে চলুক— এই দ্বিচারিতা কি দগদগে হয়ে ধরা পড়ছে না ক্রমে?